এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • দেবকী বসুর 'কবি' - একটি অটেকনিকাল পাঠ (নবম কিস্তি)

    ত্রিদিব সেনগুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সিনেমা | ২৫ এপ্রিল ২০১১ | ১৫৭৬ বার পঠিত
  • তৃতীয় প্রবাহ

    322
    00:32:54,200 --> 00:32:55,400
    My will.

    আমার মন।

    অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটি উক্তি, এবং অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। এবং সময় ও পটভূমি ভাবুন। যখন একটি নারীর ভোগের যে কোনও মুহূর্তও নিষিদ্ধ, তার সাপেক্ষে আসছে এই উক্তি। কোনও ব্যাখ্যা নেই, কোনও ভাবসম্প্রসারণ নেই। শুধু একটি উক্তি। এর আগের পরের নিতাই ও ঠাকুরঝির কথোপকথনটাকে খেয়াল করুন। বরং অভ্যস্ত অবয়বে যে ধাঁচটা আমরা পুরুষ ও নারী বলে চিনি এখানে ঠিক তার বিপরীতটা ঘটছে। যা জানে, তাই ফের ছল করে শুনতে চাইছে নিতাই, এবং স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন রকমে তা উচ্চারণ করছে ঠাকুরঝি। এর আগেও আমরা নারী-পুরুষের সম্পর্কে অভ্যস্ত ক্ষমতার মানচিত্রের একটা বদল এবং স্থানান্তরের কথা উল্লেখ করেছিলাম আমরা, কিন্তু ঠাকুরঝির এই ঘোষণাটা তার চেয়েও আরও অনেক নাটকীয়। সেই ঠাকুরঝি, যার পরিচয়ই ঠাকুরঝি, নিজের কোনও নামই নেই। এবং এই বিন্দু থেকে শুরু চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ নিজস্ব যাত্রা। যদিও তারও চিত্রনাট্য তারাশঙ্করেরই, তাই বলা কঠিন, এই পরিবর্তনের নিয়ামকটা আসলে কে। হয়তো দুজনেই। আমার ধারণা, দেবকী বসুর একটা খুব বড় অবদান আছে এখানে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারি না, কারণ দেবকী বসুর আর কোনও চলচ্চিত্রই দেখিনি আমি। অনেক বছর আগে একদিন দূরদর্শনে "বিদ্যাপতি' দেখছিলাম, মাঝখান থেকে, একটু দেখতে না দেখতেই লোডশেডিং হয়ে গেছিল।

    এবং এই আন্দাজটার কারণ ওই চলচ্চিত্রটার নাম, "বিদ্যাপতি', যা স্বাভাবিক ভাবেই একটা অত্যন্ত সক্রিয় অণ্বিষ্টতা টেনে আনে, বৈষ্ণব সাহিত্যের। এই জগতটা যে বিরাট তা আমি জানি, তার গভীরতাও কোথাও কোথাও অনুভব করি, অল্প জেনেই বা প্রায়-না-জেনেই যতটুকু অনুভব করা যায়। আর বাঙালি হয়ে, বাঙলা বিভিন্ন উপন্যাসে লেখায় অজস্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিহ্নে এই বোঝাটা চেয়ে বা না-চেয়েও এসে যায় খুব সততই। আমি বৈষ্ণব সাহিত্যে একটা বইই যত্ন নিয়ে পড়েছিলাম একসময়, কৃষ্ণদাস কবিরাজের, "চৈতন্যচরিতামৃত'। তাও "পড়েছিলাম' এই শব্দটাতেও একটা বোকা স্পর্ধা এসে যায়, এত বেশি জায়গা এত কম অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। এবং মজার কথা, "কবি' চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে আমার মাথায় গোড়া থেকেই বারবার আসছিলেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বাংলা ভাষায় যাকে প্রথম সার্থক গ্রন্থ-রচয়িতা বলে উল্লেখ করেছিলেন সুকুমার সেন, "চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের অধ্যায়ভাগ, গঠন ইত্যাদিকে মিলিয়ে। আর কৃষ্ণদাস কবিরাজের জীবনকাহিনী ভারি উত্তেজক। একজন খুব উঁচু মাপের নিতাইয়ের গল্প তাকে বলা যায় অনেকটা। কাফকার বহু প্রজন্ম আগে, চেকোস্লোভাকিয়া কেন, প্রুশিয়া জন্মেরও আগেই বোধহয়, নিজের লেখাকে নিজেই নষ্ট করে ফেলার দিকে যেতে হয়েছিল তাকে, গূঢ় বৈষ্ণব তত্ত্ব বাংলায় লিখে ফেলায় উঁচু-জাতের কুলীন বৈষ্ণবদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এতদূর গেছিল। আর কৃষ্ণদাস তো আদৌ কবিরাজ ছিলেন না। তিনি ছিলেন কৃষ্ণ দাস। যতদূর মনে পড়ছে তিনি ছিলেন নিচু জাত, বোধহয় কৈবর্ত, তিনি এসেছিলেন বৈষ্ণব পণ্ডিতদের ভৃত্য হিসাবে। তাঁর অলৌকিক সাফল্যের পরিচয়টা এখানেই যে লোকে তাঁর কাব্য ভালবেসে যে অভিধা দিয়েছিল, "কবিরাজ', সেটাই আজ তাঁর নাম হয়ে গেছে। ভেবে দেখুন, নিতাই হয়ত জানতও না কৃষ্ণদাস কবিরাজের নাম, কিন্তু নিতাই যা করতে চাইছিল তারই চূড়ান্ত একটা পারার দৃষ্টান্ত কৃষ্ণদাস কবিরাজ। সেই "চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের "রাধা-কৃষ্ণ' যুগল-রূপ বিষয়ক তত্ত্বগুলো মনে পড়ছিল আমার। চৈতন্যকে ঘিরে নারী-পুরুষ এই দুই সত্তার পারস্পরিক স্থানান্তর নিয়ে এত বেশি কিছু আছে সেখানে যে মাথায় না-আসাটাই অসম্ভব। গোটা চৈতন্য ডিসকোর্সেই আছে। কৃষ্ণবর্ণ কৃষ্ণের বিপরীতে রাধার মত গৌরবর্ণ গৌরচাঁদের ভক্তিতে নারী-আকার এবং পুরুষ-আকার দুয়েরই উপস্থিতি নিয়ে বহুকিছুই আছে বৈষ্ণব সাহিত্যে। নিতাই এবং ঠাকুরঝিকে ঘিরে যা যা নারী-পুরুষ অভ্যস্ত মানচিত্রের বৈপরীত্য ঘটছে তার একটা সূত্র হিসাবে খুব জোরালো ভাবেই আমার মাথায় আসছে বৈষ্ণব-সাহিত্যের কথা। এবং তাই "বিদ্যাপতি', এবং তাই দেবকী বসু। কিন্তু দুদিক থেকেই এই আলোচনায় আর অগ্রসর হওয়ার পক্ষে এই মুহূর্তে অযোগ্য আমি, দেবকী বসুও আর দেখিনি, এবং বৈষ্ণব সাহিত্যও কিছু জানিনা। বরং খুব কেজো একটা প্রাকৃত উদাহরণ দেওয়া যাক এই নিয়ে, এবং তাতে একটা আত্মসমালোচনাও থাকবে।

