পানিয়াভরন গইলি ...আগেই উল্লেখ করে নি, অনেকবার শোনার ও দেখার পরেও এই গানটা আমি নিজে নিজে উদ্ধার করতে পারিনি। আমি সাহায্য নিয়েছিলাম আমার কলেজেরই হিন্দী বিভাগের সহকর্মী রেখা সিং এবং সূরজ শাহের। এই অভিজ্ঞতাটাই আমার খুব নতুন লেগেছে, একটা বাংলা ফিল্মে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভোজপুরি গান, এবং যা গাওয়া হয়েছে বেশ যত্নে ও সঠিক উচ্চারণে, ওরা দুজনেই আমায় বলেছে। সংক্ষেপে অনুবাদটা এরকম: জল আনতে গেল (নারী), বাঁধানো পাকা ইঁদারা থেকে, সব সখি ছেড়ে গেল, ওহে প্রেমিক। জলের ভাণ্ডটা তুলে দাও (মাথায়), তার ঢাকনাটাও দিয়ে দাও, খুশি মনে চলে যাও, ওহে প্রেমিক। ভোজপুরী লোকগীতিতে সিপহিয়া নাকি প্রেমিক, কেন, কী করে, কবে থেকে, এসব ওর আর আমায় বলেনি, কিন্তু আমি প্রচুর ঘাবড়েছি। ইংরেজ ফৌজে চলে যেত যে জঙ্গী প্রেমিক, তার জন্য গ্রামে রয়ে যাওয়া প্রেমিকা দু:খ করত? কোন যুদ্ধ? সিপাহী বিদ্রোহ, নাকি মেসোপটেমিয়া যুদ্ধ? কে জানে? যাকগে, কলস মাথায় নারী, সে তার প্রেমিকের সাহায্য নিতে চায় - একটুও কি চেনা লাগছে? আমাদের ফিল্মের সঙ্গে সম্পৃক্ততা যদি ছেড়েও দিই, রাধাকৃষ্ণ আলোচনার সঙ্গে এটার দূরত্ব শুধু দুধ আর জল। আর রাধাদের গোয়ালা ঘরে কী হয় আমরা সবাই জানি, তারা দুধে জল মেশায় না, মেশায় জলে দুধ। জলের একটা যোগান খুব জরুরি থাকে। যাকগে, একটা আলোচনা থেকে এভাবেই গজিয়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে অন্য নানা আলোচনা। সেটা ছেড়ে দিয়ে এই চলচ্চিত্রের নিরিখে এই ভাষাগত ঘটনাটার গুরুত্বের কথায় আসি।
এক দো তিন ...
পাকওয়া ইনারওয়াসে ...
পাঁচ, ছে, সাত, আট, ন, দস।
পাকওয়া ইনারওয়াসে
সব সখি ছোড়াকে গেলাই হো সিপহিয়া।
আরে ঘালাওয়া উঠায়ে দেহু
মোহাওয়া মিলায়ে দেহু
খুশিমনসে চলা যাহু ঘর হো সিপহিয়া।
ব্রিজের উপর ট্রেনের জানালা দিয়া কাশীর দিকে চাহিয়াই সে মুগ্ধ হইয়া গেল। বাঁকা চাঁদের ফালির মত গঙ্গার সাদা জল ঝকঝক করিতেছে - সমস্ত কোল জুড়িয়া মন্দির, মন্দির আর ঘাট, আরও কত বড় বড় বাড়ী। নিতাইয়ের মনে হইল মা গঙ্গা যেন চোখঝলসানো পাকা বাড়ীর কণ্ঠি গাঁথিয়া গলায় পরিয়াছেন। ট্রেনের যাত্রীরা কলরব তুলিতেছে-জয় বাবা বিশ্বনাথ-অন্নপূর্ণামায়ী কি জয়।বা, তার একটু পরেই,
... বাংলাদেশের শেষ হইতেই সে একটা অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিতেছিল। ট্রেনে ক্রমশই ভিন্ন-ভাষাভাষী ভিন্ন বেশভূষায় ভূষিত লোকের ভিড় বাড়িতেছিল।ভাষার ও রকমের এই ভিন্নতাটা নিতাইয়ের চোখে পড়ছে। যা পুরনো বাঙলা সাহিত্যে খুব বহুল নয় আদৌ, আমরা আগেই বলেছি। যেমন আমরা আগেই বলেছি, অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির সামনে এসেই একটা জাতি-পরিচিতি বা আইডেন্টিটি নিজেকে নিজে বলে চিনতে পারে, তার খুব চমত্কার উদাহরণ আছে "কবি' উপন্যাসেই, যখন এক ভাষাগোষ্ঠী অন্য এক ভাষাগোষ্ঠীকে, তার ভাষাকে, বুঝতে চেষ্টা করে। একদিন নিতাই গঙ্গার পাড়ে গেল। বসে বসে গান গাইছিল।
গান শেষ হইলে-অল্প কয়েকজন লোক, যাহারা শেষে আসিয়া জমিয়াছিল-তাহাদের একজন তাহাকে কিছু বলিল-তাহার বক্তব্য সম্পূর্ণ বুঝিতে না পারিয়া নিতাই সবিনয়ে বলিল-কি বললেন প্রভু? আমি বুঝতে পারতা নাই।এই হিন্দি ভজনকে ঘিরে নিতাইয়ের প্রতিক্রিয়াটা ছিলই। সেটা নিয়েই সে শুয়েছিল গভীর রাতে গঙ্গার পাড়ে।
একজন হাসিয়া বাংলায় বলিল-তুমি সবে এসেছ দেশ থেকে?
-আজ্ঞে হ্যঁ¡।
-উনি বলছেন হিন্দী ভজন গাইতে। তোমার এমন মিষ্টি গলা, তোমার কাছে হিন্দী ভজন শুনতে চাইছেন।
-হিন্দী ভজন? নিতাই জোড়হাতে বিনয় করিয়া বলিল-আজ্ঞে প্রভু, আমি তো হিন্দী ভজন জানি না।
বাঙ্গালীটি হিন্দী-ভাষী প্রশ্নকারী লোকটিকে যাহা বলিল, আন্দাজে নিতাই সেটা বুঝিল; বোধ হয় বলিল-হিন্দী ভজন ও জানে না।
জনতার অধিকাংশই এবার চলিয়া গেল। যেন তাহার মধ্যে উপেক্ষা ছিল বলিয়া নিতাইয়ের মনে হইল।
রাম কর্ত্তৃক সীতা এত কষ্টে পতিতা হইয়াও ভ্রমে কখন রামের অমঙ্গল চিন্তা করেন নাই, ইহার দ্বারা সীতার পতি পরায়ণতার একশেষ প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে অর্থাত্ ঈদৃশ নির্ম্মল প্রেম সংসারে অতি দুর্ল্লভ।দুই, জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে কুসংস্কার ভাঙা।
যে মনুষ্য বিদ্যোপার্জ্জন দ্বারা জ্ঞান ধর্ম্মে আত্মার উন্নতি সাধন করিতে যত্নবান হয়, এবং মৃত্যুকে উপস্থিত জানিয়া ও ঈশ্বরকে লক্ষ্য জানিয়া জ্ঞানাস্ত্র অবলম্বন করত সংসারের মোহরাশিকে জয় করিয়া জনসমাজে উন্নতিসাধন করণানন্তর ইহলোক হইতে অবসৃত হয় সেই প্রকৃত মনুষ্য নামের উপযুক্ত। ... কুসংস্কারাপন্ন স্বদেশস্থ ভ্রাতা ভগ্নীগণের হৃদয়ে সত্যধর্ম্মের জ্যোতি: বিকীর্ণ করিবার জন্য যিনি চিরজীবনের স্বাস্থ্যরূপ অমূল্য রত্নকে বিসর্জ্জন দিয়া দ্বারে দ্বারে ভ্রমণ করিতে ও সময় বিশেষে ধর্ম্মার্থে জীবন পরিত্যাগেও কাতর হয়েন না;"সত্যধর্ম্ম' এই শব্দটায় নিশ্চিত ভাবেই মিশনারি উপস্থিতি আছে। খেয়াল রাখবেন নিবাঁধই বালিকা বিদ্যালয় শুরু হয়েছিল বেথুনের হাতে। এটা যদি ছেড়েও দিই, অবশ্যই যে লিখছে, যে তাকে শেখাচ্ছে সেই শিক্ষক যার প্রচুর প্রশংসা আছে লেখাটিতে, এবং এই গোটাটা নিয়ে যে প্রতিবেদন লিখছে, এদের কারুর কাছেই উপরের এই দুটো জায়গার মধ্যে কোনও বিরোধ ছিল না। রামের প্রতি সীতার নিষ্ঠা এবং কুসংস্কার মোচনে জ্ঞানধর্ম এই দুটোকে এক সঙ্গে বয়ে নিয়ে শিক্ষিত হচ্ছে যে মেয়েটি, ১৮৬৭ সালে তার বয়স ছিল আট। তার মানে, ১৯১৫ সালে যখন মেসোপটেমিয়া যুদ্ধ শুরু হচ্ছে, তার বয়স তখন ছাপ্পান্ন। তার যদি ১৬ বয়সে বিয়ে ও ১৮-য় ছেলে হয়ে থাকে, তাহলে ছেলে জন্মেছে ১৮৭৭-এ, যার কুড়িতে ছেলে হয়ে থাকলে, ১৯১৫ সালে তার বয়স ১৮। তার মানে সে মেসোপটেমিয়া যুদ্ধে গিয়েই থাকতে পারে। যে পরিবারে শিক্ষার শুরু তার ঠাকুমা থেকে, সে নিশ্চিত ভাবেই জওয়ান বা কুলি হতে পারে না। আমাদের ওই ছবিতে যে ভারতীয় সহকারীরা রয়েছে সাহেব অফিসারের পাশে, তাদেরই কেউ সে হতেই পারে। যুদ্ধফেরত সে নিশ্চিত ভাবেই বাবু হয়েছিল, তাকেই কি আমরা দেখেছিলাম কবির লড়াইয়ের সভায়? শৃঙখলার প্রতি তার যেরূপ নিষ্ঠা তাদৃশ দৃষ্টে, এবং মেরুদণ্ড খাড়া করে তার বসার ভঙ্গীতে, এটাই মনে হয় যে তার কোনও ফৌজি ইতিহাস থাকলেও থাকতে পারে। উনি চরিত্রও বটে, আবার, যেমন আগেই বললাম, ছুটির দিন দুপুরে কাজ না থাকলে উনি পাঠকও বটে। হয়ত বাংলা উপন্যাস পড়ে তার অন্দরমহল এবং চাকরবাকরেরাই, কিন্তু যে পাঠক মাথায় রেখে তারাশঙ্কর লিখতেন, তিনি তাদেরই একজন। বাবু বিপ্রদাসকে মনে করুন, হেভি পড়তেন, তার লাইব্রেরিতে বন্দনা খেই হারিয়ে ফেলছিল প্রায়।