এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • লা জওয়াব দিল্লী - ৯

    শমীক মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ২৯ মার্চ ২০০৯ | ৮৯৭ বার পঠিত
  • ভোজ কয় যাহারে

    আজ বরম্‌ একটু খাওয়া দাওয়ার গল্প হোক। শুধু শুধু চা আর লেড়ো বিস্কুটের জোরে আর কতদিন গল্প জমে, বলুন?

    আচ্ছা, বলেন তো, দিল্লি বললেই প্রথম কোন্‌ খাবারের কথা আপনার মনে আসে? ....... ঐ দ্যাখেন, একসাথে কতগুলো হাত উঠেছে। এদিকে দমোদিদি চোখ পাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে যাচ্ছেন "ঘেভর ঘেভর'; ঐদিকে অজ্জিতকাকু এন্তার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন আর মন্তর পড়ার মত করে বলছেন "করিম্‌স ..... লস্যি ..... মালাই মার কে'। অন্য কোণায় হাতে একটা ইয়াম্মোটা বই নিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে বাবু বৈ চক্রবর্তী তাকাচ্ছেন আর চাঁদনি চক টু মুনিরকা সব জায়গার সেরা সেরা ফুড জয়েন্টগুলোর নাম করে যাচ্ছেন। এরই মাঝে কে যেন একবার টিপ করে গলা বাড়িয়ে বলে উঠলেন, "বাবুমশাই।'

    বেশ বেশ, হয়েছে হয়েছে। দিল্লি যেমন হাজার রঙে রঙীন, তেমনি ভ্যারাইটি দিল্লির খাওয়া দাওয়াতেও, এ নিয়ে সন্দেহ নেই কোনও। খাবার আইটেমের নাম করতে শুরু করুন বা খাবার দোকানের, কোনও লিস্টিই সহজে শেষ হবে না, তবু সত্যি বলতে কি, সেই পেত্থম যৌবনে যখন গ্যাঁড়ার দিল্লি আসার প্ল্যান পাকা হয়েছিল গেঁড়ির হাত ধরে, গ্যাঁড়ার মনে একটা খাবারের নামই উদয় হয়েছিল। তখন কোথায় করিম্‌স, কিসের দিল্লি হাট, কিছুই জানা ছিল না গ্যাঁড়ার, কেবল একটাই খাবারের নাম জানত, যেটা দিল্লির নামেই ফেমাস। ...... কী বলেন তো?

    দিল্লি কা লাড্ডু। সেই ছোটবেলা থেকে গ্যাঁড়া শুনে এসেছে দিল্লি-কা-লাড্ডুর নাম, সে-নাকি শাদি করার সমার্থক। জো খায়া ও পছ্‌তায়া, জো নহী খায়া ও ভি পছ্‌তায়া। তো, না-খেয়ে পছ্‌তানোর থেকে খেয়ে পস্তানো অবশ্যই অনেক বেটার। এইজন্যেই লোকে বিয়েশাদি করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

    গ্যাঁড়া দিল্লিতে ল্যান্ড করার মাস কয়েক আগেই গেঁড়ি চলে এসেছিল দিল্লি। সেখান থেকে প্রথমবার অভিসারে ভুবনেশ্বর আসার সময়ে গেঁড়ি খুঁজেপেতে দিল্লি-কা-লাড্ডু নিয়ে এসেছিল। নববিবাহিত বরের জন্যে এর চেয়ে লাগসই উপহার আর কী-ই বা হতে পারে! গোলমার্কেটের ওপরেই একটা বিশাল মিষ্টির দোকান, নাম বেঙ্গলি সুইট্‌স, আদতে ওখানকার একটা মিষ্টির সাথেও বাংলার কোনওরকমের আত্মিক যোগাযোগ নেই, দোকানের কর্মচারীরাও বাঙালি নয়, তবু কী করে যেন ঐ নামটাই অনেকদিন আগে ওখানে বাস করা একপাল বাঙালি বাসিন্দার স্মৃতি বহন করে নিয়ে চলেছে। সেই দোকানে ডাব্বায় ভরে পাওয়া যায় লাড্ডু। কীসের তৈরি জানি না, তবে খেতে মোটেই সুখকর নয়। এমনকি গ্যাঁড়া ওর থেকেই একটা টুকরো একবার একটা ওড়িয়া বেড়ালকে খেতে দিয়েছিল, সে বেড়ালটাও খায় নি সেই লাড্ডু। অবিশ্যি ওড়িয়া বেড়ালরা বোধ হয় এমনিতেই মিষ্টি খায় না।