    অনিন্দ্য এবং আমি "কবি' চলচ্চিত্রটা দেখাকালীন একাধিকবার নিজেদের মধ্যেই, দুজনে দুজনকে বলেছি, রবীন মজুমদারকে কেমন অযৌন, অ্যাসেক্সুয়াল লাগছে বারবার। এর বিপরীতবিন্দুটা মাথায় এল আজ সকালে ব্যায়াম করতে করতে, এমপিথ্রি প্লেয়ারে বাজছিল "গীতগোবিন্দ'। চন্দ্রিল (ভট্টাচার্য) কিছু কিছু জিনিষ এমন মোক্ষম লেখে। প্রথম লাইনটাই হল, ""তোমাকে দেখাব নায়াগ্রা, তোমাকে শেখাব ভায়াগ্রা, তোমাকে করব আদরআত্তিযত্নম''। আদরআত্তিযত্নম, মানে যত্ন, আসছে বটে, কিন্তু সেটা নায়াগ্রা প্রপাত দেখানোর এবং ভায়াগ্রা ব্যবহার শেখানোর পরে, এবং দেখায় বা শেখায় তো পুরুষই। নায়াগ্রা ফলস দেখানোর উপমাটা এখানে অপ্রতিরোধ্য। আমার ক্লাস সেভেনের এক সহপাঠী আমায় বলেছিল, তখনকার চলচ্চিত্র-অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে বাংলা চলচ্চিত্রের একজন গাম্ভীর্য ও পৌরুষের প্রতীক বাচক অভিনেতা সম্পর্কে, জানিস, উনি হস্তমৈথুন করলে বীর্য হয় এক বালতি। তখন গাম্ভীর্যের সমাস ছিল "গামলা-ভর্তি-বীর্য'। পৌরুষ ও গাম্ভীর্যের সহাবস্থানটা তো বোঝাই যাচ্ছে, ওই অভিনেতার উপমায়, বাংলা চলচ্চিত্রের সূত্রে তিনি ছিলেন পৌরুষের প্রতীক। এই পৌরুষের পটভূমিতেই তৈরি হয়েছিল আমাদের পুরুষ মন। এর সাংস্কৃতিক ফলাফলটাও চিহ্নিত আছে চন্দ্রবিন্দুরই অন্য একটি গানের, "কেউ ভালবেসে', একটা লাইনে, ""সুচিত্রা কেঁদে মরে, উত্তম হেসে যায়, আর প্রেমরসে ডুবুডুবু সুতানুটি ভেসে যায়।'' ওই গাম্ভীর্য থেকে উত্তমের হাসি এটাও একটা পরিবর্তন, কিন্তু সেখানেও প্রেম ও রোমান্সের সূত্র ওটাই, অভিমানী নায়িকা কেঁদে যাবে, আর আত্মবিশ্বাসী নায়ক হেসে হেসে ভোলাবে। তবে উত্তমের হাসিটাও ছিল কিছু, সে কথা বলতেই হবে। এর একদম বিপরীত বিন্দুটা হল "কবি' চলচ্চিত্র, এটায় উচ্চকিত সশব্দ হাসি যে কবার আছে, সঙ্গে ছপণ কড়ি নিয়ে গুণতে গুণতে দেখবেন ফিল্মটা, সে সবকটিই হয় ঠাকুরঝি নয় বসন, রাজনও আছে, কিন্তু একবারও নিতাইয়ের নয়। বরং নিতাই মুচকি হাসি ছাড়া কিছু তো হাসেই নি, বহুসময়ই বেশ করুণ থেকেছে, প্রায় কাঁদো-কাঁদো। এবং, গোটা চলচ্চিত্রে, দুই নায়িকার একজনও, ঠাকুরঝি বা বসন, একবারও স্বাভাবিক আবেগ থেকে কাঁদেনি। ঠাকুরঝি একবার কেঁদেছে, সে ওঝার হাতে নির্মম মার খেয়ে, একদম শারীরিক বেদনার কান্না।

