যদি মৃত্যুই মানুষের অমরত্বের সূচক হয়ে থাকে তবে জানিয়ে রাখা ভালো কোনো কোনো মানুষ জীবৎকালেই অমর হয়ে যান। যেমন বিষ্ণু দে হয়েছিলেন অনুজ প্রতীম অরুণ সেনের কলমে, তেমনি অরুণ সেন স্বয়ং তার সমকালীন বেশ কিছু বিশিষ্টজন ও তাঁর স্নেহভাজনদের মনে।
২০১০ সাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেই তাঁর দ্বারস্থ হয়েছিলাম। আমার তত্ত্বাবধায়ক সুতপা দি তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন; মূলত আমার নির্বাচিত বিষয়ের কারণেই; শুধুমাত্র এই কারণেই কবি সুতপা সেনগুপ্তের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তখনও পর্যন্ত আমার কাছে অরুণ সেনের পরিচয় বিষ্ণু দে গবেষক হিসেবে। সুতপাদির কাছেই শুনলাম বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে তাঁর পান্ডিত্যের কথা। যদিও 'পান্ডিত্য' শব্দটি কোনোভাবেই তাঁর সঙ্গে খাপ খায় না। রক্তকরবীর সেই বিখ্যাত উক্তি 'গাম্ভীর্য নির্বোধের মুখোশ...' যথাযথ প্রমাণ করেছিলেন অরুণ সেন। প্রথমদিন তাঁর কালিন্দীর পি-৩৩ বাড়িতে পৌঁছেই সে কথা বুঝেছিলাম। ঠিকানা শুনে তাঁর বাড়িতে পৌঁছতে পেরেছিলাম বলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীতেও মতিঝিল কলেজ থেকে নিজে সন্ধান করে জ'পুরের রাস্তা ধরে তাঁর বাড়ি গেছিলাম বলে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। আসলে অচেনা জায়গাকে নিজের উদ্যোগে চিনে নেওয়ার প্রবণতা তাঁর ছিল। যখন জয়পুরিয়া কলেজে পড়াতেন ক্লাস শেষ করে ট্রেন ধরে অচেনা স্টেশনে নেমে হাঁটা পায়ে সেই জায়গা, স্থানীয় মানুষজনকে চেনার চেষ্টা করতেন। এভাবেই আপন করে নিতেন তাঁর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া অচেনাকেও।
প্রথমদিন আমার কাছ থেকেই জানতে চেয়েছিলেন আমার গবেষণার বিষয় সম্পর্কে। আমি একটু ভয়ে ভয়েই আমার ভাবনাগুলো তাঁর সামনে রাখছিলাম। উনি মন দিয়ে শুনছিলেন। মাঝে মাঝে দু-একটা কথা যোগ করছিলেন। দীর্ঘ সময় কথা বলার ফলে ভয়টা একেবারে কেটে গেছিল। ওনার বাংলাদেশ বিষয়ে একটি বড় লেখা,যা অন্তঃসার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। একসাথে বসে চা-জলখাবার খাওয়ালেন। শান্তা কাকিমা, সন্ধ্যা দি সকলের সঙ্গে পরিচয় হল। জিজ্ঞাসা করলেন,কোন কবির কবিতা বেশি পছন্দ? বলেছিলাম জীবনানন্দ দাশ। বিষ্ণু দে ভালো লাগেনা। আমার সেই ধৃষ্টতাকে হাসিমুখে সহ্য করেছিলেন।
শুরু হল যাতায়াত। একতলা-দোতলা মিলিয়ে বিরাট বইয়ের সম্ভার নির্দ্বিধায় আমার হাতে ছেড়ে দিলেন। পায়ে ব্যথার কারণে ওপরে বিশেষ উঠতে পারতেন না। কিন্তু অতো বড়ো লাইব্রেরিতে কোথায় কি বই আছে এক নিমেষে বলে দিতে পারতেন। আমি সেভাবে বই খুঁজে আনতাম নিজের জন্য। একদিন বললেন, বইগুলো বড়ো অগোছালো হয়ে গেছে; তুমি গুছিয়ে দেবে? আমি তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি। বললেন একটা শর্ত আছে। বই গোছাতে গোছাতে যে বইটির একের অধিক কপি পাবে সেটি তোমার। আমার আনন্দ তখন কোথায় রাখি। এভাবে যে কত বই আমার হস্তগত হয়েছে! আর প্রত্যেকটা বইয়ের প্রথম পাতায় আছে তাঁর স্নেহের পরশ! তাঁর তিন তলার ঘরটি ছিল সংগ্রহশালা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সেখানকার মাটির তৈরি নানা সম্ভারে পূর্ণ ছিল সে ঘর। প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা গল্প ছিল। পেঁচার মোটিফ পছন্দ করতেন। ডোকরার অসাধারণ একটি যক্ষ-যক্ষিণী মূর্তি দেখেছিলাম তাঁর বাড়িতে। একবার হস্তশিল্প মেলা থেকে আদিবাসী দুর্গামূর্তি দিয়েছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন। শেষদিকে আর বইমেলাতেও যেতে পারতেন না। প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর।
লেখালেখি নিয়ে প্রায় প্রত্যেক মাসেই দু-তিন দিন করে হাজির হতাম তাঁর কাছে। বলে দিয়েছিলেন সকালে চলে আসবে। দুপুরে আমাদের সঙ্গেই দুটি খেয়ে নেবে। বলা বাহুল্য প্রথম প্রথম একটু লজ্জাই হোত। কিন্তু উনি একেবারে পাশে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়াতেন। নিজেও ভোজনরসিক ছিলেন। ৮০ পার করেও বাজারে যেতেন। পছন্দ মতো মাছ,সবজি কিনে আনতেন। নানাধরণের রান্নার পদ তাঁর জানা ছিল। খেতে বসে মায়ের গল্প করতেন। ওপার বাংলা থেকে চলে এসেও সেই ঐতিহ্য কে কিভাবে বহন করছেন আজও শুনে সমীহ হতো। খাওয়ার সময় কিন্তু সকলকে একসাথে টেবিলে চাই। এমনকি সন্ধ্যা দিকেও। আমি বহুদিন পর বুঝেছিলাম সন্ধ্যা দি ও বাড়িটা দেখাশোনা করেন। সন্ধ্যা দির মেয়ের পড়াশোনা,বিয়ে সবই নিজের অভিভাবকত্বে করিয়েছিলেন। অবাক হয়েছিলাম দেখে, সন্তান জন্মানোর পর আদর যত্নের জন্য শকুন্তলা কে দোতলার একটি ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে,এতো মার্জিত, সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য হয়েছিলাম।
দুপুরে একটু বিশ্রাম নেওয়ার অভ্যেস ছিল। বাকি সময়টা লেখাপড়া করতেন নিরলস ভাবে।যাই হোক, বিকেলের চা-জলখাবার খাইয়ে তবে আমাকে ছাড়তেন। সেই সব সময়েও পুরোনো দিনের গল্প করতেন।প্রতীক্ষণের দিনগুলো বারবার গল্পে উঠে আসত। সেই সূত্রে দেবেশ রায়ের মতো মানুষদের কথাও বলতেন, যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন তাঁর সঙ্গে। আমার বিষয় নিয়ে, বিষয় ছাড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশ, সেখানকার সাহিত্য, বারবার বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এসব নিয়ে আলোচনা করতেন। শাহবাগ আন্দোলনের সময়টা বেশ চিন্তায় দিন কাটাতে দেখেছি। কলেজ স্ট্রিটে একটা সভা করা হয়েছিল।সেখানেও মূল বক্তা ছিলেন উনি আর শঙ্খ ঘোষ। কখনো কখনো এসব আলোচনায় শান্তা কাকিমাও যোগ দিতেন।চিত্রকলার বিভিন্ন বই তো ছিলই বাড়িতে; আরো আরো কিনতেন। রামকিঙ্কর বেইজ, যামিনী রায়,যোগেন চৌধুরীর ছবি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতেন। আমি তো থাকতামই, ওনার পুত্রবধূ সোমাও উপস্থিত থাকত। কথায় কথায় বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যেত। যতক্ষণ না পৌঁছানোর সংবাদ পাচ্ছেন উদ্বিগ্ন থাকতেন।
গবেষণার কাজ এগোচ্ছিল। একটা বিষয় লক্ষ্য করতাম, কোনো বিষয়ে বলতে শুরু করে খানিকটা বলার পর আমাকে বলতে দিতেন। আমি কতটা বুঝতে পারছি জানতে চাইতেন। আরোও একটি কারণ ছিল। অরুণ বাবু কোনোদিনই সুবক্তা ছিলেন না। নিজের এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে নিজেই মজা করতেন। বলতেন, তুমি বলো। তুমি তো ভালো বলতে পার। আমি আর কি করি। কথা বলে যেতাম।আর উনি হাসি হাসি মুখে শুনতেন। তখন ওনার সঙ্গে দু-একটা সেমিনারেও যাতায়াত শুরু করেছি। দেখতাম,উনি শুরুতেই নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে লিখিত বক্তব্য পাঠ করতেন। কিন্তু তাঁর ভাষা ব্যবহার এতোই প্রাঞ্জল ছিল যে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। উনিই সেই ব্যক্তি যিনি গুরুগম্ভীর বিষয়কে অধ্যাপক-সুলভ জটিল শব্দ প্রয়োগে ভারাক্রান্ত না করে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারতেন। ওনার কাছ থেকে এটা আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
একবার যাদবপুরে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের পক্ষ থেকে। মূল বিষয় বাংলাদেশ। আমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে চললেন। যেখানে যেতেন তাঁর পরিচিতদের কাছে ছাত্রী বলে আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিতেন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক তনভীর মোকাম্মেল, অধ্যাপক পবিত্র সরকার, কবি শঙ্খ ঘোষ সকলের কাছেই পরিচিত হয়েছিলাম তাঁর সূত্রে। সেদিন প্রথম অর্ধের আলোচনা শেষ হয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি; তারপর দ্বিতীয় অর্ধের প্রথম বক্তা ছিলাম আমি। কিন্তু অরুণ বাবুর এবং আরো কয়েকজনের আসতে দেরি হয়েছিল। ফলে আমার বক্তব্য ওনার শোনা হয়নি। সে নিয়ে বহুদিন পর্যন্ত আফশোস করেছিলেন। আমিই সংকোচ বোধ করতাম। কিন্তু উনি বারবার বলতেন। ছোটো বলে,অল্প জানি বলে তুচ্ছ তো করতেই না, বরং এতোটাই আপ্লুত থাকতেন যে লজ্জায় পড়তে হতো। এভাবেই ছোটোদের উৎসাহিত করতেন। ধৈর্য্য ধরে শুধরে দিতেন। ওনার সঙ্গে সাহিত্য-পরিষদেও গেছি। সুবিমল মিশ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তখন বিষ্ণু দে'র জীবনপঞ্জী নতুন করে লেখার কাজ চলছিল। বাড়ি ফেরার পথে বললেন, একটা লাঠি কিনলে কেমন হয়! বেশ ভর দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাঁটা যাবে। শ্যামবাজারে নেমে লাঠি কেনা হল।তারপর দোকানীর সঙ্গে কত গল্প। কথা বলতে ভালোবাসতেন। শেষ দিকে অসুখের কারণে কথা বলতে অসুবিধা হওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলেন।
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হতে চলল। ততদিনে ও বাড়ির একজন হয়ে উঠেছি। কিন্তু পারিবারিক নানা গোলযোগে আমি তখন ডুবতে বসেছি। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে কেমন করে যেন টের পেয়েছিলেন। নিজে থেকেই তখন বারবার খোঁজ নিতেন।কাছে ডাকতেন। মূলত ওনার উদ্যোগেই গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। বিষয় বিভাজন থেকে তথ্যসূত্র নির্মাণ,বানান সবটাই হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। চোখের অসুবিধে সত্ত্বেও প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন। ডিগ্রি পাওয়ার পর আমার বাবা-মার থেকে কিছু কম আনন্দ পাননি।
তারপর নিজেই উদ্যোগী হয়েছেন গবেষণা কাজটিকে বই আকারে রূপ দিতে। প্রকাশকের সঙ্গে নিজেই কথা বলেছেন। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে সমস্ত খুঁটিনাটি নিজে তত্বাবধান করেছেন। এসব কাজের সময় ওনার সিরিয়াসনেস শিক্ষনীয়। ভুল করলে সে সময় বকুনি দিয়েছেন। আবার মিষ্টি খাইয়ে মুখে হাসি ফিরিয়ে এনেছেন। ততদিনে পরিচয় হয়েছে আরো এক পন্ডিত মানুষের সঙ্গে; ওনার বন্ধু রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। মাসের দ্বিতীয় রোববার করে রামকৃষ্ণ বাবু আসতেন। খাওয়া-দাওয়া তো ছিলই।আর হতো গল্প।আমি ওই লোভেই হাজির হতাম। আমাকেও জুড়ে নিতেন।সেসব গল্পে যে কত সমৃদ্ধ হয়েছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অরুণ বাবুর অনুরোধেই রামকৃষ্ণ বাবুও বইয়ের প্রুফ দেখেছিলেন। এ যে আমার মতো অভাজনের কতো বড় প্রাপ্তি! বই যেদিন প্রথম হাতে এলো সেদিন ছেলেমানুষের মতো একটা বই বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন আমাকে একটা বই তুমি নিজে হাতে লিখে উপহার দিও। আমার কাছে রেখে দেব। সেদিন কেঁদে ফেলেছিলাম।
আমার চাকরি পাওয়া, নিজের বাড়ি কেনা সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর বারবার ফোন করে কথা বলতেন।হতাশা কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তখন আত্মজীবনী লিখছেন। তার নামকরণ থেকে শুরু করে কতো বিষয়ে আলোচনা করতেন,মতামত চাইতেন। কম্পিউটারে বাংলা টাইপ করে বই লেখার কাজ করতেন। বিষ্ণু দে চর্চা, কলকাতার বাঙাল প্রত্যেকটি বই আমার জন্য এক কপি করে বরাদ্দ থাকত। স্নেহাস্পদেষু, আরোগ্য কামনায়, আমার ডাকনাম উল্লেখ করে সেই সব বই হাতে দিতেন। এ সবই এখন অমূল্য সম্পদ আমার কাছে।
শেষের কদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন; লকডাউনের জন্য যেতে পারিনি। তাই গান রেকর্ড করে পাঠাতাম। শুনে খুশি হতেন। সুস্থ হয়ে ওঠার কথা বলতেন। বয়স নিয়ে বেশ প্রচ্ছন্ন একটা অহংকার ছিল। ৪ জুলাই রাতে যখন খবরটা পেলাম মনে হল মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেল। কোনোদিন স্যার ছাড়া অন্য কিছু বলে সম্বোধন করিনি। কিন্তু তিনি তো শুধুই আর শিক্ষাগুরু ছিলেন না,হয়ে উঠেছিলেন জীবনের পথপ্রদর্শক। এখনো কানে ভাসছে আমার নাম ধরে সেই উদাত্ত কন্ঠের ডাক! সে ডাক কখনো হারিয়ে যাবে না... আমার অন্তরে সে ডাক বহুদূর থেকে দূরে সঞ্চারিত হবে। তিনি যে কাজ করে গেছেন সারাজীবন ধরে সেসব বাংলা ভাষা-সাহিত্য সমালোচনার জগতে,চিত্রকলা-আলোচনার জগতে বহুমূল্য সঞ্চয় হয়ে থাকবে। কিন্তু আমরা যারা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য করেছিলাম তাঁরা জানি মানুষ হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে তিনি কতোটা উদার, স্নেহপ্রবণ, অনুপ্রেরণীয়।
অরুণ সেন মারা গেছেন শুনে খারাপ লাগল। ওনারা কালিন্দীতে বাড়ি করে চলে যাবার আগে লেকটাউনে আমরা প্রতিবেশী ছিলাম। ওনারা না আমরা - কারা আগে লেকটাউন ছাড়ি মনে নেই, তবে প্রায় একই সময়ে, ১৯৮০ সাল নাগাদ। তখন অরুণ সেন যে কে ভাল করে জানতাম না। কলেজে পড়ান জানতাম। বইমেলায় গেলে দেখতাম পরিচয়ের স্টলে। শান্তাকাকিমা বেথুনে পড়াতেন, জানতাম। অরুণকাকা-শান্তাকাকিমার পরিচয় ছিল নন্দিনী-নীলের বাবা-মা হিসেবে। নীল অনেক ছোট। নন্দিনী আমার বয়েসী। খুব বই পড়ে। তখনকার মধ্যবিত্ত পাড়ার রীতি অনুযায়ী গল্পের বই দেওয়া-নেওয়া হত খুব। গ্রিম ভাইদের রূপকথা নন্দিনীর থেকে নিয়ে প্রথম পড়ি। সীতা দেবী-শান্তা দেবীও কি? বইয়ের জগতের একটা দিক খুলেছিল তখন, অরুণকাকা-শান্তাকাকিমার নেপথ্য পরিচালনায়, নন্দিনীর মাধ্যমে। ওদের বাড়িতে বই থইথই করত।
আর ছিল ৭৮ আরপিএম রেকর্ড। আমাদের একটা সোনির রিল-টু-রিল টেপ রেকর্ডার ছিল। তাতে বহু ৭৮ আরপিএম সংগ্রহ করা হয়েছিল। একটা অংশ এসেছিল সেনবাড়ি থেকে। স্মৃতি যদি খুব না ঝোলায় তাহলে মনে হয় তখন দুষ্প্রাপ্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের ১৪ বছর বয়েসের টপ্পার রেকর্ড "এত কী চাতুরী সহে প্রাণ" আর "সখী কী করে লোকেরই কথায়" অরুণকাকার সংগ্রহ থেকেই এসেছিল। সে গান শুনতে ভীষ্মদেববাবুর আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি দেহ রাখলেন।
আর একটা জিনিস খুব চোখে পড়েছিল। দোলের দিন আমরা সব পুরনো জামা পরে রঙ খেলতে বেরোতাম। নন্দিনীদের বাড়িতে গেলে অরুণকাকা আর বরুণকাকা ধপধপে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরে আবীর খেলতে বেরোতেন।
কত মানুষ চলে গেলেন যাঁদের সঙ্গে শেষবেলায় দেখা হলে ছেলেবেলাটা ঝালিয়ে নেওয়া যেত!