    তা সে যাই হোক, আপনারা যদি কখনও দিল্লি আসেন, দিল্লির লাড্ডু না-খেলেও চলবে। ও না খেলেও পস্তানোর কিছু নেই।

    এমনিতে মিষ্টি অনেক রকমই পাওয়া যায় দিল্লি জুড়ে, তবে সেই মিষ্টির সাথে বাংলার মিষ্টির মিলের থেকে অমিলই বেশি। কীরকম? বলছি। বাংলার মিষ্টি তৈরি হয় মূলত ছানা দিয়ে। বিভিন্ন পরিমাণে ছানাকে জাঁকিয়ে তারপরে জারিয়ে তৈরি হয় বাংলার বিভিন্ন মিষ্টি। কিন্তু দিল্লি তথা উত্তর ভারতের মিষ্টি তৈরির মূল উপাদানই হল খোয়া আর ক্ষীর। ছানা দিয়ে এখানে অতি সামান্যই মিষ্টি তৈরি হয় আর বানানোর গুণে তার স্বাদও বাংলার মিষ্টির থেকে অনেকটাই আলাদা হয়। এখানে অনেক দোকানে এমনকি "বংগালি মিঠাই' নামক এক বা একাধিক ধরণের মিষ্টিও বিক্রি হয়, কিন্তু দূর দূর তক কোনও বংগালি মিঠাইয়ের সাথে তার মিল নেই।

    উপরন্তু, সমগ্র দিল্লি, তথা উত্তরভারতে মিষ্টি বিক্রি হয় ওজনে, পিস্‌ হিসেবে নয়। দোকানে গিয়ে যদি কালাকাঁদ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ক্যায়সে দিয়ে (এটাই "কত করে'-র কথ্য হিন্দি, কিত্‌না করকে হ্যায়-টা তারা বলেন যারা নতুন এসেছেন হিন্দি বলয়ে), তো দোকানদার বলবে একসো অস্‌সি রুপয়ে, মানে একশো আশি টাকা কিলো। এইবার আপনার ছটা কালাকাঁদ নেবার থাকলে আপনাকে আন্দাজ করে বলতে হবে এক পাও নেবেন, না সাড়ে তিনশো।

    বাঙালি, মাছ আর মিষ্টির প্রতি বাংলায় থাকাকালীন যত না আসক্ত থাকে, তার চেয়ে বেশি আসক্ত হয় বাংলার বাইরে এলে। তাই দিল্লির খাঁজে খোঁজে গজিয়ে উঠেছে অনেক বাঙালি মিষ্টির দোকানও। তবে সেখানকার মিষ্টির দাম শুনলে চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হয়। হুগলিতে যে ক্ষীরকদম দুটাকায় পাওয়া যায়, নয়ডার মিষ্টিমুখে তার চেয়ে ছোট সাইজের ক্ষীরকদমের দাম ছটাকা। তা, যস্মিন দেশে যদাচার। কী আর করা!

    মিষ্টি খাবার হ্যাবিটের ব্যাপারেও দিল্লিওয়ালা আর বাঙালিদের তফাৎ আসমান জমিন। এমনিতেও বাংলার মিষ্টি সম্বন্ধে রস্‌গুল্লার বেশি আইডিয়া প্রায় কারুরই নেই, একবার গ্যাঁড়ার সামনেই গ্যাঁড়ার দুই বন্ধু বেদম তর্ক জুড়েছিল সন্দেশ কাকে বলে, সেই নিয়ে। দুজনেই দুটো আলাদা আলাদা মিষ্টি রেফার করছিল যার কোনওটাই সন্দেশ নয়। অ্যাকচুয়েলি তারা দুজনেই জানত সন্দেশ কোনও একটা পার্টিকুলার মিষ্টির নাম, সন্দেশ যে একটা সেট অফ মিষ্টি'জ , সে সম্বন্ধে দুজনেই অজ্ঞ ছিল।

