এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর ধারাবিবরণী

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
    আলোচনা | বিবিধ | ২২ মার্চ ২০০৭ | ৯৫৭ বার পঠিত
  • পূর্বকথন।
    -----------
    "আমাদের ছেলে রাজনকে এটা দিয়ো। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।"
    এরপর ও (রাজনের মা) আর একটিও কথা বলেনি। শীতল মৃত্যু তাকে ততক্ষণে ছুঁয়ে ফেলেছিল।
    ওর মৃত্যুর পরের দিন আমি চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে বিশ্বাস করে দিয়ে গিয়েছিল যে কয়েনগুলো, সেগুলো তখনও হাতের প্যাকেটে ধরে আছি।

    -- মেমোরিজ অফ আ ফাদার। ইয়েচারা ভারিয়ার।

    "১৯৭৬ সালের ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি আমার সন্তান রাজনকে আমি শেষবার দেখি'' -- লিখছেন রাজনের বাবা ইয়েচারা ভেরিয়ার। তারপর আর দেখা হয়নি। অভিযোগ, এর তিনদিন পরে কেরলের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র রাজনকে তার কলেজ থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। সে আর বাড়ি ফেরেনি।

    বাড়িতে সবসময় একপাত্র ভাত রান্না করে রাখা হত, কারণ, ছেলে যেকোনো সময়েই ঘরে ফিরতে পারে। তার ক্ষিধে পেতে পারে। কোনো কোনো রাতে, রাস্তার কুকুররা যখন অকারণে হল্লা মাচায় রাস্তার মোড়ে, বাবার ঘুম ভেঙে যেত, দরজা খুলে পুত্রের পদশব্দের জন্য তিনি অপেক্ষা করতেন অধীর আগ্রহে। কিন্তু সেই কাঙ্খিত পদশব্দ আসেনি কখনও। ভাতের থালাও থেকে গেছে অস্পর্শিত। রাজন ঘরে ফেরেনি। পুত্রের খোঁজে কেরলের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাবা। সরকারি পাথরের দেওয়ালে মাথা ঠুকেছেন। কোর্টের দরজায় কড়া নেড়েছেন। একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন, ছেলে ফিরবেই, সেই আশ্বাস বুকে নিয়েই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন রাজনের মা। কিন্তু খোঁজ শেষ হয়নি। এই খোঁজার গল্প তিনি নিজেই লিখেছেন একটি বইয়ে, যার নাম মেমোরিজ অফ আ ফাদার।

    সেই বইয়ের টুকরোটাকরা নিয়েই তৈরি এই লেখা। সঙ্গে সামান্য কিছু বাইরের রেফারেন্স। মূলত: কিছু জানা কথা পুনরুচ্চারণের, মনে করিয়ে দেবার প্রচেষ্টা রইল, এই দুহাজার সাত সালের এপ্রিল মাসে, যার কিছু মূল্য থাকলেও থাকতে পারে।

    রাজনের কথা।
    --------------
    ২৯ শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৬। কালিকট থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরের একটি রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র রাজন, একটি যুব উৎসবে অংশগ্রহণ করে কলেজে ফিরছিল। পুলিশ অপেক্ষাই করছিল, বাস থেকে নামা মাত্রই কলেজের সামনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যতদূর জানা যায়, সেখান থেকে তাকে প্রথমে কালিকট, পরে কাক্কয়ম পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কায়ান্না পুলিশ স্টেশনে নকশাল হামলার তদন্তের বিশেষ উদ্দেশ্যে এই পুলিশ ক্যাম্পটি বানানো হয়। ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারাল জয়রাম পাডিক্কল ছিলেন এই ক্যাম্পের "একনায়ক"।

    কি হত এই ক্যাম্পে?

