“আহা মরি কী বাহার”
গুপী-বাঘা থাকলে গুরুর ছোট্টদের সাজানো প্যান্ডেল দেখেটেখে ঠিক মহানন্দে গলা ছেড়ে আবার গেয়ে উঠত এই গানটা ।সত্যি,কী সুন্দর এঁকেছ তোমরা, মা দুগগা যেন সশরীরে নেমে এসে ছুটির মেজাজে আয়েস করে বসেছেন।
তা,পুজো কেমন কাটল তোমাদের? নিশ্চয়ই হাজারো মজায়, ফুর্তিতে আর আনন্দে কাটিয়েছ। আমি তো দিল্লীতে থাকি,আর আমাদের পাড়ায় অনেকদিন ধরে পুজো হয়ে আসছে। কিন্তু এইবার পুজোয় একদম অন্যরকম একটা মজা হল,বলি শোন সেই গল্পটা।
বুঝলে,আমাদের এইখানে দুটো বাঙালীদের ক্লাব আছে,তাদের মধ্যে কখনো দেখবে বেজায় রেষারেষি আবার কখনো গলাগলি ভাব। আমাদের ক্লাবের নাম “পূর্বাচল” ,আর অন্য ক্লাবের নাম হল ”পশ্চিমী”। এই নাম নিয়েই কী কম ঝগড়া হয়েছে! শেষে দুই ক্লাবের বড়রা একসঙ্গে বসে, অ্যাতো সিঙ্গারা,নিমকি,মোমো, পিৎজা ইত্যাদি ধ্বংস করে, এই নাম দুটো ঠিক করলেন। তাতেও অবিশ্যি শান্তি হোলো না,সর্বদা কম্পিটিশন লেগেই আছে। পুজোতে একদল করলো লক্ষণের শক্তিশেল,তো অন্যদল লঙ্কাদহন। এরা ক্লাবের মিটিং-এ চিংড়ীর নূরজাহান পোলাও খাইয়েচে ? অন্যরা ইলিশের শাজাহান বিরিয়ানী।ওরা গতবার পুজোয় "বুনো ওল"ব্যান্ড এনেছিল,যার সব গায়কদের মাথা ন্যাড়া, তারা প্রচণ্ড ঝাঁই ঝাঁই ঝাঁই বাজনা বাজায,গটগট করে একবার ইদিক আর একবার উদিকে যায়, আর মাঝেমধ্যে দুএকলাইন গান গায়!আমরা আনলুম"বাঘা তেঁতুল" ব্যান্ড ,গায়কদের সব মাথাভর্ত্তি ঝাঁকড়া চুল , গম্মগম্ম করে ব্যান্ড আরো কী সব বাজায়, নাচে ,লাফায়, কখনো দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে তেড়ে আসে।গান?গাইল না বল্লেই হয়।সেসব গল্প লিখতে গেলে এতো মোটা বই হয়ে যাবে, আর তোমাদের পাইমাসী ও সোসেনমাসী আমাকে ভীষণ বকবে।
অবিশ্যি এক ক্লাবের মেম্বাররা দলবল নিয়ে অন্য ক্লাবের পুজোতে পাত পেড়ে মহানন্দে খেয়েও যায়।বিজয়া দশমীতে প্রণাম,কোলাকুলি ইত্যাদিরও বেজায় ঘটা।
তা যে কথা বলছিলুম,দেখতে দেখতে এসে গেল ২০১২ সালের পুজো। এবার আমাদের প্যান্ডেলটি হয়েছে ভারী দেখনবাহার,হলুদ,সবুজ,নীল,কমলা,মেরুন নানা রঙে একেবারে ঝলমল করছে,তার ওপর আবার তোমাদের মত বাচ্চারা তাদের আঁকা কত চমৎকার চমৎকার ছবি লাগিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমীর প্যান্ডেলও সুন্দর,তবে কিনা আমাদের মত হয়নি মোটেই।হুঁ হুঁ বাবা,সকলে মহা খুশি।
তবে একটা কথা আছে- আমাদের পুজোটি হয় একটি ইশকুল বাড়ীর মাঠে। মাঠ নষ্ট হবে তাই সেখানে বেশী গভীর গর্ত্ত করে বাঁশ পোঁতার অনুমতি নেই । ফলে মন্ডপ মোটেই শক্ত পোক্ত হয় না। একটু জোরে হাওয়া দিলেই হেলে দোলে,তবে ওদিকে কেউ বিশেষ মন দেয় না।
সপ্তমী,অষ্টমীর পর এসে পড়ল নবমীর সকাল। পুজোর শেষদিন,তাই ঘটাপটা বেশী, বিকেলে হবে ছোটদের মহিষাসুরমর্দিনী নাটক,আর বড়দের নাটক-ভাড়াটে চাই।। একদিকে পুজো হচ্ছে,অন্যদিকে দুর্গা ,লক্ষ্মী,সরস্বতী এমনকি গণেশও দুর্গার দশ হাত লাগিয়ে নাচানাচি করছে। মহিষাসুর কিন্তু একবারও তার গোঁফটি পরে সকলের সামনে আসেনি,নাকি স্টেজে একদম তাক লাগিয়ে দেবে। বড় নাটুকেরা(যাদের কাজকম্ম নেই,ভেবোনা যেন তাদের মধ্যে আমি আছি)ঘুরে ঘুরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পার্ট মুখস্ত করছে।সব মিলে নবমীর সকালটি দিব্যি জমে উঠেছে।
এমন সময় দেখা গেল আকাশ মেঘলা হয়ে আসছে।
নবমী পুজোর পর যজ্ঞ হয়,পুরোহিত মন্ত্র পড়ে অগ্নিতে ১০৮টি বেলপাতা দেন। সেদিন একটু দেরী হয়েছে,হোম শুরু হতে হতে প্রায় দেড়্টা। বেলপাতা দেয়া শুরু হল আর চাদ্দিক অন্ধকার হতে লাগল।পুরুতমশাই প্রচন্ড স্পীডে মন্ত্র পড়তে ও আগুনে বেলপাতা দিতে লাগলেন। বল্লে বিশ্বেস করবে না, ১০৮ নং বেলপাতাটি আগুনে পড়ল আর মনে হল চাদ্দিক থেকে যেন একশোটা মোষ ধেয়ে আসছে।তখনো পুরুতমশাই যজ্ঞের আগুন নেভাতে ইতস্তত কচ্ছেন,(আরতি হয় নি কিনা)আমাদের সমবেত চিৎকারে তিনি আগুন নেভাতে না নেভাতে মনে হল ঝড়ের চোটে হুড় মুড় করে অদ্ধেক প্যান্ডেল নেমে আসবে।
তখন যে কী ভয়ানক চ্যাঁচামেচি,হুড়োহুড়ি,ঠেলাঠেলি ইত্যাদি হতে লাগল সে আর বলা যায় না।কেউ চিৎকার করছে বিজলীর লাইন কেটে দাও,কেউ টেন্টওলাদের ফোন করার চেষ্টা কচ্ছে,কেউ বাচ্চাকে ডাকছে,কেউ ঐ দুর্যোগেও ভোগের থালা সামলাচ্ছে। কয়েকজন দৌড়ে গেল প্রতিমার কাছে। রোগারা মোটাদের , মোটারা রোগাদের ঘাড়ে পড়তে পড়তে ও সবাই সবাইকে বকতে বকতে বহুকষ্টে সকলে মিলে ঠেলেঠুলে ইশকুল বাড়ীতে ঢুকে পড়া গেল।
আর তখনই এল আসল ঝড়, হাওয়ার জোর এত ভয়ংকর, যে ভাবা যায় না। হঠাৎ হো-ও-ও-ও করে ভীষণ এক চিৎকার শুনে দেখি-
প্যান্ডেল,আমাদের সাধের প্যান্ডেল পতপত করে ঝড়ের সাথে আকাশে উড়ে যাচ্ছে, টেন্ট কোম্পানীর টিঙটিঙে ছেলে দুটো চিত্পাত হয়ে পড়ে আছে।
হায়,হায়,ঐ প্যান্ডেলেই যে বাচ্চাদের আঁকা সুন্দর সুন্দর ছবি সাঁটা রয়েছে!
হায়,হায়,হায়,ঐ প্যান্ডেলেই যে সন্ধেবেলা নাটক,ধুনুচি নাচ,ডিনার পার্টি,কাল বিজয়ার অনুষ্ঠান!!!