    এরকমই কোনও ছক, নিজের কাছে অসচেতন কিন্তু মাথার পিছনদিকে প্রবাহিত কোনও পৌরুষের বিম্ব থেকেই অনিন্দ্য বা আমি প্রতিকৃত হইনি তো - অনিন্দ্যর আর আমার বাল্য-কৈশোর সময়গত ভাবে অনেকটা পৃথক, কিন্তু বাঙলা সমাজ তার ভিতর অত কিছু বদলে যায়নি বলেই আমার মনে হয় - এই চিন্তাটা আমার মাথায় এল ঈপ্সিতার কিছু কথার সাপেক্ষে। যেদিন আমার বন্ধুর মেয়ে আত্মহত্যা করল, আমি খুব খারাপ ছিলাম, লিখতে পারলাম না আর, মেল পাওয়ার পরে ঈপ্সিতা ফোন করেছিল একাধিকবার, সেই সুদূর ওয়াশিংটন থেকে। আমি ছিলাম না, বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর আবার করল, ওরও খুব কষ্ট হচ্ছিল সংবাদটায়, এবং ওর কথায় ঠিক সেটাই হল, যেটা সবচেয়ে কাজ করে একটা মানুষ কষ্টে থাকলে, অন্য অনেকের একই রকম কষ্টের কথা মাথায় আসা। ও আমায় বলেছিল, দীপঙ্করদা তুমি গুণে উঠতে পারবে না, কত এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে রোজ, সব খবরও তো আসে না। ওর কথা শুনতে শুনতে আমার মাথায় আসছিল গোটা বাস্তবতাটা। নিজের মেলটার কথা মনে পড়ল, সেখানে ওর আত্মহত্যার কথা বলার পরেই যোগ করে দিয়েছিলাম, ও ছিল সমকামী। এবং এই বাক্যাংশটুকুই কী অদ্ভুত এবং নির্মম ভাবে পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করে দিল। ""ওর এই মেয়ে ছিল সমকামী, তাকে নিয়ে অনেক চাপ নিতে হত ওকে, ওদের পরিবারকে, আমার এই বন্ধুকে'' - ঠিক এই বাক্যটাই লিখেছিলাম, আর কাউকে ব্যাখ্যা করতে হয়নি কী চাপ কেন চাপ ইত্যাদি। অথচ ও আমার বন্ধুর মেয়ে, তার যৌন-অভ্যাস একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়, তা তো আমার কাছে প্রাসঙ্গিক তথ্য হয়ে ওঠার কথা নয় আদৌ। আমি তো অসভ্যতা আকারে করিনি, আমার বা অন্যের কাছে এটা প্রয়োজনীয় তথ্যই হয়েছিল পরিস্থিতিটাকে বোঝার, অথচ গোটাটা কী ভয়ঙ্কর একটা সামগ্রিক অসভ্যতার উপর দাঁড়িয়ে আছে। অসভ্যতা, নির্মমতা। সেই রাতে আমার বন্ধুর বাড়িতে যে গেলাম, সেখানেও বেশ কিছু বেদনার উপাদান ছিল, যাকগে।

    এদিন অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম ঈপ্সিতার সঙ্গে, ফোনে। কথা বলতে একটা আরামও পাচ্ছিলাম। ততক্ষণে, ওদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে, আমার একটু স্বাভাবিকও লাগছিল। আমরা কথা বলছিলাম এই নির্মম অসভ্যতা নিয়েই। ও বলছিল, ও নারী-পুরুষ এই দুই পরিচিতি, তার নানা সমস্যা, পরিচিতি পরিবর্তনের আকাঙ্খা বা বেদনা, তাদের বিভিন্ন যৌন অভ্যাস, তার উপরে সামাজিক অত্যাচার - এগুলো নিয়ে ও লেখে এই কারণে ওর ওয়েবসাইট বা পত্রিকার বন্ধুরা কেমন পরিহাসমূলক কটাক্ষে বলে থাকে, এটা তো হিজড়েদের সাইট, বা হিজড়েদের পত্রিকা, ইত্যাদি। এগুলি পরিহাস, কিন্তু তার মধ্যে তো আক্রমণের রক্তাক্ততা একটুও কম থাকে না। অনিন্দ্য বা আমি, আমরাও তো পরিহাসই করছিলাম, কিন্তু আসলে এগুলো ওরকম কোনও পৌরুষশালী অবস্থানের অভ্যন্তরীণ হিংস্রতা বেয়ে আসেনি তো? যে অবস্থান আমাদের মধ্যে ঢুকে এসেছে আমাদের বাল্যে কৈশোরে, চিন্তা নিয়ে চিন্তা শুরু করার অনেক আগে থেকেই। সেই অবস্থানই তো বারবার বারম্বার ঘুরে ঘুরে আসে আমাদের সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, জনপ্রিয় বিম্বে। নায়িকারা কাঁদে, নায়কেরা হাসে। যে নায়ক যে নায়িকাকে পৌরুষ দেখিয়েছে, এবং যৌনতা শিখিয়েছে। "কবি'-র ঠাকুরঝি ও বসন, নিতাইয়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, এই অবস্থান থেকে বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি জাগিয়ে তোলে বেশ কিছুবার, চলচ্চিত্র চলাকালীন। এবং যেমন বলেছি, উপন্যাসে হয়ত এর ভ্রূণটা ছিল, কিন্তু এই যাত্রাটা একান্তভাবেই চলচ্চিত্রের। ঠাকুরঝি বলেছিল ""আমার মন'', কিন্তু আজও কটা মেয়ে সেটা বলে উঠতে পারে, বা বললেও শোনে সবাই, শুনে উঠতে পারে? আমার ঘোর সন্দেহ, "কবি' চলচ্চিত্রে অভ্যস্ত অবস্থানের এই বৈপরীত্য এসেছিল শুধু বদলাতে থাকা সময়ের প্রভাবে নয়, বাঙলার সনাতন সংস্কৃতি, বৈষ্ণব সাহিত্য ইত্যাদি এখানে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। সেটা কাজ করেছিল তারাশঙ্করের অভ্যন্তরেও। শাক্ত ও বৈষ্ণব এই দুই আলোচনার, ডিসকোর্সেরই একটা বেশ বড়, জটিল, বহুস্তরিক এবং নিবিড় সম্পর্ক আছে "কবি'-র "কবি' হয়ে ওঠায়। কিন্তু সেই বিশ্লেষণের যোগ্যতাও আমার নেই, এবং এটা বোধহয় তার জায়গাও নয়।

    323
    00:32:56,500 --> 00:32:57,200
    Your will?
    324
    00:32:57,350 --> 00:32:59,500
    Yes, my will. So what?
    325
    00:33:01,600 --> 00:33:08,800
    I was thinking: If I became a kabial,
    Why I came from a low caste?

    তোমার মন?
    হ্যঁ¡, আমার মন। তো কী?
    আমি ভাবছি ঠাকুরঝি, আমি যদি কবিয়াল হলাম তো নীচ কুলে জন্মালাম কেনে?

    খেয়াল করুন, ঠাকুরঝির কাছ থেকে ""আমার মন'' এই উত্তর এসেছিল নিতাইয়ের প্রশ্নেই। তারপর, উত্তরটা ঠিক শুনছে বা বুঝছে কিনা তা বুঝতে, নিতাই ফের প্রশ্ন করল, ""তোমার মন?'', তাতে আবার উত্তর দিল ঠাকুরঝি, ""হ্যঁ¡, আমার মন। তো কী?'' মন মানে ইচ্ছা, বাসনা। নারীর এই উন্মুক্ত বাসনার সামনে অস্বস্তিগ্রস্ত, নিরুত্তর হয়ে পড়ছে নিতাই। সে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছে নিয়তির বাধ্যতার প্রশ্নে। বাসনা পরিপূরণের পথ যে নিয়তির দ্বারাই অবরুদ্ধ সেই জায়গায় সরে যাচ্ছে। ব্যক্তি নিতাই এই উত্তরের ঘাতটা নিজের দিকে আসতেই দিচ্ছে না। এর পরের বাক্যগুলোতেও সেই নিয়তি-বিষয়ক পথেই এগোচ্ছে কথোপথন। আমি এর সাথে বেশ মেলাতে পারি পুরুষের ব্যক্তিগত অস্বস্তিকে। এত দেখেছি, এত দেখি আমরা চারপাশে, নারীর উন্মুক্ত বাসনার চোখে তাকাতেই পারে না পুরুষ অবস্থান। নারীর বাসনা উন্মুক্ত হলেই সে হয়ে যায় ছেনাল, বা ডাইনি, বা ওইরকম কিছু। পুরুষ অবস্থান এই ছকটাতেই অভ্যস্ত যে বাসনাটা তার নিজের দিক থেকেই জাগবে, নারী সেটা পরিপূরণ করবে, বা আরও সঠিক ভাবে বললে, নারীর আধারে সেটা পরিপূর্ণ হবে। নারীর বুক থেকে দুধ খেয়ে তার বাসনার জন্ম হয়েছিল, নারীর যোনিতে তার বাসনার পরিপূরণ। সে পুরুষ যখন বাসনাগ্রস্ত হয়, নারীশরীর থেকেই সেই বাসনার পরিতৃপ্তি। নারী এখানে নারীশরীর। যেই নারীশরীর শুধু শরীর রইল না, তার একটা সত্তা স্পষ্ট উচ্চারিত হল, যে সত্তার নিজস্ব বাসনা আছে, তার সঙ্গে আর কথোপকথনেই আসতে পারছে না পুরুষ অবস্থান।

    ঠাকুরঝির স্পষ্টতার ধারেকাছেও নয়, তবু একরকম একটা উচ্চারণ আসবে নিতাইয়ের, নিজের ইচ্ছার। অনেক পরে। ঠাকুরঝির উপর ওঝার অত্যাচারের তীব্র সঙ্কটের মুহূর্তে, রাজনের প্রশ্নে, সে উত্তর দেবে, হ্যঁ¡, সে ঠাকুরঝিকে ভালবাসে, কিন্তু সেই বাক্যেও থাকবে একটা "কিন্তু'। এই "কিন্তু' বেয়ে সে চলে যাবে, "জাত', "ঘর' ইত্যাদি প্রশ্নে। তার নিজের বাসনার একটা পরোক্ষ উল্লেখ থাকবে, যখন নিতাই রাজনের কাছে বলবে, বৃন্দাবনের ঘর সে ভেঙে দিতে চায় না, তাহলে বৃন্দাবনের বুকে সেই একই ব্যথা বাজবে, যা তার নিজের হচ্ছে। এই বেদনা হচ্ছে কেন? বাসনা অপরিপূরণে। তাই এই ভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে নিতাইয়ের বাসনা। কিন্তু তাও দেখুন, "জাত', "বিয়ে' বা "ঘর' ইত্যাদি সামাজিক ভাবে প্রদত্ত ধারণার নিরিখে। মুক্ত স্বতন্ত্র একটি ব্যক্তির নির্জলা বাসনার আকারে, যে ভাবে এসেছিল ঠাকুরঝির উচ্চারণ, আদৌ সেটা আসে না পুরুষ-অবস্থান থেকে। এই জায়গাটা বারবার ভাবায় আমায়, সামাজিক অভিজ্ঞতার নিরিখেও। আমার মনে হয়, সিমোঁ দ বোভোয়ার নিতান্ত ভুল দিয়েছিলেন বইয়ের নামটা। নারী সেকেন্ড সেক্স নয়, ফার্স্ট সেক্স। প্রথম লিঙ্গ নারী। যেখান থেকে নারী বা পুরুষ দুই লিঙ্গই জন্মায়। আমার ভীষণ ঈর্ষা হয় নারী অবস্থানকে, যে জন্ম দেওয়ার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। একটিও মৌলিক পুরুষ অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা নেই যা নারীর হতে পারে না কিছুতেই। কিন্তু দুটি মৌলিকতম অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি নারীর আছে যা কিছুতেই পুরুষের হতে পারে না। এক, গর্ভধারণ ও জন্ম দেওয়া। আর দুই, স্তন্যপান করানো। আমার নিজের ভিতর এই নিয়ে একটা বিষণ্নতাও বোধহয় আছে, যার একটা ছায়াপাত ছিল, যতদূর সম্ভব, "সোনার গল্প' নামে আমার একটা আখ্যানে (http://ddts.randomink.org/bangla/bn-stories.html)। এসব নিয়ে বহু কিছু মাথায় আসে আমার। ভাইস-ভার্সা নামে মার্জরি গার্বরের একটা বইয়ের সূত্রে তা লিখবও ভেবেছিলাম একসময়, লেখা হয়ে ওঠেনি। যাক গে। "কবি'-র কথায় ফেরা যাক।

    নিতাই কবিয়াল, মানুষ হিসাবেও তার একটা মূল্যবোধ আছে। তাই ঠাকুরঝি তার কাছে ডাইনি হয় না, এমনকি ওঝা ডাইন-শাসনের চিকিৎসা করার পরেও। সে হয়ে যায় চাঁদ, "চাঁদ তুমি আকাশে থাকো/ আমি তোমায় দেখব খালি/ ছুঁতে তোমায় চাইনা ওহে চাঁদ/ তোমার সোনার অঙ্গে লাগবে কালি' এই গান গাইতে গাইতে সে গ্রাম ছেড়ে বিদায় নেবে। হয়তো এই আকাশের উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়াটাও এসেছিল সেই শাক্ত যোগাযোগে, শক্তি-উপাসনার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত রকমেই। শক্তি উপাসনা নিতাইয়ের কাছে ভারি মহিমার একটা জায়গা, ভক্তির। এমনকি ঝুমুরগানের আসরের মত বেমানান জায়গাতেও, মদ খেয়ে অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্ত অব্দি সে গেয়ে গেছে "ক-এ কপালিনী, খ-এ খপ্পরধারিনী' ইত্যাদি মাতৃকা নামের গান। এবং এই উচ্চতায় তুলে দেওয়ার মধ্যেও পুরুষ অবস্থান থেকে অভ্যস্ত যৌনতার সেই মৌলিক অবস্থান একটা ছায়া ফেলে। পুরুষ নারীর সত্তার সঙ্গে কথা বলতে পারে না, নারী তার কাছে শরীর মানে বস্তু হয়ে আসে, কারণ তার কাছে বাসনা মানেই শরীরের প্রতি বাসনা, সত্তার প্রতি নয়। তাই শরীরি মলিনতা দিয়েই তাকে নিজের দূরে চলে যাওয়াকে ব্যাখ্যা করতে হয়, দ্বিতীয় ভাগের ১২ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে গিয়ে, "ছুঁতে তোমায় চাই না ওহে চাঁদ/ তোমার সোনার অঙ্গে লাগবে কালি।' (এই গানটা "চাঁদ তুমি আকাশে থাকো', দ্বিতীয় ভাগের ১২ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে শুরু, গোটা "কবি' চলচ্চিত্রে আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত, এবং শুনতে গেলেই মনে হয়, রবীন মজুমদার ছাড়া আর কেউ পারত এটা গাইতে?) এই চাঁদ ও কলঙ্কের একটা প্রেক্ষিত তার আগেই থাকবে নিতাই ও ঠাকুরঝির কথোপকথনে। ঠাকুরঝিকে নিতাইয়ের দেখতে থাকার সূত্রে প্রথম ভাগের ৫৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের শেষদিকে আসবে "চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে বলে/ কে দেখে না চাঁদ?' অর্থাৎ, এই চাঁদ ও সম্পৃক্ত কলঙ্কের প্রসঙ্গে পিতৃতন্ত্র ইতিমধ্যেই সদাসর্বদা উপস্থিত - সেই প্রশ্ন, লোকে কী বলবে? এই লোক শব্দটা তো সত্য অর্থেই একটা প্রতীকী উপস্থিতি।

    ঠাকুরঝির সঙ্গে নিতাইয়ের এই চালু কথোপকথনেই, এর পরের বাক্যগুলিতেই, খেয়াল করুন, যে স্বীকারোক্তি এত অনায়াসে আসে ঠাকুরঝির কাছ থেকে, তা কিছুতেই বলে উঠতে পারে না নিতাই। ঠাকুরঝি তার জন্য রাগ করে, অনুনয় করে, অভিমান করে। কিন্তু নিতাই তার নিজের সঙ্কোচ ছেড়ে বেরোতে পারে না। এটাও আমাদের অভ্যস্ত পুরুষ-নারী রকম থেকে খুবই আলাদা, প্রেম ও প্রেমের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে, যা ঘটে থাকে। এবং সাহিত্য বা চলচ্চিত্র তো নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেই চায়, তার মানে, জীবনে যা ঘটে থাকে, বা, সঠিক ভাবে বললে, জীবনে যা ঘটে থাকে বলে পাঠক-মন বা দর্শক-মন যা বিশ্বাস করে। ঠাকুরঝি চলে যাওয়ার আগে শেষ অব্দি সেটা বলে কবিয়াল, সেটা শুনে নেওয়া যাক।

    336
    00:33:50,300 --> 00:33:56,700
    You and me - we were both born.
    But, why born to different castes?

    তুমি আমি সংসারে জন্মালাম, তো ভিন্ন জাত হয়ে জন্মালাম কেনে?

    এই প্রশ্নের পর দুজনেই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকে, এবং তার মধ্যেই ফ্রেমের বাইরে থেকে অফ ভয়েসে রাজনের গলা ভেসে আসে, সে নিতাইকে ডাকছে। নিতাইয়ের প্রশ্নটাকে খেয়াল করুন, প্রশ্নটাই বদলে গেছে। ভিন্ন জাতে জন্মালে প্রেম থেকে বঞ্চিত হওয়াটাই নিয়তি, এটা সে মেনেই নিয়েছে। সে ইতিমধ্যেই নিজের প্রেম থেকে সরে গেছে, সরে গেছে নিজের জন্মে, নিজের জাতে। সে ভাবছেও এই জন্ম ও জাতে বর্গীকৃত বাস্তবতা দিয়েই। চারপাশের পিতৃতন্ত্রের বাস্তব শুধু আর নিতাইকে শাসন করছে না, শাসন করছে নিতাইয়ের চিন্তাকেও। নিজের ব্যক্তিগত আবেগ ও শরীরি অনুভূতি দিয়েও সে আর তার বাইরে যেতে পারছে না। নিজেকে নিজের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রেও সে ঠাকুরঝির চেয়ে দুর্বল। এই দুর্বলতা এসে থাকতে পারে তার নড়বড়ে জাতি-অবস্থান থেকেও। সে জাতিতে ডোম, কিন্তু হয়ে উঠতে চাইছে কবিয়াল, যা ঘটে উঠতে পারে একমাত্র ওই পিতৃতন্ত্রের মধ্যস্থতাতেই।

    এখানে নিতাইয়ের এই অস্পষ্টতা আর একটা সূত্র থেকেও এসে থাকতে পারে, সেটা লেখক তারাশঙ্করের চিন্তা ও সমাজ বাস্তবতার দর্শন, এবং তার সাপেক্ষে তার নিজের অবস্থানকে তিনি কী ভাবে দেখতেন। এর একটা ইঙ্গিত আমরা আগেও দিয়েছি, ওই কবি ও পোয়েট শব্দের তুলনার সূত্রে। আমার নিজের যা মনে হয়েছে বৈষ্ণব সাহিত্যে তথা লোকাচারে একটা বিরাট অধিকার ছিল তারাশঙ্করের, যার প্রমাণ ছত্রে ছত্রে রয়েছে তাঁর ছোট গল্পগুলিতে। এবং এত রক্ত মাংসে জীবন্ত সেগুলো। নিচু জাতের মানুষদের বিষয়ে তার প্রত্যক্ষ জ্ঞান তাকে ওই অধিকার দিয়েছিল, সেই বাস্তবতা যা সব সময়েই পিছলে যেতে থাকে পিতৃতন্ত্রের কাঠামো থেকে। এবং বাংলার এই নিচু জাতের মানুষের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্মের একটা প্রসার ছিল। দীনেশ সেনের বৃহৎ বঙ্গে যেমন আছে, ব্রাহ্মণ্যের অত্যাচারে যারা বৌদ্ধ হয়েছিল, তারাই পরে বৈষ্ণব হয়, এবং তাদেরই একটা বিরাট অংশ পরে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। মুসলিম ধর্মের সঙ্গে মুণ্ডিত মস্তকের কোনও সম্পর্ক না থাকার পরেও, হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমদের "লেড়ে' বা "নেড়ে' ডাকার এটাই বোধহয় ব্যাখ্যা। এর আগে ম্যাথরানি তথা মেথর শব্দেও এই প্রসঙ্গটা একটু এসেছিল। আমার সেই কৈশোর বয়সেও তারাশঙ্করের সাহিত্য অনেক বেশি জীবন্ত লাগত, শরত্‌চন্দ্রের অন্নদাদিদি, সব কিছুর পরও, মুসলিম হয়ে জীবন কাটানোর পরেও, স্বামীর মৃত্যু হওয়া মাত্র ফিরে যায় হিন্দু ধর্মের আচার-ব্যবস্থায়, কিন্তু তারাশঙ্করের রাইকমল বা বেদেনীদের চিরকালই এর চেয়ে অনেক বেশি জ্যান্ত লাগত। তারাশঙ্করের লেখায় বৈষ্ণব ধর্মের উন্মুক্ততাটা সব সময়েই অনেক বেশি রক্ত মাংসের একটা রূপ নিয়ে আসত। একদিকে সেই উন্মুক্ততা, অন্য দিকে সমাজের ক্ষমতার হাত ধরে কবিয়াল হয়ে ওঠার টান, এই দুইয়ের মধ্যে একটা লড়াই ইচ্ছে করেই রেখেছিলেন তারাশঙ্কর, এটা একটা ব্যাখ্যা। এটা হতেও পারে, কারণ, এই উপরের কথোপকথনটা একান্তই চলচ্চিত্রের নিজস্ব, কিন্তু প্রায় এই একই টানাপোড়েন ছিল উপন্যাসেও। এটা হতে পারে, কিন্তু আমি এটায় খুব বেশি জোর পাই না। ইচ্ছে করে যদি নিতাইকে অমন নড়বড়ে করতেন তারাশঙ্কর, তাহলে সেটা অনেক বেশি উচ্চারিত হত বলেই মনে হয়। আর প্রায় একই রকম একটা সাংস্কৃতিক নড়বড়েপনার শিকার হিসাবে তারাশঙ্করকেই আমরা আলোচনা করেছি ওই কবি-পোয়েট সূত্রে।

    আর, আর একটা দ্বিতীয় ব্যাখ্যাও থাকতে পারে। যেটা আর একটু অস্বস্তিকর। সেটা হল, সমাজ কাঠামো ও ক্ষমতার পিতৃতন্ত্রের সাপেক্ষে তারাশঙ্করের নিজের অবস্থান, এবং সেটাকে নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য করে তোলার মত একটা সমাজ দর্শন, যা তারাশঙ্কর নিজের মধ্যেই বানিয়ে তুলেছিলেন, তার সঙ্গে শিল্পী হিসাবে তার দেখা অনুভব করা ও বোধের লড়াই। নিজে বহুকিছু দেখছেন, অথচ দেখতে চাইছেন না, অন্য কিছু তাকে দেখাতে হবেই, তার সামাজিক অবস্থান তাকে সেই দিকে নিয়ে যাচ্ছে, এই দুয়ের মধ্যেকার একটা কাটাকুটি। "অশ্লীল' শব্দের সূত্রে সেটাও আলোচনা করেছি আমরা। এবার নিতাইয়ের দিকে তাকান, সে তার দেহের সংকেতের বাইরে চলে যাচ্ছে, নিজের ব্যক্তি আবেগকেও অস্বীকার করছে। অথচ, ওইরকম নিবিড় একজন শিল্পী হয়ে তারাশঙ্করের এটা চোখে না পড়া অসম্ভব যে জাত কিভাবে ভাঙে, জ্যান্ত রকমে জ্যান্ত যৌনতায়। কোথায় পড়েছিলাম মনে করতে পারছি না, কোনও নৃতত্ত্বের বই, ডেভিড স্ট্যানার্ড হতে পারে, পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও কখনও টানা একটা প্রজন্ম বা পঁচিশ বছরও কাটেনি যে দুই নরগোষ্ঠী পাশাপাশি থেকেছে অথচ রক্তমিশ্রণ ঘটেনি। এই তারাশঙ্করেরই গল্পগুলো ভাবুন, বা "গণদেবতা' "পঞ্চগ্রাম' ইত্যাদি। সেই কাহারদের ঘরে ফর্সা ফর্সা বাচ্চার কাহিনী, বা সেই দুর্গা, দুর্গাই তো, গ্রামের নিজস্ব বেশ্যা, যার সঙ্গে পুলিশেরও যোগাযোগ ছিল, ছিরু পাল একমাত্র যাকে ভয় পেত। তাহলে নিতাই কেন একবারও পারল না তার নিজের যৌনতার প্রতি সৎ হতে? সে কিছু মূল্যবোধ বহন করছে, যা থেকে চ্যুত হলে ব্রাহ্মণ্যের পিতৃতন্ত্র তাকে আর "কবিয়াল' করবে না, নাকি এ আরও গভীর কিছু। নিতাইয়ের সঙ্গে নিজের কাছে নিজের লেখক-পরিচিতি, বা আইডেন্টিটি, একভাবে সংযুক্ত হয়ে যাওয়ায় তারাশঙ্করেরই কোনও সামাজিক অবস্থান, যা কোথাও একটা জাতপাতের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার অবস্থানকে সমর্থনই করে? একটু দেখে নেওয়া যাক উপন্যাস থেকে।

    উপন্যাসে আছে, ঝুমুর দলে যোগ দেওয়ার এবং সেখানে ঝুমুরগানের কবিয়াল হিসাবে সাফল্যের পরপরই নিতাই একদিন গেল রাধাগোবিন্দ মন্দিরে। চলচ্চিত্রেও খেয়াল করবেন, নিতাই ঝুমুরদলে যোগ দিতে এসেই, সেই মুহূর্তেই, জিগেশ করেছিল, কাছাকাছি কোনও রাধাগোবিন্দের মন্দির আছে কিনা। তারপরে একটা মন্দিরে তার একটা গানও ছিল, "প্রেমের কাজলকালো রাধার নয়নচাঁদে, ধরিতে হিয়ার মাঝে আমার পরান কাঁদে'। সেখানে গায়ক নিতাইয়ের কাছেই একজন মহান্তও দাঁড়িয়ে ছিলেন আব?ছায়া অন্ধকারে। আমার ধারণা, এর পরে, উপন্যাস থেকে যে অংশটা আমরা তুলতে যাচ্ছি এটা এক ভাবে আনার পরিকল্পনায় ছিলেন দেবকী বসুও। কারণ, ছেঁড়া সুতো গোটা চলচ্চিত্রে প্রায় নেইই, ওই আগে আমরা যেটা উল্লেখ করেছি, কুলিগিরি-রামায়ণ সূত্রে, সেটা ছাড়া। কতটাই পরিপাটী চলচ্চিত্রটির গঠন, যে খেয়াল করবেন, একটা দীর্ঘ গানহীন নাচের দৃশ্য চলছে বসনের, তার ভিতরেও হঠাৎ একবার মুখ বাড়িয়ে চলে যায় বৃন্দাবন। তখন মনে হয়, কী হল এটা। পরে বোঝা যায়, বেশ খানিকটা পরে, যখন তার নিজের মাকেও জানায় বৃন্দাবন যে সেদিন নাচের আসরেও সে খুঁজতে গিয়েছিল বৌকে, কিন্তু পায়নি। তাই, আলপটকা আচমকা ওরকম রাধাগোবিন্দ মন্দিরের প্রসঙ্গ তুলবেই বা কেন নিতাই, এবং সে যখন গাইছে তখন একটি সম্পূর্ণ অব্যাখ্যাত চরিত্র কাছে দাঁড়িয়েই বা থাকবে কেন। যাই হোক, উপন্যাসে সেই মন্দিরে নিতাই গান গেয়ে ওঠার পর, মোহান্ত তার গানের প্রশংসা করেন। সেখানে অনেক কথা হয় নিতাইয়ের সঙ্গে। নিতাই জানায় যে তার জন্মও হীন, নীচ কুলে জন্ম, আবার কর্মও হীন, সে ঝুমুর দলের বেশ্যাদের সঙ্গে থাকে। তখন অনেক কিছু বলেন মোহান্ত। তার কিছুটা তোলা যাক।

    তারপর বলিলেন-কর্ম তোমার অতি উচ্চ কর্মই বাবা। তোমার ভাবনা কি! যাঁরা কবি, তাঁরাই তো সংসারে মহাজন, তাঁরাই তো সাধক। কবির গানে ভগবান বিভোর হন। চণ্ডীদাসের পদাবলী শুনে মহাপ্রভু ভাবে বিভোর হয়ে নাচতেন। ... প্রভুর সংসারে নীচ কেউ নাই বাবা। নিজে, পরে নয়-নিজে নীচ হলে সেই ছোঁয়াচে পরে নীচ হয়। নীল চশমা চোখে দিয়েছ বাবা? সূর্যের আলো নীলবর্ণ দেখায়। তোমার চোখের চশমার রঙের মত তোমার মনের ঘৃণা পরকে ঘৃণ্য করে তোলে। মনের বিকারে এমন সুন্দর পৃথিবীর উপর রাগ করে মানুষ আত্মহত্যা করে মরে। আর বেশ্যা? বাবা, চিন্তামণি বেশ্যা-সাধক বিল্বমঙ্গলের প্রেমের গুরু।


    এই বৈষ্ণব অবস্থান বারবার ফিরে ফিরে এসেছে, তারাশঙ্করের নানা লেখায়, কাহিনীতে, উপন্যাসে। আর লেখক তারাশঙ্কর নিজে, জাত নিয়ে কী ভাবছেন সেটাও দেখা যাক, লেখকের নিজের জবানিতে, অন্য কারুর নয়। কিছুতেই যখন ঝুমুরদলের মত করে গান গাইতে পারছে না নিতাই, বসনের হাতে চড় খাওয়ার পরে, নিতাই গেল মদ খেতে। তার প্রথম বার মদ খাওয়ার পরে নেশার বিবরণটা একটু পড়ে নেওয়া যাক।

    সব যেন দুলিতেছে। ভিতরটা জ্বলিতেছে; দুনিয়াটা তুচ্ছ হইয়া যাইতেছে! এখন সে সব পারে। সে কালের ভীষণ বীরবংশী বংশের রক্তের বর্বরত্বের মৃতপ্রায় বীজাণুগুলি মদের স্পর্শে-জলের স্পর্শে মহামারীর বীজাণুর মত, পুরাণের রক্তবীজ হইয়া অধীর চঞ্চলতায় জাগিয়া উঠিতেছে। ... অশ্লীলতা, কদর্য ভাষা, ভাব নিতাইয়ের অজানা নয়। কিন্তু জীবনে সামান্য শিক্ষা এবং কবিয়ালির চর্চা করিয়া সে-সব এতদিন সে ভুলিতে চাহিয়াছিল। সে-সবের উপর একটা অরুচি, একটা ঘৃণা তাহার জন্মিয়াছিল। কিন্তু আজ বসন্তের কাছে আঘাত খাইয়া সেই আঘাতে ক্ষোভে নির্জলা মদ গিলিয়া সে উন্মত্ত হইয়া গেল। মদের নেশার মধ্যে দুরন্ত ক্ষোভে অর্জন-করা সব কিছুকে ভুলিয়া সে উদ্‌গীরণ করিতে আরম্ভ করিল জান্তব অশ্লীলতাকে।


    তারাশঙ্করের "অশ্লীল' বিষয়ে এই অবস্থান আমরা আগেই দেখেছি। এটা অপরিচিত কিছুও নয়। ঔপনিবেশিক পুঁজির জন্মের গোটা সময়টা, যখন একই সঙ্গে তৈরি হয়ে চলেছে মুৎসুদ্দি পুঁজি এবং ভদ্র মধ্যবিত্ত দালাল শ্রেণী, যাকে আমরা নবজাগরণ বলে ডাকি, যখন পুঁজির প্রয়োজনে আসছে প্রকৌশল, তার প্রয়োজনে আসছে নানা ধরনের বিজ্ঞান ও বিদ্যা, সেই গোটা সময়টারই একটা বড় চিহ্ন এই শ্লীলতাবোধ। এই নিয়ে বহু আলোচনা বহু জায়গাতেই আছে। আমরা এর কিছুটা পেয়েছিলাম মুসলিম নিষেধের ধারাবাহিকতায়, আর কিছুটা ভিক্টোরিয় খ্রীস্টান অনুশাসন বোধ থেকে, যা প্রায় সরাসরি অনুদিত হয়েছিল তখনকার শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে, তা নিয়ে কথা বলার জায়গা এটা নয়। কিন্তু এটা খেয়াল করুন যে, সেই অশ্লীলতা কী করে ফেরত এল নিতাইয়ের মধ্যে, তার ব্যাখ্যা যে ধরনের জাতি ও বংশধারার বোধ দিয়ে করছেন তারাশঙ্কর, তা প্রায় মেইন ক্যাম্ফ, "বীরবংশী বংশের রক্তের বর্বরত্বের মৃতপ্রায় বীজাণু'। মেইন ক্যাম্ফ ও মহাপ্রভু এই টানাপোড়েনটা কেবল একবারই ঘটেছে তা নয়। "কবি' উপন্যাসে দেখবেন, বারবার এটা ফিরে ফিরে এসেছে তারাশঙ্করের নিতাইয়ের বংশধারার বীজ ব্যাখ্যায়। তাই ""ভিন্ন জাত হয়ে জন্মালাম কেনে'' এই প্রশ্নের মধ্যে প্রথমেই নিজের আবেগকে অনস্তিত্ত্ব করে দেওয়া, এবং জাতের কাঠামোটাকে অবিকৃত ভাবে মেনে নেওয়া এটা কোনও সচেতন শৈল্পিক সৃষ্টি নাও হতে পারে, তার সময়ের দ্বন্দ্ব ও লড়াইকে বোঝাতে তারাশঙ্কর যা সচেতনে এনেছেন। তারাশঙ্করের নিজের মননের সন্তান নিতাই, সে তার এই লেখক পিতার কাছ থেকেও পেয়ে থাকতে পারে এই টানাপোড়েন। কিন্তু চলচ্চিত্র "কবি' এর থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসে। জাতপাতের চিহ্নগুলি যেখানেই এসেছে, যেমন ঝুমুরদলের প্রহরীর হাতে যখন রাজন খাবার দিতে যাচ্ছে, মাসির আঁতকে ওঠা ইত্যাদি, সেগুলি এত উচ্চারিত যে তার প্রতি কোনও গোপন সমর্থন দেবকী বসুর "কবি' চলচ্চিত্রে আমি পাইনি।

    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৫ এপ্রিল ২০১১ | ১৫৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন