আমি জাতব্যবসা ছেড়ে গান বাঁধি, কবিগান গাই। তাই ওরা আমার উপর রাগ করেছে।নিজের ডোম জাতের ভিতরকার বিরূপতার কথা বলা মাত্রই নিতাই বলে ওঠে ভদ্দরলোকদের মানে উঁচু জাতের বিরূপতার কথাও। তার এই দ্বিমুখী দ্বিধার কথা আমরা আগেও একাধিকবার উল্লেখ করেছি, সে আর শূদ্রও নেই, এবং উঁচুজাতও সে হয়ে ওঠেনি, এই নিরালম্ব বায়ুভূত অবস্থানটা চিহ্নিত করে একটা মাধ্যমিক অবস্থিতির কথা। যখন সে কোনও বর্গেই আর পড়ছে না। এবং নতুন অর্থ নতুন দৃষ্টি নতুন সংস্কৃতি জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে এই বর্গসঙ্করতার তাৎপর্যের কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি।
ভদ্দরলোকেরাও রেগে গেছে আমার উপর।
ওরে ব্যাটা, ডোমের ছেলে হয়ে মায়ের এখানে গান করতে পেরেছিস, সেই তোর ভাগ্যি।সাংস্কৃতিক স্তরে স্বীকৃতিটা এসেছে, এখনও বাস্তব অর্থে, অর্থকরী জায়গায়, টাকা ও পয়সার অঙ্কে বদলটা চিহ্নিত হতে কিঞ্চিত দেরি আছে। সংস্কৃতিতে বদলটা ঘটেছে, অর্থনীতিতে আসতে আরও একটু দেরি আছে।
তার উপরে আবার টাকা? বলিহারি ময়না, বুলি শিখেছিস ভাল। এবার মা চামুণ্ডাকে তোর টাকার জন্যে হ্যান্ডনোট লিখতে হবে, না?
মহাদেবদা তো ঠিকই বলিছিল, _সুবুদ্ধি ডোমের পো, কুবুদ্ধি ঘটিল_।খেয়াল করুন, মহাদেব কবিয়ালের মূল পংক্তি একটু বদলে গেছে এই উদ্ধৃতিতে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। গানের পংক্তি যখন মুখে মুখে ফেরে তখন এই ভাবেই সেটা বক্তার নিজের পংক্তি হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা আমার নিজের গদ্যের সাপেক্ষেও বেশ জরুরি একটা কথা। আমার গদ্যে শুধু বহু বাক্য নয়, এমনকি ধরতাই অব্দি অনেক জায়গায় তৈরি করেছি "সাতটি তারার তিমির' ঝাড়েবংশে লোপাট করে করে। লোকে বুঝতে চায়না গদ্যের নিচে নিচে সেই পংক্তিগুলো আসলে জীবনানন্দের না, আমারই লেখা। যাকগে, ও কথা ছেড়ে দিন। জায়গাটা দেখুন, এই "ভদ্দরলোক' শ্রেণীর কুলি খুঁজতে থাকা মানুষটি ইতিমধ্যেই একজন জ্যান্ত সম্পাদকও হয়ে উঠছেন। তিনি চয়ন করছেন সমগ্র কবিয়াল অনুষ্ঠান থেকে নির্বাচিত কিছু পংক্তি, এবং সেগুলো নিজের বাচনের মত করে বদলে নিয়ে তিনি প্রয়োগ করছেন।
হ্যঁ¡ রে নিতাই, মহাদেবদা তোকে কী বলছিল রে? _আস্তাকুঁড়ের এঁটো পাতা, সগ্গে যাবার আশা গো_, ও: হো।একটু আগে আমরা সাংস্কৃতিক বা আলথুসের কথিত দি কালচারালের কথা উল্লেখ করেছিলাম, গোটা সমাজ জুড়ে সাংস্কৃতিক ক্রিয়া বা রচনার অর্থ তৈরি হওয়া, সেই অর্থকে বার করে আনা, এবং সেই অর্থকে নিজের কাজে নিজের মত ব্যবহার করার জটিল ও বহমুখী পদ্ধতিটাকে আলথুসের নাম দিয়েছিলেন দি কালচারাল। আর ক্ষমতা তৈরি হওয়া, বার করে আনা, এবং সেটা ব্যবহার করার নাম দিয়েছিলেন দি পলিটিকাল বা রাজনৈতিক। রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকের নিবিড় পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও অতিনির্মাণের এর চেয়ে ভাল উদাহরণ যে কোনও ভাষার সাহিত্য বা চলচ্চিত্রেই বিরল। "মিথস্ক্রিয়া' শব্দটি কারুর কারুর কাছে অপরিচিত লাগতে পারে, তাই জানাই, "মিথ:' বা "মিথস্' শব্দের অর্থ ঋগ্বেদ, রামায়ণ বা অভিজ্ঞানশকুন্তল অনুযায়ী অনুযায়ী হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় করেছেন "১। সহ, অন্যোন্য, পরস্পর; ২। রহ:, একান্তে, নিভৃতে'। ওভারডিটারমিনেশন বা অতিনির্ণয় এই প্রক্রিয়ার সমার্থক শব্দ হিসাবে এই শব্দটা বেশ যায়, যদি আমরা প্রথম অর্থটা নিই, "পারস্পরিক ক্রিয়া' এই অর্থে। বাংলা ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র, রাজশেখর, রামেন্দ্রসুন্দর ইত্যাদি দুচারজনের আর কেউ যে তত্ত্বচর্চায় তেমন লিপ্ত হননি তার ফল ভোগ করতে হয় আমাদেরই, দর্শন-বিজ্ঞান-তত্ত্ব চর্চার সঠিক গদ্যই তেমন তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। এখানেও সেই একই সমস্যা, বাংলা ভাষায় লেখালেখি পড়ে কারা, ঘরের বৌয়েরা আর চাকরবাকরেরা। হুবহু মনে নেই কিন্তু প্রায় এরকমই একটা মন্তব্য ছিল বঙ্কিমের লেখায়। যে কোনও লেখায়, প্রবন্ধ হোক বা গল্প বা উপন্যাস, একটু বিশেষ অর্থে কিছু বলতে গেলেই শব্দ অকুলান হয়ে পড়ে।
আর তুই তার উত্তরে কী বললি? _উড়ুপ উড়ুপ উঁপ, খ্যাকোর খ্যাকোর উঁপ, চুপ রে বেটা মহাদেবা, চুপ চুপ চুপ_, আ: হা: হা:।
বিপ্রপদ হৈ হৈ করিয়া উঠিল-এই! এই! চোপ, সব চোপ!তারপর তাহাকে সম্বর্ধনা করিয়া বলিল-বলিহার ব্যাটা বলিহার! জয় রামচন্দ্র! কাল নাকি সত্যি সত্যি লঙ্কাকাণ্ড করে দিয়েছিস শুনলাম। ভ্যালা রে বাপ কপিবর।উপন্যাসের সঙ্গে এখানে চলচ্চিত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভেদ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এক, এখানে বিপ্রপদর ভূমিকায় অভিনেতা নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের শরীরে সঙ্কেতেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা নিতাইয়ের মুখের কথায় খেয়াল করিয়ে দিতে হয়েছিল তারাশঙ্করকে, "বাঁদর, উল্লুক, হনুমান, জাম্বুমান' ইত্যাদি। আর দুই, এটা আরও বড় একটা তফাত, রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিকের অভ্যন্তরীন মিথস্ক্রিয়াটা উপন্যাসে প্রায় অনুপস্থিত। একটু ব্যাখ্যা করে নেওয়া যাক। চলচ্চিত্রে ঘটনাটা ঘটছে একজন ভদ্রলোকের আদেশ কুলি নিতাই মানতে অস্বীকার করার পর। এবং সেখানে এই রামচন্দ্র-কপি পরিপ্রেক্ষিতটাও আর উচ্চারিত হচ্ছে না। উপন্যাসে যা হচ্ছে, বিপ্রপদর "রামচন্দ্র' "লঙ্কাকাণ্ড' ইত্যাদি উল্লেখে। অর্থাৎ, ধর্মের ডিসকোর্সে ভগবান ও ভক্তের প্যারাডাইমে বা গঠনে সেখানে আশ্রয় খুঁজে নিতে পারে নিতাই। "বাঁদর বা হনুমান' যেখানে রামচন্দ্রের এক ভক্তের নাম, মানে এক ধরনের একটা সম্মান আছে সেই সম্বোধনের। আর চলচ্চিত্রে সেটা না থাকায়, এবং পরপর দুই ভদ্রলোকের, মানে ক্ষমতার ক্রমবদ্ধতায় হায়েরার্কিতে নিতাইয়ের চেয়ে উচ্চাসীন দুজনের পরপর দুটি আক্রমণে এখানে বাঁদর-পরিপ্রেক্ষিতটা নিতান্তই অপমানজনক, তার থেকে নিস্কৃতির কোনও উপায় নেই। এবং, নিতাইয়ের নিজের গানের পংক্তিকে বিকৃত করে বানর-ডাকে পরিণত করা হচ্ছে। যেখানে, দুই ভদ্রলোকই মহাদেব কবিয়ালের পংক্তিগুলিকে তাদের ইচ্ছিত অর্থেই বজায় রাখলেন। এখানে সাংস্কৃতিকের উপর রাজনৈতিকের আক্রমণ অস্বীকার করার কোনও উপায়ই আর থাকছে না। অর্থাৎ, ক্ষমতার নির্মাণ/নিষ্কাশন/আত্মীকরণের প্রক্রিয়া, যার নাম রাজনৈতিক, সে অর্থ নির্মাণ/নিষ্কাশন/আত্মীকরণের প্রক্রিয়া বা সাংস্কৃতিককে নিজের মত করে বদলে দিচ্ছে, নিজের সুবিধা মোতাবেক চয়ন, সঙ্কলন, সম্পাদন করে, বা, এক কথায়, স্থানান্তর ঘটিয়ে ফেরত দিচ্ছে। আলথুসেরের এই তাত্ত্বিক কাঠামোর এর চেয়ে সুন্দর উদাহরণ আমি "কবি' চলচ্চিত্র দেখার আগে কখনও পাইনি।
আশ্চর্যের কথা, বিপ্রপদর পুরানো রসিকতায় নিতাই আজ অত্যন্ত আঘাত অনুভব করিল, মুহূর্তে সে গম্ভীর হইয়া গেল।
বিপ্রপদর সেদিকে খেয়াল নাই, সে উত্তর না পাইয়া আবার বলিল-ধুয়ো কি ধরেছিলি বল দেখি? "উঁপ! উঁপ! খ্যাকোর-খ্যাকোর উঁপ! চুপ রে ব্যাটা মহাদেবা চুপ চুপ চুপ' না কি? বলিয়া সে টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল।
নিতাই এবার হাত জোড় করিয়া গম্ভীরভাবে বলিল-আজ্ঞে প্রভু, মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, ছোট জাত; বাঁদর, উল্লুক, হনুমান, জাম্বুমান যা বলেন তা-ই সত্যি।
হ্যঁ¡! ভারি আমার বাম্মন। কই, এমনি মুখে মুখে বেঁধে গান করুক দেকি? আগে আমার সব্বাঙ্গ জ্বলে যায়, হ্যঁ¡।"কবি' উপন্যাস আর চলচ্চিত্র দুটোতেই এটা একটা জোরের জায়গা যে, ঠাকুরঝির নিতাইয়ের প্রেমে পড়া সবরকম অর্থেই একটা প্রেমে পড়া। চলচ্চিত্রে এর আগে মেলার দৃশ্যে মনে করুন, বৃন্দাবন ঠাকুরঝির মালা কেনার সখের কথা শুনে সস্নেহে জিগেশ করছে, ""মালা লিবি বউ?'' এবং ঠাকুরঝি তাতে আদুরে হাঁসের মত করে ঘাড় নেড়ে (আমি আদুরে হাঁস দেখিনি, বরং আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, কলেজ স্কোয়ারের একটি দুষ্কৃতী রাজহাঁস আমায় রীতিমত তাড়া করে এসেছিল, এবং কামড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু হাঁস আদুরে হলে ওরকমই করে এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত) সায় দিচ্ছে। উপন্যাসেও ছিল এই কথা। নিতাইকে রাজনের বৌ বলেছিল বৃন্দাবনকে নিয়ে।
-রঙ পেরায় গোরো, বুঝলে ওস্তাদ, তেমনি ললছা-ললছা গড়ন। লোকটিও বড় ভাল। দুজনাতে ভাবও খুব, বুঝলে!
(চা বানানোর পরে, নিতাই এবং ঠাকুরঝি দুজনেই চায়ে চুমুক দিতে যায়, এবং ঠাকুরঝির মনে পড়ে যায়, নিতাই সামনে রয়েছে এবং তখন সে উঠে দরজার আড়ালে গিয়ে চায়ে চুমুক দেয়।)ঠিক এই দৃশ্যটার কথাই আগে আমরা উল্লেখ করেছিলাম। লেখক তারাশঙ্করকে যেটা ঠাকুরঝির জবানিতে বলে বা ভেবে নিতে হয়েছিল, ঞ্ছমেয়েদের ভাল লাগার কথা নাকি বলিতে নাইঞ্জ, সেটা চলচ্চিত্রকার দেবকী বসু সরাসরি দর্শককে দেখিয়ে নিতে পারেন এই দৃশ্যটা দিয়ে, আলাদা করে কোনও বক্তব্য যোগ করার প্রয়োজনই পড়ে না। এবং মেয়েদের ভোগের প্রতি স্বত:ক্রিয়াশীল এই নিষেধের নিরিখেই আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঠাকুরঝির প্রতি নিতাইয়ের যত্নের ওই বিশেষ তাৎপর্যটা, যার আলোচনা আমরা আগেই করেছি। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে একটা তৃতীয় প্রবাহ হলে ভাল হয়। দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হয়েছিল ১৬ পাতার মাঝামাঝি প্রথমটাকে ভেঙে, আর এখন চলছে ৩৩। শুধু সেদিক দিয়েই নয়, নারী ঠাকুরঝির খুব স্পষ্ট আত্মঘোষণাগুলো এবার আসতে যাচ্ছে। এবং সেটা এতটাই উজ্জ্বল লাগে আমার যে বোধহয় একটা প্রবাহ-ভেদ এখানে ভালই যায়।