প্রযুক্তি জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে গুগুল (Google) গত বছরের শেষের দিকে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় জানায় কোয়াণ্টাম কম্পিউটারের সাহায্যে অতি দ্রুত গণণা কষতে (৩মিনিটে) সক্ষম হয়েছে যা সুপার কম্পিউটারের দীর্ঘ সময় (প্রায় ১০ হাজার বছর) লাগত। কিন্ত তাদের এই বক্তব্যকে ভুল বলে দাবী করে আই বি এম (IBM)। তাদের হিসাব অনুযায়ী সুপার কম্পিউটারে সেই গণণা করতে মাত্র আড়াইদিন সময় লাগতে পারে।
জানি, বিজ্ঞান জগতে এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চললেও উপরের বক্তব্য পড়ে আমাদের পাঠক সমাজের কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে না। এর কারণ এই নয় যে, পাঠকসমাজ কৌতূহলী নয়, কারণ হল প্রসঙ্গের গভীরতা। তাই প্রসঙ্গের গভীরে যাওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে কোয়াণ্টাম তত্ত্ব কি?এল কিভাবে? কোযাণ্টাম আধিপত্য কি? কোয়াণ্টাম কম্পিউটার কিভা্বে সুপার কম্পিউটার থেকে দ্রুত কাজ করে?
মূল আলোচনা শুরুর আগে বহু পুরানো দ্বন্দ্ব নিয়ে আমরা যদি আলোচনা শুরু করি, তবে মূল প্রসঙ্গ বুঝতে সুবিধা হবে। বিষয়টা হল, আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের একটি অঙ্গ নিয়ে, যা ছাড়া আমাদের জীবন একেবারেই অচল তা নিয়ে- আলো। এই আলো কি? এটা কি কোন কণা(particle)? নাকি এটা তরঙ্গ (wave)? এই দ্বন্দ্ব বহুযুগ ধরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল।
আরবীয় বিজ্ঞানী ইবন আল হাতেম (Ibn- Al Haytham) তাঁর “ বুক্স অব অপটিক্স” (Books of Optics) বইতে আলোক প্রতিফলন (Reflection) ও প্রতিসরণ (Refraction) ধর্মের ব্যাখ্যা দেন, এবং পিনহোল ক্যমেরায় (Pinhole Camera) বস্তুর আপাতিত রশ্মির উলটো প্রতিবিম্বের ( inverted image of an object as rays of lights travelling from a point of source) ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, আলো কণার সমষ্ঠী।
১৬৩০ সালে রেনে ডেস্ক্রাটেস (Rene Descrates) এর বিপরীতে মত দেন সমুদ্রের উপর যেভাবে ঢেউ সঞ্চালিত হয়, সেভাবেই ইথার তরঙ্গের (luminiferous aether wave) মাধ্যমে সূর্য থেকে আলো তরঙ্গ আকারে ভেসে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। তাই আলো তরঙ্গ।
১৬৭০ সালের গোড়ার দিকে নিউটন (Issac Newton) করপাসকুলার তত্ত্ব (Corpascular theory) খাঁড়া করলেন, এবং যুক্তি দিলেন, যেহেতু প্রতিফলিত আলোকরশ্মি সরলরেখায় থাকে, সে কারণে আলোকরশ্মি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমষ্ঠী। আলোর অপর ধর্ম প্রতিসরণ ঘটে কোন ঘন মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় আলো কণার প্বার্শীয় ত্বরণের কারণে (accelerated laterally)।
ঠিক একই সময়ে তাঁর সমসাময়িক রবার্ট হুক (Robart Hook), ক্রিস্টিয়ান হুগেন্স (Christiaan Hyugens) এবং পরে অগাস্টিন জেন ফ্রেস্নেল (Augustine –Jean –Fresnel) গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে দেখালেন আলো ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন বেগে প্রবাহিত হয়, এবং আলোর প্রতিসরণ ধর্মকে তরঙ্গ ধর্মের (medium depended propagation of light wave) সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
১৮০৩ সালে, থমাস ইয়ং (Thomas Young) দ্বিছিদ্র পর্দা পরীক্ষার মাধ্যমে আলো যে তরঙ্গ তার স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ দেন।
দ্বিছিদ্র পর্দা পরীক্ষা (Double Slits Experiment)
পরীক্ষাটির সাধারণ ধারণা এই, একটি নিরবিচ্ছিন্ন একক বর্ণযুক্ত আলোক উৎসর (ধরা যাক লেসার রশ্মি) সামনে একটা পর্দা রাখা হল যার উপর আলোক রশ্মি আপাতিত হয়। আলোক উৎস ও পর্দার মাঝে প্লেট রাখা হল যার সমান্তরাল ছিদ্র বর্তমান এবং আলোক রশ্মি সেই ছিদ্রযুক্ত প্লেটের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে পর্দায় আপাতিত হতে পারে। এবার আলোক উৎস থেকে আলোক রশ্মি পাঠিয়ে দেখা গেল তরঙ্গের ব্যতিচার (interference) ধর্মের মতো প্লেটের পিছন দিকে পর্দায় উজ্জ্বল আলোক ও অন্ধকারের একটা ক্রমসজ্জা সৃষ্টি করেছে। আলোক রশ্মিকে কণা হিসাবে কল্পনা করলে তরঙ্গ ধর্মের মত এই ধরণের সজ্জাক্রম তৈরী কখনোই সম্ভব নয়।
দ্বিছিদ্র পর্দা পরীক্ষা
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clark Maxwell) তাঁর তড়িৎচৌম্বকীয় সূত্রের (Maxwell equation) সামান্য পরিবর্তন করে দেখান আলোক রশ্মি তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ(Electro Magnatic Wave)। সুতরাং বিজ্ঞানী মহল ধরণা করে নিয়েছিলেন আলোক শক্তি কণা নয়, তরঙ্গ।
কালো বস্তুর খোঁজে (Black Body)
সালটা ১৮৬০। জার্মান বিজ্ঞানী গুস্টভ কিরচফ (Gustav Kirchoff) একটা বিজ্ঞান পত্রিকায় নিজের গবেষণা সংক্রান্ত প্রবন্ধে কালোবস্তু (Black body) সম্পর্কে ধারণা দিয়ে লিখলেন,
“উপরিউক্ত সূত্রের প্রমাণ দিতে অনুমানের উপর ভিত্তি করে অসীম ক্ষুদ্র উচ্চতা সম্পন্ন বস্তুর কল্পনা করতে পারি, যা আপাতিত রশ্মি সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে পারে, কিন্ত প্রতিফলিত করে না বা পরিবহন করে না। আমি এই ধরণের বস্তুকে সম্পূর্ণ কালো বলব, ছোট কথায় কালো বস্তু।”
আলোক তড়িৎক্রিয়া (Photo Electric Effect)পরীক্ষা
সালটা ১৮৮৭। হেনরিক হার্টজ একটা পরীক্ষা করলেন। তিনি একটা বাতাসশূণ্য গ্লাসটিউবে ক্যাথোড ও অ্যানোড- দুটো বিভব সৃষ্টি করলেন। বিভব থেকে নির্গত স্ফুলিঙ্গ পরিষ্কার যাতে দেখা যায়, তার জন্য তিনি চারপাশ অন্ধকার করে দিলেন। এবার দেখলেন ধাতব চার্জ পাতে অতিবেগুনী রশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটানোর সাথে সাথে ধাতব পাত থেকে ইলেক্ট্রনের প্রবাহ অন্য বিভবের দিকে ছুটে চলেছে।
কিন্ত কেন? কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না।
১৯০২ সালে ফিলিপ লেনার্ড আবিষ্কার করলেন ইলেক্ট্রনের প্রবাহ আলোর তীব্রতার (intensity) উপর নির্ভরশীল নয়, বরং নির্দিষ্ট আলোর কম্পাঙ্কের ( বর্ণের) উপর নির্ভরশীল। নিম্ন কম্পাঙ্কের ( frequency) আলোক রশ্মির ক্ষেত্রে কোন ইলেক্ট্রন নির্গত হয় না, সেই আলোক রশ্মি যতই তীব্র হোক।
আসল সমস্যা বিকিরণ সংক্রান্ত। নিউটনের গতিতত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব ছিল না।
ম্যাক্সওয়েল ও তাঁর তড়িৎচৌম্বকীয় সূত্র দিয়ে কোন সমাধান খুঁজে পেলেননা।
কালোবস্তু বিকিরণ (Black body Radiation) কাল্পনিক সংলাপ- কোয়াণ্টামের জন্ম।
কোন বস্তুকে যখন খুব উত্তপ্ত করা হয়, তখন সেই বস্তু থেকে আলো বর্ণালীর লাল আলো বিচ্ছুরন ঘটে। এই তাপ যখন আরো বাড়ানো হয়, আলোর বর্ণের পরিবর্তন ঘটে- লাল থেকে হলুদ, সাদা এবং নীল হয়ে যায়। অর্থাৎ কম তরঙ্গদৈর্ঘের (বেশি কম্পাঙ্কের) আলো রেখা দেখা যায়। আবার বস্তুটিকে ঠাণ্ডা যখন করা হয়, তখন বস্তুটি পুরোপুরি কালো (ব্লাক বডি)হয়ে পড়ে। বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণালীকে বলা হয় কালো বস্তুর বিচ্ছুরণ বা ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন।
এক লহমা আপনার জন্য তাড়াহুড়ো করে ২য় পর্ব দিলাম।