September29, 2009
আমাদের নিজেদের মেলিং লিস্টে অন্য একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল। তার মধ্যে সুস্মিত লিখল, দীপঙ্করদা, পুজোয় একটা ব্লগ লেখো। আমরা সকলেই বেশ মজা পেলাম, পুজোয় চাই নতুন ব্লগ। তখন থেকেই মাথায় বিষয়টা নিজের গোচরে অগোচরেই কাজ করছিল, যেন পুজোটাকে লক্ষ্য করছিলাম, সবসময় ভাল করে নিজে না-বুঝেই।
লক্ষ্য করে চলার কিছু সুযোগও আসছিল এবার। আমিই এতটা বুড়ো, আমার বাবা-মা নিশ্চিতভাবেই আরও প্রচুরতর বুড়ো, মানু কিছুদিন ধরে বলছিল, তাদের অনেকদিন ধরে ইচ্ছে রু-এর সঙ্গে পুজোয় ঠাকুর দেখতে যাবে, আর কবে কী হবে না-হবে, সেটাও এবারেই সংগঠিত করা হয়েছিল। রু, বাবা, মা, সঙ্গে সবিতা আর পার্বতী, বহু বছর ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করে, মানু, আর আমি। গাড়ি করে কলকাতা যাওয়া, ঠাকুর দেখা, আর সঙ্গে, যেমন দস্তুর, বাইরে কোথাও খেতে হবে, অ্যাম্বার-এ খাওয়া।
অদ্ভুত লাগছিল নিজের এটা ভাবতে, কিন্তু এটা সত্যি, এটা সে অর্থে আমার প্রথম ঠাকুর দেখতে যাওয়া। খুব ছোটবেলায়, আমাদের ছোটবেলায়, কলোনি থেকে অভ্যস্ত মফস্বল হয়ে উঠতে চাওয়া মধ্যমগ্রামে, বা তারও আগের শিশুবয়সের নিউব্যারাকপুর, সেজেগুজে ঠাকুর দেখতে যাওয়া মণ্ডপে মণ্ডপে তখন কেবল একটু একটু চালু হচ্ছে, কোনওক্রমে টিঁকে থাকা মানুষের একটু একটু করে ক্রমসঞ্চয়মান সময় ও সারপ্লাস, একটু আধটু বোধহয় গেছিও অমন, খুব ছোটবেলার আবছা স্মৃতি ঘেঁটে মনে হচ্ছে। বা এমনও হতে পারে, ওরকমই তো হওয়ার কথা, তাই ওরকম ভেবে নিচ্ছি, অন্য ছবি দিয়ে স্মৃতির ভাঁড়ারের ফুটো মেরামত করার চেষ্টা করছি।
যেটা পুজো সংক্রান্ত স্মৃতি আমার খুব স্পষ্ট ভাবে আছে, সেটা পাঁচ ছয় নাগাদ, নিউব্যারাকপুরের স্মৃতিটা ঠিক পুজোর নয়, পুজো উপলক্ষে ব্যায়ামসমিতির করা শরীরের পেশী প্রদর্শন, আর মামাবাড়িতে, মধ্যমগ্রামের বিধানপল্লীতে, দুলুদার দোকানের সামনে ফাঁকা মাঠে পুজোর মণ্ডপে, খুবই মাঠো সব, বাঁশের বেড়ার গায়ে চটের আবরণ, তার মধ্যে তখনকার ডেকরেটরের কাঠ-পিজবোর্ডের চেয়ারে বসে আমি আর গজো, তখনকার এক সঙ্গী, একটা খেলনা পিস্তল দিয়ে মারামারি করছি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য: যুদ্ধে আমিই জিতেছিলাম। ফিরে এসে আমার মামাতো ভাই লবকে সেই জয়ঘোষণায় আমার করা বাক্যটা আমার এখনও মনে আছে, গজোকে জুতো পালিশ করে দিয়েছি।
এর পরের কয়েকটা বছর জুড়ে, মেয়েদের প্রতি, উঙ্কÄল পোষাকের প্রতি আকর্ষণ ছাড়া পুজোর উৎসবের আর যে জিনিসটা মনে আছে সেটা হল মণ্ডপে বসে থাকা। আমি চিরকালই বেজায় কুঁড়ে, বসে বসে চেয়ে থাকার চেয়ে বেশি সক্রিয় কোনও ক্রিয়া আমায় আজও তেমন একটা টানে না। এই মণ্ডপে বসে থাকা, মণ্ডপের নানা, তেমন সুশ্রী নয় বিষয় আমার মাথায় রয়ে যাওয়া কাজ করেছিল তপন বিশ্বাসের খিদের বত্রিশ ঘন্টা লেখার সময়ে। আর লেখায় ওটা চলে আসা নিয়ে বেশ অদ্ভুত এবং কুৎসিত একটা অভিজ্ঞতা আমার প্রায় ঐ বয়সেই হয়েছিল। হিন্দুস্কুলে আমাদের ক্লাস সেভেনে বাংলা পড়াতেন যে মাস্টারমশাই, হঠাৎ এই লিখতে গিয়ে দেখছি তার নামটা মনে করতে পারছি না, তিনি বাংলা রচনা লিখতে দিয়েছিলেন, রথের মেলা নিয়ে। আমি সে বছরই রথের মেলায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, কীর্তন যেখানে হচ্ছে সেই গোটাটা। সেখানের একটা উপাদান আমি রচনায় এনেছিলাম। কীর্তনের খোল বাজাচ্ছে যে লোকটা, মাড়ি আর দাঁত কালো, একটু উঁচু, কোনও নারী এসে কাছে দাঁড়ালেই তার দিকে একটু ঝুঁকে যাচ্ছে আর তার খোলের বাজনার জোরও বাড়ছে একটু। গোটাটা সত্যি, আমার এখনও ছবিটা মনে আছে, ঝাপসা ঝাপসা। কী ভাষায় লিখেছিলাম মনে নেই। আমায় ক্লাসে উনি দাঁড় করিয়ে জিগেশ করলেন এটা কী লিখেছ, রম্যরচনা? আমি শব্দটার মানে জানতাম না, এর অনেক বাদে জেনেছিলাম, এবং কী উত্তর দিয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই, কিন্তু উনি আমায় বেঞ্চ থেকে বার করে এনে মেরেছিলেন। আমি সেই মুহূর্তে ভারি ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গিয়েছিলাম, এবং মার চলাকালীনই বুঝতে পারছিলাম, আমি যা-ই উত্তর দিতাম উনি বোধহয় মারতেন। এখনকার বাজারে এটা বেশ কঠিন, কিন্তু কাম বা যৌনতা নিয়ে কোনও দূরাণ্বয়ী কথাও তখন কী ভীষণ হিংস্রতা বার করে আনত। তখন সেটা বুঝিনি, লোকটা যে পাঁঠা, মজাটা বুঝল না, এটাও বুঝেছিলাম অনেকটা বাদে।
আর এর মাঝেই শুরু হয়ে গেল রাজনীতি। সেই কৈশোর বয়সেই। তখন তো তঙ্কÄটঙ্কÄ কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু যে লোকগুলো এলাকায় রাজনীতি করত, সিপিএম রাজনীতি, গজোর বাবা তাদের একজন, নিউব্যারাকপুরের অমূল্যজ্যাঠা আর একজন, দেশহিতৈষী নিয়ে আসত আমাদের বাড়িতে, বহুবছর জেল খাটা, দাড়িতে চুলে কিছুটা রূপকথা হয়ে ওঠা সুরেশজ্যাঠা ছিলেন, এরা যে চারপাশের মানুষগুলোর থেকে অনেকটা অন্যরকম, সেটা সেই তখনই বুঝতে পারতাম, কেমন একটা অন্য অনুভূতি হয়, স্বপ্ন দেখানো রকমে একটা কিছু। একটা ভাল অনুভূতি হত, এখনকার সিপিএমদের দেখলে ঠিক যার উল্টোটা হয়। আমি এঁদের নিয়ে কোনও রূপকথা তৈরি করছি না। অতটা ছেলেমানুষ আমি ছেলেবয়সেও ছিলাম না, অনেককিছুই চোখে পড়ত আমার। আটাত্তরের পর থেকে এই লোকগুলৈ ক্রমে, তাদের চারপাশ পরিজন পরিবেশ, ক্রমশ: গেঁজে যেতে শুরু করল, ঐ স্বাধীনতা আন্দোলনের পেনশনের মত আত্মত্যাগের বাড়িভাড়া পেতে ও নিতে শুরু করল, দেখলাম। কিন্তু তার আগেই রাজনীতি এসে গেল।
রাজনীতির সেই কিশোরবয়স থেকেই পুজো মানেই হয়ে উঠল অনেক অনেক বই পড়ার অবিমিশ্র ছুটি। শারদীয়া যে কোনও সংখ্যা, বেশ মোটা হলে আমার একদিন ছাড়াত, নয়তো দিনের দিনই নেমে যেত। এর পরপরই এসে গেল পার্টির পুজোর বইয়ের স্টল। বইয়ের সঙ্গে বসে থাকতে, পড়ে থাকতে, এমনকি ঘুমিয়ে থাকতে অব্দি বেজায় ভালবাসতাম চিরকালই। একবার একটা গল্পে একটা চরিত্র লিখেছিলাম যে সঙ্গে বই মানে অক্ষরের কবচকুণ্ডল না থাকলে ট্রেনে উঠতে ভয় পেত, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত, আত্মপরিচিতি ঘেঁটে যেত তার, সেটা নিজের প্রতিক্রিয়া থেকেই। কম্পিউটার এই উপকারটা করেছে আমার, অন্য অনেক কাজে সাহায্যের পাশাপাশি, বইপ্রতিমার বাতিক দূর করেছে। তবে বোকা ইগোর আত্মঘোষণাটা থাকেই, হয়তো সেটা করে উঠতে নিজেকে অনুমতি দিই না, বা নিজের অগোচরে হয়ত দিয়েও ফেলি, কিন্তু তার প্রতিমাটা অন্তত বদলেছে।
তাই, পুজো ও ঠাকুর দেখতে যাওয়া আমার এই প্রথম। ওরকম শোভাযাত্রা করে দামি জায়গায় খেতে যাওয়াটাও। এখন তো একটু পয়সাটয়সাও হচ্ছে আমার। বুড়ো হতে হতে যেমন হয়েই থাকে।
এবার আরও একটা নতুন জিনিস করলাম। জীবনে প্রথম। বিসর্জনের মিছিলে যাওয়া। রাজনীতির মিছিলে অনেক হেঁটেছি। অনেক রকম। কিন্তু বিসর্জনের মিছিলে এই প্রথম। আর আমার তো সেই খুব ছোটবেলার পর থেকে ভক্তিটা কেমন একটা খসে গিয়েছিল, কোনও কিছুতেই কোনও ভক্তি হত না, লোককে না ঠাকুরকে না। আমার ক্ষেত্রে এটা অন্তত একটা বিষাক্ততা নিয়েই এসেছিল। একটা প্যারানইয়াও হতে পারে, সবাই এটা করছে, আমায় করাতে চাইছে, তার মানেই এটায় কোনও বদমাইসি আছে। কোনও ভক্তি নেই বলে জীবনের খুব একা খুব তিক্ত সময়গুলোয় মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একা বোকা এবং বিষণ্নও লেগেছে, আমার হায় নালিশ জানানোর কোনও জায়গাও নেই। তাই অন্য মানুষগুলোকে, তাদের খুব আবেগ হচ্ছে, ফাঁকা মণ্ডপ দেখে, ঠাকুর চলে যাচ্ছে, কেঁদে ফেলছে, আর সেই লোকগুলোকে তো আমি বেশ ভালই বাসি, পছন্দ করি, তাদের খারাপ লাগায় আমারও লাগছে। এই গোটাটাই আমার বেশ কৌতূহলোদ্দীপক আর আকর্ষণীয় লাগছিল।
এই দুটোকে মিলিয়ে অনেকটা লেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ভূমিকাটা বড্ড বড় হয়ে গেল। আর একটা ঘটনা কাল রাত থেকে ভীষণ খারাপ একটা অনুভূতি দিচ্ছে। সেটা উল্লেখ করে আজকের ব্লগটা শেষ করি। ওগুলো নিয়ে হয়তো পুজোর ব্লগ ২ লিখব এর পর।
এবারের পুজোর কলকাতা দেখে, এবং অন্যদের কাছ থেকে শুনেও যা পেলাম, বেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। মাইকের এবং বাজির কদর্যতা বেশ সহনীয় ছিল। গোটা গাদটা এসে জমা হয়েছে মফস্বলে। সারাদিন ধরে প্রবল জোরে মাইক বেজেছে সর্বত্র, রাত্তির এগারোটা নাগাদ মোটামুটি হয়ত বন্ধ হয়েছে, অন্তত মধ্যমগ্রাম নিউব্যারাকপুরে, কিন্তু সারাদিন ধরে সে যে কী কষ্ট হয়েছে। অজস্রবার জানানো হয়েছে গিয়ে, রীতিমত অসুস্থ লাগছিল, কিন্তু কিছু তেমন লাভ হয়নি। আর বাজি ফেটেছে ভয়ঙ্কর। খারাপ অভিজ্ঞতাটা সেই বাজি নিয়েই।
আমার এক বহু পুরোনো ছাত্র, এখন আমার বন্ধু, তার বউ অন্ত:স্বত্তা। সেখানে নানা সমস্যাও আছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর ওর প্রথম বাচ্চা সাড়ে তিন বছর বয়েস। নিউব্যারাকপুরে ওদের বাড়ির কাছে গতকাল বিসর্জনে এমন বাজি ফেটেছে, সেই সাড়ে তিনের মেয়ে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বমি পায়খানা করে ফেলেছে। সেটা শোনা থেকেই এত কষ্ট হচ্ছিল। আমাদের এখানেও, ঘুমন্ত বাচ্চারা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এবং এটা চলে অন্তত রাত একটা দশ পর্যন্ত। আমি ঘুমোতে পারছিলাম না আওয়াজে। ঐ সময়ে আমি ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে গেছিলাম।
এবার আওয়াজের মাত্রা আবার বেড়েছে, শুনছি যুক্তিটা নাকি শ্রমিকশ্রেণীর হয়ে। যদি শব্দবাজি না হয় এরা কোথায় কাজ পাবে? এ যে কি অদ্ভুত যুক্তি। তাহলে পাইপগান তৈরিকেও স্বীকৃতি দিতে হয়, নইলে শ্রমিকদের কী হবে? বাজি বানাতে কি এতটাই দক্ষতা লাগে, ইতিহাসের মাস্টারমশাই যেমন অঙ্ক শেখাতে পারেন না, যে এই শব্দবাজি-শ্রমিকরা তুবড়ি বা রংমশাল বানাতে পারবেন না?
ছত্রধর মাহাতোকে ধরা হল রাষ্ট্রের বিরোধিতার দায়ে। তাহলে লালা বাংলা ছেড়ে পালা আর ভুল ইংরিজিতে ওদের ভাষাতেই ওদের উত্তর দেওয়া হয়েছে এই দায়ে বিমান-বুদ্ধকে কেন ধরা হবে না কে জানে? আইনবিভাগকে অপমান করা মানেও রাষ্ট্রবিরোধিতা। বা, মুখ্যমন্ত্রী হয়েও, সংবিধানের ভাষা না বলে দুষ্কৃতীদের ভাষায় কথা বলতে চাওয়া অবশ্যই রাষ্ট্রবিরোধিতা। এরা এই অসভ্যতা গুলো করে করে যা করেছেন তা হল কোনও রকমের কোনও প্রকারের কৌম অস্তিঙ্কÄটাই মুছে গিয়েছে, কোনও অনুশাসনের প্রয়োজনীয়তাও। তাই কোনও ক্রমে দম চেপে কলকাতা থেকে তাড়ালেও তা এসে জোরতর হয়ে চেপে বসছে কলকাতার বাইরে, খ্রীষ্ট যেখানে হাঁটেননি।
October11, 2009
সুস্মিত বলেছিল পুজোর ব্লগ লিখতে। হয়নি। লেখা শুরু করে হাজিপাজি লিখতে শুরু করেছিলাম। আজ লিখি, লেখার একটা কারণ এল।
আজ গেছিলাম আড়িয়াদহে, আমার বন্ধু সুমিতা ও মধুসূদনের মেয়ে তিতাসের জন্মদিনে। আমি কোথাও যাইনা বলে বিশ্বপৃথিবীর সবাই আমাকে গালাগাল দেয়, নিজের ঘরে নিজের কম্পিউটারের সামনে পড়ে থাকি। তাই মাঝেসাঝে, মানে মাঝে-বছর-দুয়েক-অন্তর-সাঝে, এরকম হঠাৎ করে কোথাও গিয়ে পড়ি, গিয়ে সততই নিজেকে বেশ উজবুকের মত লাগে, কেন গেছি এর কোনও কারণ খুঁজে পাই না, কেন কথা বলছি, বা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর, ঠিক কী বলছি সেটা নিজেই ভাল বুঝে উঠতে পারি না। আমার ভিড় ভাল লাগে না, সে আলাদা করে ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দসই লোকের ভিড় হলেও, কেমন দম আটকে আসে। জোর করে তেতো ওষুধ গিলছি এমনটা লাগে। কিন্তু, তাও, মাঝে সাঝে
ইত্যাদি।
ঠিক এটাই হচ্ছিল আমার দশমীর দিনও।অপাড়ার সবাই তখন ঠাকুর তুলছেপরপর পাঁচটা ভ্যানে। সঙ্গে লাইট ইত্যাদি লাগিয়ে বিসর্জনে যাবে। কৌশিক, আমাদের পাড়ার ছেলে, আগেই একদিন গল্পসূত্রে বলেছিল, ঠাকুর বিসর্জনের আগে ওর কান্না এসে যায়, সেদিনও দেখছিলাম, ওর চোখ বদলে গেল। ওর, এবং আরও দুজনের, অনুভব করতে পারছিলাম। সরাসরি কেউ কাঁদছে না, কিন্তু বেশ গভীর একটা মন-খারাপ হচ্ছে। আমার এটা হচ্ছিল না, এবং হচ্ছিল না বলে একটা খারাপ লাগা তৈরি হচ্ছিল, যেন সবার মত আমারও এটা হওয়া উচিত, কিন্তু হচ্ছিল না এটাই সত্যি। আমি বারবার তখন প্রতিমা তুলে ফেলা ফাঁকা মণ্ডপটা দেখছিলাম, বরং, সত্য অর্থেই, খুব গোপনে আমার বোধহয় একটা আরামই হচ্ছিল: যাক মাইকটাও তো বন্ধ হল। তখনও, সেই ঠাকুর তুলে ফেলার মুহূর্তেও পাড়ার ছোট ছেলেরা এসে চালিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল, বাবা আমার কি বিয়ে হবে না ইত্যাদি। খুবই বিশ্রী লাগছিল, কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না, এই মানুষগুলোকে, এই সমবায়টাকে এত কম চিনি, কোনটুকু বলা যায়, কোনটুকু যায় না, সেটাতেই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। আর যেহেতু এক সময় রাজনীতিটা সত্যিই সবচেয়ে জরুরি কাজ হিসাবে করেছি, অনেকগুলো বছর একটানা, তাই এটুকু অন্তত বুঝি, এরকম কিছু দাগ সদাসর্বদাই থাকে, কোনটুকু করা যায়, কোনটুকু যায় না। শেষে পাড়ারই এক দিদি, তিনি প্রায় বছর ষাটেক, তিনি অত্যন্ত পুজোসক্রিয়, তাই এই সমবায়ের খুব কেন্দ্রীয় অবস্থানেই আছেন, বলা যায়, তিনি গানগুলোয় বিরক্তি প্রকাশ করা মাত্র, ইলেকট্রিকের ছেলেটিকে বললাম, ওটা খুলে দাও।
সত্যিই তখন চারপাশে ঐ বিষণ্নতাটা ছিল। এত অস্বস্তিকর লাগছিল সেটার অংশ হয়ে উঠতে না-পারায়, যে, শেষ অব্দি আমি সমবায়টার হয়ে পরিশ্রম করতে শুরু করলাম। এটা আমার বহুযুগের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। আমাদের কিশোর-যুবক বয়সে একটা শব্দ খুব চালু ছিল:আঁতেল। এটা ছোটবেলা থেকেই খুব শুনতে হত, কারণ আমি ভিড় ও সমাগম খারাপ বাসতাম। আমার আত্মীয়স্বজন, নিকটজনদের বিয়ে জন্মদিন অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধ বিবাহবার্ষিকী এই সবই খুব বিরক্তিকর লাগত। লোকজন এত সাজে, এত বানায়, এত ভণ্ডামি করে। কিন্তু এ একটা অদ্ভুত সমবায়ের ফ্যাসিজম যে সবাইকেই ওটা খুব পছন্দ করতে হবে, হবেই। আর সবাই যখন বলত, আঁতেল তো তাই ও পছন্দ করে না, সেটা হয়ত আমাকে চেয়ে আমাকে ভালবেসেই, আমাকে অনুষ্ঠানের অংশ করে নেওয়ার ইচ্ছাতেই করা একটা পরিহাস-আক্রমণ, কিন্তু পরিহাস বলে তার দাঁতে ও নখে বিষ কম থাকত না। সেটায় কেমন বিপন্ন লাগত, অসহায় লাগত। আবার এটাও ঠিক, কোনও অনুষ্ঠানে গেলেই কিছুক্ষণ পর থেকে আমার সম্মুখস্থ প্রতিটি লোকের মুখে থাবড়া মেরে চলার গোপন বাসনা চারিয়ে উঠতে থাকত। অনেক পরে, তখন এমএসসি পড়ি, আমার এক সহপাঠী দেবু বলেছিল, কোনও বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার একমাত্র মানে হয় প্রচুর গাঁজা খাওয়ার পরেই, ও নাকি একবার সেই অবস্থায় গিয়ে, ওর পাড়ারই এক মেয়ের বিয়েতে তার হবু শ্বাশুড়ির সঙ্গে দেশভাগের দু:খে হাউহাউ করে কেঁদেছিল। এবং, এই গল্পটায় আমার সবচেয়ে উত্তেজক লেগেছিল এই জায়গাটা যে, এই ধরনের একটা কিম্ভুত ঘটনা ঘটানোর পরেও কেউই দেবুকে লাথি মেরে বার করে দেয়নি সেই বিয়েবাড়ি থেকেএর পরেও ও অনেকবার গেছে সেই বাড়িতেসেই ভদ্রমহিলাও, আজও, এখনও, ওকে পছন্দই করে। পুরো গল্পটা বলে দেবু আমায় বলেছিল, সেই মুহূর্তে সেটা আমার মাথাতেও ঘুরছিল, বিয়েবাড়িফাড়িতে সবাই বোধহয় গাঁজা কি সিদ্ধি খেয়ে থাকে, কেউই শালা বোঝে না কী হচ্ছে কী করছে।
তা দেবুর সেই সমাধান আমার কোনওদিনই করে দেখা হয়নি। বরং আমার গায়ের জোর আর কায়িক শ্রম করার ক্ষমতা চিরকালই গড়ের চেয়ে বেশি বলে আমি আমার পক্ষে সহজ একটা সমাধান তৈরি করে নিয়েছিলাম, অনুষ্ঠানের সঙ্গে বসবাসের। পরিবেশন কি মালপত্র টানাটানি গোছের এমন একটা কাজ নিয়ে নিতাম যা শেষ হবে না, করেই চলতে হবে, করেই চলতে হবে, তাতে ঐ সাজগোজিত ন্যাকামোর আক্রমণ এবং করার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাব। পেতামও। আরও বাড়তি কিছু পেতাম। কাজের শেষে, সবকিছু মিটে যাওয়ার পর, সবাই যখন জিরোচ্ছে, বয়স্করা উল্লেখ করতেন, ও:, ও কিছু খেটেছে বটে, আসলে ওর কিন্তু টানটা খুব। ইত্যাদি। একটু অস্বস্তি লাগত, ঠকাচ্ছি না তো, কিন্তু ভালও লাগত, নিজেকে ঐ সমবায়ের অংশ বলেও মনে হত, সেটাতে ভালও লাগত, হয়ে উঠতে ইচ্ছে করত, সেই ইচ্ছেটা করত আমার চিরকালই। আমি কোথাও ঐ গোটাটার অংশ হয়ে রইলাম সেই জায়গা থেকে যত ছোট করেই হোক নিজেকে একটু অর্থপূর্ণও লাগত।
দশমীর সন্ধ্যায় আমার সেই পুরনো অভিযোজনে ফিরে গেলাম অনেকদিন পরে ফের একবার। অতগুলো প্রতিমা, দুর্গার মূলটা, আর চারটে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক ও গনেশের, আটফুট দশফুট লম্বা সেই প্রতিমাগুলো মণ্ডপ থেকে নামিয়ে ভ্যানে সাজানোটা সত্যিই একটা প্রবল পরিশ্রম। সেটাতেই হাত লাগালাম। পাড়ার বয়স্ক একজন, পুজো সংগঠকদের একজন, আরও এখন তো আমিও বয়স্ক, বললেনও, তুমি করছ এসব, এ কী? বানিয়ে না, বেশ সসঙ্কোচ হয়েই বললেন। আমার আবার সেই সমবায়ে ফেরার অনুভূতিটা হল। এদের বেদনার ভাগ নিতে পারছি না, হচ্ছে না আমার, কিন্তু শ্রমের ভাগ তো নেওয়াই যায়।
অনেকটা সময় লাগল সবটা হতে। ঘামে জামা বেশ ভিজেও গেল। এর মধ্যে, একটু জিরিয়ে নিতে, পাড়ার মোড়ে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। তখন অন্য অনেক পুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা বেরিয়েও গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেসব দেখছিলাম, সেই প্রবল আওয়াজ, কিন্তু খোলা জায়গা বলে খুব অসুবিধাও হচ্ছিল না। আর প্রচুর ঢাক বাজছিল। ঢাকের বাজনাটা আমার দেখি বেশ লাগে। এমনকি অনেকসময় শরীরেও তালটা অনুভব করতে পারি।
এই রকম সময়ে ঘটল ঘটনাটা। উল্টোদিকে বাঁদিকের লেন দিয়ে শোভাযাত্রাটা আসছে বলে একটা অটো রাস্তার বিভাজকের কাটা অংশ দিয়ে ডানদিক থেকে বাঁদিকে চলে গেল, অটোটা মধ্যমগ্রাম ইস্টিশন থেকে চৌমাথার দিকে যাচ্ছিল। শোভাযাত্রার স্বেচ্ছাসেবক যাননিয়ন্ত্রকরা তাকে বারণ করছিল হাত তুলে, সেটা না-দেখেই, বা, হয়তো, দেখার পরও অটোটা ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুচারজন ছুটে এল, একজন অটোচালককে মারতে শুরু করল। আমি হাতের সিগারেট ফেলে রাস্তা পার হতে হতেই অটোচালকের মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেছে, এবং শাসকদের একজনেরও। অটোচালকটি, একটু চুপচাপ ধরনের চশমা পরা গোলগাল মুখের স্বাস্থ্য ভাল একজন মানুষ, বোধহয় তার প্রতিবর্তী প্রক্রিয়াতেই ঘুষি খেতে খেতে হঠাৎই একটা পাল্টা ঘুষি মেরে বসেছে।
আমি গিয়ে একজন দুজনকে জাপটে ধরলাম। সেই মুহূর্তে, আমার মনে আছে, আমি একটা যুক্তি খুঁজছিলাম। একটা কোনও জোরালো যুক্তি, যেটা সজোরে বারবার চেঁচাতে থাকলে, একসময়, কয়েকজনের অন্তত মাথায় সেটা ঢোকে। আমার নিজের ভক্তি ব্যাপারটা অনুপস্থিত, কিন্তু এই লোকগুলোর তো আছে, একটু আগে দেখছিলাম সেটাও হয়তো মাথায় কাজ করছিল, আমি বারবার চেঁচাতে থাকলাম, আরে ভাসান ভাসানভাসানের দিন একটা লোকের রক্তপাত করছেন। সেই পলকটায় যে কথাটা সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে হয়েছিল আর কী। বলছিলাম, আর নিজের ভারি শরীরটা আক্রমণকারী লোকগুলো আর ড্রাইভারের মধ্যে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আর কিছু মাথায় কাজ করছিল না, শুধুমাত্র একটা মার খেতে থাকা একটা লোককে বাঁচানোর চেষ্টা। কিছুই হলনা। শেষ অব্দি ছেলেটির গলাও আমি আমার ঘাড় পিঠ বাড়িয়ে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কিছুই প্রায় করতে পারলাম না, নিজের সাদা ফতুয়ায় রক্ত লেগে যাওয়া ছাড়া।
এবং, সেই মুহূর্তেই আমি লক্ষ্য করছিলাম, কী ভনক অনুপস্থিত কোনও জাতের কোনও ভক্তি সেই মানুষগুলোর মধ্যে। একদম ছিঁচকে মস্তান সব। প্রবল ভাবে মদ খেয়ে রয়েছে বলেই যে ভক্তিটা কাজ করছিল না তা নয়। দুই দশক ধরে মাস্টারির অভিজ্ঞতায় অন্তত ছেলেপিলেদের চোখ চিনতে কিছুটা তো শিখেছি, ঐ যুক্তিটা ওদের স্পর্ষমাত্রও করেনি।
ফিরে আসার পর পাড়ার লোকে বলল, যারা আমায় মাস্টারমশাই হিসাবে চেনে, আপনি ওদের মধ্যে গেছিলেন কেন সমস্ত ছিঁচকে বদমাইস। ওরা নাকি বঙ্কিমপল্লীর বান্ধবসমিতির, ঠিক গুন্ডা না, গুন্ডাগোছের, ওরা ওদের কাউকে কাউকে চেনেও, পাড়ার কেউ কেউ বলল।
আজ, আড়িয়াদহ থেকে এলাম সোদপুর, রু, মানু আর আমি। সেখান থেকে মধ্যমগ্রামের অটো ধরলাম। একটি কমবয়েসি ছেলে চালাচ্ছিল। তাকে জিগেশ করলাম, আচ্ছা দশমীর ভাসানের দিন একটা অটো এই রুটেই মধ্যমগ্রাম চৌমাথা যাচ্ছিল, ছেলেটি ফ্লাইওভারের সামনে মার খেয়েছিল, তার কী হল, জানো? যা জানলাম, সেই রাত থেকেই সে হাসপাতালে, ও সোদপুর স্ট্যান্ডের ছেলে, সোদপুর ইস্টিশনের ফ্লাইওভারের নিচে ওদের ইউনিয়নের অফিস থেকেই চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে। নাকে খুব গভীর কোথাও লেগে গেছে।
আমি তার পর থেকেই অস্বাভাবিক হয়ে আছি। এতটাই, যে, ফিরে এসে মানুকে যেই বললাম, এটা ব্লগে লিখি, ও প্রায় লুফেই নিল, হ্যাঁ, লিখেই ফেল, তাতে যদি একটু স্বাভাবিক হও। আমার মাথায় বহু কিছু আসছিল, বহু কিছু, পুজো নিয়ে, ভাসানের শোভাযাত্রা নিয়ে, এবছরে পুজো দেখতে চেয়ে আমি যা যা দেখেছি, তার বহু কিছুই। কিন্তু সবচেয়ে যে জায়গাটায় আমার ঝাড়টা নামছিল, সেটা আসলে আরও অনেকটা গভীর। সেদিন, সেই মুহূর্তে, ছেলেটাকে বাঁচানোর সময়েই আমি খেয়াল করেছিলাম, বড়সড় চেহারা, একটু গোলগাল, চোখে চশমা, আমার সঙ্গে কোথাও একটা মিল আছে। আমার চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু বছর চল্লিশেক বয়স হবে, তার মানে, আমার কোনও ভাই থাকলে তো এরকমই হত। আজকে এটা শোনামাত্রই আমার মনে এসে গেল, আমার শিশু বয়সে বাবাদের ইস্কুলে একটা মামলা চলছিল বলে বাবা বহুবছর মাইনে পায়নি। তাও তো বাবা টিউশনি করত, তাও তো মা, যদিও তখন অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ মাইনের, একটা চাকরি করত। তার পরও নিজেদের অভাবটা মনে পড়ছিল। মনে আসছিল, ওরও হয়তো ছেলে মেয়ে আছে। তাদের মুখগুলো গজিয়ে উঠছিল মাথার ভিতর। হয়ত, এর মধ্যে যদি সময় পাই, সোদপুরের ওদের ইউনিয়ন অফিসে যাবও একদিন।
কিন্তু এটা তো পুজো, এটাও পুজো। এই ছিঁচকে বদমাইসদের পুজো, একটা কাজের লোককে অকেজো করে দেওয়ার পুজো। সেই দশমী থেকে আজ কালীপুজোর আর কয়েকদিন বাকি, বাড়ির স-আয়িক লোকটা অনায়িক হয়ে যাওয়ায় বাড়ির বাচ্চাদের অপেক্ষা করে থাকার পুজো। সুস্মিত, তোর পুজোর ব্লগ এবারও শেষ হল না। অনেক কিছু লেখার আছে রে, অনেক কিছু। কিন্তু জানিনা কবে হবে, আদৌ হবে কিনা। তবু একটু তো হল।
October19, 2009
এটাই পুজোর ব্লগের শেষ লেখা। এমনটাই মনে হচ্ছে। কারণ কাল থেকে প্রবল কাজের চাপ। লেখার কাজ যতটুকু এগিয়েছে তার থেকে অনেকটা বেশি এগোনোর দরকার ছিল। তাই আর সময়ও হবে না। আজই শেষ এক টুকরো অবসর এই বকেয়া বিষয়টা শেষ করার। আমি কী দেখলাম এই বছরের পুজোর, বা, যেমন আগেই লিখেছি, আগে তো পুজোর অংশ হইনি কখনঐ, এমনকি পুজোর দর্শক হিসাবেও নয়, তাই আসলে পুজো ব্যাপারটাই আমি কী দেখলাম। আসলে আমি কিছুই দেখিনি মানে, দেখেছি অনেক শূন্যতা, আর শূন্যতা তো দেখা যায় না।
উল্টোদিক দিয়ে শুরু করা যাক। আজ সন্ধ্যাবেলা ফিরে এলাম কালীপুজোর দিনগুলো এক আত্মীয়বাড়িতে কাটিয়ে। ফিরে এসেই, মধ্যমগ্রাম স্টেশনে নেমেই পেলাম গাঁক গাঁক করে মাইকের আওয়াজ। তার পরে পাড়ায় ফিরে। শনিবার গেছে পুজো, আজ সোমবার, আজও বিরাট দাপটে ও গতিতে চলছে মাইক ও বাজি। এই কথা বোধহয় সকলেই কমবেশি বুঝতে পারছে এবার, সব এলাকারই, মানু আমায় বলল, খবরের কাগজেও লিখেছে।
আমার কলেজের এক সহকর্মী ফোন করেছিল। ওর বাড়ির কাছেই বস্তি, ও থাকে একটা সরকারি আবাসনে, সেটার মধ্যে কোনও পুজো হয়না, কিন্তু পিছনের বস্তিতে হয়। ওরও খুব আওয়াজে কষ্ট হয়, এইগুলো নিয়ে তাই অনেক কথাও হয়। আজও হল। শনিবার থেকে আজ পর্যন্ত, ও আমায় বলল, জানো দীপঙ্করদা, কোনও বাড়িয়ে বলছি না, অন্তত পঞ্চাশবার একটা সিডি চলেছে, আমার ফ্ল্যাটের থেকে ফুট কুড়ি গজের মধ্যে মাইক, তাই গোটা গানটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আমায় গানের কথাগুলূ বলল ও, আমি এখন লিখতে গিয়ে দেখছি ভুলে গেছি, ও ফুলির মা, ফুলিকে বলো না, সবার সঙ্গে ডেট মারে, আমাকে আর দেখে না ইত্যাদি। শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতি তো তাই বোধহয় একটু অপরিচিত গান। আমি ওকে জানালাম, ঐ একই অবস্থা সব ধরণের জীব ও জীবীদেরই, পরান যায় জ্বলিয়া রে আমাদের পাড়ায় চলছিল। এবং যে গানই চলুক, যাই চলুক, মন্ত্র বা গান বা গোষ্ঠীর পিণ্ডদান, সব কিছুতেই একই অবস্থা।
আমার এই সহকর্মীও নিজে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে, এই সব নিয়ে। ও একটা মজার জিনিসও জানাল, আগে সচরাচর অবাঙালীদের দিওয়ালি বাঙালী কালীপুজোর পরের দিন হত, কিন্তু এবারে একই দিনে পড়েছে, তাও বাজি ও আওয়াজ দুদিন ধরেই, আজ তৃতীয় দিনও চলছে, বাঙালীর উৎসব ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। আমি জিগেশ করলাম, তোকে লোকে কী বলল। ও বলল, জানো, অনেকেই বলল, একটা ফেস্টিভাল, সেলিব্রেট তো করবেই লোকে।
আমাকে প্রথমে আকৃষ্ট করল শব্দ দুটো। ফেস্টিভাল ও সেলিব্রেট। কথা হচ্ছে পুজো নিয়ে। পুজোর ধর্মের জায়গাটা যদি ছেড়েও দিই, সেখানে উৎসব নয়, ফেস্টিভাল। দ্বিতীয় শব্দটা প্রথম খুব চালু হতে দেখেছিলাম মদ্যপানের জন্য যুক্তি হিসাবে। এবং সেই ধারণাটাও এমন যে, আমার ছোটবেলায় যে বাঙালী অস্তিঙ্কÄ আমি চিনতাম, তার জানা-বোঝার পরিসর দিয়ে বোঝা যায় না। ফেস্টিভালও তাই। আমি যে আমার ইতিহাসকে জানি সেখানে এটা সতত সঞ্চরমান শব্দ ছিল না। একটা আমদানি। আমদানি তো তাই যা মূল অবস্থানে নেই এমন কিছু বাইরে থেকে আনা।
আমি ওকে বললাম, এই জায়গাটাই আমাকে অবাক করে, সেলিব্রেট করতে হবে কেন আলাদা করে? যদি আনন্দ থাকে, তা তো স্বপ্রকাশ হবেই। আনন্দ যদি থাকে, তবে তো নিজের বউয়ের সঙ্গে বারান্দায় বসে চা খাওয়াও তো চূড়ান্ত আনন্দিত অবস্থাকে হাজির করতেই পারে। এটা কারুর ক্ষেত্রে কখনও মদ্যপানকে আনতে পারে, বাজিকেও আনতে পারে, গানকেও নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু মূলটা কোথায়? আনন্দে। আর তাই যদি হয়, তাহলে বিশেষ কোনও কিছু একটাকে প্রয়োজন হবেই কেন? তার মানে প্রয়োজনটা ঐ জিনিসগুলোরই। আনন্দটাকে একটা বক্তব্য, একটা উপস্থাপনযোগ্য যুক্তি হিসাবে হাজির করছি আমরা। ও আমার এই যুক্তিটাকে সমর্থন করল। ও নিজে কিছুদিন আগে একটা মানসিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়কার কথা মনে পড়িয়ে বলল, মনে নেই, ঐ সময় আমি কেমন ছুতো খুঁজতে থাকতাম, যাই পেতাম তাই নিয়ে কখনো মাল্টিপ্লেক্স কখনো মল এই সব করে বেড়াতাম।
একটু পিছৈ। গত তিন চার দিন, কালীপুজোটা যেখানে কাটালাম আমার এক আত্মীয় বাড়ি। সেখানে নানা অতিথি অভ্যাগতদের সঙ্গে, বা কখনও আমরাও গেছি কারুর কারুর বাড়ি বা কোথাও, অনেকটা সময় কাটালাম। কী দেখলাম?