    মোটামুটি শেষ পাতে মিষ্টি খাবার হ্যাবিট বাঙালি অবাঙালি সবারই। দিল্লিওয়ালাদের শেষপাতের হট ফেভারিট হল, গুলাবজামুন, আর গাজর কা হাল্‌বা। সত্যিই হট। জিভে দিলে জিভ পুড়ে যাবার চান্স। রইয়ে সইয়ে খেতে হয়। আর নস্টালজিক বাঙালির মনে আছে ফেলে আসা দিনের বিয়েবাড়ির সেই ভিয়েন? গরম গরম রসগোল্লা? দিল্লিওয়ালারা রসগোল্লাটা খায় ঠান্ডা। পশ্চিম, দক্ষিণ দিল্লি আর গুরগাঁওয়ের দিকে অনেক রাস্তায় দেখতে পাবেন সাইকেলের পেছনে টিনের বাস্‌কো নিয়ে একটা লোক ঘুরছে ঠা-ঠা গরমে, টিনের বাক্সে লেখা ঠন্ডে রস্‌গুল্লে। শীতকালে ঐ লোকটাই গরম খাস্তা কচৌড়ি বিক্কিরি করে।

    মিষ্টি আরও আছে। দিল্লি ফেমাস। যেমন, রাবড়ি। যে-সে জায়গার নয়, চলে যান চাঁদনি চক। খানাপিনার রইস জায়গা হল এই চাঁদনি চক। ফেমাস বলে ফেমাস? এখানেই আছে আদি ও অকৃত্রিম, করিম্‌স। এঁয়ারা এককালে মুঘল সম্রাটদের খাস বাবুর্চি ছিলেন। সেই আভিজাত্যের ছোঁয়া আজও এঁদের রান্নায়। বাটার নান, বাখরখানি, মাটন বিরিয়ানি তো অনেক জায়গায় খেয়েছেন, একটিবার এখেনে এসে খেয়ে যান, তাইলে বুঝবেন, এ জগৎ মায়াময়। যা-ই খান, সঙ্গে একপ্লেট গুর্দা-কলেজি নিতে ভুলবেন না। চাম্পিস জিনিস। উপ্‌স, লিখতে গিয়ে একফোঁটা জল ঝরে পড়ল গ্যাঁড়ার কীবোর্ডে।

    করিম্‌সের আদি দোকান চাঁদনি চকে, জামা মসজিদের উল্টোদিকে, এ ছাড়াও ওদের আরেকটা খানদানি রেস্তোরাঁ আছে নিজামুদ্দিনে। যাবার আগে ম্যাপবই হাতে রাখবেন। কারণ নিজামুদ্দিনে যেখানে করিম্‌সের রেস্তোরাঁ, সেই পর্যন্ত গাড়ি যায় না। বেশ খানিকটা রাস্তা হেঁটে যেতে হয়। এ ছাড়াও নয়ডা গাজিয়াবাদ লক্ষ্মীনগর ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় তাদের ছোটোখাটো রেস্তোরাঁ বা টেক অ্যাওয়ে আছে, তবে সেগুলো নিতান্তই ফ্র্যাঞ্ছাইজি।

    খাদ্যরসিকদের জন্য চাঁদনি চকে আরও একটি অবশ্যগন্তব্য জায়গা হল, পরান্ঠেবালী গলি। এটা মেন চাঁদনি চক রোডের থেকে হঠাৎ ঢুকে যাওয়া একটা ক্ষীণকায় গলি। এখানে পাওয়া যায় না এমন ভ্যারাইটির পরোটা নেই। যেমনি তাদের নাম, তেমনি তাদের খোসবাই, তেমনি তাদের ইতিহাস। দিল্লির তাবড় তাবড় বড়লোকের দল এসে ভিড় জমান এই গলিতে, পরোটা খাবার জন্য।

    এমনিতে উত্তরভারতীয়রা ভেজিটেরিয়ান, নন-ভেজ লোকেরাও খুব ধর্মবিশ্বাসী, সপ্তাহে একদু-দিন তো ভেজ খায়ই, বছরে দুবার নভরাত্রের সময়ে ফাস্ট রাখে, ভেজ খায় টায়। তখন বাজারে এমনকি মুরগির ডিমেরও আকাল হয়ে যায়। তবে নন ভেজ খাবার জায়গার কোনও কমতি নেই। পিওর ভেজ রেস্টুরেন্টও যেমন আছে, নন ভেজ রেস্টুরেন্টও তেমনি আছে পাল্লা দিয়ে।

    চাইনিজ খেতে চাইলে, গ্যাঁড়ার জ্ঞান অনুযায়ী, বেস্ট রেস্তোরাঁ হল বারকোস্‌। কনট প্লেসে, নয়ডায় আরও কোথায় কোথায় যেন আছে তাদের আউটলেট। দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের জন্য নামকরা মুনিরকার উডুপী, ওদের আর কোনও শাখা আছে কিনা জানা নেই, এ ছাড়া সাগর রত্ন নামে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের চেইনও আজকাল খুব নাম করেছে। নয়ডা আট্টা মার্কেটের Bamboo shoot -এর নাম খুব শুনে টুনে এক ভ্যালেন্টাইন দিবসে থাই ফুড খেতে গিয়ে গ্যাঁড়া খুব হতাশ হয়েছিল। তিন পিস পুঁটি মাছের সাইজের ফিশ স্যাটে-র দাম নিয়েছিলো সাড়ে তিনশো টাকা। নর্ম্যাল রেস্তোরাঁয় ঐ দামে একটা-দুটো আস্ত লবস্টার হয়ে যায়। বরং গ্যাঁড়া মনে রাখবে গুরগাঁওয়ের ডিএলএফ সিটি সেন্টার মলের দোতলায় সেই থাই রেস্টুরেন্টটাকে। অফিসের পার্টিতে খেতে গিয়ে, আক্ষরিক অর্থে গলা পর্যন্ত ভর্তি করে খেয়ে এসেছিল। থাই খাবার যে অমন মধুর হয়, গ্যাঁড়া তার আগে জানত না।

    এখন তো মল্‌ কালচার। দুনিয়ার সবকিছুই এক ছাদের তলায়। খাবার জায়গাও। তার নাম ফুড কোর্ট। পিজা হাট, ডমিনোজ, ম্যাকডি, সাবওয়ে, ইয়ো চায়না, পরাঠা জংশন, সব খেয়ে বেড়াতে পারবেন ইচ্ছেমত। দু এক জায়গায় শোনা গেছে হাওড়া জংশন, বা ওহ্‌ ক্যালকাটা নামের রেস্তোরাঁও খুলেছে যেখানে মহার্ঘ্য সব বাঙালি খাবার দাবার পাওয়া যায় মহার্ঘ্য দামে। বাজেটের মধ্যে বাঙালি খাবার চাইলে চলে যান চিত্তরঞ্জন পার্কের বাবুমশাই তে। মন্দ রাঁধে না বাটা মাছের ঝালটা।

    আপনাদের কেউ কখনও চিত্তরঞ্জন পার্কের কালীবাড়ির ধর্মশালায় থেকেছেন? ওদের ক্যান্টিনে দুপুরে খেতে গেলে ধর্মশালায় থাকার বাধ্যবাধকতা নেই অবশ্য। খুব শস্তায় একটিবার কোনও এক ছুটির দুপুরে খেয়ে আসবেন। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ টাকায় সাবেকি ঘরোয়া খাবার। ডাল-ভাত সবজি একটা ভাজা, মাছের ঝোল আর শেষপাতে একতু চাটনি পাঁপড়। এক-দুটাকা বেশি দিলে মিষ্টিও পাবেন। খাওয়াটা খুব কিছু হাইফাই নয়, কিন্তু ঐ সিম্‌প্লিসিটিটাই টেনেছিল গ্যাঁড়াকে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে সবাইই তো পোলাও কালিয়া সাঁটায়, ঘরোয়া পরিচ্ছন্ন পরিবেশে এমন খাবার কজন সার্ভ করে?

    কালীবাড়ির ছায়া ছেড়ে আসুন, যাওয়া যাক, দিল্লি হাটে। দিল্লি আসার দু বছরের মাথায়, দিল্লি হাটে কখনও যায় নি শুনে গ্যাঁড়ার তৎকালীন প্রতিবেশি এমন হ্যাটা করেছিল গ্যাঁড়া-গেঁড়িকে, যে পরের শনিবারেই তারা ছুটেছিল সেখানে। সালটা ছিল দু হাজার চার। আজও গ্যাঁড়ারা সময় পেলেই ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়ে দিল্লি হাটের দিকে।

    দিল্লি হাটটা হল, দক্ষিণ দিল্লিতে একটা সর্বভারতীয় কুটির শিল্পের আখড়া। সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া কুটির শিল্পের কারিগররা তাঁদের শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেন এখানে, বছরের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মেলার মাধ্যমে তা বিক্রি করেন দেশ বিদেশের খরিদ্দারদের কাছে। দিল্লি হাটে গরম একটু কমলেই যে-কোনওদিন গিয়ে দেখবেন, ওখানে সাদা চামড়ার আধিক্য চোখে পড়ার মত। আর তার ফলেই, তার সাথে তাল মিলিয়ে ওখানকার কুটির শিল্পের দামও বেশ চড়া। খুব চোখে পড়ার মত কোনও আইটেম হলে অবশ্যই কিনতে পারেন দরদস্তুর করে, না হলে এমনি জামাকাপড় কিনবার হলে একটু কষ্ট করে একটা অটো নিয়ে চলে যান, পাশেই সরোজিনী নগর মার্কেট, ওখানে অনেক শস্তায় পেয়ে যাবেন।

    তো, যা বলছিলাম। কুটির শিল্পের কেনাকাটা ছাড়াও, দিল্লি হাটের বিশেষত্ব হল, ফুড জয়েন্ট। ভারতের প্রত্যেকটা রাজ্যের নামে যেমন একটা করে বড় বড় প্যাভিলিয়ন আছে প্রগতি ময়দানের সুবিশাল এলাকায়, তেমনি দিল্লি হাটের ছোট পরিসরে ভারতের প্রতিটা রাজ্যের নামে আছে একটা করে ছোট ছোট রেস্তোরাঁ। খোলা রেস্তোরাঁ। প্রতি কাউন্টারে পাওয়া যায় সেই রাজ্যের অথেন্টিক খাবার দাবার। পশ্চিমবঙ্গের কাউন্টারটা চালায় বিজলিগ্রিল, ইলিশ মাছ ভাত, রসগোল্লা সিঙাড়া চমচম সব পাওয়া যায় বেশ উচ্চদামে। তবে বেশি ভিড় হয় উত্তরপূর্বের ফুডকাউন্টারগুলোয়। কেন জানি না, দিল্লি হাটে গেলেই মোমো আর ফ্রুট বীয়ার খাওয়াটা আস্তে আস্তে একটা রিচুয়ালে পরিণত হয়ে গেছে। আর সেইসব খাবার উৎকৃষ্ট জায়গা হল অরুণাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর, আর ত্রিপুরার স্টলগুলো। এই মোমো আর ফ্রুট বীয়ার ব্যাপারটা দিল্লি হাটে এখন এত ফেমাস হয়ে গেছে, লোকে নর্থ ইস্টের কাউন্টারে বসার জায়গা না-পেয়ে রাজস্থানের কাউন্টারের সামনে বসেও মটকা কুলফি বা চুস্‌কি ছেড়ে ফ্রুট বীয়ার অর্ডার করে। দিল্লি হাটে, ফ্রুট বীয়ার বোধ হয় সমস্ত রাজ্যের স্টলই রাখে। সেখানে বসে মনের আনন্দে মোমো থুক্‌পা কি ডালবাটি চুরমা খান, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকবে মনোরঞ্জক মাটির বেহালার ছড়ের টান। তার সুর ছড়িয়ে বেড়ায় সারা দিল্লি হাটের পরিসরে। লোকটা কত বছর ধরে ওখানে মাটির বেহালা বেচছে, কে জানে! ঐ সুর, একমাত্র ঐ লোকটা ছাড়া আর কেউ তুলতে পারে না। কত লোক তো ওর কাছ থেকে কিনে নিয়ে গেছে ঐ বেহালা, আর তো কোথাও শুনি নি তেমন মন-কাড়া সুর।

    দিল্লি হাট থেকে বেরিয়েই, রাস্তার ঠিক উল্টোপাড়ের ঘিঞ্জিমত মার্কেট এরিয়াটার নাম হল, INA মার্কেট। নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে এর কোনও কানেকশন ছিল কিনা, জানা নেই। তবে পুরো নামটা, সত্যিই, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি মার্কেট। ইহা দিল্লির "ফুড বাজার' নামে খ্যাত। তাজা সী-ফুড, মাছ, মাংস, মশলা, সবজি থরে থরে সাজানো আছে খদ্দেরদের জন্য। এমন কিছু মশলা এখানে পাওয়া যায়, যা আপনি সারা দিল্লিতে পাবেন না তো বটেই, রসিকজনের জন্য জানিয়ে রাখি, এই মার্কেটে অনেক দুÖপ্রাপ্য ওয়াইনও পাওয়া যায়। যা আপনি দিল্লির অন্য কোথাও পাবেন না। আরেকটা ইউনিক জিনিস কী বলুন তো এই মার্কেটের? এই মার্কেটে যত দোকানদার আছে, প্রায় সবাইই ইংরেজি ছাড়াও এক বা একাধিক বিদেশী ভাষা বলতে পারে। ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্ছ, চাইনিজ, জার্মান, পর্তুগীজ .......

    যা:, খাবার গল্প করতে করতে কোনদিকে চলে যাচ্ছি। তো, মোটের ওপর, খাবার জায়গা, খাবার ভ্যারাইটি বলতে দিল্লিতে এইই, অন্তত গ্যাঁড়া যতটুকু দেখেছে, এর সাথে সারা ভারতের কুইজিন তো এখানে ওখানে পাওয়া যায়ই। সর্সেঁ¡ দা সাগ আর মক্কি দি রোটি যেমন পাবেন অথেন্টিক সর্দারজির রেস্টুরেন্টে, তেমনি ডালবাটি চুরমাও খেতে পারেন রসিয়ে রসিয়ে (যদিও তেমন রসালো খাবার নয়) ব্যাকগ্রাউন্ডে "পধারো হ্মারে দেস্‌' গান শুনতে শুনতে, চিংড়ি মাছের মালাইকারির সাথে ভাতও খেতে পারেন বাঙালি পরিবেশে।

    রাস্তার ধারে শীতকাল জুড়ে বিক্রি হয় গরম গরম মুঙ্গফলি, মানে বাদাম, ছোলা, বাদামচাক্তি, আর সারা বছরই বিক্রি হয় গোলগাপ্পে, যার মুম্বাইতে নাম পানিপুরি, আর বাংলায় আদি অকৃত্রিম, ফুচ্‌কা। তবে গোলগাপ্পার স্বাদ মোটেই বাঙালি ফুচকার কাছাকাছি হয় না, গোলগাপ্পাকে গোলগাপ্পা ভেবেই খাওয়া ভালো, ফুচকার সাথে দৃষ্টিগত সিমিলারিটি ছাড়া আর কোনও মিল বিশেষ নেই।

    টিভিতে রোজ রান্না শিখিয়ে চলা সঞ্জীভ কাপুরের একটা রেস্টুরেন্ট চেইন আছে এখানে নয়ডা গাজিয়াবাদে, নাম ইয়েলো চিলি। দুর্দান্ত খাবারদাবার। একবার খেলে বারবার খেতে চাইবেন।

    আর কী? আর রইল রাজমা চাওল, আর কড়ি চাওল। আম দিল্লিবাসীর রোজদিনকার খাবার। এ ব্যাপারে গ্যাঁড়া কিছু বলতে অপারগ, ও আপনি কোনও দিল্লিবালী ভাবিজীকে ধরে পুছ লিজিয়েগা, যান!

    এই এতক্ষণ ধরে গ্যাঁড়া যা যা ভাটালো, তা কেবলই তার আঁখো দেখি বিবরণ, এর বাইরেও হয় তো দিল্লিতে আরও আরও অনেক খাবার জায়গা ও সুস্বাদু খাবার জিনিস আছে, যদি আপনাদের জানা থাকে, তাহলে সহৃদয়ে গ্যাঁড়াকে জানিয়ে বাধিত করবেন। গ্যাঁড়ার পরবর্তী কিছু উইকএন্ডের সুরাহা হয় তা হলে।

    (দম ফুরিয়ে আয়া হ্যায়, কিন্তু চলেগা নেহি, আভি ভি দৌড়েগা)

    মার্চ ২৯, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৯ মার্চ ২০০৯ | ৮৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন