করোণা আবহে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অন্য এক সমস্যা দেখা গেছে। গভীর সঙ্কটাপন্ন রোগীরা, যারা করোণায় আক্রান্ত নন কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষা দরকার, তাঁরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। তাঁদের সংখ্যা কত তা কিন্তু সরকারী হিসাবে নেই এবং এ নিয়ে অদ্ভুতভাবে সকলেই নীরব। হাসপাতাল বা নার্সিংহোম শুধুমাত্র প্রসুতি বিভাগেই রোগী ভর্তি নিচ্ছে, কিন্তু অন্য রোগীর স্থান দূর অস্ত।
দেশ যখন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন সরকারের উচিৎ বিচক্ষণ সরকারি নীতি দ্বারা অন্যান্য অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্টানগুলির ( যেমন- ব্যবসা বাণিজ্য, বেসরকারি সংস্থা, প্রচারমাধ্যম) ফলপ্রদ কার্যসূচির সঙ্গে একত্রে যুক্ত হওয়া। এর ফলে দূর্যোগ মোকাবিলার পথ সুগম হয়। অবশ্য সরকার যে আমাদের মাথার উপর ছাতা ধরেনি একথা বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। ‘মন কি বাত’ –এ প্রধামন্ত্রীর ‘লোকাল ভোকাল’- এর সুর ধরেই পরদিন থেকে অর্থমন্ত্রী পাঁচদিন ধরে একগুচ্ছ প্রকল্প দেশবাসীর সামনে আনলেন। তবে আমাদের বুঝে নিতে হবে সরকারী ঘোষণাগুলো আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিসাধনে সহায়ক কিনা বা আয়ের সামর্থ্যে পরিবর্তন এনে জীবনযাপন স্বচ্ছল করে তুলছে কিনা। এই সরকারী ঘোষণাগুলি বিশ্লেষণ করার আগে আমরা বাজার অর্থনীতি নিয়ে দুচার কথা জেনে নি। কারণ অধিকাংশ সরকারীনীতিই ছিল বাজারভিত্তিক।
বাজারের উপর অর্পিত সামর্থ্য ও তার দ্বারা সম্ভাব্য কার্যসাধনের উপর বাজারের ভূমিকা নিরূপিত হয়। বাজারের অবাধ ক্রিয়া দ্বারা বহু লোকের স্বার্থ সুষ্ঠুভাবে সাধিত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী হয়ে অর্থনীতিতে বাজারের ভূমিকাকে খর্ব করে। অনেক সময় এই বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে দেশি বা বিদেশি প্রতিযোগিতার সুযোগকে নস্যাৎ করে একচ্ছত্র একমাত্র উৎপাদনকারী হিসাবে দেখা দেয় এবং তাদের প্রস্তুতজাত উচ্চমূল্য যুক্ত অথচ নিম্ন গুণমানযুক্ত মাল জনসাধারণের উপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সঙ্ঘবদ্ধ প্রভাবশালী শিল্পপতি গোষ্ঠী তাদের লাভ সংরক্ষিত করে।
এবিষয়ে অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ এর বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে,-“ বাণিজ্য বা উৎপাদনের কোন শাখায় যারা নিরত তাদের স্বার্থ অনেক বিষয়েই জনসাধরণ থেকে ভিন্ন এবং এমনকি বিপরীতমুখী। ব্যবসায়ীর স্বার্থ সর্বকালেই বাজারের বিস্তৃতি এবং প্রতিযোগিতাকে সঙ্কীর্ণ করা। বাজারের ব্যপ্তিসাধন প্রায়ই হয়তো জনসাধারণের স্বার্থ সমর্থক হবে, কিন্তু প্রতিযোগিতাকে সঙ্কুচিত করা সর্বকালেই জনসাধারণের স্বার্থবিরোধী এবং কেবলমাত্র ব্যবসায়ীদের কাজে লাগবে, তারা স্বাভাবিকভাবে যে লাভ করত তার থেকে অনেক বেশি পেতে সাহায্য করবে আর নিজেদের স্বার্থে তাদের স্বদেশি নাগরিকদের উপর অসম্ভব বোঝা চাপানো হবে”।
এবার আসি, অর্থমন্ত্রী ঘোষিত নীতিগুলির বিশ্লেষনে। তিনি প্রথম দিনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এম এস এম ই) নিয়ে যে ঘোষণা করলেন তা নিম্নরূপ-
১) তিন লক্ষ কোটি টাকার ঋণ- যাদের ব্যঙ্কে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২৫ কোটি টাকা, তাঁরাও ঋণ পাবেন।
২) ২০,০০০ কোটি টাকার সাব অর্ডিনেট ঋণ – দুই লক্ষ এমএসএমই এই ঋণের সুবিধা পাবে। ব্যঙ্কে যাদের ঋণ অনাদায়ী আছে, তারাও এই সুবিধা পাবে।
৩) এমএসএমই –র ইক্যুইটির জন্য ৫০,০০০ কোটি টাকার তহবিল।
২০১৮-১৯ সালের এম এস এম ই-র বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে সর্বমোট ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ৬৩৩.৮৮ লক্ষ এবং দেশের জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধিতে তাঁদের অবদান ২৮.৭৭%। রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রাম ও শহর মিলিয়ে অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৬৩০.৫২ লক্ষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৩.৩১ লক্ষ এবং মাঝারি শিল্প ব্যবসায়ী ৫০০০ জন। সুতরাং উপরের তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয়, অর্থমন্ত্রী ঘটা করে সকলের সামনে ঘোষণা করলেন দুইলক্ষ ব্যবসায়ী ঋণের সুযোগ পাবেন, তা আয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নগণ্য। তবে ব্যাপারটা এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। আগে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল- শিল্প ও পরিষেবা। এমএসএমই- র সংজ্ঞা অনুযায়ী শিল্প ক্ষেত্রে (কারখানা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে) যাদের বিনিয়োগ ৫ লক্ষের কম, তারা অতি ক্ষুদ্র শিল্পব্যবসায়ী, ৫ লক্ষ থেকে থেকে ৫ কোটি টাকা যাদের বিনিয়োগ তারা ক্ষুদ্র এবং ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা অবধি যাদের বিনিয়োগ তারা মাঝারি ব্যবসায়ী। পরিষেবা ক্ষেত্রে শিল্প যন্ত্রাংশে বিনিয়োগ ১০ লক্ষের কম হলে তা অতিক্ষুদ্র, ১০ লক্ষ থেকে ২ কোটি অবধি হলে তা ক্ষুদ্র ও ২ কোটি থেকে ৫ কোটি হলে তা মাঝারি শিল্প ব্যবসায়ী হিসাবে ধরা হত। অর্থমন্ত্রী আর্থিক প্যাকেজ জানানোর সময় ঘোষণা করলেন নতুন ফরমান। তিনি শিল্প ও পরিষেবার ভাগটা তুলে দিলেন এবং অতি ক্ষুদ্রের উর্ধসীমা ৫ কোটি টাকা, ক্ষুদ্রের উর্ধসীমা ১০ কোটি টাকা এবং মাঝারিদের উর্ধসীমা ২০ কোটি টাকা করলেন। অর্থাৎ, আগের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ৬৩৩.৮৩ লক্ষ অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বা বলা ভাল সিংহ ভাগ ব্যবসায়ীরা, যাঁদের বিনিয়োগ সর্বনিম্ন ৫ লক্ষ ও সর্বমোট ৫ কোটি টাকার কিছু বেশি তাঁরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেন। অন্যদিকে খুব সামান্য সংখ্যক শিল্পপতিদের তিনি তাঁর স্নেহধন্য বর্ষণ করলেন।
এর পরেরদিন গুলিতে তিনি আরো কিছু প্যাকেজ ঘোষণা করলেন তার মধ্যে অন্যতম হল,-
১) কয়লা খনির বিকেন্দ্রীকরণ
২) দেশি নির্মাতাদের দ্বারা অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়।
৩) বিমানবন্দর সহ অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রে বেসরকারি বিলগ্নিকরণ।
মাথায় রাখতে হবে দেশীয় নির্মাতাদের মধ্যে রিলায়েন্সের মত এমনকিছু নির্মাতা আছেন যাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অসামান্য কিন্তু অভিজ্ঞতার ঝুলি শূন্য। সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট, মুখে লোকালদের জন্য ভোকাল হওয়ার আহ্বান জানালেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত কার্যপ্রণালী তাঁর কৃপাধন্য মুষ্টিমেয় শিল্পপতিদের জন্য।
রাজনীতির অঙ্গন ছেড়ে এবার আসি স্বচ্ছতার প্রশ্নে। বিভিন্ন দেশের অনুকরণে আমরা স্বাস্থ্য পরিষেবীদের সামরিক হেলিকপ্টর করে দেশ জুড়ে পুষ্পবৃষ্টি করতেই পারি, কিন্তু স্বচ্ছতার প্রশ্নে আমরা কি ততটাই অনুকরণ করতে পারি কি? অতীতের দিকে যদি তাকাই, পুলওমায় প্যারামিলিটারিদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা প্রতিবেশী দেশের উপর স্ট্রাটেজিক্যাল স্ট্রাইকে নিজেদের জাহির করলাম বটে, কিন্তু আমাদের দেশ সব স্তরের প্রহরীদের নজর ও সতর্কতা এড়িয়ে কি করে ৩০০ কিলোগ্রাম আরডিএক্স এসে পৌঁছাল সে ব্যাপারে সরকার নীরব। এখনো তদন্ত চলছে। অথচ সামরিক খাতে সর্বোচ্চ অর্থপ্রদান-ই দস্তুর।
এ রকম ঘটনা ভুরি ভুরি। তুল্যমূল্য আলোচনাতে যদি যাই তবে দেখব, ওবামা কেয়ারের অনুকরণে পিএমসি কেয়ার তৈরী হল বটে, কিন্তু তা ক্যাগের অডিট ক্ষমতার বাইরে রাখা হল। এর কারণ প্রশাসনিক স্তরে যাই কিছু বলা হোক না কেন, জনগণের কাছে আসল সত্য পরিষ্কার।
আমেরিকাতে একজন কালো মানুষের অকারণ হত্যা নিয়ে যখন দেশ উত্তাল, প্রেসিডেণ্ট ট্রাম্প যখন তাঁর গভর্নরদের প্রশাসনিক সহায়তার উপর জোর না দিয়ে চুপ থাকাকে তিরস্কার করছেন তাঁদের দুর্বলতা হিসাবে, তখন হাউস্টন প্রদেশের পুলিশ প্রধান সরাসরি ট্রাম্পের এই অনর্থক নাক গলানোতে মিডিয়ার সামনে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করলেন কিন্তু এতে তাঁর কর্মজীবনে কোন প্রভাব পড়েনি। উল্টোদিকে আমাদের দেশে্র দিকে তাকালে দেখব গুজরাটের আইপি এস অফিসার, সঞ্জয় বাট ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করার কারণে আজ কারবন্দী। ডাঃ মহম্মদ কাফিল উত্তরপ্রদেশের শিশুমৃত্যুর কারণ হিসাবে অক্সিজেন সিলিণ্ডার নিয়ে মুখ খোলায় আজ কারাবন্দী।
অতীতে আমরা আমাদের আইন ব্যবস্থার উপর খানিকটা ভরসা রাখতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে নানা ঘটনায় (অযোধ্যা কাণ্ডই হোক বা পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি সরকারের বৈমাতৃসুলভ আচরণই হোক) সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিদের রায়দানকে কেন্দ্র করে সরকারের প্রতি তাঁদের নিরেপক্ষতাকে প্রশ্নচিহ্নে আনতে বাধ্য করেছে। আশা করা যেতেই পারে আইন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার প্রশ্নে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এক বিস্তর ফারাক আছে।
নিরপেক্ষতার প্রশ্নে একই ফারাক দেখা যায় সংবাদমাধ্যমের প্রচারিত ও প্রকাশিত সংবাদেও। যেখানে সংবাদপত্রের নিরপেক্ষ ভূমিকা কাম্য, সেখানে দেখা যায় চতুর্থ স্তম্ভ প্রকাশ্যে সরকারের স্তুতি করতে তৎপর।
অমর্ত্য সেন তাঁর ‘উন্নয়ণের লক্ষ্য ও পন্থা’ প্রবন্ধে স্বাধীনতা প্রসারের ক্ষেত্রে দুটি পথের ভূমিকা উল্লেখ করেছেন।
১) প্রাথমিক বা গঠনমূলক ভূমিকা
২) মূখ্য বা করণকারক ভূমিকা
মানুষের ইচ্ছামত থাকার স্বাধীনতা বা করণকারক ভূমিকাকে তিনি পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন।
১) রাজনৈতিক স্বাধীনতা
২) অর্থনৈতিক কার্যসিদ্ধির সহায়তা
৩) সামাজিক সুযোগসুবিধা
৪) স্বচ্ছতার আশ্বাস
৫)সংরক্ষণকারী নিরাপত্তা
সুতরাং এ কথা নিশ্চিত, স্বাধীনতার নিরিখে ১৯৪৭ সালের পরে যদিও বিদেশিদের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছি, অর্থনৈতিক ভাবে অথবা জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধিতে উন্নতি লাভ করতে পেরেছি, কিন্তু উপরের পাঁচটি ভাগের নিরীখে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা আজও প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। আমাদের ব্যক্তিগত উন্নয়ণের ক্ষেত্রে তথা দেশের উন্নতির ক্ষেত্রে এই সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
ইণ্টারন্যাশানাল মনিটারি ফাণ্ডের হিসাব অনুযায়ী, অতীতের মহামারী গুলোর ক্ষেত্রে গড়ে ৫ বছর পর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। সুতরাং, সহজেই অনুমেয় করোণার প্রভাবের কারণে এক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক মন্দাসহ আমাদের শর্তসাপেক্ষ জীবনযাপন ৫ বছরের হিসাব ধরেই এগোতে হবে।
সুতরাং শর্তসাপেক্ষ জীবনযাপনের প্রধান শর্ত নিজেকে নিয়ে বাঁচা নয়, সকলকে নিয়ে বাঁচা বা মনের দরজা উন্মুক্ত করে সকলের সাথে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া। ঘরের মধ্যে বন্দী থেকে ফোন বা সোসাল অ্যাপ মারফত চারপাশের মানুষজনের খোঁজ নেওয়া, নিজের সুপ্ত প্রতিভার সাথে কসরত করাই হল জীবনে বাঁচার রসদ। এখন অনেক ছোট ছোট গ্রুপ ক্রাউড ফণ্ডিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন বিপর্যয়ের সময়ে দেশ সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। কিন্তু তা চাহিদার ক্ষেত্রে খুব সামান্য হলেও আশাব্যঞ্জক। সকলের পারষ্পরিক মেলবন্ধনে অর্থনৈতিক মন্দা না কাটলেও তার প্রভাব অনেকটাই কমে যাবে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সকল স্তরে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব কিনা? দেশের নাগরিক হিসাবে এই স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের ভূমিকা কতটুকু?
উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট শিক্ষার গুরুত্ব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপরিসীম। আমাদের দেশে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ২০১০ সালে ৬ থেকে ১০ বছরের বাচ্ছাদের সারা দেশব্যপী সর্বশিক্ষা অভিযান শুরু হয়েছিল। এই অভিযানে বিশ্বব্যাঙ্ক ও ইউনিসেফ এর সহায়তায় কেন্দ্র ৮৫% ও রাজ্য সরকার ১৫% খরচ বহন করত। অভিযানে প্রত্যেকের প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র প্রথমিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, সর্ব ক্ষেত্রে শিক্ষা ও সচেতনতা সমানভাবে দাবী করে। প্রত্যেক ৬ থেকে ১০ বছরের বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষার সাথে নৈতিক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই নৈতিক শিক্ষাই তাকে দেশের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। শিক্ষা শুধুমাত্র স্কুল থেকেই নয়, পারিবারিক শিক্ষাও সমান অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। একথা এখানে পরিশকার করা দরকার, আমরা আমাদের বাচ্ছাদের সবসময় বুদ্ধিমান হতে উৎসাহ দিই, কিন্তু মানবিক হতে তত উৎসাহী করি না। কিন্তু আজকের দিনে আই কিউ এর সাথে ই কিউ সমানভাবে দরকারী। শিশু যদি প্রতিনিয়ত বাড়িতে দেখে তার বাবা মায়ের উপর অত্যাচার করছে বা অসম্মান করছে তবে সেই শিশু ছেলে হলে ভবিষ্যতে দেশের নাগরিক হয়ে নারীদের হীনমন্য চোখেই দেখবে এবং শিশু যদি মেয়ে হয় তবে ভবিষ্যতে এই প্রত্যাশা নিয়েই বড় হবে যে নারী জীবনে অত্যাচার, হীনমন্যতাই কাম্য।
আমাদের দেশ যখন ব্রিটিশদের অধীন ছিল, অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও শিক্ষার গুণে আমরা যে সকল আদর্শবাদী নেতৃবর্গ পেয়েছিলাম আজ তার অভাব বর্তমান নেতৃবর্গের মধ্যে ভাল অনুভূত হয়। অতীতের নেতাদের মধ্যে পারষ্পরিক মতপার্থক্য থাকলেও তাঁরা লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। আর এখনকার নেতাদের মতপার্থক্য থাকার সাথে সাথে লক্ষ্য সম্পূর্ণ আলাদা। অবশ্য এখনকার নেতারা যে সবাই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল নয় একথা বললে মিথ্যা বলা হবে। তাঁরা সকলেই আত্মকেন্দ্রিক, নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। বলা বাহুল্য, তাঁদের সেই লক্ষ্য দেশের বা দেশের মানুষের উন্নয়ণে খুব বেশি সহায়ক নয়।
উপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, আজকের দিনে দেশ যত এগোচ্ছে, ভারতের পরিচিতি বিশ্বের দরবারে যত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দেশের প্রয়োজনে বিচক্ষণ, কর্মঠ, সংবেদনশীল, সুশিক্ষিত, উদ্যমী নেতার ভূমিকা তত বেশিভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই ধরণের গুণ সম্পন্ন নেতার অভাব আজকের দিনে বেশি। এর কারণ আমরা। আমাদের দেশে উদ্যমী, বোধবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিভার অভাব না থাকলেও আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে শুধুমাত্র ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে বাধ্য করি। দেশপ্রেম বা দেশ সেবার কাজে তাদেরকে সেভাবে উৎসাহিত করি না। নিজেদের ক্ষেত্রেও আমরা ‘সাতে-পাঁচে থাকতে’ অস্বচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমাদের এই হাল ছাড়া মনোভাাবও আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হওয়ার অন্যতম কারণ।
ব্যক্তিগত উন্নয়ণ তথা দেশকে উন্নতির পথে আনতে গেলে আমাদেরকেই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা নিতে হবে। পারষ্পরিক দূরত্ব ত্যাগ করে দেশের কাজে নিজেদেরকে সামিল করতে হবে। সংবাদ পরিবেশনে, প্রশাসনিক কাজে প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করতে হবে এবং ভুল সংবাদ পরিবেশনে অথবা প্রশাসনিক কাজে দূর্নীতি দেখলে প্রতিবাদ মুখর হতে হবে। এইভাবেই মানুষের অনুসন্ধিৎসু ভূমিকা প্রত্যেককে বাধ্য করবে গুণমান সম্পন্ন কাজ করতে। দেশের প্রতি প্রতিটি মানুষ দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপানে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর অন্ধকার। পরমাণু বোমা নিক্ষেপিত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ক্ষেত্রে জাপান পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। আজ এশিয়া মহাদেশের মধ্যেই নয়, সকল উন্নতশীল দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক দেশ হিসাবে জাপানের স্থান তৃতীয়। এর প্রধান কারণ জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সুসংহত সামাজিক ব্যবস্থা।
আমাদের দেশে কিছু বছর আগেও তামিলের সমস্ত মানুষ এক জোট হয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষা করে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জাল্লিকাট্টু প্রথাকে রদ হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। নির্ভয়া কাণ্ডে মানুষের সমবেত ক্রোধ রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল আইনে বদল আনতে আর দোষীকে শাস্তি দিতে। আবার আজকের দিনে করোণার আবহে সাধারণ মানুষের সমবেত প্রতিবাদের চাপে বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান তাদের বেতন কমাতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং আমরা দেশের নাগরিকই পারি আমাদের দেশের ভবিষ্যতকে সুগঠিত করতে। সব কিছুই নির্ভরশীল আমাদের হাতে।
তথ্যপঞ্জী
ইউটিউব
উইকিপিডিয়া
https://en.wikipedia.org/wiki/Bengal_famine_of_1943
https://en.wikipedia.org/wiki/Sarva_Shiksha_Abhiyan
গুরুচণ্ডালী
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17576
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17591
অন্যান্য
https://blogs.imf.org/2020/05/11/how-pandemics-leave-the-poor-even-farther-behind/
Interview of S. Irudaya RAjan, Proff: of Centre for Deve;lopment Studies – Times of India, 1st June 2020.
‘উন্নয়ণের লক্ষ্য ও পন্থা’- অমর্ত্য সেন।
https://msme.gov.in/sites/default/files/MSME-AR-2017-18-Eng.pdf
https://msme.gov.in/sites/default/files/Annualrprt.pdf
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6506569/
প্রথম পর্ব- https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=17796