পুজো উপলক্ষেও একটা প্রতিযোগিতা। যার চূড়ান্ত ভাঁড় উদাহরণটা হল, একটি পুজোর মন্ডপে কুড়ি সেকেন্ডে সর্বোচ্চসংখ্যক ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা। এক, যদি কারুর মধ্যে ন্যূনতম ধর্মীয় অনুভূতিও থাকে, যেমনটা আমি দেখেছি আমার এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি, বীরভূমে, বাহিরি গ্রামে, শান্তিনিকেতনের কাছেই, কালীপুজোয়, সমস্ত মানুষ সামগ্রিক ভাবে যেন এক ভরগ্রস্ততায় চলে যেত, ঢোল বাজছে, কাঁসর বাজছে, সবচেয়ে বড় কথা, মানুষগুলোর চোখগুলৈ বদলে গেছে সেই মধ্যরাত্রে, এ আমি নিজে দেখেছি, সেই ধর্মীয় অনুভূতির খণ্ডমাত্রও যদি থাকত, তার কাছে তো এই গোটাটাই আপত্তিকর লাগত। আমায় যদি কেউ জীবনানন্দের জন্মদিনে ফুচকার প্রতিযোগিতায় নামতে বলে আমার যেমন লাগবে।
আমি সেই ধর্মীয় বাতাবরণের পক্ষে কথা বলছি না। আমি মোটেও পক্ষে নেই তার। সেই বলি, সেই রক্ত, সেই উন্মত্ততা। কিন্তু কথাটা হল এই যে, সেটা ভিন্ন। তার মানে ধর্মীয় অনুভূতি থেকে এটা ঘটছে না। তাহলে কী থেকে ঘটছে? আবার আমরা ফিরে এলাম সেই একই জায়গায় আনন্দের বেলাতেও যেমন শরীরটা লোপাট হয়ে গেছে, কিন্তু তার জ্বর হচ্ছে, হিসি পাচ্ছে, কপকপ করে খাচ্ছে।অএকটা শূন্যতা। আর তাকে ঘিরে আছে প্রচুর পূর্ণতার চিহ্ন।
এই চিহ্নগুলো আসছে কোথা থেকে আমরা গোটাটাই চিনি, আমি যে টিভি দেখি না, সেই আমিও, কোথাও গিয়ে টিভি বন্ধ করার আগের সময়টুকুতে, বা, কিছুতেই বন্ধ করায়, যতটুকু যতটুকু দেখে ফেলি, তাতেই দেখেছি, এবম্বিধ নানা প্রতিযোগিতা। এমনকি তা বাংলা সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদেও রসগোল্লা খাওয়ার প্রতিযোগিতা।
প্রতিযোগিতা শুধু ফুচকাতেই নয়। বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়দের মধ্যেও। একজন কেউ কারমেল নিয়ে কিছু বলল তো আর একজনের তাতে প্রতিক্রিয়া হল, কারণ তার ছানা পড়ে কারমেলে নয়, এবং অন্য কোনও নিকটাত্মীয়ের ছানা পড়ে কারমেলে। এই ছানাদের এবং ছানাদের বাবামায়েদের প্রতিযোগিতা নানা কিছুতেই পুজোয় কার কী পোষাক হল, কতটা মহার্ঘ, কোন রেস্টোরেন্টে, কতটা কুলীন, কারা কোথায় গিয়েছে। ইত্যাদি। কতকগুলি ব্রান্ডের মধ্যেকার প্রতিযোগিতা, যার শিকার হচ্ছে কিছু লোক যারা মনে করছে যে তারা পুজোয় আনন্দ পাচ্ছে। একটা কথা ঠিক, কিছু কিছু ছানাদের, সবকিছুর ভিতরই, আমি প্রবল উত্তেজিত হতে, আনন্দ পেতে, এবং পাগলামো করতে দেখেছি। কিন্তু সেই কথায় আমি একটু পরে আসছি। ওটা আরও একটু পিছিয়ে।
আমাদের পাড়ার ভাসানে গিয়ে, অন্য অনেক কিছুই দেখেছি, তার কিছু তো আগেই লিখেছি। আরও একটা জিনিস উল্লেখ করি এই প্রসঙ্গে। সেই মিছিলে, সে এক মহামিছিল হয়ে গিয়েছিল, এলাকার প্রচুর পুজোর ভাসানের মিছিলের সমান্তরাল এবং সমমুহূর্তিক উপস্থিতিতে। সেখানে আমার এক পরিচিত মহিলাকে আমি বারবার নেচে উঠতে দেখলাম। তাঁকে, তাঁর স্বামীকে, তাঁর সন্তানদেরও চিনি আমি। তার পারিবারিক অবস্থানটাও জানি, অত্যন্ত গড় একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের আর পাঁচজনের মত। একটু রূঢ়ভাষী, এছাড়া আর কোনও পরিলক্ষ্যনীয়তা তাঁর ভিতরে আমি কখনও নজর করিনি। মহিলাটি এবং তার ছেলেমেয়েরা ঐ একই মিছিলেই ছিলেন, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই নাচটায়, যেমন হয়, আর প্রায় কিছুই ছিল না সঙ্গমমুদ্রা ছাড়া, যে কোনও ফিল্মের নাচগান, টিভিতে যা দেখায়, সেগুলোয় যা দেখা যায়। এবং মাঝেমাঝেই তিনি হাতের ভুঁইপটকা মাটিতে আছড়ে ফেলে ফাটাচ্ছিলেন। গোটাটায়, ওনার সমস্ত ভঙ্গীগুলো মিলিয়ে, ছিল একটা সাবভারশন। সঙ্গতকে ফাটিয়ে ফেলে বেরিয়ে আসা নিরুদ্ধ সত্তার স্ফোরণ। সেটা আমার মজাই লাগছিল। এটাই আনন্দ? বোধহয় আমার এবারের এই গোটা পুজো অভিজ্ঞতায় এটাই আমার বয়স্কদের স্তরে একমাত্র খুঁজে পাওয়া।
বাচ্চাদের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। নবমীর দিনে আমার এক পুরোনো ছাত্রী, এখন বন্ধু, ফোন করেছিল। কী গো, কী করছ? আমি বললাম, তুই কী করছিস? বলল, জানো আমি শুধু বকা খাচ্ছি সবার কাছে। আমি বললাম, কেন, কী করেছিস? ও বলল, আমি করিনি, আমার মেয়ে করেছে। মানে, বকছে আমাকেই। আমি বললাম, কী হয়েছে। বলল, দেখো না, মেয়ের তো প্রবল ফূর্তি, শুধুই লাফাচ্ছে। আর আজ যা গুমোট, পাগলের মত ঘামছে, সন্ধ্যা থেকেই চার বার জামা বদলেছি। ঘটনাটা এই যে, সুন্দর সুসজ্জিত করে রেখে না দিয়ে ও কেন ওর মেয়েকে ওরকম লাফাতে দিচ্ছে এটা নিয়েই অন্যদের আপত্তি। ওর ন-বছরের মেয়েকে ও কেন সেই রকম সাজিয়ে রেখে দেবে না ও যেমন ওরা তাদের বাচ্চাদের রেখেছে।
আবার আমরা সেই একই জায়গায় ফিরে এলাম। আনন্দে মানুষ সাজে, সেই চিহ্নটা থাকলেই চলবে, আনন্দকে বরং মেরে দাও। ওকে আমি কী বললাম সেটা বরং পরে বলছি। তার আগে একদম পিছিয়ে যাই, সেই সপ্তমীর দিনে আমাদের পুজো ও ঠাকুর দেখতে গাড়ি চড়ে কলকাতায় যাওয়া এবং অ্যাম্বারে খেতে যাওয়ার গল্পে।
লিখতে গিয়ে যেটা খুব উল্লেখনীয় লাগছে প্রথমেই সেটা হল রাস্তায় জমে যাওয়া জ্যামে অজস্র যানের এবং যানের লোকেদের মধ্যে কী ভয়ঙ্কর নীচতা। একটি গাড়ির ভিতর একটি বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার গাড়ির লোক যখন তাদের গাড়িটা একটু পাশ কাটিয়ে বার করে নিতে চাইলেন, তখন অন্যান্যদের প্রতিক্রিয়া দেখলাম। একজন বললেন, বোসপুকুরের পুজোর এখানে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়ল ইত্যাদি। হতেই পারে যে ওটা সত্যি নয়, কিন্তু সত্যি কিনা জানিনা এই অবস্থায় এই পরিস্থিতিতে মানুষ কী আপত্তি করে? তার চেয়েও বড় কথা, কোনও আনন্দিত মানুষ? আনন্দে থাকাকালীন তার ঔদার্য তো বরং বাড়ার কথা? আমাদের নিজেদের গাড়ি নেই। আর গাড়িতে বা ট্যাক্সিতে চড়াটা আমার ঘটে নমাসে ছমাসে, তাই গাড়ি-আসীন মানুষের মানুষের জায়গা থেকে এই ঘটনার স্বাভাবিকতা বা অস্বাভাবিকতা কতটা তা আমি জানিনা।
(বাজির শব্দে রু কেঁপে ও কেঁদে ওঠার পর ওকে কম্পিউটারে সিনেমা চালিয়ে দিতে হল, তাই লেখায় এখানে একটু থামতে হয়েছিল।)
তারপরে দেখলাম, মানুষ খাচ্ছে। কী পরিমাণ যে মানুষ খেতে পারে, অবলীলায়, তার ধারণাটাই আমার বদলে গেছে ঐ দিনের পর। কী একটা ঘোরগ্রস্তের মত মানুষ খাচ্ছে। আমি কোনওদিন বিদেশে যাইনি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয় ইউরোপ আমেরিকায় উৎসবের সময় খাদক মানচিত্রটা ঠিক কী দাঁড়ায়। কারণ, আমার নিজর বিশ্বাস, সেদিন সেই উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত মানুষগুলোর মুখে হাতে চামচে প্লেটে আমি একটা তৃতীয় বিশ্বের দুর্ভিক্ষতাড়িত বুভুক্ষা দেখতে পাচ্ছিলাম। যেন টিভিতে একটু আগেই দেখে এসেছে মধ্যপ্রদেশের গোণ্ডরা কী ভাবে না খেতে পেয়ে মারা গেছে, এবং সেই স্মৃতি থেকে এরা সব খেয়ে যাচ্ছে।
খাওয়া নামক ক্রিয়ার সেই অঘোষিত প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আর একটা প্রতিযোগিতা দেখছিলাম, পোষাকের ও শরীরের প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা। হয়ত একটা মানেই অন্যটা। আবার সেই বুভুক্ষা। এবার খাদ্যের নয়, কামের।
আনন্দ কই?
খুব আনন্দিত অবস্থা মানে তো অভিলাষের পরিপূর্ণতার আরাম। এর এ তো শুধু অভিলাষের ও বাসনার আরও আরও অপরিপূরণ। তাহলে আনন্দ কোথায়?
আমার সেই ছাত্রীকে যা বলেছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি, আরও অনেকটা লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শেষহীন এই শব্দবাজি ও মাইকের অত্যাচারে শুধু রু না, আমিও কেঁপে উঠছি বারবার, এবং ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। আমি ওকে বললাম, তোর কী ধারণা, পুজো কেন হয়? ও বলল, কেন আবার হয়, পুজো তো হয়েই আসছে। আমি ওকে বললাম, না, পুজো হয় মিডিয়ার জন্যে। মিডিয়া প্রচার করে, আর এই মানুষগুলো এত শূন্য যে, সেই প্রচারের পরে এরা বিশ্বাস করে নেয় যে, এই এই এই
ক্রিয়াই হল আনন্দ। এই এই জিনিস কেনা, খাওয়া, পরা ইত্যাদি। তখন তারা তাই করতে থাকে, এবং এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করে নেয় যে তারা আনন্দ পাচ্ছে। তখন, ফলত, সবাই একই জিনিস বিশ্বাস করে নেওয়ায়, সেটাই আনন্দ হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র যে ক্রিয়াটা এই গোটাটায় তা হল আরও আরও বিক্রি। বাজির, মাইকের, খাবারের, পোষাকের, প্রসাধনের। আমি টিভি দেখলে মিলিয়ে মিলিয়ে বলতে পারতাম, কী কী বিজ্ঞাপনে কোন কোন জিনিস আসে। খেয়াল রাখিস, সংবাদ মানেও কিন্তু বিজ্ঞাপন, সংবাদ নামের বিজ্ঞাপন, অনুষ্ঠান নামের বিজ্ঞাপন, এবং বিজ্ঞাপন নামের বিজ্ঞাপন।
সঙ্কর্ষণ লিখেছিল, জয় হো সিরিজে কিছু লেখা উচিত।
জয় হো মানুষের পুজোর আনন্দের।
২৯শে মার্চ, ২০১০