আকাশটা আজ একটু গাঢ়, বৃষ্টি হবে বোধহয়। হাইওয়েতে মার্জ করেই অ্যাকসিলেটরে চাপ পড়ল, শুধুই অভ্যেস। রেডিওটা চলছে, কানে ঢুকছে, কিন্তু মনটা একদশীতে। ভাগ্যিস আজ একাদশী, নইলে ডাক্তাররা কেউ ছিলেন না। সবার পুজোর ছুটি। কাশিটাও তাই চেপেচুপে রাখতে রাখতে আজ দম ফেটে বেরল। ডেরিফাইলিনেও কাজ হল না। ডাক্তারদের এই কদিনে ফোন করা হয় নি। তারাও তো মানুষ, বছরকার দিনে সামান্য সর্দ্দি কাশি নিয়ে বিব্রত করতে প্রাণ চায় নি। তাই অপেক্ষা। ফোনে জানা গেল জুনিয়র ডাক্তার ঠিক বারটা অবধি থাকবেন, তার মধ্যেই যেতে হবে। আশার কথা টান কিম্বা কাশি দুইই উপসর্গ আসল রোগ নয়। সে তো হাড়ে মজ্জায় নিশ্চুপে কাটছে, দেখা যায় না, বোঝা যায়, শোনা যায় ফোন করলেই।
আজ প্রায় দেড় বছর ধরে হাড়ে বাসা বেঁধেছে অসুখ, কুরে কুরে খাচ্ছে। আকস্মিক কিছু হবার নয়, যা হবার হবে ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে, অভয় দিয়েছেন ডাক্তার। এক ডাক্তার থেকে অন্য ডাক্তার, এক শহর থেকে অন্য শহর, এক ওষুধ থেকে অন্য ওষুধ পাল্টে পাল্টে যায় আর পাল্টে যায় সেই মানুষটা। শরীরটাও খারাপ হয়। খুব কিছু চাহিদা নেই শুধু নিজের কাজটুকু নিজে করার, তাও দিতে পারে না চিকিৎসা। ওষুধটাই যে এমনই। না খেলে যে.....। কি হবে? না হয় আর কটা দিনের কম যন্ত্রনা। না হয় আর একটু বেশি স্বাধীনতা। নিজের কাপড়টা কাচার একটু বাড়তি আনন্দ। দিদির বাড়ি বিজয়া করতে যাওয়ার বহুবছরের অভ্যেস। কে জানে, কি চায় অসুস্থ মনটা।
পুজোয় এবারে দুটো নতুন শাড়ি, একটাও পড়া হল না। পাড়ার প্যাণ্ডেলটাও যে অনেকদূর। হাতে পায়ে আর জোর নেই। দশকদম হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠে প্রাণটা। সবাই বলে ওষূধের উপসর্গ। কই গতবছরে তো হয় নি। স্মৃতিও আজ ধুসর। একই ওষুধ ছিল তো। নাকি হয়েছিল? ডাক্তার বলেন, বয়সের তুলনায় বেশিই কাহিল নাকি। বিদেশে সবাই নাকি এই ওষুধেও সাইকেল চালিয়ে বাজার করে। এখান ওখানে শোনা যায় এদেশেও সবাই এই ওষুধ খেয়েও দিব্যি করে চলেছে সব কাজ। কেন যে পারা যায় না? সারাদিন টিভিতে চোখ। একের পর এক আসছে যাচ্ছে পুজো পরিক্রমা, সাচ কা সামনা, খনা, আস্তে আস্তে চোখ লেগে আসে। রাতে ঘুমের জন্যও ওষুধ আছে। অষ্টমীর রাতে ঘুম থেকে তুলে টুপসি সন্ধি পুজোর আরতি গায়ে মাথায় মাখিয়ে দিয়েছিল। শিশুর উচ্ছাসে পরের দিন সকালে সেই খবর ফোনে ফোনে পৌঁছে গিয়েছিল দেশে দেশান্তরে। ফোনে সেদিন মনে হয়েছিল যাক ওষুধে বোধহয় কাজ হচ্ছে।
ওষুধে নয়, মূহুর্তের সেই উচ্ছাস পথ্যে। হাতে করে মানুষ করা নাতনির আদরে। বোঝা গেল দশমীর দিনই। সেদিন আর ওঠার ক্ষমতা নেই, শ্বাসকষ্টটাও খুব বেশি। কিন্তু আজ কি করবে? আটত্রিশ বছরের সঙ্গীটি আজ অসহায়। কোথাও যাওয়া আসার উপায় নেই। আর একটা দিন কাটাতে পারলেই হল। সময় গোনে লোকটি। কিছু করার না থাকায় ফোন করে সকলকে। যিনি নিয়ে যাবেন তাকে বার চারেক ফোন করে বলে দেন ভোর হলেই যেন চলে আসে। ফোন করাতে কি কি হতে পারে না তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। পূবকোণে আগুন রাঙিয়ে ভোর হয় রোজকার মতন।
হাসপাতালে এমার্জেন্সীতেই নিয়ে যায়। অক্সিজেন দিতে হবে তো তাই, ফোনে সবাইকে বলেন লোকটি। মনে হয় নিজেকেই বারবার প্রবোধ দিতে চান। আটত্রিশ বছরের অভ্যেস তো, মানতে মন চায় না। ডাক্তার বলেছেন কাল পরশু নাগাদই জেনারাল বেডে দিয়ে দেবে, আর চার পাঁচ দিন বাদেই ছেড়ে দেবে। লাংসে ইনফেকশান হয়েছে তো। ইম্যিউনিটিটা বড্ড কমে গেছে। কিন্তু রেজাল্ট তো সব ভাল। নিজের মনেই বলে যায়, কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে। খেয়াল হতে ফোনটা এগিয়ে দেয়। অক্সিজেন মাস্ক একটু সরিয়ে তার মধ্যে থেকেই একটু গলা - 'ভাবিস না বাবু, সব ঠিক আছে। ঠাকুরজামাই ঠিকুজী দেখে বলেছে আরও দশ বছর'। কাশির দমকে হাসিটা হারিয়ে যায়। বাঁচার অদম্য ইচ্ছে? না, ছেলের গ্লানিকে আড়াল করার অদম্য প্রয়াস? চারিদিক ঝাপসা হয়ে বৃষ্টি নামল, ওয়াইপার টা চলছে, অনেক গাড়ি, শহর এল বোধহয়।
২৯শে মার্চ, ২০১০