এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • অর্থনৈতিক উন্নয়ণ ও করোণার আবহে আমরা -প্রথম পর্ব

    Rajkumar Raychaudhuri লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৬ জুন ২০২০ | ৩০৬৬ বার পঠিত
  • মহাভারতের এক চরিত্র, একালব্য অর্জুনের সমকক্ষ ধনুর্ধর ছিলেন, কিন্তু  প্রথাগত শিক্ষালাভ না করে শুধুমাত্র দ্রোণাচার্যের মূর্তি বানিয়ে ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী হয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষায় চমকৃত হয়ে দ্রোণাচার্য তার বুড়ো আঙুল কেটে নেন।

    না, আলোচ্য বিষয়ের সাথে মহাভারত বা রামায়ণের কোন সম্পর্ক নেই। আসলে আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, তাই অর্থনীতির প্রথাগত জ্ঞান আমার নেই। কিন্তু   ডঃ অমর্ত্য সেনের বই পড়ে তাঁর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে না এসেও দ্রোণাচার্যের মত তাঁকে গুরু জ্ঞান করে এই ধরণের গুরুতর বিষয়ে আলোচনায় নেমে পড়েছি। এতে আমার আঙ্গুল না কাটলেও আমার বিশ্লেষণ কতটা সফল তার দায়িত্বভার পাঠকরা নেবেন।

    প্রথমেই বলে রাখা ভাল, করোণা নিয়ে তথ্যবহুল লেখা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। কারণ এ নিয়ে আমি আগেও লিখেছি এবং অনেকেই নিজের মতো করে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, করোণায় কি করণীয়, রোগেরর ধরণ ইত্যাদি লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। মজার কথা, রাজনৈতিক ভাবে, স্বাস্থ্য সচেতনতার নিরীখে যেমন লেখা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ অনেক কম। যদিও গুরুচণ্ডালীতে অনেক গুনী মানুষ এ নিয়ে লিখেছেন, কিন্তু একথা মানতেই হবে রাজনৈতিক দিক থেকে আমরা যতটা সচেতন, অর্থনৈতিক দিক থেকে ততটা নয়।

    করোণা চিরস্থায়ী নয়, কালের নিয়মে তা চলেও যাবে। কিন্তু আমাদের সভ্যতা থাকবে। তবে করোণার সঙ্কটের আগেও ভারত দুর্ভিক্ষ মহামারীর মত সমস্যায় পড়েছিল এবং পরে তা স্বাভাবিক হয়েছিল, বরং করোণা আবহে ঘটনাপ্রবাহকে অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করে শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।

    করোণায় আমাদের অবস্থা কি রকম আর ভবিষ্যতে তার প্রভাব কি রকম হবে তা নিয়ে আলোচনার আগে একটু অতীতের দিকে ফিরে তাকাই। ১৯৪৩-১৯৪৪ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়,যা বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে খ্যাত। যদিও দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট আর করোণা সংক্রমণের প্রেক্ষাপট এক নয়, কিন্তু সেটাও ছিল এক জাতীয় বিপর্যয় যা বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ঘটেছিল, এবং করোণার প্রাদুর্ভাব একই অর্থে বিশ্ব তথা জাতীয় বিপর্যয় তো বটেই।  সেদিক থেকে তুল্যমূল্য আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণের সুযোগ আমাদের আছে।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে ১৯৪৩ এ দুর্ভিক্ষ, ম্যালেরিয়া ও অপুষ্টির মরণ কামড়ে প্রায় ২১- ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। বাংলার মানুষ প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে এসময় কি কৃষি বিস্তারে অভাব ঘটেছিল? নাকি খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি ছিল? এই দুর্ভিক্ষে কি ধরণের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল?

    সত্যি বলতে তখন দেশের জনগণের জন্য মাথাপিছু যে পরিমাণ খাদ্যের যোগান  খুব কম ছিল না। সেই সময় মাথাপিছু খাদ্যের পরিমাণ ছিল ১৯৪১ সালের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি অথচ ১৯৪১ সালে কোন দুর্ভিক্ষ হয় নি। আসলে অপুষ্টি, অনাহার ও দুর্ভিক্ষ তিনটি অর্থনীতি ও সমাজের কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল- শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদন ও কৃষি বিস্তারের মাধ্যমে নয়। দেশে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য মজুত থাকলেও কোন ব্যক্তি যদি তা কিনতে না পারেন, তবে তিনি ক্ষুধার্ত থাকবেন। এই অক্ষমতার কারণ হতে পারে কাজ হা্রিয়ে বেকারত্ব বা তার নিজস্ব উৎপাদনের চাহিদার হ্রাস।

    এই দুর্ভিক্ষ হওয়ার পিছনে রাজনৈতিক অনুৎসাহিতা ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবোধ ছিল অন্যতম কারণ। এ প্রসঙ্গে উইন্সটন চার্চিলের বিখ্যাত মন্তব্য স্মরণযোগ্য। তাঁর মতে এই মন্বন্তরের মূল কারণ ছিল ‘নেটিভ’ দের খরগোশের মতো বংশবৃদ্ধির প্রবণতা। তাঁর অন্য কুখ্যাত উক্তি – “ভারতীয়রা জার্মানদের পরেই সবচেয়ে পশুশ্রেণীর লোক”।

    ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ অধীন ভারতবর্ষে পরিকাঠামোগত ত্রুটির ফলে জমি বণ্টনের অসমতা সৃষ্টি হয়েছিল এবং যার সুফল লাভ করেছিল জমিদার, জোতদার ও বর্গাদাররা এবং  ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক, মাছচাষীরা এই দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সময়ে কৃষিশ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য মূল্যের বদলে ফসল উৎপাদনের ভিত্তিতে দৈনিক মজুরি পেতে লাগল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্যের সাপেক্ষে সেই মজুরি অনেক কম হওয়ায় তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেল।

    বাংলার মাছ চাষীরা বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।  মাছ যেহেতু উঁচু শ্রেণীর খাদ্য তাই বেঁচে থাকার তাগিদে, পুষ্টি যুক্ত আহার পেতে জলের দামে মাছ বেচে তারা নিম্ন মাণের চাল সংগ্রহ করত।  ফলে বাজারে এদের ক্রয় ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়।

    শুধু মাছ চাষীরাই নয়, বহু জীবিকাই সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নাপিতেরা সে সময় দুই ধরণের সমস্যায় জর্জরিত হয়েছিল- ১) সে সময় মানুষ চুল কাটা বন্ধ করেছিল, ফলে তাদের উপার্জন ক্ষমতা কমে গেছিল। ২) প্রধান খাদ্যের অনুপাতে নাপিতের পরিশ্রমের আপেক্ষিক হার নিম্নমুখী হয়।  

    অর্থাৎ নিজেদের মজুরি বা আর্থিক আয়কে সম্বল করে এই পরিস্থিতির সাথে পাল্লা দেওয়া যাদের সম্ভব ছিল না, তারা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল।

    অন্যদিকে  নিয়ন্ত্রিত মূল্যে খাদ্যের রেশন ব্যবস্থার ফলে  যুদ্ধের বাজারে লাভবান শহরবাসীদের  ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে গেছিল এবং বাকি অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্যের যে চাপ শহরের বেচাকেনা তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল।

    এবার আসি করোণা প্রসঙ্গে। নিঃসন্দেহে করোণা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ত্রাস সৃষ্টি করেছে। তবে যদি আমরা অতীতের দুর্ভিক্ষের সাপেক্ষে এই সঙ্কটকে দেখি তবে করোণা ভাইরাসের তীব্রতা অনেক কম। ১৪ই জুন পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোণা সংক্রমণে ৭৪ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত এবং ৪ লক্ষ ১৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভারতবর্ষের দিকে তাকালে  দেখা যাবে ৩ লক্ষ ২১ হাজার জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ১৯৫ জনের। সরকারি রেশন ব্যবস্থার সুব্যবস্থার ফলে আকস্মিক লকডাউনে প্রাথমিক সমস্যা থাকলেও দুর্ভিক্ষের মত পরিস্থিতি কোথাও হয় নি। সেদিক থেকে বিচার করলে আমরা অনুমান করতে পারি অতীতের দুর্দিন কাটিয়ে যদি আমরা আজকের বর্তমান পরিস্থিতে যদি আসতে পারি, তবে করোণার ভয়াল ভয়ংকররূপ উপেক্ষা করে আমাদের প্রজন্ম ভবিষ্যতের দিকে স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে যেতে পারবে।

    এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে করোণার সঙ্কট যদি অতীতের দুর্ভিক্ষের নিরীখে অত ভয়ংকর যদি না হয় তবে আমরা এত শঙ্কিত কেন? তার প্রধাণ কারণ হল করোণার প্রাদুর্ভাবে গোষ্ঠী সংক্রমণের প্রবণতার সাথে সাথে অর্থনীতির চাকা আকস্মিকভাবে দুর্বিপাকের পাঁকে আটকে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে আপমর জনসাধারণের উপর। এছাড়াও অন্য গৌণ কারণও আছে। অনেক সময় টি আর পি বাড়ানোর জন্য মিডিয়া মারফৎ একই খবর বারংবার প্রচারের ফলে  ( অনেক সময় সোসাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য ও বার বার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে) এবং নঞ অর্থক খবর প্রাধান্য পাওয়ার ফলে মানুষের মনে অনাবশ্যক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

    এতদূর আলোচনা করার পর আশা করা যায়, পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণে  সক্ষম হয়েছি যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আলোচনা শুধুমাত্র অর্থ সংক্রান্ত নয়। অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে অর্থনীতির বিষয়বস্তু কি? অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাণ দণ্ড কি জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি (G.D.P), শিল্পায়ণ, আর্থিক স্বচ্ছলতার উপর নির্ভরশীল? মানুষের জীবনযাত্রার মাণ উন্নয়নের সাথে কি শুধু আর্থিক উন্নতিসাধন জড়িয়ে আছে? স্বাধীনতা বলতে আমরা কি বুঝি?

    অর্থনীতির এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের বাড়ির রান্নাঘর নিয়ে একটা ছোট উপমা দিই। প্রতিদিন আয় অনুযায়ী যেমন বাজার আসে ঠিক তেমনি রান্না হয়। বাজার কম এলে কম, বেশি এলে বেশি রান্না। এ নিয়ে কোন বিরোধ নেই।  কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রান্নার গুণমাণ কিন্তু বাজার থেকে আসা সামগ্রীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে যিনি রান্না করছেন তাঁর রান্না সম্পর্কিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, এ ছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা। ধরা যাক, ভোরবেলা উঠে কোন গৃহিনীর সামনে যদি তাঁর স্বামী চায়ের পাত্র নিয়ে বেড টি পরিবেশন করেন, তবে তিনি দিনের শেষে কম সামগ্রী নিয়ে যে পরিপাটি, তৃপ্তিদায়ক সুস্বাদু রান্না পরিবেশন করবেন আর যিনি  সকালে ঘুমচোখে উঠেই হেঁসেলে গিয়ে ঢোকেন, বেশি সামগ্রী থাকা স্বত্তেও তাঁর রান্নার গুণমানের তারতম্য ঘটবেই।

    অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই উপমা খাটে। সমাজে বসবাসকারী মানুষের স্বাধীনতা বৃদ্ধির উপায় হিসাবে জাতীয় সম্পদ বা ব্যক্তিগত উপার্জনের বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাই একমাত্র কারণ হতে পারে না। অন্যভাবে বলতে গেলে অ্যারিস্টটলের উক্তিতে বলতে হয়-‘ঐশ্বর্য্যলাভ আমাদের লক্ষ্যবস্তু নয়, এটি কেবলমাত্র প্রয়োজনে এবং আরও অন্য কোন কাজেও লাগে’।

    অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে জীবনের আয়ু ও মানের উন্নতিসাধন প্রকৃত মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল নয়। মৃত্যুর হার হ্রাস, জীবন যাত্রার উন্নতিসাধন নির্ভরশীল হয় পরিবর্তিত সামাজিক ব্যবস্থার উপর (সুস্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক শিক্ষা)।  তিনি মানুষের উন্নতি বৃদ্ধির মূল হিসাবে স্বাধীনতার প্রসারকে জোর দিয়েছেন। এবার দেখা যাক, করোণার প্রকোপে বা তার আগে থেকেই আমাদের কি কি স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। এই খর্ব হওয়া স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন হলেই আমরা সেগুলি অর্জনে সক্ষম হতে সচেষ্ট হব যা ভবিষ্যত উন্নয়ণের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

    আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বা ৬৭ শতাংশ কর্মী তাদের কাজ হারিয়েছেন এই আকস্মিক লকডাউনের কারণে। সমীক্ষায় দেখা গেছে শহরাঞ্চলে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জন এবং গ্রামাঞ্চলে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। প্রায় ৪৯ শতাংশ মানুষ সমীক্ষায় জানিয়েছেন সাপ্তাহিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার সামর্থ্য তাঁরা হারিয়েছেন এবং ৮০ শতাংশ শহরাঞ্চলের মানুষ, ৭০ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের মানুষ জানিয়েছেন তাঁরা আগের তুলনায় অনেক কম খাবার খাচ্ছেন। সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী শহরাঞ্চলের  ৩৬ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশ মানুষ এবং গ্রামাঞ্চলের ৫৩ শতাংশ মানুষ সরকারের তরফ থেকে পাঠানো এককালীন ভাতা লাভ করেছেন।

    সরকারের রেশন ব্যবস্থার ফলে খাদ্য সঙ্কট না ঘটলেও এক্ষেত্রেও সঙ্কটের প্রধান শিকার হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকসমাজ। এখানে একটু বিস্তারিত বলার আছে। আমরা সবাই জানি করোণা প্রাদুর্ভাবের আগে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যস্ত ছিলেন দেশ থেকে বহিরাগতদের উচ্ছেদ করতে। ছোট কথায় NRC (National Register of Citizen) নামে পরিচিত। আমরা এন আর সি প্রসঙ্গ এখানে আনছি না, তবে এই ঘটনার সাপেক্ষে বর্তমান অবস্থাকে বিচার করছি মাত্র। এর উদ্দেশ্য ছিল তথ্য প্রমাণের সাহায্যে বিদেশীদের চিহ্নিতকরণ এবং তাদের নাগরিক অধিকার খর্ব করা। আসামে এই কারণে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরী করে তাদের বন্দী করা হয়েছিল অনেক হতভাগ্যকে এবং আসামের এন আর সি করে তার থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সারা দেশ জুড়ে এই প্রক্রিয়া চালানো সরকারের উদ্দেশ্য ছিল। কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল দেশের সম্পদ শুধুমাত্র দেশবাশীর জন্য এবং তা বিদেশীদের জন্য নয়। দেখা গেছে ১৯ লক্ষ আসামের মানুষ এই বিদেশী তালিকায় নথিভুক্ত হয়েছিলেন এবং সমগ্র প্রক্রিয়ায় খরচ হয়েছে ১৬০০ কোটি টাকা। তর্কের খাতিরে আইনি পথে গিয়ে যদি অনেকে নাগরিকত্ব প্রমাণ অর্জন করতে পারেন, সেক্ষেত্রে আমরা যদি সংখ্যাটা কমিয়ে ১০ লক্ষ ধরি এবং খরচটা কমিয়ে আনুমানিক ১৩ শত কোটি টাকা ধরি তবে বিদেশী তালিকাভুক্ত করতে মাথাপিছু খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা।

    এবার চলে আসি পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা বিবরণে। আকস্মিক লকডাউনের ফলে সারাদেশের প্রায় ১ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়েছিল। কাজ হারানোর ফলে তারা প্রায় কপর্দকশূণ্য হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন এন জি ও র সহায়তায় যদিও তাদের খাদ্যের যোগান চলছিল, কিন্তু তাদের চাহিদার কাছে সেই যোগান ছিল অপ্রতুল। এই সময় তাদের মধ্যে ছিল ঘরে ফেরার তাগিদা, অথচ তাদের অর্থবল ছিল খুবই কম। মজার কথা প্রকৃত দেশবাসী বাছতে সরকার মাথাপিছু ১৩ হাজার টাকা খরচ করতে দ্বিধা করে না, অথচ দেশবাসী যখন প্রকৃত সমস্যার সম্মুখীন তখন শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে একই পরিমাণ অর্থ মহার্ঘ হয়ে দাঁড়ায়, সরকার এইসময় নীরব ভূমিকা পালন করে। রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারই গড়িমসি করতে থাকে। অবশেষে সরকারের আশা ছেড়ে যখন শ্রমিকরা নিজেরাই সাইকেলে, পায়ে হেঁটে ভিন্ন শহর থেকে ফিরে আসতে থাকে, কিছু শ্রমিক ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ট্রেনের তলায় আত্মবলিদান দেয়, সরকারের টনক নড়ে, বিরোধীদের চাপে শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর জন্য তৈরী হয়। অবশ্য এতে সমস্যা খুব একটা কমে যায় না, বরং বাড়ে।  কারণ -
    প্রথমতঃ, বন্দীদশাপ্রাপ্ত অল্পসংখ্যক শ্রমিকদের মধ্যে করোণা সংক্রমণ আগে থেকে ছিল, একসাথে থাকার ফলে তা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। এত দিনে তারা যখন ঘরে পৌঁছায়, গ্রামেও ভাইরাস ছড়িয়ে গোষ্ঠীসংক্রমণের প্রবণতা দেখা দেয়। দ্বিতীয়তঃ, সেণ্টার ফর ডেভলপমেণ্ট স্টাডিস, তিরুভন্তপুরম এর প্রফেসর এস ইরুদায়া রাজনের মতে শহর থেকে ফিরে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৩০ শতাংশ এই অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার শিকারের ফলে কাজের জায়গায় আর ফিরে আসবে না। ফলে শ্রমিক সমাজের চাহিদা ও যোগান নিয়ে বড় একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। তিনি আবেদন করেছিলেন প্রত্যেক শ্রমিকের ব্যাঙ্কে টাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য, যদিও সরকার কার্যত সেই আবেদনে নীরব তা বলাই বাহুল্য।

    উপরের বিশ্লেষণ প্রমাণ করে রাজনৈতিক অনুৎসাহিতা ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবোধ যেমন আগেও ছিল, এখনো আছে। আমরা হয়তো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল কে বিদেশী বলে ভৎর্সনার চোখে দেখতে পারি, কিন্তু যদি একই দৃষ্টান্ত আমাদের স্বদেশী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তার নির্লজ্জ প্রকাশ দেখি তখন লজ্জা ও রাগ ছাপিয়ে হতাশার শিকার হতে হয়।

    নিম্ন মধ্যবিত্তদের পর যারা এই সঙ্কটের শিকার তারা হলেন মধ্যবিত্ত সমাজ। এই সমাজের মধ্যে অনেকেই পড়েন। চাকুরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী, অভিনেতা ইত্যাদি অনেকেই। আকস্মিক লকডাউনের ফলে অনেকেই কাজ হারিয়ে গৃহবন্দী। আইটি সেক্টরে ঘর থেকে কাজকর্ম চালু থাকলেও মাসিক বেতন অনেক কমে গেছে। আকস্মিক কর্মহীন পরিবেশের ফলে মানসিক অবসাদ, অনুৎসাহতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব মানুষকে গ্রাস করে ফেলে। যার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই অভিনয় জগতের ক্ষেত্রে। মানসিক অবসাদের কারণে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী আত্মহত্যার খবর আমাদের চোখের সামনে।

    চাকুরিজীবী সমাজের উপর চক্ষুশূল হিসাবে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যালয়ের বেতনবৃদ্ধি। আকস্মিক কর্মহীনতার জেরে অনেকের রোজগার যখন টালমাটাল তখন এই সকল বেসরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বেতন আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রতিবাদে অনেক স্কুল প্রতিষ্ঠান তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলায় রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের নীরব ভূমিকা চোখে পড়ার মত।

    স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সরকার দেশের সুরক্ষা খাতে সর্বাধিক অর্থ ব্যয় করে এসেছেন। কিন্তু এই মহামারীর সময়ে দেশের সামরিক বল অপেক্ষা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশী অনুভূত হয়েছে। অথচ এই মহামারীর প্রাদুর্ভাবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কি সরকারি বা বেসরকারি, সর্বস্তরে দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে। যেখানে ডাক্তার, নার্সদের প্রয়োজনীয় পিপিই দেওয়ার প্রয়োজন, করোণার জন্য অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রয়োজন, ভাল ভাল যন্ত্রপাতি এনে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থার দরকার এবং লকডাউনে কিটস এনে বাড়ি বাড়ি পরীক্ষা করার দরকার, সেখানে প্রধানমন্ত্রী গালভরা ভাষণ দিয়ে, কখনো থালা বাজিয়ে, ডাক্তারদের মাথায় ফুল ছড়িয়ে করোণা মোকাবিলার আকাশকুসুম কল্পনায় মেতে উঠেছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিকে পরিকল্পনামাফিক এগোলেও পরেরদিকে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কার্যকারী সিদ্ধান্তের বদলে কখনো পিপিই নিয়ে রাজনীতিতে বা কখনো মৃতদের পরিসংখ্যান ঢাকতে ব্যস্ত হয়েছেন। পরবর্তীকালে তাঁর সিদ্ধান্তগুলিতে দিশাহীনতা এবং রাজনৈতিক সুবিধালাভের চেষ্টাই দেখা গেছে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৬ জুন ২০২০ | ৩০৬৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অনিন্দিতা | 103.87.***.*** | ২৬ জুন ২০২০ ১৩:২৫94640
  • লেখাটি পড়ে যে কোন বিষয়ে আলোচনা করার জন্য প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন যে কতখানি তা আবার উপলব্ধি করলাম। উন্নয়নের অর্থনীতি, অর্থনৈতিক ইতিহাস, সমষ্টিগত অর্থশাস্ত্র, সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এর প্রতিটির নিজস্ব তত্ত্ব ও  বিশ্লেষণের ধারা আছে। একটি থেকে অন্যটিতে কেবল লাফিয়ে যাওয়া যায় না। 

  • স্বাতী রায় | 42.***.*** | ২৬ জুন ২০২০ ১৫:৪০94641
  • পড়ছি। লেখার চলন টা সুন্দর।   এটা তো প্রথম পর্ব। পরের পর্ব গুলো আগে পড়ি। 

  • Rajkumar Raychaudhuri | ২৬ জুন ২০২০ ১৮:২৬94642
  • @অনিন্দিতা আসলে অর্থনীতির ছাত্র না হওয়ার অসুবিধা যেটা         প্রথাগত ধারণা নিয়ে লেখাটা নয়। এটা সাধারণের চোখে অর্থনীতিকে দেখা বা বোঝা।  তবে, আশা করব,  লেখার খামতি গুলো আরো বিস্তৃত ভাবে তুলে ধরলে পরর লেখাটা লেখার সময় আরো ভাল করে বুঝে লিখতে পারব।

    @স্বাতী রায়, পরের পর্বেই লেখাটা শেষ করেছি। কড়া সমালোচনা আশা করব। 

  • একলহমা | ২৬ জুন ২০২০ ২৩:৫০94644
  • বিশাল পরিসরে ধরতে চেয়েছেন। কঠিন কাজ। উপসংহার পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন