কবন্ধ শয়তানের কাহিনী
ঢং করিয়া একটা বাজিল. পার্ক স্ট্রিট এর একটি নিশিনিলয় হইতে এক সুদীর্ঘ ছায়া বাহির হইল. সেই ছায়া র এক হস্তে একটি সবুজ শিশি ও অন্য হস্তে প্রলয়্নাথ বিশী র সদ্য কর্তিত মুন্ড. কিন্তু দয়াময় ভগবান এর অপূর্ব লীলাখেলায় সেই কর্তিত মুন্ড হইতে উষ্ণ শোনিতের পরিবর্তে "টপ টপ" শব্দে ঝরিতেছে প্রগাড় পীতবর্ণ হিসি. গোয়েন্দা কৃষ্ণকমল একটি সুউচ্চ গৃহের বাতায়ন হইতে সেই চলন্ত ছায়ার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখিতেছিলেন. তাঁহার সুদৃশ্য মুখমন্ডল টি ঋষি কাপুর এর মুখোশে ঢাকা. চলন্ত ছায়া রাস্তা পার হইয়া একটি পুরাতন কালো রং এর মোটরগাড়ি র দিকে ধাবিত হইল. উত্তেজিত কৃষ্ণকমল পকেট হইতে একটি মিশি র কৌটা বাহির করিলেন. দেখিতে উহা নিরীহ একটি ইস্পাত এর কৌটা হইলে ও উহাতে কৃষ্ণকমল এর স্নাইপার খানি ভাঁজ করিয়া রাখা আছে. কৌটা খানি উপুর করিয়া কৃষ্ণকমল হাত এর উপর ধরিতে স্নাইপার খানি পাতলা রুমাল এর ন্যায় বাহির হইয়া আসিল. তিনি বাম হস্তে উহার অগ্রভাগ ধরিয়া একখানি প্রবল ঝটকা দিলেন...ততক্ষনাত পুরা স্নাইপার খানি কৃষ্ণকমল এর হাতে র উপর খুলিয়া আসিল.
চলন্ত ছায়া গাড়ি র দরজা খুলিয়া হিসি মাখা মুন্ড টি পেছনের সিট এ রাখিয়া দিল. তাহার পর পকেট হইতে একখানি রুমাল বাহির করিল. তাহার পর সেই ছায়া নিজের মুন্ড টি দুহাতে ধরিয়া অনায়াসে ঘুরাইতে ঘুরাইতে খুলিয়া ফেলিল. ঠিক যেমন কেহ বয়াম এর ঢাকনা খুলিয়া থাকে. এই পৈশাচিক দৃশ্য দেখিয়া কৃষ্ণকমল এর পশ্চাতে দন্ডায়মান প্রতুল এর মস্তকের প্রতিটা চুল খাড়া হইয়া উঠিল. কৃষ্ণকমল তাহা অনুধাবন করিয়া ইশারায় প্রতুল কে চুপ করিয়া থাকিতে বলিলেন. চলন্ত ছায়া নিজ মুন্ড টি অনায়াসে রুমালে বাঁধিল, এবং সামনের সিট এ যত্ন করিয়া রাখিল. কার্যত চলন্ত ছায়া এই সময় অন্ধ. এই সুযোগ এর সদ্ব্যবহার করিবে ভাবিয়া কৃষ্ণকমল তাঁহার স্নাইপার টি তাক করিলেন. প্রচন্ড "ঢিসুম" শব্দে রাত্রি র নিরবতা কে বিঘ্ন করিয়া স্নাইপার গর্জিয়া উঠিল.
কিন্তু একি? কৃষ্ণকমল নিজ চক্ষু কে বিশ্বাস করিতে পারিল না. চলন্ত ছায়া ততক্ষনাত ঘুরিয়া অনায়াসে বন্দুকের গুলি টি দুটি আঙ্গুলে ধরিয়া ফেলিয়াছে. মুন্ডহীন, স্কন্ধকাটা সেই অপার্থিব জীব টি কোন দৈবশক্তি বলে বন্দুকের গুলি দেখিয়া ফেলিয়াছে. প্রতুলের হাত হইতে দূরবীন খানি লইয়া কৃষ্ণকমল ছায়া টি কে পর্য্যবেক্ষণ করিলেন. তখনি তাঁহার চোখে পরিল সেই অমানুষিক দৃশ্য টি. গাড়ি র পিছনের সিট এ রাখা বিশী র মুন্ড হইতে দুইখানি চক্ষু উত্পাটিত করা হইয়াছে. পিশাচসিধ্ধ সেই ছায়া কোনো শয়তান এর আশির্বাদে দুইখানি চক্ষু আপন অন্ডকোষে প্রতিস্থাপিত করিয়াছে. সেই ছায়ার নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ উলঙ্গ এবং চক্ষু দুইখানি অন্ধকারে ব্যাঘ্রের চক্ষের ন্যায় জ্বলিতেছে. পার্ক স্ট্রিট এর সেই ভয়ানক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ছায়া র নিম্নাঙ্গের দিকে দৃষ্টিপাত করে কৃষ্ণকমল শিহরিয়া উঠিল. ঠিক যেন একটি লম্বা নাসিকার দুই পার্শ্বে দুটি জ্বলন্ত হলুদ চক্ষু.... ঠিক যেন নরকের পুতিগন্ধময় অন্ধকার ভেদ করিয়া উঠে আসা শয়তান এর মুখমন্ডলের প্রতিফলন।
গোয়েন্দা কৃষ্ণকমল শিহরিয়া দ্বিতীয়বার স্নাইপার তাক করিলেন কবন্ধ শয়তান এর দিকে. কিন্তু এইবারে সেই ছায়া আরো চঞ্চল, আরো সজাগ হইয়া উঠিয়াছে. উপরন্তু প্রথম বুলেট টি র আক্রমনে চকিত শয়তান টি মুহুর্মুহু অন্ডকোষ দুলাইয়া শত্রু র সন্ধান করিতেছে. নিশিথের সেই সূচিভেদ্য অন্ধকারে দোদুল্যমান অন্ডকোষ এর উপর দুটি পীতবর্নীয় চক্ষু ঝড়ের নৌকাবক্ষে দুটি অপার্থিব লন্ঠনের ন্যায় কাঁপিতেছে. গোয়েন্দা কৃষ্ণকমল ঘটনা র গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া দ্বিতীয়বার "ফায়ার" করিলেন না. বন্দুকের গুলিতে এই শয়তান মরিবার নহে. ইহাকে বোধ করিবার অন্য উপায় খুঁজিতে হইবে.