এত চিৎকার,হৈচৈ কোন কিচ্ছুতে কান না দিয়ে আমাদের প্যান্ডেল উড়ে চলে গেলো আর শিলাবৃষ্টি নামল । বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাবতীয় পূজার জিনিস ছাদের তলায় সরানো হল।একটু বৃষ্টি কমে এলে সকলে খানিক ধাতস্থ হল,ঠাকুরের মন্ডপের ওপর ত্রিপল বিছানো হল।
আশ্চর্য-এত কান্ডেও প্রতিমার কোন ক্ষতি হয় নি,এমনকি কলাবৌএর গামছাটি পজ্জ্জন্ত শুকনো।
এদিকে আবিষ্কার হল,প্রচন্ড বৃষ্টিতে স্টেজ নষ্ট হয়ে গেছে ও ঝড় শুরু হওয়া মাত্র ক্যাটারারের লোকেরা যে যেদিকে পারে দৌড়েছিল,সমস্ত রান্নাও জল পড়ে খারাপ হয়ে গেছে।
এইবারে যা হতে লাগল তা আগের বারের চেয়েও ভীষণ-
সব ছোটোরা চ্যাঁচাতে লাগল,ঐ প্যান্ডেলই তাদের চাই।
ঠাম্মা দিম্মারা মহা গোল করতে লাগলেন,এতগুলো লোক খাবে কী?
দুর্গা,লক্ষ্মী ইত্যাদিরা ভীষণ কান্না জুড়ে দিল, স্টেজ নেই,তাদের নাটকের কি হবে?
পুরুত মশাই বলতে লাগলেন আরতি কখন হবে?
যে কোন অদ্ভুত ঘটনা ঘটলেই বড়রা যা করে, সবাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ফোনে কথা বলতে লাগল।
আমরা সাত আটজন সেই ছেলে দুটোকে জলটল দিয়ে খাড়া করলুম, তারপর খুব রাগমাগ করতে লাগলুম,”কেমন প্যান্ডেল তোমাদের বাছা,যে একটু হাওয়া দিলেই উড়ে যায়?”ফ্যাকাশে মুখে তারা আবার মুচ্ছো যাওয়ার চেষ্টা করছে,হেনকালে একটি ফোন এল-
“পশ্চিমী ক্লাবের অদিতির ফোন,নিশ্চয়ই মজা দেখতে ফোন করেচে,হাতি পাঁকে পড়লে –“এইসব বলতে বলতে অনুদি ফোনটি ধরলেন-“হ্যাঁ,বলো,হ্যাঁ ঝড় হয়েচে, সে কি তুমি বলবে তবে জানব,অ্যাঁ,অ্যাঁ,সে কি,সত্যি বলচ।তোমাদের পাশের বাড়ীর ছাদে আমাদের প্যান্ডেল গিয়ে পড়েচে,তাই নাকি?ক্ষী-ই আশ্চয্যি, আচ্ছা,আচ্ছা,আমরা একখুনি আসচি।“
এই দ্যাখো ফটো,বিষ্টি থেমে ঝকঝকে রোদ উঠে গেছে, যেন ঝড়বৃষ্টি নামে কিছু ছিলই না কখনো। আমরা সবাই ভিজে চুপ্পুস,ভাল ভাল শাড়ী টাড়ী সব ভিজে ন্যাতা,বেজায় খিদেও পেয়েছে,কিন্তু সকলের মুখে হাসি ধরছে না,পাঁচটা গাড়ী বোঝাই করে আমরা পশ্চিমীপাড়া থেকে আমাদের প্যান্ডেল আনতে যাচ্ছি।আগে আগে যাচ্ছে টেন্ট কোম্পানীর টেম্পোগাড়ী,অন্যদের মাঝে ওতে বসে আছে সেই ছেলে দুটো,বিকেলের মধ্যে ওরা আবার প্যান্ডেল বানিয়ে দেবে আর নতুন স্টেজও বেঁধে দেবে।সন্ধেবেলা পশ্চিমী ক্লাবের সক্কলের নাটক দেখা আর বিরিয়ানী খাওয়ার নেমন্তন্ন।
“দ্যাখো রে নয়ন মেলে,জগতের বাহার”- গুপীবাঘা থাকলে গাইত।
_______________________________________________________________________________________________
ছবি-শাওন, মুনিয়া, বাবিন, সোনালি
ইন্টারনেটের ঋণ স্বীকৃত।
******************************************************************************************************