পরশুরাম সেই কোনকালে লিখে গেছিলেন বালখিল্যদের গল্প, তারপর থেকে কতবছর কেটে গেল, ফেটে গেল, চটকে ছেঁচড়ে গেল কত বা কিন্তু তার প্রাসঙ্গিকতা এখন ভাস্বরতর, মতান্তরে আরো ভয়ংকর।
এইবছর ইউনিপেপ (ইউনিসেফ এর মতোই সংস্থা, এরা পীড়িত বাবা মায়ের কল্যাণ করে থাকেন, বা চেষ্টা করেন) এর সাধারণ সম্মেলনে বিশ্বের ৭০৪২ টা দেশের সবকটা থেকেই কোটি কোটি বাবা মায়েরা জড়ো হয়ে এক সপ্তাহব্যাপী কাঁদুনি গাইলেন, যার মূলসুর মোটামুটি এক- নিত্যনতুন গজিয়ে ওঠা শিশুক্লেশ নিবারণী আইন তাদের ধনেপ্রাণে মেরে পথে বসিয়ে ছেড়েছে।
সেই কোনকালে ২০১১ সালে নরওয়েতে ঘটা ঘটনাটা অনবরত টুকরো হতে থাকা সারা পৃথিবীকে যে এভাবে এক করে দেবে কেউই তা ভাবতে পারেন নি। তেইশ শতকের সেই প্রথম শিশুবিপ্লবের পর থেকেই বিশেষ কানুনের বলে নানা ভাষা নানা মত ওয়ালা সারা বিশ্বে শিশু সংক্রান্ত আইন তার ধারা উপধারা অবধি এক হয়ে গেল। আর সেই নিয়ম কানুন অনবরত আরও বেশি শিশুবান্ধব করে তোলা হচ্ছে দিন কে দিন। এখন সবকটা দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা বিরাট অংশ পরিচালনা করেন দশ বছরের অনুর্ধরা। আর সেই ক্রমবর্ধমান শিশু সংবিধান এর প্রথম ধারাই বলছে এই বইয়ের কোনো ধারাই লোপ করা যাবে না - শুধু বাড়িয়ে নেওয়া যাবে।
আর এখান থেকেই যত সমস্যার সুত্রপাত।
এই বাবা মায়েরাই যখন শিশু ছিলেন তারা কিন্তু অন্য কথা বলতেন - কিন্তু আঠেরো বছর হতেই তাদের ভোটাধিকার শেষ হয়ে যেতেই তারা আছড়ে পড়লেন বাস্তব সমুদ্রে - শুরু হল পড়াশোনা আর তার ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে পেট চালানো। আঠেরো বছর হয়ে গেলে রাষ্ট্র আর তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে না যে।
সেই কুড়ি-একুশ শতক থেকেই বাবা মায়েরা বুঝতে পারছিলেন কীভাবে বাড়ির শিশুটি প্রভাবিত করে তাদের জীবনযাত্রা। ব্যবসায়িকরাও বুঝতে শুরু করেছিলেন সংসারের কেনাকাটায় শিশুর পছন্দ গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। বিজ্ঞাপনের ভাষা বদলে যাচ্ছিল দ্রুত।
সামাজিক মেলামেশায় বাবার সামান্য বেশি পানাসক্তি শিশুকে বিচলিত করেছিল বলে আদালত অবধি তার জের টানা হচ্ছিল একুশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই। এখন তো বাপ মায়েরা বেশ ভয়ে ভয়ে থাকেন - তাদের কাজের জায়গায় বা তাদের সামাজিক পরিমন্ডলে এমনকি রাস্তায় একলা হাঁটার সময়েও এমন কিছু করার জো নেই যাতে বাড়ির শিশুটির খারাপ লাগতে পারে। বেশ কিছু বাবা মা মেনে নিয়েছেন- যারা মানলেন না তারা এসে বানালেন ইউনিপেপ - যেখানে তারা একটু মনের দুঃখ ভাগ করে নিতে পারেন সমমনস্কদের সঙ্গে।
মান্ধাতার সময়কার শহরগুলির কিছু স্কুলে এখনো বয়স্ক মানুষ মাস্টারমশাইরা ক্লাস নেন। তাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সারা বছরই মোটামুটি পরীক্ষা থাকে তাদের। ক্লাসে একমিনিট দেরি করে এলে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যে সঙ্গে সঙ্গে লাইভ দেখান হয় একটি জনপ্রিয় ফোন চ্যানেলে।
শিশুচালিত বিশ্বের গতিপ্রকৃতি কিন্তু মানুষ নিজেই বেছে নিয়েছিল বাইশ শতকের শেষ অর্ধে। তার আগে অবধি পৃথিবীর কাছে ক্রমবর্ধমান দূষণ ও ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহের কোনো স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না। একটি বাংলা ই-দৈনিক, গুরুচণ্ডা৯র কচিকাঁচারা একবার প্রস্তাব করে ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত নিয়ে পৌনে এক শতাব্দী ধরে চলা বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া হোক ক্রিকেট (এক ধরণের বিরক্তিকর খেলা যা সেই সময়ে জনপ্রিয় ছিল) খেলে। সেই প্রস্তাব সোসাল নেটওয়ার্কিং এর হাত ধরে এই দুই দেশে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলেন এবং সবাইকে অবাক করে দুই দেশ সত্যি সত্যি রাজী হয়ে গিয়েছিল এতে।
অবশ্য অনেকে বলে রাজনীতিকরা দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বাড়িয়ে নিয়ে নিজের দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতেই নাকি এই দাওয়াই নিয়েছিল কিন্তু এর ফলেই আজকের পৃথিবী যে যুদ্ধহীন হয়ে বেঁচে গিয়েছিল তার সন্দেহ নেই।
সেই আন্দোলনের জয় আস্তে আস্তে পৃথিবী থেকে সব রকমের সম্মুখ ও ছায়াযুদ্ধ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে - তার বদলে যেকোনো রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামাজিক, পররাষ্ট্রঘটিত এমনকি আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান ও খেলার মাঠেই হয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক এই জায়গাটা থেকেই শিশুরা দাবি জানায় অভিন্ন শিশু সংবিধানের। দ্বিধাদ্বন্দ্বে দীর্ণ পৃথিবী সেই প্রথমবার একজোট হল যখন সারা বিশ্বের শিশুরা মিলে গিয়েছিল আর বলাই বাহুল্য সেই মত সর্বজনগ্রাহ্য হল শেষ অবধি খেলার মাঠেই - প্রথম শিশুবিপ্লব এভাবেই কায়েম করল সারা বিশ্বব্যাপী অভিন্ন শিশু সংবিধান।
পরিবেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধান এল এই পথেই। শিশুরা গ্রীণহাউস গ্যাস পছন্দ করে না। গাড়ি চালানর লাইসেন্স নেই বলে তাদের যাতায়াত স্বাধীনতা দিল স্কেটবোর্ড। বিশ্বের সবকটা দেশেই স্কেটরোড হল দ্রুতগতিতে। গাড়ি কমে গেল, চাহিদা কমল পেট্রোপণ্যের। সোলার সেলে চার্জড স্কেটগুলো দারুণ দেখতে চলেও চমৎকার।
ইউনিপেপের সেই সম্মেলনের থেকে কথায় কথায় অন্য দিকে চলে যাচ্ছি। তা, সেই ইউনিপেপের সভায় "কী করা উচিত" এই বিভাগে কেউই ঠিক বলতে পারছেন না। যতই গোপন করার চেষ্টা হোক না কেন আজকের শিশুরা এই সভার সবকিছুই জেনে যাবেন এটা সেই সভায় যোগ দিতে আসা মানুষেরা জানে। নিজেদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলে যদি তাদের নিজেদের দেশের শিশুদের সহানুভূতি পেতে পারে ভেবে সবাই এই রাস্তাই নিল।
চরমপন্থীরা ফিসফিস করে বললেন অনেক হয়েছে এবার বলপ্রয়োগ করেই নিজেদের অধিকার কেড়ে নিতে হবে - কিন্তু তারা সংখ্যায় এত অপ্রতুল সেই দাবী উঠতে না উঠতেই মিইয়ে গেল। নরমপন্থীরা বলল সেই এক গান্ধীগিরির কথা। শিশুদের আরো মাথায় তোলো তাহলেই তারা আমাদের সব দাবী মেনে নেবে - এইসব। তারাও দাবড়ানি খেয়ে চটপট চুপ হল।
সম্মেলনের দিন এদিকে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, নানা দেশ থেকে যারা ছুটিছাটা নিয়ে এসেছেন সবাই চিন্তিত - নেটওয়ার্কিং এ সব রকম কথা চালাচালি সম্ভব নয় - এই সম্মেলন থেকে কিছু সমাধানসুত্র বের করতে তারা আশাবাদী ছিলেন। দাবীদাওয়া আদায় করতে খেলার মাঠে নেমে ফের হার স্বীকার করতে তারা আর রাজী নন। শিশুদের সঙ্গে পেরে ওঠা খুবই মুশকিল।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে কথাটা হাওয়ায় ভাসছিল - সেটাকেই ধরে নিলেন বৃদ্ধ মামুকাকু। "ছোট শিশু হওয়ার সাহস, আছে কি একফোঁটা - " রবিঠাকুরের সেই সংশয় থেকে তিনি ভাবনাকে প্রসারিত করতে থাকলেন - কবে কোনকালে লিখেছিলেন সেই অবশ্যপাঠ্য "বিমানবন্দরের নৌকাভাষা"। আজকের সঙ্কটে সেই যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর উত্থানকাহিনী বর্ণণা করতে শুরু করলেন।
মাত্র তিনশ নব্বই বছরের বয়সের সদ্যোজাত বৃদ্ধ তিনি। ত্রিকালদর্শী বলে পরিচিত। শিশুরাও জানেন তাকে, সমীহ করেন তাঁর প্রজ্ঞা। একটু শীর্ণ হয়ে গিয়েছেন আজকাল, সারা মাথায় তিনখানি চুল অবশিষ্ট আছে, সাদা ভুরু তার নেমে এসে মিশে গেছে পাতলা হয়ে আসা ঝোলা গোঁফের শেষ কখানি অবশেষে, সব মিলেমিশে তারপর তারা দাড়িতে মিশে গেছে। সব মিলিয়ে দূর থেকে দেখায় যেন অল্প সাদা মেঘের আড়ালে থাকা রহস্যময় হিমালয়শৃঙ্গের মতো। তিনি চুপ ছিলেন এই কদিন - নিজের হাতের তালুতে বসানো পর্দায় আঁকিবুকি করছিলেন তন্ময় ভাবে।
তিনি বলতে শুরু করতেই আশার সঞ্চর হল যেন দর্শকমহলে। "বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে" শীর্ষক আলোচনায় দেখালেন সঙ্কটের স্বরূপ। সেই ধারণা প্রসারিত করে দিল এক নতুন দিগন্ত যখন প্রাচীন কবিতা থেকে পেলেন তার শক্তি-
"আসলে কেউ বড় হয় না বড়র মতো দেখায়-
আসলে আর নকলে তাকে বড়র মতো দেখায়"
দেখালেন এই সঙ্কট শুধু বড়দের সঙ্কট - শিশু যেমন একদিন বড় হবে বলে প্রকৃতি নির্ধারিত থাকে তবে বড়রা কেন চেষ্টা করলে শিশু হতে পারেন না। যে চিন্তাভাবনায় যুদ্ধহীন পৃথিবীর দেখা পাওয়া গেছে, দুষনহীন পৃথিবীর খোঁজ মিলেছে - যে ভাবনায় আর নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে শিশুর খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে - সেটাই তো পথ।
বড়দের কাছে ফের খুলে গেল চিন্তার আর একটি দিক - সম্মেলনটি থেকেই প্রস্তাব উঠল ইউনিপেপ ভেঙে দেওয়ার কথা।
নতুন করে প্রস্তাব উঠল শিশু সংবিধান এ যোগ করার জন্য একটি নতুন ধারা - "শুধু বয়স নয় মননের শৈশবই প্রকৃত শিশুর পরিচায়ক"।
শুরু হল নতুন বয়স্ক শিক্ষা অভিযান, নতুন মোড়কে। শিশুশিক্ষার দাওয়াই নিতে দলে দলে বড়রা ফের স্কুলে যেতে শুরু করল।
শিশু, দি বস।।
জয় দুনিয়া।
_____________________________________________________________________
ছবি -সোনালি সেনগুপ্ত, ইন্টারনেটের ঋণ স্বীকৃত।
_________________________________________________________________________________________________________________________________
লেখার আইডিয়ার জন্য ঋণ স্বীকার ঃ পট্ট