ইতোমধ্যে সেই চলন্ত ছায়া মোটর গাড়ি টি তে উঠিয়া বসিয়াছে. কিন্তু কবন্ধ সেই ছায়ার দৃষ্টিশক্তি কেবলমাত্র অন্ডকোষে আবদ্ধ. কাজেই চালকের সিট এ ছায়াটি শীর্ষাসন এর ভঙ্গিতে বসিয়াছে ও দুই পা এর দ্বারা স্টিয়ারিং চালনা করিতেছে. এই দৃশ্য দেখিয়া প্রতুলের মূর্ছা যাইবার অবস্থা. পার্ক স্ট্রিট এর সেই রাত্রে অন্ধকার বৃখ্শের ছায়ার মধ্য দিয়ে এইরূপ চালক কোনো গাড়ি চালাইয়া গেলে অনেক পথিকের ই মূর্ছা কেন, হৃদস্পন্দন বন্ধ হইবার উপক্রম হয়. কৃষ্ণকমল অপসৃয়মান গাড়িটি র ছায়া র প্রতি চাহিয়া একটিমাত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন.
প্রতিপদ গুহের সন্ধানে যে সকল তান্ত্রিক ও দৈবশক্তি র আরাধক রা ছিলেন, সকলের সান্নিধ্যে ই আসিয়াছেন কৃষ্ণকমল. কিন্তু এইবারে তাহারা ও হতাশ করিলেন. কবন্ধ শয়তান কে মরিবার উপায় তো দূর অস্ত, কেহ তাহার বর্ণনা শুনিয়া ই মূর্ছ যাইলেন. কৃষ্ণকমল বুঝিলেন প্রতিপদ গুহ দোর্দন্ডপ্রতাপ বড়বাবু হইতে পারেন, কিন্তু কবন্ধ শয়তান এর নাম শুনিয়া ই তাঁহার মনে ভয় এর সঞ্চার হইয়াছে . অতঃপর ভরসা একমাত্র উপস্থিত বুদ্ধি এবং প্রচন্ড সাহস. এই সাহসে ভর করিয়াই কৃষ্ণ এবং প্রতুল শহরের বাহিরে অবস্থিত লোমাগ্নি মহাশ্মশান এর দিকে যাত্রা করিলেন.
লোমাগ্নি মহাশ্মশান অতীব ভয়াবহ স্থান. বহুকাল পূর্বে এই স্থান অতীতের অত্যাচারী রাজা লোমদেব এর বধ্যভূমি ছিল. কালের বিবর্তনে উহা এখন মহাশ্মশান, কিন্তু সেই ভয়াবহতা আজ ও বিদ্যমান. অমাবস্যা র নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সুবিশাল মহীরুহ হইতে অতীতের আর্তনাদ ঝড়িয়া পড়িতেছে. যাহারা মরিয়া ও মরে নাই, সেই সব অমানুষিক প্রেতাত্মাদিগের চারণভূমি এই স্থান. কৃষ্ণ এবং প্রতুল সভয়ে দেখিল কিছু বৃক্ষের উপর মানুষের অর্ধ-ভক্ষিত দেহাবশেষ ঝুলিতেছে, কভু বা চলিতে চলিতে পায়ের নিচে পড়িতেছে মানব উদর হইতে কর্তিত অন্ত্র-যকৃত-প্লীহা. চারিদিকে ভয়ানক পূতিগন্ধ. উভয়ে অনুধাবন করিল নরক শব্দের আসল অর্থ.
কিছুদুর অগ্রসর হইবার পর সহসা প্রতুল লক্ষ্য করিল অন্ধকারে দুটি হলুদ চক্ষু তাহার প্রতি নির্নিমেষে তাকাইয়া আছে. কোনরকম শব্দ করিবার আগে ই কবন্ধ শয়তান তীব্র বেগে প্রতুলের দিকে ধাবিত হইল এবং প্রতুল এর মস্তক টি দুই বজ্রের মত কঠিন ও বলশালী হস্তে ধরিয়া মোচড়াইতে লাগিল. প্রবল যন্ত্রণা ও বিস্ময়ে প্রতুল চিত্কার করিয়া উঠিল "কৃষ্ণ, বাঁচাও.....". কৃষ্ণ প্রতুল কে ছাড়াইয়া কিছুখানি অগ্রসর হইয়াছিল. সহসা এই চিত্কার শুনিয়া সে ঘুরিয়া দাঁড়াইল. পশ্চাতে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখিয়া সে মুহুর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমুড় হইয়া গেল. পরক্ষণে ই প্রতুল জিহ্ভা র তলা হইতে লুক্কায়িত "ব্যারেটা" খানি বাহির করিয়া উপর্যুপরি তিনটি ফায়ার করিল কবন্ধের শরীর লক্ষ্য করিয়া. কিন্তু হা হতোস্মি, কবন্ধের শরীরে গুলি র কোনো প্রভাব পড়িল না. সে দুই হাতে প্রতুল এর মস্তক ঘুরাইয়া প্রায় ধর হইতে আলাদা করিয়া ফেলিবার উপক্রম করিল . হঠাত ই কৃষ্ণের খেয়াল হইল কবন্ধ শয়তান মরিবার পূর্বে বাঙ্গালী ছিলেন. বাঙ্গালী রা মরিলে ও তাহাদের সহজাত প্রবৃত্তি ও স্বভাব নষ্ট হয় না. অতএব সেই চরম মুহুর্তে আপন উপস্থিত বুদ্ধি র উপর নির্ভর করিয়া কৃষ্ণ শ্মশান এর মাটি হইতে এক খানি বংশদন্ড উঠাইলেন ও সবেগে উলঙ্গ ছায়াটি র পাযুদেশে ঢুকাইয়া দিলেন. যেমন করিয়া জোঁক এর মুখে লবন পড়িলে তাহা শিকার কে ছাড়িয়া দেয়, ঠিক তেমনি একটি গগনভেদী হাহাকার করিয়া সেই চলন্ত ছায়াটি প্রতুল কে ছাড়িয়া মাটি তে লুটাইয়া পড়িল. কৃষ্ণ বংশ দন্ড টি ধরিয়া আর একটু শক্তি র সহিত মোচড়াইয়া শয়তান এর পাযুদেশে প্রথিত করিল. একটু গোঙানির ন্যায় আওয়াজ করিয়া শয়্তানটি উপুর হইয়া পড়িল. তাহার পর কৃষ্ণ ও প্রতুল এর চক্ষের সম্মুখে কবন্ধ শয়তান এর দেহটি মাটি র ন্যায় ঝুরঝুরে হইয়া ঝড়িয়া পড়িল.
কৃষ্ণ প্রতুল এর নিকট আসিয়া উহাকে মাটি হইতে তুলিয়া ধরিল. শয়তান কে মরিতে দেখিয়া প্রতুল একটু বল পাইয়াছে. সে কৃষ্ণ কে শুধাইল, "ভাই কৃষ্ণ, এই বংশ-দান কি করিয়া আবিষ্কার করিলে?" কৃষ্ণ স্মিত হাসিয়া বলিল, "প্রতুল, বন্ধু আমার, শিশির ঝরিলে ঝরে ঘাসে, আর বাঙ্গালী মরিলে মরে বাঁশে". এই কথাটি র সমর্থনে ই যেন মহাশ্মশান এর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া শৃগাল ডাকিয়ে উঠিল, "হুক্কা হুয়া". কৃষ্ণ ও প্রতুল হাত ধরাধরি করিয়া শহরের পথে প্রস্থান করিতে লাগিল।
মায়াবিনী গুম্ফবতীর বিভীষিকা
বাহিরে টিপ টিপ করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে, বিদ্যুতের তীব্র আলোকে চারিদিক দিন এর মত উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছে. এই বিদ্যুচ্চমক এর আলোতে কৃষ্ণকমল একখানি সুদীর্ঘ নারীমুর্তিকে বাগানবাড়ির সদর দরজা দিয়া অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে দেখিল. সেই নারীমূর্তি সাড়ে ছয় ফিট দীর্ঘ এবং অত্যন্ত শীর্ণ. তাহার হস্তের শিরাগুলি পাকাইয়া মাস তিনেকের পুরাতন, বাসী চাউমিন এর ন্যায় হইয়া গিয়াছে. মস্তকে উস্কখুস্ক কেশ লাসিথ মালিঙ্গা র কেশাপেক্ষা ও জীর্ণ দশা পরিগ্রহণ করিয়াছে. তাহার চক্ষু দুইখানি ভাটার ন্যায় জ্বলিতেছে, দূর হইতে দেখিলে কেহ উহাকে স্টেট বাস এর হেড লাইট বলিয়া ভ্রম করিবেন. সেই নারীর মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কৃষ্ণকমল এর অন্তরাত্মা শিহরিত হইয়া উঠিল. বিদ্যুতের তীক্ষ্ণ আলোকে কৃষ্ণ লক্ষ্য করিল সেই নারীর কান্চন্নগরের ছুরিকা সদৃশ সুবিশাল নাসিকার নিচে প্রলয়ের মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলিতেছে একখানি কৃষ্ণবর্ণের পুরুষ্টু গুম্ফ. সেই গুম্ফখানি কপিল দেব নিখান্জের গুম্ফের ন্যায় সুন্দর এবং বিলাসবহুল. এই একখানি বৈশিষ্ট্য সেই গুম্ফবতী র মুখমন্ডলকে নারকীয় রূপ দিয়াছে. সেই নারীর এক হস্তে একটি বায়স পুচ্ছ ও অপর হস্তে শ্রী বেনীমাধব শীল এর পূর্ণ পঞ্জিকা শোভা পাইতেছে.
এই ভয়াবহ দৃশ্য অবলোকন করিয়া প্রতুল এর দন্তে দন্তে ঠোকাঠুকি লাগিয়া কথ্থক নৃত্যের ঘুঙ্গুর এর আওয়াজ বাহির হইতেছিল. সহসা কৃষ্ণকমল তাহার নখের অগ্রভাগ হইতে একখানি সূচিকা র ন্যায় সরু দন্ড বাহির করিয়া তাহার পশ্চাতে ফু দিতে লাগিলেন. অনতিবিলম্বে সেই সূচিকা একখানি তিন হাত তরবারিতে রুপান্তরিত হইল. সেই তরবারিখানি হস্তে শক্ত করিয়া ধরিয়া কৃষ্ণ বাগানবাড়ির দিকে অগ্রসর হইল. প্রতুল অগত্যা তাহাকে অনুসরণ করিল.
বাগানবাড়ি র সদর দরজা দিয়া ততক্ষণে সেই ভয়াবহ গুম্ফবতী ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে. অভ্যন্তরে কৃষ্ণকায় ষন্ডের অন্ডকোষের ন্যায় দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকার. এই অন্ধকার কোষ্ঠকাঠিন্যের বিষ্ঠার ন্যায় যেন কঠিন, যেন চাহিলে ই ইহাকে স্পর্শ করিয়া অনুভব করা যায়. কৃষ্ণ সাহসে ভর করিয়া ধীরে ধীরে এই অন্ধকার এর মধ্যে পদার্পণ করিল. পশ্চাতে প্রতুল ও রামনাম জপ করিতে করিতে কৃষ্ণ কে অনুসরণ করিল. কৃষ্ণ আপন নাসিকাছিদ্রের মধ্যে আঙ্গুল প্রবেশ করাইয়া একখানি লুক্কায়িত de -hydrated টর্চ বাহির করিল. বাহিরে বৃষ্টি র জল এর স্পর্শ পাইয়া ছাগবিষ্ঠা সদৃশ সেই de-hydrated টর্চ খানি একটি বিপুল পাঁচ মনি পুলিশের ব্যাটনের রূপ ধারণ করিল. উহার আলোকে সমস্ত বাগানবাড়ির অভ্যন্তর আলোকিত হইয়া উঠিল.
কৃষ্ণ সন্তর্পনে বাগানবাড়ির পশ্চিম কোণে অবস্থান লইলো . প্রতুল ও তাহার সহিত এক ই স্থানে পাংশু মুখে দাঁড়াইয়া থাকিল. প্রতুল এতক্ষণে বুঝিতে পারিয়াছে যে আজ সমূহ বিপদের দিন. একে তো দিবারাত্র মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিতেছে, উপরন্তু গুম্ফবতী কে অনুসরণ করিয়া তাহারা এতদূর আসিয়া পড়িয়াছে. কৃষ্ণ ইতোমধ্যে পশ্চিম কোণের ঘরের বাহিরে চুপ করিয়া কিছু ঠাহর করার চেষ্টা করিতেছে. হঠাত ই ঘরের মধ্য হইতে মন্ত্রের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতে লাগিল. কৃষ্ণ বুঝিলেন যে নারীকন্ঠের এই মন্ত্রোচ্চারণ গুম্ফবতী ভিন্ন অন্য কারো নহে. ধীরে ধীরে সে দরজা ফাঁক করিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করিল. সঙ্গে সঙ্গে সে শিহরিয়া চার পা পিছাইয়া আসিল. ঘরের মধ্যের সে নারকীয় দৃশ্য আর ইহজীবনে কখনো সে ভুলিবে না.
ঘরের মধ্যে একখানি ছোট মন্দিরের মত সিংহাসন, সেই সিংহাসনে অবস্থিত বাবা কোষ্ঠদেব এর ভয়াল ভয়ংকর প্রতিমা. সে প্রতিমা কষ্ঠিপাথরে গড়া, কুচকুচে কৃষ্ণবর্ণের. বাবা কোষ্ঠদেব স্বর্ণ সৌচালয়ে বিষ্ঠাত্যাগ করিবার ভঙ্গিতে উবু হইয়া বসিয়া আছেন. উলঙ্গ সে প্রতিমার এক হস্তে একটি কচুপাতা র বৃন্ত ও ওপর হস্তে একটি মন্ত্র:পুত গাড়ু. নিষ্ঠাভরে বাবা কোষ্ঠদেব এর পাদদেশে বসিয়া আছে বিভীষিকাময় গুম্ফবতী. গুম্ফবতী র অস্থাধরে একটি অপার্থিব নিষ্ঠুর হাসি শোভা পাইতেছে. গুম্ফবতী দুলিয়া দুলিয়া মন্ত্র পড়িতেছে. কৃষ্ণ কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল সেই নারকীয় মন্ত্রাবলী:
জাগ্রত হলেন বাবা কোষ্ঠ দেব আজি-
বিষ্ঠা আরাধনায় এলো গুম্ফবতী সাজি,
গুম্ফের দৈর্ঘ্য প্রস্থ কোষ্ঠদেব কৃপা-
কোষ্ঠদেব দেব-দ্বিজে মহান খলিফা.
যেদিন কাতর ধরা কোষ্ঠদেব শরে-
কোষ্ঠ কাঠিন্যে শয়ে শয়ে লোক মরে.
অত:পর কোষ্ঠদেব সেবা কর সবে-
মম কোষ্ঠ পরিষ্কার-তোমাদের ও হবে.
যেজন শুনিবে না এ মধুর বচন-
এ মুহূর্ত থেকে তার বন্ধ রেচন.
প্রতুল শিহরিয়া ফিসফিসাইয়া কৃষ্ণ কে জিজ্ঞাসা করলো, "কৃষ্ণ, কিছু কর?". কৃষ্ণ সন্তর্পনে দরজা খুলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল.
কৃষ্ণের পদশব্দে সচকিত হইয়া গুম্ফবতী ফিরিয়া তাকাইল. সে বর্ষণমুখর রাত্রি, বজ্রগর্ভ পরিবেশ আর বাগানবাড়ির অন্ধকারে কৃষ্ণের মনে হিল সে যেন নরকের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে. সম্মুখে গুম্ফবতী র দীর্ঘ অমানুষিক চেহারা, কৃষ্ণবর্ণের গুম্ফরাশির মায়াজাল. বিদ্যুচ্চমকের আলোকে সেই মসিকৃষ্ণ গুম্ফজাল আরশির ন্যায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে. আপন ভীত মুখাবেগের প্রতিফলন কৃষ্ণ যেন দেখিতে পাইল সেই উজ্জ্বল গুম্ফরাজির বুকে. ইহার পর যাহা হইল তাহাতে অত্যন্ত সাহসী লোকের ও চক্ষু কপালে উঠিয়া যাইতে বাধ্য.
বাহিরে তীব্র বেগে শীতল বাতাস বহিতেছে, বাগানবাড়ি খানি একটি প্রেতাবিষ্ট গৃহগোধিকা র ন্যায় যেন জবুথবু হইয়া বসিয়া আছে. এই চরম মুহুর্তে হঠাত ই গুম্ফবতী র সুদৃশ্য গুম্ফখানি চক্ষের নিমেষে অক্টোপাস এর শুঁড় এর ন্যায় বর্ধিত হইয়া কৃষ্ণের পানে ধাইয়া আসিল এবং কৃষ্ণ উহাকে এড়াইয়া সরিয়া যাইবার ঠিক পূর্বে সেই গুম্ফ খানি কৃষ্ণের তরবারি চাপিয়া তাহা ছিনিয়া লইল. বজ্রের ন্যায় শক্ত ইস্পাতের তরবারিখানি বাগানবাড়ি র মার্বেল এর মেঝেতে পড়িয়া চুরমার হইয়া ভাঙ্গিয়া গেল. কৃষ্ণ লাফাইয়া সেই ধাবমান গুম্ফপাশ কে পাশ কাটাইয়া একপাশে সরিয়া গেল. কিন্তু বেচারা প্রতুল গুম্ফপাশ হইতে নিস্তার পাইলো না. এক গতিশীল ষ্টিম ইঞ্জিনের ন্যায় সেই গুম্ফজাল প্রতুলের কন্ঠ প্যান্চাইয়া ধরিল. প্রতুল হাহাকার করিয়া পলায়নের চেষ্টা করিল. কিন্তু গুম্ফবতী র গুম্ফের ঝটকায় সেই মহাভযন্কর নাগপাশ ফাঁসির দড়ির ন্যায় প্রতুলের কন্ঠে কাটিয়া বসিতে লাগিল. প্রতুল কোনমতে বলিল: "কৃষ্ণ, আমাকে উদ্ধার কর".
কৃষ্ণ ইতোমধ্যে আপন বগলের নিচে লুক্কায়িত শটগানখানি বাহির করিয়া গুম্ফবতির দিকে তাক করিয়া ধরিয়াছে. সেই নিশ্চুপ রাত্রির নিশ্ছিদ্র বিষন্নতা ভঙ্গ করিয়া শটগান গর্জিয়া উঠিল "ঢিসুম". কিন্তু শটগান এর লৌহবুলেট ও গুম্ফবতির গুম্ফের মায়াজাল ভেদ করিতে পারিল না. রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া গুম্ফবতী অট্টহাস্য করিয়া উঠিল "হা হা হা হা ". সেই কুহকিনী হাস্য শুনিয়া কৃষ্ণের দেহের রক্ত জল হইয়া যাইল.
প্রতুল এর কন্ঠে গুম্ফপাশ এর চাপ ক্রমশ বাড়িয়া উঠিতেছে, প্রতুলের সমস্ত দেহ অবশ হইয়া উঠিল, তাহার গলা দিয়া গোঙানির আওয়াজ বাহির হইতে লাগিল. সেই মুহুর্তে কৃষ্ণ আপন হিপপকেট হইতে বাহির করিয়া আনিলো শ্রী কমল চন্দ্র কর এবং কোং কর্তৃক প্রস্তুত সর্বকেশহরী লোমনাশক স্প্রে. ডান হস্তে সেই স্প্রে ধরিয়া আপন সর্বশক্তি প্রয়োগ করিয়া কৃষ্ণ সেই সর্বকেশহরী লোমনাশক স্প্রে করিয়া দিল গুম্ফবতির নাকের নিচে, গুম্ফপাশের উত্সস্থলে.
ততক্ষনাত সুতীব্র হাহাকার করিয়া গুম্ফবতী বাগানবাড়ির মর্মর মেঝেতে লুটাইয়া পড়িলো. প্রতুলের কন্ঠে গুম্ফপাশ শিথিল হইয়া গেল. সভয়ে সে লক্ষ্য করিল গুম্ফপাশ গুম্ফবতির নাসিকানিম্ন হইতে খসিয়া কর্তিত কদলীবৃক্ষ ন্যায় পড়িয়া রহিয়াছে. উভয়ের ভীত দৃষ্টির সম্মুখে গুম্ফবতির দেহখানি একরাশ ঘনকৃষ্ণ কেশে রুপান্তরিত হইলো. প্রতুল আপন কন্ঠে হস্ত বুলাইতে বুলাইতে জিজ্ঞাসা করিল: "কৃষ্ণ, ভাই আমার, কি করে এমন হয়?" কৃষ্ণ হালকা হাসিয়া উত্তর দিল:" বন্ধু, এ জগত কেশময় - কেশ সর্ব স্থলে, মানুষ ও কেশবিশেষ -
সর্ব লোকে বলে." নিশিথের সে নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া কোথাও হায়েনা হাসিয়া উঠিল. কৃষ্ণ এবং প্রতুল গলা জড়াজড়ি করিয়া বাগানবাড়ির বাহিরে আসিয়া আপন গৃহের পানে প্রস্থান করিল.
পৌষ্টিক পিশাচ উপাখ্যান
বৈশাখ মাসের গভীর রাত্রি. গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে গাবগাছ হইতে আঠা বাহির হইয়া পথিকের মাথায় পড়িতেছে. প্রবল গুমোট উষ্ণ আবহাওয়ায় প্রতুলের দম বাহির হইয়া আসিতেছিল. এমন সময় প্রতুল ও কৃষ্ণকমলের পশ্চাতে একটি সেগুন কাষ্ঠের দরজা প্রখর ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ করিয়া খুলিতে লাগিল. সচকিত হইয়া কৃষ্ণ ও প্রতুল ঘুরিয়া তাকাইলো. প্রবল গ্রীষ্মের রাত্রে মেডিক্যাল কলেজের মর্গের পাশে যে দৃশ্য তাহারা অবলোকন করিল, তাহা তাহারা জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিবে না.
সেগুন কাষ্ঠের ভারী দরজা খুলিয়া মেঝের উপর এক নারকীয় উরগ-সদৃশ ছেঁচরাইয়া বাহির হইয়া আসিল একটি মানবদেহ হইতে বিছিন্ন সম্পূর্ণ পৌষ্টিকতন্ত্র. খাদ্যনালী হইতে শুরু করিয়া পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র এমনকি পাযুদ্বার অবধি সেই নারকীয় দেহাবশেষে অক্ষুন্ন রহিয়াছে. কোনো এক পৈশাচিক মন্ত্রবলে সেই পুতিগন্ধময় জীবটি প্রাণ পাইয়াছে. একখানি কেঁচো র ন্যায় আপন অন্ত্রকে সংকুচিত ও প্রসারিত করিয়া মাটির উপর দিয়া সেই পৈশাচিক জীবটি ঘষ্টাইয়া অগ্রসর হইতেছে. জীবটির সারা দেহ তাজা রক্তে মাখা, পাযুদ্বার হইতে ফোঁটা ফোঁটা ঝরিতেছে পীতবর্নীয় তরল বিষ্ঠা. সমস্ত মেডিক্যাল কলেজের শান্ত পরিবেশ কে ভয়ংকর মন্ত্রবলে অশান্ত করিয়া সেই অপার্থিব জীবটি মর্গের দ্বারবান এর প্রতি অগ্রসর হইতে লাগিল.
মর্গের দ্বারবান একখানি কাঠের কেদারায় বসিয়া আপন মনে খৈনি খাইতে খাইতে গুনগুন করিয়া দেশোয়ালি ভাষায় কোনো গান গাইতেছিল. তাহার বিন্দুমাত্র খেয়াল হয় নাই যে তাহার পশ্চাতে একটি সম্পূর্ণ মানব পৌষ্টিকতন্ত্র জীবিত হইয়া তাহাকে মরিবার উপক্রম করিতেছে. কৃষ্ণকমল বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করিয়া কর্ণের ছিদ্রের ভিতর লুক্কায়িত deflated কালাশনিকভ রাইফেলখানি বাহির করিয়া আনিল. deflated অবস্থায় উহা দেখিতে একখানি সরু খড়কে কাঠি সদৃশ, কিন্তু যেই কৃষ্ণ উহার পশ্চাতে মুখ লাগাইয়া ফু দিতে লাগিল, ততক্ষনাত উহা ফুলিয়া একখানি পূর্ণাঙ্গ রাইফেল এর রূপ নিল. কালাশনিকভ বাগাইয়া কৃষ্ণ চকিতে নিশানা লাগিল. বজ্রঘোষের ন্যায় "গুরুম" শব্দে মেডিক্যাল কলেজের রাত্রিকালীন নিস্তব্ধতা যেন মেঝেতে পড়িয়া খান খান হইয়া ভাঙ্গিয়া গেল. চমকিয়া দ্বারবান মহাশয় কেদারা হইতে নীচে পড়িয়া গেলেন.
কালাশনিকভের গুলি কৃষ্ণের অব্যর্থ লক্ষ্যে সেই পৈশাচিক দানবের খাদ্যনালী ভেদ করিয়াছে. ঘন কৃষ্ণবর্ণের রক্ত ফিনকি দিয়া বাহির হইতেছে. এমতাবস্থায় একখানি আহত বৃশ্চিকের ন্যায় সেই মায়াবী পাকস্থলী ঘুরিয়া দাঁড়াইল. কৃষ্ণ বা প্রতুল বিন্দুমাত্র নড়িবার পূর্বে ই সেই শয়তান তাহার উন্মুক্ত বৃহদন্ত্র উঁচাইয়া পাযুদ্বার হইতে বিষাক্ত বাতাস বাহির করিতে লাগিল. ঠিক যেমন বৃশ্চিক আক্রমন করিয়া হুল হইতে বিষ ঢালিয়া দেয় শত্রুর শরীরে. সেই ভয়ানক পুতিগন্ধময় বাত্কর্মের আবহাওয়ায় সম্পূর্ণ মেডিক্যাল কলেজের মর্গ যেন নরকের চৌরাশি খানা কুন্ডে রুপান্তরিত হইলো. নারকীয় পাকস্থলী তখনও তাহার পৈশাচিক পাযুদ্বার হইতে মুহুর্মুহু বিষবাষ্প ত্যাগ করিয়া চলিতেছে একখানি অমানবিক ট্র্যাকটর এর সাইলেন্সার এর ন্যায়. সেই ভয়ংকর গন্ধে কৃষ্ণ ও প্রতুলের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল হইয়া আসিতে লাগিল. তাহারা চক্ষু র কোনায় লুক্কায়িত গ্যাস-মাস্ক বাহির করিবার পূর্বে ই সেই ভয়ানক বিষ-বাতাসের প্রকোপে মূর্ছিত হইয়া পড়িল. ভীষণ দুর্গন্ধে মাথা ঘুরিয়া পড়িবার ঠিক পূর্বে কৃষ্ণ দেখিল পৈশাচিক পাকস্থলিখানি ছেঁচড়াইয়া সিঁড়ি দিয়া নিচে নামিয়া সদর দরজার দিকে অগ্রসর হইতেছে.
প্রতুলের জ্ঞান ফিরিল স্মেলিং সল্টের তীব্র গন্ধে. কৃষ্ণ গম্ভীর মুখে পায়চারী করিতেছে. প্রতুল জিজ্ঞাসা করিল: "কৃষ্ণ, সে কৈ?" কৃষ্ণ গম্ভীর হইতে গম্ভীরতর হইয়া উত্তর দিল: "ভাই, সে জানিলে কি আজ এখানে বসিয়া থাকিতাম?" এমন সময় ঘরের দরজায় প্রবল করাঘাত, সচকিত হইয়া কৃষ্ণ দরজা খুলিয়া দেওয়া মাত্র একখানি অর্ধ-উলঙ্গ মানুষ ঝড়ের বেগে ঘরে প্রবেশ করিল. সভয়ে প্রতুল লক্ষ্য করিল তাহার কটিতে একখানি লাল ল্যাঙ্গট ভিন্ন সারা শরীরে আর কোনো পরিধেয় বস্ত্র নাই. তাহার মুখে সন্ন্যাসীদের ন্যায় প্রলম্বিত গুম্ফ-শশ্ম্রু, তাহার চক্ষু দুইখানি ভাটার মত ঘুরিতেছে. ঘরে ঢুকিয়াই সে গম্ভীর গলায় বলিয়া উঠিল: "ওরে, জেগে ওঠ, কিছু কর, সর্বনাশ যে আসন্ন."
প্রতুলের বিস্মিত চক্ষের সম্মুখে কৃষ্ণ মাটিতে শুইয়া সেই মানুষটিকে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করিল. প্রতুল সচকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, "কৃষ্ণ, কে ইনি?". কৃষ্ণ মাটি হইতে উঠিয়া স্মিত হেসে বলিল, "প্রতুল, ইনার আশির্বাদ নাও, ইনি মহান তন্ত্রসাধক, কাপালিক শ্রী শ্রী বিজ্ঞপাদ. আমাদের মহা বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এসেছেন". বিজ্ঞপাদ বলিলেন,"বালক, কিসে সে মরবে তা আমি জানিনা, কিন্তু তাকে ডাকার মন্ত্র আমি তোকে বলছি, শুনে রাখ, তাকে ডেকে তাকে বোতলে বন্দী করতে পারলে তার মুক্তি, নতুবা সর্বনাশ." কৃষ্ণ স্মিত হাসিয়া বলিল,"প্রভু, মন্ত্র বলুন, তাকে বন্দী করার দায়িত্ব আমার."
কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত্রি. বাহিরে কালবৈশাখীর মেঘ আকাশে জমিতেছে . মেঘের গর্ভে বিদ্যুত খেলা করিতেছে. কৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজের মর্গে বসিয়া মন্ত্রোচ্চারণের প্রস্তুতি লইতেছে. পাশের ঘরে প্রতুল একখানি কাঁচের বৃহত বোতল লইয়া অপেক্ষা করিতেছে পৈশাচিক পাকস্থলীর আগমনের. গুরুগম্ভীর গলায় কৃষ্ণ মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করিল:
নমি তব দেবাদিদেব পাকস্থলী প্রভু,
ভক্তের মিনতি ব্যর্থ করিও না কভু.
নিষ্ঠাভরে ডাকিতেছি, বিষ্ঠাদেব তুমি,
আমাশা -কনস্টিপেশনে তোমারেই নমি.
ধুরন্ধর অতি তুমি, পেটে তব গ্যাস,
দীন ভক্তে দয়া করা তোমারি অভ্যাস.
এস প্রভু দেখা দাও করি এ বিনতি,
কোষ্ঠ-মুক্তি বর দাও ভক্তদের প্রতি.
তুমি সৃষ্টি, তুমি ভোগ, মহাত্যাগী তুমি,
তোমা বিনা শৌচালয় হবে ধরাভুমি.
সহসা কালবৈশাখীর মেঘ গর্জিয়া উঠিল. সমগ্র মেডিক্যাল কলেজ বিল্ডিং খানি কাঁপিয়া উঠিল. প্রতুল চমকিয়া বোতলখানি চাপিয়া ধরিল. কৃষ্ণের মন্ত্রোচ্চারণ ছাপাইয়া প্রবল শব্দে মুষলধারে বৃষ্টি নামিল. কৃষ্ণ কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল একখানি ঘর্ষণের আওয়াজ. ঠিক যেন মেঝের উপর দিয়ে কেহ এক খানি কাষ্ঠের দন্ড ঘষ্টাইয়া টানিয়া লইয়া জিতেছে. কৃষ্ণ বুঝিল মাহেন্দ্রক্ষণ আসন্ন, এখনি দেখা মিলিবে সেই ভয়াবহ পৌষ্টিক দানবের.
প্রতুল বোতলখানি লইয়া দন্ডায়মান অবস্থায় ঝিমাইতেছিল. সহসা অপার্থিব পুতিগন্ধে তাহার শ্বাসনালী বন্ধ হইবার উপক্রম হইল. ভীতি এবং শঙ্কায় বিচলিত হইয়া সে অবলোকন করিল সিঁড়ি বাহিয়া এক খানি ভয়াল ভয়ংকর বিশালাকায় রজ্জুর ন্যায় উঠিয়া আসিতেছে পৌষ্টিক দানব. তাহার পাকস্থলিখানি এক নিদারুন বৃহত ফুটবল সদৃশ আন্দোলিত হইতেছে. তাহার পাযুদ্বার হইতে বিচিত্র আওয়াজ এর সহিত বিষাক্ত গ্যাস ধীরে ধীরে বাহির হইতেছে এক খানি জেট বিমানের পুচ্ছের ন্যায়.
সিঁড়ি বাহিয়া দ্বিতলের ঘরের দরজার সম্মুখে আসিয়া সেই নারকীয় দেহাবশেষ কৃষ্ণের সম্মুখীন হইল. অন্য কেহ হইলে এই ঘোরতর দৃশ্য অবলোকন করিয়াই মূর্ছা জাত. কিন্তু কৃষ্ণের শরীরে অসীম বল এর সহিত মনে যারপরনাই তেজ. প্রবল পরাক্রমে সাহস সঞ্চয় করিয়া কৃষ্ণ গর্জন করিয়া উঠিল:
"কে তুই? কি চাস?"
প্রতুলের হাড় হিম করিয়া সেই অপ্রাকৃতিক প্রাণী নড়িয়া উঠিল. তাহার পর আপন বৃহদন্ত্র কে স্বরযন্ত্রের ন্যায় ব্যবহার করিয়া পাযুদ্বার হইতে বাত্কর্মের আওয়াজ সদৃশ সেই পৌষ্টিক শয়তান বিড়বিড় করিয়া বলিয়া উঠিল
"আমি ক্ষুধার্ত প্রেত. আমি খেতে চাই. আমায় খেতে দে."
কৃষ্ণ বুঝিল বাক্যালাপ বৃথা. খাদ্যগ্রহণ করিলে এই শয়তান এর শক্তি আরও বাড়িয়া উঠিবে আর ইহাকে বন্দী করা অসম্ভব হইবে. কৃষ্ণ বগলের ভাঁজ হইতে কুন্ডলীকৃত মিনি-ল্যাসো খানি বাহির করিয়া পৌষ্টিক দানবের উপর নিক্ষেপ করিল. কিন্তু দানব অতীব ক্ষিপ্র, ত্বরিতে ল্যাসো এড়াইয়া পুনর্বার সে নারকীয় বিষবাষ্প পাযুদ্বার হইতে উদগীরণ করিতে আরম্ভ করিল. প্রতুল বুঝিয়াছে এইবারে সমূহ বিপদ. একবার জ্ঞান হারাইলে এইবার আর তা ফিরিবে না. লম্ফ দিয়া সে বোতলের পার্শ্ব হইতে গ্যাস মাস্ক খানি তুলিবার চেষ্টা করিল. কিন্তু সেই নিদারুন কটুগন্ধে তাহার সমস্ত শরীর শিথিল হইয়া যাইতে লাগিল.
কৃষ্ণ ও বুঝিয়াছে সমূহ বিপদ অবশ্যম্ভাবী. সে অপাঙ্গে দেখিল প্রতুলের অবস্থা সমীচীন. এদিকে তীব্র কটুগন্ধে তাহার ও শরীর যেন শিথিল হইতে হইতে আসন্ন মৃত্যুর প্রতিক্ষা করিতেছে. এমন সময় সে আপন হিপ পকেট হইতে বাহির করিয়া আনিল এম এ করিমের চশমা মার্কা অম্লজীন চূর্ণ. এই চূর্ণ গ্যাস ও বদহজমের মহৌষধ. দক্ষিন হস্তে চূর্ণের কৌটার ঢাকনা খুলিয়া সে পৌষ্টিক দানবের কর্তিত খাদ্যনালী লক্ষ্য করিয়া নিক্ষেপ করিল.
জোঁকের মুখে লবন নিক্ষেপ করিলে যেরূপ তাহা সঙ্কুচিত হইয়া শিকার ছাড়িয়া দেয়, অম্লজীন চূর্ণের মহান কর্মক্ষমতায় পৌষ্টিক শয়তান টি ও সেইরূপ হাহাকার করিতে করিতে মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। একখানি চুপসানো বেলুনের মত তাহার ও পাকস্থলী হইতে শেষ বিন্দু বিষ বাষ্প পায়ুপথে বিচিত্র তানপুরার ন্যায় শব্দ করিতে করিতে বাহির হইয়া আসিল। বাহিরে ভয়ানক বজ্রপাতের শব্দের সহিত সেই বিচিত্র ধ্বনি মিশ্রিত হইয়া যেন কোন নারকীয় সঙ্গীত রচনা করিতে লাগিল। কৃষ্ণকমল আসিয়া প্রতুল কে দুই হস্তে তুলিয়া ধরিল। প্রতুল তখনও সংজ্ঞাহীন। কৃষ্ণ হাহাকার করিয়া উঠিলঃ
“প্রতুল, ভগবানের দোহাই, চোখ খোলো।“
সেই বজ্রাদপি হস্তের বন্ধনে ধীরে ধীরে প্রতুল চক্ষু মেলিয়া চাহিল। কিন্তু সেই পৌষ্টিক শয়তানের দেহাবশেষ এর দিকে দৃকপাত করিয়া সে সভয়ে দুই পা পিছাইয়া যাইল। কৃষ্ণ ম্রিদু হাসিয়া বলিয়া উঠিল,
“ভয় নাই আর, সে মরেছে।“
প্রতুল সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে সেই নারকীয় প্রাণীটির দিকে চাহিয়া শুধাইলঃ
“কিন্তু কি ও?”
কৃষ্ণ স্মিত হাসিয়া বলিলঃ
“ভাই প্রতুল, আমি ই বা কি জানি কি এই জীব? কিন্তু এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই পৌষ্টিক তন্ত্র কোন বাঙ্গালির দেহাবশেষ। নতুবা এত গ্যাস ইহ জীবনে কোন প্রাণী সঞ্চয় করিতে পারে বলে আমার ধারনা নাই। কথায় বলে না,
বাঙ্গালির পায়ু,
ভরা শুধু বায়ু,
কাতর গন্ধে,
সকাল সন্ধ্যে।“
কৃষ্ণের বক্তব্য সমরথন করিয়া সুদূরে কোথাও শৃগাল ডাকিয়া উঠিল। সেই অপার্থিব রাত্রি শেষে নিভন্ত চন্দ্রালোকে একে অপরের হস্তে হস্ত রাখিয়া কৃষ্ণ ও প্রতুল আপন গৃহের প্রতি প্রস্থান করিল। পশ্চাতে পড়িয়া রহিল নারকীয় পৌষ্টিক দানবের দেহাবশেষ।
চিত্রঃ লেখক