এই গুণীজনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় ধন্যবাদ। বিষ্ণু দে'কে নিয়ে অরুণ সেনের দু-একটি লেখার হদিস দেবেন? অবশ্যই পড়তে হবে।
প্রতিক্ষণের পকেট বুক সিরিজেও ওনার একটা দুটো বই ছিল। একটা বোধহয় দুই বাংলার নাটক নিয়ে।
ভালো লাগল জেনে
খুব চমৎকার লিখেছেন রিনি। অরুণ সেনের বিশেষ করে বাংলাদেশ বিষয়ে লেখাগুলি আমায় খুব টানতোঃঃ 'দুই বাঙালি, এক বাঙালি '. শান্তা সেনের 'পিতামহী ' বইটিও আমার খুব প্রিয়। দিল্লিতে পরিচিত অনেক লোককে পড়িয়েছি। খুব ইচ্ছে ছিল একবার ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়। একবার তো অল্পের জন্য দেখা হলো না। যোধপুর পার্কে অমিতাভ গুপ্তের বাড়িতে একদিন গিয়ে শুনি একটু আগে পত্রিকার একটি কপি দিতে উনি এসেছিলেন, কেননা ঐ পত্রিকায় অমিতাভর একটি লেখা ছিল । তবে বাংলাদেশের দীপঙ্কর দাস একবার ফোনে ওঁদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন। আমার অধ্যাপক শিশির কুমার দাশের কাছেও অরুণ সেনের কথা অনেক শুনেছি। ওঁরা মনে হয় সহপাঠী ছিলেন ।
রিণির লেখাটা এতোই সুন্দর যে মনে হয় অরুণ সেনকে যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি
ডক্টর রিনি গঙ্গোপাধ্যায়ের অত্যন্ত মূল্যবান রচনা - স্বাদু গদ্যে উপস্থাপিত। লেখক - গবেষক রিনি হয়তো একান্ত প্রচার বিমুখ। পাঠক হিসেবে আমাদের এটুকু তো প্রত্যাশা করি যে - অন্তত সংক্ষেপে তাঁর গবেষণার বিষয় টির সঙ্গে আমাদের মতো অভাজনের পরিচয় করিয়ে দেবেন। অশেষ ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
অনেক ধন্যবাদ। অধ্যাপক গবেষক লেখক শিক্ষক ও সর্বোপরি নিখাদ খাঁটি এক ভালো মানুষ শ্রদ্ধেয় অরুণ সেন মশায়ের এরকম এক পরিচিতি চিত্রণের জন্য। পণ্ডিত মানুষদের তার জ্ঞানের গুরু গম্ভীর গাম্ভির্য্যের জন্য আমরা সাধারণ জন এড়িয়েই চলি। দূর থেকেই সম্ভ্রমে প্রণাম জানাই। তাঁদের চরণ স্পর্শ করবার সৌভাগ্য সবার হয়ে ওঠে না। জানা হয়ে ওঠে না তাঁদের পাণ্ডিত্যের অন্তরে ফল্গু ধারার মতো বয়ে চলে এক অভিভাবকের পথ প্রদর্শকের স্নেহের ভালোবাসার স্রোতের ধারা। আপনার এই লেখা পড়ে সেই ধারায় স্নাত হলাম। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।