    "জয়রাম পাড্ডিকাল একটা চেয়ারে বসে অর্ডার দিতেন, আর পুলিশ জিপগুলো মুহুর্মুহু তরুণ ছেলেদের বোঝাই করে আনত। মারধর শেষ হবার পর, একটা কাঠের বেঞ্চে হাত-পা নিচের দিকে করে বেঁধে দেওয়া হত। তারপর একটা ভারি কাঠের রোলার থাইয়ের উপর চালানো হত। অনেকেই সহ্য না করতে পেরে অচেতন হয়ে যেত। কান্না বন্ধ করার জন্য তাদের মুখে গুঁজে দেওয়া হত কাপড়ের টুকরো। এরপর তাদের জয়রাম পাড্ডিকালের কাছে আনা হত। জেরা করতে করতে হাতে তিনি একটা সরু পেনসিল নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন; তারপর হঠাৎই ছুরির মতো সেই পেনসিল ঢুকিয়ে দেওয়া হত মাংসপেশীর মধ্যে, হাড় থেকে আস্তে আস্তে আলগা করে আনতেন মাংসের টুকরো। কোরু বলেছিল, সেই সময়ে মনে হত, এর চেয়ে মরে গেলে ভালো হয়।"

    এই ক্যাম্পেই রাজনকে প্রথমে আনা হয়।

    "কায়ন্না পুলিশ স্টেশন থেকে যে রাইফেলটা চুরি যায়, সেটা কোথায়? ওরা জানতে চাইছিল। ওর ছোট্টো জীবনে, রাজন কখনও একবারের জন্যও মার খায়নি, তাই এই প্রথম দফার অত্যাচারই ওকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। এরপর ওই কাঠের বেঞ্চে বেঁধে ওর উপর রোলার চালানো হয়। মা-মা করে কাঁদছিল বলে মুখে গুঁজে দেওয়া হয় কাপড়ের টুকরো। অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্য ও বলে, যে, ও রাইফেল খুঁজে দেবে। তখন ওকে জয়রাম পাডিক্কালের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি পুলিশের লোকেদের বলেন একটা জিপ নিয়ে রাজনের সঙ্গে রাইফেলের সন্ধানে যেতে। ও তখন আবার কেঁদে ফেলে। বলে, রাইফেল টাইফেলের কথা কিছু জানেনা, অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য খুঁজে দেবার কথা বলেছিল। শুনেই পুলিক্কোডন নারায়ন ওই ভারি পুলিশি বুট দিয়ে পেটে লাথি মারতে থাকেন। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে ও পড়ে যায়, তারপর নিথর, শান্ত হয়ে যায়।"

    "রাজনের দেহ একটা বস্তায় ভরে জিপে করে সরিয়ে ফেলা হয়। জঙ্গলের মধ্যে পুড়িয়ে ফেলা হয় দেহ। শুনেছি চিনি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে হাড়ের অবশেষও না থাকে"।

    "একজন বলেছিল যে পুলিকোড্ডন নারায়ন লাথি মেরে মেরে ফেলার আগে রাজন প্রাণভিক্ষা করছিল। আর না ছেলেরা, আর বোলো না, আমার ছেলের প্রাণভিক্ষার গল্প যথেষ্ট হয়েছে। ওর কোমল মুখের কথা মনে পড়ে, হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা করছে। সোনা আমার, এই অসহায় বাবাকে ক্ষমা কোরো, আমি চিৎকার করে উঠি।"

    এসবই একজন পিতার বর্ণনা। আদালতে এসব প্রমাণিত হয়নি। ওই ক্যাম্প থেকে যারা জ্যান্ত অবস্থায় ফিরেছে, তারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানিয়েছে এসব। "এই হাড়হিম করা অত্যাচারের গল্প বলতে বলতে ওরা কাঁপছিল', লিখেছেন ভারিয়ার, "যেন ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি কখনও কোনো প্রশ্ন করিনি, কখনও জানতে চাইনি। তবুও ওরা বলেছে"।

    মন্ত্রী আর পুলিশ
    ---------------
    ১০ই মার্চ, ১৯৭৬। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করুণাকরণের সঙ্গে দেখা হয় মরিয়া ভারিয়ারের। ত্রিবান্দ্রমের মনমোহন প্যালেসে, এক বন্ধুর সহায়তায়। তখনও জানা নেই রাজনের শেষ মূহুর্তগুলির কথা। তখনও রাজন "নিখোঁজ"।

    মুখে চওড়া হাসি নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন করুণাকরণ, কিন্তু আমাকে দেখেই সেই হাসি কি একটু বিবর্ণ হয়ে গেল? বোকার মতো ভাবছি, নিজেকেই বলি আমি।

    আমাকে উনি জড়িয়ে ধরলেন। "আগে বলেননি কেন? আমি তক্ষুনি একটা ব্যবস্থা করতাম,'' তিনি বললেন। মনে আশার ঝলক টের পেলাম।
    উনি আরও বললেন, "এই রাজন নামটা চেনাচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা সিরিয়াস ঝামেলায় জড়িয়েছে।''

    শ্রদ্ধায় আমার হাত জড়ো হয়ে এল। একটা অজানা আবেগ আমাকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। "নানা, এসব করার ক্ষমতাই ওর নেই। যখন উগ্রপন্থীরা কায়ন্না থানা আক্রমণ করেছে, তখন তো ও ফারুক কলেজের যুব উৎসবে। ওর কলেজের ও আর্টস ক্লাব সেক্রেটারি,'' আমি বললাম।

    করুণাকরণ আমার কাঁধে হাত দিলেন। তাঁর গলা নরম হয়ে এল। "আমি খোঁজ নিয়ে জানাব। যতটা পারি করব। আমাদের সম্পর্কটা কি সেরকমই নয়?''

    আমি আরও একবার হাত জোড় করলাম। শ্রদ্ধায়।

    রাজনীতিকদের এরকম একটা মানবিক মুখ রাখতে হয়। বলাবাহুল্য, করুণাকরণ কিছুই করেননি, বা করতে পারেননি। পুলিশের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন ভারিয়ার, যার শুরু মার্চের প্রথম দিন। করুণাকরণের সঙ্গে দেখা হবার ঠিক নদিন আগে।

    "অনেকেই বলেছিল কাক্কায়াম পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে কোনো লাভ নেই, তবুও আমি গেলাম।"

    কাঠের ব্রিজের পাশে রাইফেল হাতে একজন সান্ত্রী দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে কথা বললাম। সে খুব গম্ভীর, কিন্তু আমার সঙ্গে একটিও খারাপ কথা বলেনি। সে ক্যাম্পের ভিতরে গেল এবং ফিরে এসে আমাকে জানাল ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যাবেনা। বলল, আমার ছেলে রাজন ভিতরেই আছে, এবং ভালো আছে। আমার আবেগ একটু কমে এসেছিল, তবুও বললাম "আমি শুধু আমার ছেলেকে দেখতে চাই''। আমার সামনে সে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

    আমার এতো একা লাগল, যে, আমি চিৎকার করে উঠলাম। জোরে চিৎকার করে উঠলাম।

    এইভাবে শুরু। এরপর পুলিশের বয়ান বদলে যাবে ক্রমশ:। বদলে যাবে করুণাকরণের ভাষ্যও। ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে তিনি জানাবেন, "আই অ্যাম অন ইট। কদিন পরে জানাবেন, যে, উগ্রপন্থীদের গোপণ এক ডেরায় নিয়ে যাবার সময় পুলিশের হাত থেকে পালিয়েছে রাজন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ ভাহাবুদিন প্রাণ হাতে করে যাবেন কাক্কায়ম পুলিশ ক্যাম্পে, ক্যাম্পের "একনায়ক" জয়রাম পাডিক্কল তাঁদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করবে, তাঁরা দেখবেন, চারদিকের সেল থেকে ছাত্ররা উঁকিঝুঁকি মারছে, কিন্তু তাদের মধ্যে রাজন থাকবেনা।

    জরুরি অবস্থা তখনও চলছে। তার মধ্যেই মরিয়া ভারিয়ার ভারতের সমস্ত সম্ভাব্য প্রভাবশালী মানুষকে পাঠাতে থাকবেন চিঠি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি প্রাপকদের মধ্যে অন্যতম। সেইসব আবেদনপত্র নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এর্নাকুলাম জেলার পুলিশ সুপার ডেকে পাঠাবেন ভারিয়ারকে। জানাবেন, যে, পনেরো দিনের মধ্যে তিনি রাজনকে মুক্তি দেবেন।

    তবুও, রাজন ফিরে আসবেনা। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করুণাকরণ নীরব ও নিরুত্তর থাকবেন। ভারিয়ারের পরিচিত একজন এমপির সঙ্গে করুণাকরণের দেখা হলে তিনি জানাবেন, যে, এই জাতীয় কোনো চিঠি তিনি পাননি। এই নীরবতা করুণাকরণ ভাঙবেন অনেক অনেক পরে, যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারিয়ারের দায়ের করা মামলাটি আলোচনার জন্য উঠবে বিধানসভায়।

    ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭। বিষয়টি বিধানসভায় উত্থাপিত হওয়া মাত্র লাফিয়ে উঠে করুণাকরণ ঘোষণা করবেন, "রাজনকে কখনও গ্রেপ্তারই করা হয় নি"। এভাবেই এতদিন পরে জানা যাবে সত্য। সুভদ্র, স্মিতহাস্য, সহৃদয়, নরম করুণাকরণের মুখে।

    আদালত ও রাজনীতি
    --------------------
    ২৫ শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৭। জরুরি অবস্থা উঠে যাবার পর হাইকোর্টে প্রথম যে রিট পিটিশনটি দাখিল করা হয়, সেটি প্রফেসর ভারিয়ার বনাম কেরালা সরকার। খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। খরচ চালানোর জন্য তৈরি হয় রাজন কেস এইড কমিটি। প্রফেসর মাধবন ছিলেন প্রেসিডেন্ট। গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের রামাচন্দ্রন পট্টি আহ্বায়ক। শিল্পপতি পিসি আব্রাহাম কোষাধ্যক্ষ। বিভিন্ন আইনজীবী এবং রাজনীতিকরা এর সদস্য ছিলেন। বিরোধী নেতা স্বনামধন্য একে গোপালন ভারিয়ারের লেখা চিঠিটিকে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে "ফরোয়ার্ড" করেন। সিপিআইএম সক্রিয়ভাবে কেসটিতে সহযোগিতা করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে।

    একবিংশ শতকে ঘটলে গান্ধীবাদী-শিল্পপতি-কমিউনিস্টদের এই জোটকে মহাঘোঁট বলা হত সন্দেহ নেই। গুজব ছড়ানোর ধান্দাবাজি, বা লাশের রাজনীতি তো বলা হতই, কারণ শেষ পর্যন্ত ভারিয়ার কথিত অত্যাচারের বিবরণগুলির একটিও আদালতে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তখনও এইসব পরিভাষা সূর্যের আলো দেখেনি, তাই ঠিক এসব না বললেও কাছাকাছি কিছু কথা অবশ্যই বলা হচ্ছিল। আসাধু পত্রিকায় শ্রী জেসুদাস লিখলেন, বাবার অনৈতিক কাজকর্মের জন্য রাজন বাবাকে ঘৃণা করত। ইঙ্গিত পরিষ্কার। বীক্ষণম এবং জনযুগম, এই দুটি কাগজ প্রবন্ধটি নিজেদের কাগজে পুনর্মুদ্রন করল। মালয়ালা মনোরমা রাজনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখে ফেলল। "আমি কখনও ভাবিনি", ভারিয়ার লিখেছেন, "বড়ো সংবাদপত্রগুলি নিজেদের নৈতিক মানকে এতো এতো নিচে নামিয়ে আনতে পারে।"

    সুখের কথা এই, যে, একদল মানুষ, আগে আদালতে প্রমাণ হোক তারপর দেখা যাবে, দর্শনে বিশ্বাসী না হয়ে রাজনের বাবাকে বিশ্বাস করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সিপিআইএম নেতা একে গোপালন, নিজের দুই উকিল রাম কুমার এবং ঈশ্বর আয়ারের কথা বারবার লিখেছেন ভারিয়ার। মূলত: এই সব মানুষদের প্রচেষ্টাতেই, এবং বিরোধীদের গড়ে তোলা জনমতের প্রভাবে রাজন কেস এইড কমিটিতে প্রয়োজনের অনেক বেশি অর্থই জমা হয়।

    মামলাটি প্রায় দুমাস চলে। ইতিমধ্যে করুণাকরণ, জয়রাম পাডিক্কাল সহ, পুলিশ, সরকার ও প্রশাসনের বড়োকর্তারা সবাই কোর্টে আলাদা আলাদা এফিডেভিট দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, যে রাজনকে কখনই গ্রেপ্তার করা হয়নি। এবং তাঁদের কেউ কখনও তাকে চোখেও দেখেননি। অনেক সাক্ষী-সাবুদ, জেরা-টেরার পর ১৩ই এপ্রিল, ১৯৭৭ আদালত রায় দেয়, যে, একথা সত্য, যে, পুলিশ রাজনকে গ্রেপ্তার করে কাক্কয়ম ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ২২ শে মের মধ্যে রাজনকে আদালতে হাজির করতে হবে, কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

    এই রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তরা সুপ্রিম কোর্টে অ্যাপিল করেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের রায়ই বহাল রাখে।

    ন্যায়বিচারের উপাখ্যান
    --------------------
    ২২শে মের মধ্যে পুলিশ রাজনকে যে আদালতে হাজির করতে পারেনি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে, কারণ জ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলার বিবিধ কায়দা পুলিশ আয়ত্ত করলেও, মৃত মানুষকে ফিরিয়ে আনার বিদ্যা, হায়, আজও তাদের অনধিগত। অত:পর কেরালা সরকার এই বিষয়ে একটি তদন্তের আদেশ দেয়। কিমাশ্‌চর্য, এবার তদন্তে দেখা যায়, রাজনকে গ্রেপ্তার করে কাক্কয়ম ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছিল। এবং তার উপর অত্যাচার করা হয়েছিল।

    হাইকোর্ট তখন দোষী ব্যক্তিদের, এবং মিথ্যা এফিডেভিটকারীদের শাস্তির আদেশ দেয়। ফলে আরেকটি মামলা শুরু হয়। যেহেতু এটি ক্রিমিনাল কেস, তাই সরকারী আইনজীবীই অভিযুক্তদের শাস্তির পক্ষে সওয়াল করার জন্য নিযুক্ত হন। ভারিয়ার কেরালা সরকারের কাছে নিজব্যয়ে নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ করার অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। এই মামলায় সরকার নিয়োগ করে আশি বছর বয়সী বৃদ্ধ আইনজীবী অচ্যুত মেননকে। অন্যদিকে অভিযুক্তদের পক্ষে সওয়াল করতে আসেন রাজ্যের নামী-দামী আইনজীবীদের একটি বিরাট দল। সরকারি আইনজীবী কি অদ্ভুত কায়দায় সওয়াল করেছিলেন এই মামলায়, তার বিবরণ ভারিয়ার দিয়েছেন তাঁর লেখায়।

    "জেরার শেষ দিনে তিনি আমাকে একটিই প্রশ্ন করলেন। যার সঙ্গে এই মামলার কোনো সম্পর্ক নেই: "এই মামলায় সাক্ষী দেবার জন্য এর্নাকুলাম থেকে কোয়েম্বাটুর আসার সময় আপনি কি আপনার আইনজীবী রামকুমারের সঙ্গে আসেন নি?'' আমি বিব্রত বোধ করলাম, কারণ এর সঙ্গে এই মামলার কি সম্পর্ক। আমি মিস্টার এক্স বা ওয়াই যার সঙ্গেই এসে থাকি, তাতে এই মামলার কি? একজন বিখ্যাত আইনজীবীর করা এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে আমি অবাক হলাম। "হ্যাঁ'', বললাম আমি, এবং পরবর্তী প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ওই একটা প্রশ্ন দিয়েই জেরা শেষ হয়ে গেল। এই উকিলটিকে নিয়োগ করার কারণ সবাই আন্দাজ করতে পারেন, মামলা চালানোর ক্ষেত্রে যে সামগ্রিক খামতিগুলি দেখা গিয়েছিল, তা কিন্তু একটা পর্দার আড়ালে থাকা ষড়যন্ত্রের দিকেই অঙ্গুলী নির্দেশ করে।

    এই মামলায় সাক্ষীরাও হঠাৎ বেঁকে বসে। আগে যে বয়ান দিয়েছিল, তারা জানায়, সেগুলি মিথ্যা। তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল।

    প্রমাণের অভাবে সকলকেই হত্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। জয়রাম পাডিক্কাল সহ ক্রাইম ব্রাঞ্চের তিনজনকে শুধু খুব সামান্য কিছু অপরাধের জন্য এক বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। অভিযুক্তরা সকলেই হাইকোর্টে অ্যাপিল করে, এবং ছাড়া পেয়ে যায়। রাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং অভিযুক্তরা মিথ্যা বলেছিল, প্রমাণিত হলেও, মিথ্যা হয়ে যায় অত্যাচারের যাবতীয় গল্প, পেন্সিল দিয়ে খুবলে আনা মাংসের টুকরো, আর্তচিৎকার। মিথ্যে হয়ে যায় রাজনের শেষ প্রাণভিক্ষা, পেটে লাথির পর লাথি। মিথ্যে হয়ে যায় পুলিশি ভ্যানে চুপিসাড়ে সরিয়ে ফেলা একটি একাকী লাশের গল্প।

    কারো শাস্তি হয়নি। খুনের অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি।

    তবে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং জনমতের চাপে পদত্যাগ করেন করুণাকরণ। ততদিনে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই চেয়ার ছেড়ে দিতে হয় তাঁকে। খুনের অভিযোগে তাঁর অবশ্য শাস্তি হবার কথাই ছিলনা। কারণ তিনি নিজে হাতে খুন করেছেন, বা রাজনকে খুন করার প্রত্যক্ষ আদেশ দিয়েছেন, এরকম অভিযোগই কেউ করেননি। কিন্তু পুলিশি অপকর্মের দায় শেষমেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই নিতে হয়।

    উপসংহার
    ---------
    কিন্তু এসব তো শুকনো তথ্য। সরকারের তরফে তথ্য চাপা দেওয়া, সরকারি বয়ানের অসারতা, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই, সবাই জানেন। কিন্তু ইতিহাস তো নিছক সরকারিভাবে প্রমাণিত তথ্যের সমাহার নয়। তথ্য, যুক্তি, সংখ্যা আর বাদপ্রতিবাদের পরেও তো কিছু পড়ে থাকে। পড়ে থাকে আবেগ। হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি। পড়ে থাকেন একলা একজন বাবা। ভারিয়ারের স্ত্রী, মানসিক স্থিতিশীলতা হারানো রাজনের মা বেঁচে থাকেন ২০০০ সাল পর্যন্ত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে জানানো হয়নি "সত্য', শেষ দিন পর্যন্ত রাজনের জন্য অপেক্ষা করে গেছেন তিনি। পড়ে থাকে রোজকার ভাতের থালা, যা রেখে দেওয়া হত, রাজন ফিরবে বলে। ফিরলে তার ক্ষিধে পেতে পারে, আর কে না জানে, রাজন ক্ষিধে একেবারের সহ্য করতে পারেনা। পড়ে থাকে সেই কয়েনগুলি, যা বহু বিশ্বাসে মা দিয়ে যান প্রিয়তম সন্তানের বাবাকে, একদিন তা ছেলের হাতে পৌঁছবেই, এই বিশ্বাসে। আর রাজন, তার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মৃতদেহ পড়ে থাকে,রোদে পুড়তে থাকে , ভিজতে থাকে অকারণ বৃষ্টিতে, পৃথিবীর অজ্ঞাত কোনো প্রান্তে, পৃথিবীর কোনো মরমানুষ কখনও যার সন্ধান জানবেনা।

    "এইসব বর্ষণমুখর রাতে আমি ওর ক্যাসেটভরা গান শুনি। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া এক ঢেউকে আমি উদ্ধার করার চেষ্টা করি এই টেপ রেকর্ডার থেকে। যে গান আজও আমি, এই মোড়কহীন মানুষটি কখনও শুনিনি, সেই গানে ভরে যায় পবিত্র পৃথিবী। আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে,বৃষ্টিতে ভিজে যায় আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলে।

    আমার প্রতিশোধস্পৃহা আছে কিনা জানিনা। সত্যি জানিনা। শুধু এই বিশ্বচরাচরের কাছে একটি প্রশ্ন আছে : আমার নিষ্পাপ শিশুটিকে তোমরা মৃত্যুর পরেও বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেন?

    আমি দরজা বন্ধ করবনা। বৃষ্টি আসুক। ঘরে বৃষ্টি আসুক। আমাকে ভিজিয়ে দিক। আমার শুন্যে মিলিয়ে যাওয়া ছেলে অন্তত: এইটুকু জানুক যে বাবা কখনও দরজা বন্ধ করে দেয়নি।'

    এইসব পংক্তি, যা পড়তে পড়তে চোখের পাতা ভিজে আসে, তা যদি ইতিহাসের অংশ না হয়, তবে ইতিহাস কি?
    ----------------------------------------------------------------------------------

    এই লেখার সমস্ত উদ্ধৃতি "মেমোরিজ অফ আ ফাদার" থেকে নেওয়া। মূল বইটির ইংরিজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর বর্তমান লেখকের। দক্ষিণী নামের ভাষান্তরে, হয়তো, হয়তো কেন অবশ্যই, কিছু গোলমাল থেকে গেল। লেখার শিরোনামটি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কাছ থেকে ধার নেওয়া।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২২ মার্চ ২০০৭ | ৯৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন