তুমি হাসো, আমি কাঁদি,গোটা ফিল্ম জুড়ে উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত রকমে যে অগণ্য সংখ্যক রাধা-কৃষ্ণ আলোচনার উল্লেখ ছড়িয়ে আছে তারই একটা এটা। প্রেম তার চূড়ান্ততার তুলনা পায় তখনই যখন সেই প্রেমে কদমতলায় বাঁশি বেজে ওঠে। মানে যেখানে প্রেমিক প্রেমিকা রাধা আর কৃষ্ণর যুগলরূপ পেয়ে ওঠে। যখন এর আগের লাইনগুলো গাওয়া হচ্ছে, সেই সময় থেকে একটানা পর্দায় নিতাই কাছে আসতে থাকে, এবং তার সঙ্গে তার বাঁদিকে আসরে বসে থাকা ঠাকুরঝি, খুব সচেতন ভাবেই ধরে রাখা ওখানের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখটি। এই লাইনদুটি যখন গাওয়া শেষ হয় তখন ফ্রেমে পড়ে থাকে সত্য অর্থে শুধু এই দুজনই। রাধা-কৃষ্ণ প্রসঙ্গ আর আমরা চিহ্নিত করব না, কিন্তু গুণতে গুণতে যান, কতবার আসছে, এক সময় গোণা ছেড়ে দিতে হবে। এটাকে একটু আলোচনায় আনার হয়তো প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বৈষ্ণব সাহিত্য এলাকায় আমি একমাত্র পড়েছি কৃষ্ণদাস কবিরাজের "চৈতন্যচরিতামৃত', তাই এই এলাকায় আমার খড়্গ নিষ্কোষিত করা নিতান্তই বেমানান। এবং রাধা-কৃষ্ণের প্রেম থেকে বৃহত্তর বাঙলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনূঢ়া কন্যার বিবাহ অব্দিও যে বিস্তৃত হয়ে গেছিল কদমের প্রেক্ষাপট, শুধু একটু হাতিঘোড়ার উপস্থিতিতে, তার প্রমাণ তো আছেই, ""চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে, কদমতলায় কে/ হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে, সোনামণির বে।''
বাঁশি বাজুক কদমতলে রে।
এ কী? কে ফেলে দিল? আমার রামায়ণ, আমার মহাভারত, মনসামঙ্গল? আমার ঘর থেকে এগুলো এখানে কে ফেলে দিল?
যাহা ভাল লাগে তাহাই সে সযত্নে রাখিয়া দেয়। বইয়ের সংগ্রহ তাহার কম নয়-কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, কৃষ্ণের শতনাম, শনির পাঁচালী, মনসার ভাসান, গঙ্গামাহাত্ম্য, স্থানীয় থিয়েটার ক্লাবের ফেলিয়া-দেওয়া কয়েকখানি ছেঁড়া নাটক; ইহা ছাড়া তাহার পাঠশালার বইগুলি-সে প্রথম ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেকখানি আছে।
আমাদের বুড়ো বালিয়া বলে মন্দ নয়। টিরেন লেট হোতি, লেকিন ছোকরি না লেট হোতি।
অয়, অয় কথা আমি সইতে লারি। মহারাণী! না ঘর, না দুয়ার, অ্যালের ধারে বাস! আজ চণ্ডীতলা, কাল পিণ্ডিতলা। মহারাণী! মেথরানি! ছ্যঁ¡চরানি!
তুম উস্তাদ, দিনমে কুলিগিরি করকে পেট ভরাও, আওর রাতমে গানা গাকে দিল ভরাও, হাঁ? চলো, চলো।না রাজন। কুলিগিরি আর আমি করব না।
কেয়া?
তুমি ঘরে এসো রাজন। আমি তোমায় রামায়ণের একটা পদ পড়ে শোনাই। তুমি ততক্ষণ সিগারেট খাও।
তারপর তোমার প্রাণ যা চায় তাই আমাকে শুনিও।
এসো রাজন।
নিতাই গম্ভীরভাবে বিষণ্ন মৃদু হাসিয়া বলিল-কুলিগিরি আর করব না রাজন।
রাজা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল। ... রাজা আসিয়া বসিয়াই তাহাকে প্রশ্ন করিল-কেয়া হুয়া ভাই তুমারা? কাম কেঁও নেহি করেগা? ...
নিতাই হাসিয়া বলিল-শোন, আগে এই কাহিনীটা শোন।
রাজা বলিল-দূ-রো, ওহি লিখাপড়ি তুমারা মাথা বিগড় দিয়া।
নিতাই তখন পড়া শুরু করিয়া দিয়াছে। রাজা অগত্যা একটি বিড়ি ধরাইয়া শুনিতে বসিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তন্ময় হইয়া গেল।
""বর দিয়া ব্রহ্মা গেলা আপন ভবন।
আদিকাণ্ড গান কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।।''
পড়া শেষ করিয়া নিতাই রাজার মুখের দিকে চাহিল। রাজা তখন গলিয়া গিয়াছে। সে হাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া বলিল-সীয়ারাম! সীয়ারাম! তারপর নিতাইয়ের তারিফ আরম্ভ হইল-আচ্ছা পড়তা হ্যায় তুম ওস্তাদ! বহুত্? আচ্ছা!
নিতাই এবার গম্ভীরভাবে বলিল-রাজন, এইবার তুমিই বিবেচনা ক'রে দেখ।
রাজা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল-কী?
জানালা দিয়া রেললাইনের রেখা ধরিয়া দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিতাই বলিল-রত্নাকর, ধর কবি হলেন, তারপর কি তোমার তিনি ডাকাতি করতেন, না, মানুষ মারতেন? ... তবে? আর কি আমার মস্তকে করে মোট বহন করা উচিত হবে? বাল্মীকি মনির কথা ছেড়ে দাও! কার সঙ্গে কার তুলনা! ভগবানের অংশ, দেবতা ওঁরা। কিন্তু আমিও তো কবি। না হয় ছোট।
না:।
আর তোমার ছোট কাম করা চলবে না ওস্তাদ। কভি নেহি।
রাগ কোরো না ঠাকুরঝি। আজ আমার লতুন ঘর পাতানো হল।
তাই গোছাতে দেরি হয়ে গেল।
চায়ের উলুন, হাঁড়িতে জল - সব ঠিক করে এলাম।
তুমি চা করবে, চা খাবে। আজ রাজনের বাড়িতে নয়।
-এস, এস, একটুকুন চা আছে-খাবে এস।
-না না। ঠাকুরঝির চা খাইতে বেশ ভালই লাগে, কিন্তু মেয়েদের ভাল লাগার কথা নাকি বলিতে নাই। ছি!
(চলবে)