এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপার বাংলা

  • জাতীয়তাবাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং অসমে মাতৃভাষার কাজিয়া

    সুশান্ত কর লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | ১৫ আগস্ট ২০১১ | ৮০৯ বার পঠিত
  • গেল ২৫ জুন, ২০০৮ তারিখে অসমের এক বাংলা দৈনিকের এক সংবাদ শিরোনাম ছিল, "বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কামতাপুরিরা'। এতে কামতাপুর প্রগ্রেসিভ পার্টির নেতৃত্বে পৃথক কামতাপুর রাজ্য এবং কাপতাপুর ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলন বেশ হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠতে পারে বলে সাংবাদিকটি বেশ আতংক প্রকাশ করেছেন। এবং আমরাও যাতে বেশ আতংকিত হয়ে উঠি এটিই যে তাঁর ইচ্ছে তা বেশ স্পষ্ট। কিন্তু এহ বাহ্য! তাঁর বক্তব্য হল, কে পি পি প্রধান অতুল রায় সাংবাদিকদের হাতে যে বিবৃতিটি তুলে দিয়েছেন তাতে বুঝি, "কঠোর ভাষায় বাঙালি বিরোধী বক্তব্য রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামী ৬ জুলাই থেকে বাংলা ভাষা বয়কট করা হবে। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। বিবৃতিতে অতুল রায় বলেছেন, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার পরিবর্তে কামতাপুরি ভাষার প্রবর্তন করতে হবে।' আমি এ সংবাদের অর্থ কিছুই বুঝিনি। ইতিমধ্যে জুলাই পেরিয়ে সেপ্টেম্বর এসে গেছে। এ নিয়ে কোনো হিংসার খবর এখনও পাইনি।

    উত্তর বাংলার কোচ-রাজবংশি অধ্যুষিত এলাকায় কেউ যদি বাংলা ভাষাকে বয়কট করে নিজের মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেখতে চায় তবে তার মধ্যে বাংলা বিদ্বেষ কী করে থাকতে পারে তা আমার বুদ্ধিতে ধরে না। কারণ, যে উপত্যকাতে আমি আবাল্য বড় হয়েছি সেখানেও আমরা যখন অসমিয়াকে বয়কট করে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে তিন তিনবার রক্ত ঢেলে লড়াই করেছি তখন কখনই মনে হয় নি যে আমাদের মনে অসমিয়ার প্রতি কোনো বিদ্বেষ আছে। যা আছে, তা আমাদের মাতৃভাষার প্রতি এক স্বাভাবিক ভালবাসা। জানা লোকে জানেন যে বর্তমান লেখক এবং তাঁর বন্ধুদের অনেকেই ৮৬র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলাম। এবং বহু অসমিয়াকেও আমরা তখন সে আন্দোলনের সমর্থনে পেয়েছিলাম। বস্তুত, সারা অসম জনজাতীয় ছাত্র সংস্থার (আটসু) নেতৃত্বে রাজ্যের প্রায় সব ক'টি জনজাতীয় ছাত্র সংগঠন যখন ১৫ আগস্ট চূড়ান্ত সময় সীমা বেঁধে দিয়ে চরমপত্র দিয়েছিল, তখনই সরকার কুখ্যাত সেবা (SEBA) সার্কুলার প্রত্যাহার করে নেয়। কেবল মাত্র ২৫ জুলাইর জশন-যিশুর আত্মদান একে সম্ভব করেনি। সরকারের ভয় ছিল, এই সার্কুলার যদি বহাল থাকে তবে বরাক উপত্যকাতে তার সমর্থন ভিত্তি সম্প্রসারণতো দূরেই থাক ব্রহ্মপুত্রের যে সব জনগোষ্ঠির উপর ভিত্তি করে উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতি চলছিল সে ভিত্তিটুকুও যাবে। আর হয়েওছিল তাই। বডো-কার্বিরা তার পরেই অসমিয়া পরচিতির থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্বের লড়াই শুরু করে। উগ্রজাতীয়তাবাদের সেই যে ধস্‌ নামতে শুরু করেছে তাতেই সর্বশেষ সংযোজন কিছু সংখ্যালঘু সংগঠনের অসমিয়া পরিচিতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান। তারা আগামী অক্টোবরে রীতিমত সম্মেলন করে সংগঠিত উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন। যদিও মুসলমান বলে নয়, মূলত: এক কৃষিজীবি সম্প্রদায় হিসেবে তাদের এই উদ্যোগ কতটা এগুবে আমাদের সন্দেহ আছে।* কারণ ভাষা নিয়ে এদের কাজ কর্ম সত্যি অতি অল্প, এদের মধ্য শিক্ষিতের হার তথা মধ্যবিত্তের সংখ্যাটাই যে অতি অল্প।

    ২০০৫এ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুনর্বিন্যাস (Refreshers Course) পাঠক্রমে গিয়ে শেষ দিনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সবাই জানেন, তিনি আজকাল মাতৃভাষা নিয়ে বেশ আবেগিক। ক্যালকাটার "কলকাতা' হবার পেছনে তাঁকে বেশ ঘাম ব্যয় করতে হয়েছে। বরাকের ১৯কে সে বাংলাতে জনপ্রিয়তার পেছনেও তাঁর এক বড় ভুমিকা আছে। বক্তৃতার এক জায়গাতে, তিনি আক্ষেপ করে বললেন, "গিয়ে দেখুন না এখন দার্জিলিঙে! ওখানে বাঙালি আর আগের মতো পাবনে না।' পরের বছর সত্যি সত্যি আমি সপরিবারে দার্জিলিঙ-গ্যাংটকে ঘুরতে গেছিলাম। গিয়ে দেখি, ওখানকার প্রায় সমস্ত বড় বড় হোটেল, রেঁস্তোরার, ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক এবং কর্মচারি, রেলের কর্মচারি সবাই বাঙালি। আমাদের গাড়িতে করে ঘুরিয়ে আনবার জন্যে যাদের ডাক পরেছিল তাদের মধ্যে কেউ শুধু ছিল ভুটিয়া কিম্বা নেপালি! সুনীলের কথা শুনে আমার মনে হছিল, আমি ব্রহ্মপত্র উপত্যকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বসে আছি। সেখানে বক্তব্য রাখছেন কোনো অসমিয়া বুদ্ধিজীবি। বলছেন, "গিয়ে দেখুন না বরাক উপত্যকাতে! ওখানে অসমিয়া আর আগের মতো পাবেন না। ওখানকার বেতারে বাজে কেবল বাংলাদেশের গান!' পাঠকের মনে পড়বে বিখ্যাত অসমিয়া বুদ্ধিজীবি ইসমাইল হোসেন চাকরি সূত্রে শিলচর থেকে গুয়াহাটি গিয়েই "সাদিনে' বেশ ক'টি সংখ্যাতে সেরকমই অনেক কথা লিখে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। বহু অসমিয়াও তখন তাঁর বিরুদ্ধে তখন কলম ধরেছিলেন। সুনীল ইংরেজির পক্ষেও বেশ কিছু সওয়াল করেছিলেন। আমি শুধু তখন প্রশ্ন করেছিলাম, ইংরেজির এই আধিপত্য অক্ষত রেখে কী বাংলার প্রচার প্রসার সম্ভব বলে তিনি মনে করেন? তিনি কী উত্তর দিতে পারেন, "দেশ' পত্রিকার পাঠকেরা তা ভালই জানেন।

    এই এক বড় ট্র্যাজেডি আমাদের! উত্তর ঔপনিবেশিক সমস্ত ভারতীয় মধ্যবিত্ত মানুষের। ইংরিজির কাছে আমরা আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি-পরম্পরা-ঐতিহ্য প্রায় সবই স্বেচ্ছায় বিকিয়ে দিয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করছি। কিন্তু আমাদের চেয়ে দুর্বল, আমাদের চেয়ে দরিদ্র, আমাদের চেয়ে সংখ্যাতে যারা খাটো সেই সব দেশবাসীদের থেকে জুজুর ভয় আশংকা করে আমরা রাতের পর রাত ঘুম নষ্ট করছি। শরীর নষ্ট করছি, স্বাস্থ্য নষ্ট করছি। নষ্ট করছি দেশ! তার পরেও গলা উচিঁয়ে গান করছি, "বন্দে মাতরম!' কিম্বা "সকল দেশের রাণি সে যে আমার জন্মভূমি।' আমরা সবসময়ই চেয়েছি এক অখন্ড ভারতবর্ষ। কিন্তু আমাদের চেয়ে সংখ্যায়, সহায়-সম্বলে খাটো জনগোষ্ঠির থেকে আশা করেছি তারা আমাদের শর্তে বাঁধা থাকবে, তাদের নিজেদের শর্ত আরোপ করে আমাদের আধিপত্য এবং শ্রেণীস্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে না।

    বিখ্যাত অসমিয়া লেখক বুদ্ধিজীবি হোমেন বরগোঁহাই সম্প্রতি "আমার অসম' (১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮) কাগজে "প্রথম কলামে' ময়মনসিংহমূলের মুসলমানদের কেউ কেউ নিজেদের "মাতৃভাষা' বাংলা ঘোষণা করবার আয়োজনের বিরুদ্ধে যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন তাতে সেই উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতীয় পরম্পরাই অনুসরণ করেছেন। এর মধ্যে সবটাই শুধু "অসমিয়া জাতীয়তাবাদ' নেই। তাঁর বিরুদ্ধে উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদি হবার অভিযোগ বোধহয় তাঁর ঘোর শত্রুতেও এতদিন দিতে পারতো না। তিনি বাংলা পড়েন, বাংলা লেখেন। বিদেশী তকমা দিয়ে বাঙালি পীড়নের পক্ষে তো ছিলেনই না, বরং কখনো কখনো তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচুর গুণগ্রাহীও তৈরি করে রেখেছেন। বাঙালি এবং বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে তাঁর বলবার কিছু নেই এমনটি সেদিনের "প্রথম কলামে'র থেকেও প্রমাণ করা যাবে। তিনি লিখেছেন, "এই সম্প্রদায়ের মানুষ বরং পূর্বাপরই বাংলাভাষী হয়ে থাকাটাই যুক্তি সম্মত হতে পারত। সে ক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে কার কিছু বলবার থাকত না।' তার পরেও এটি নিশ্চিত যে ঐ লেখার পর তিনিই যাদের "ন-অসমিয়া' বলেন তাদের মধ্যে তো বটেই, অন্য বহু বাঙালীর মধ্যেও তাঁর অনেক গুণগ্রাহীদের হারাবেন। অনেকেই প্রচুর মনোকষ্ট পাবেন, কিন্তু সেটি তিনি টেরও পাবেন না। কেন না আন্তরিকতার সঙ্গে সংখ্যালঘুর মনোকষ্ট বোঝার কোনো উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতীয় পরম্পরা তৈরিই হয় নি। এই যে তিনি "পূর্বাপর বাংলাভাষী হয়ে থাকার' কথা লিখেছেন, তিনি কি জানেন না যে এই কৃষিজীবি সম্প্রদায়ের কাছে তা কোনোদিনই সহজ ছিল না। বর্তমান লেখক নিজেও শ্রী বরগোঁহাইর একজন গুণগ্রাহী পাঠক ছিলাম, আছি এবং থাকব। কেন না যে আশ্চর্য পৌরুষ তাঁর প্রতি রচনার ছত্রে ছত্রে ভারতীয় সাহিত্যে সে এক দুর্লভ অর্জন। কিন্তু তাঁর সেদিনের সে "প্রথম কলাম' আমাকেও যে দু:খ দিয়েছে তা প্রকাশ করবার উপায় ব্রহ্মপুত্রের পারে খুব একটা নেই। কেউ কেউ সেই প্রকাশিত দু:খকেই অসমিয়া অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক বঙ্গ সন্তানের ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখতে পারেন। উত্তর বাংলার অতুল রায় আর উত্তর অসমে বসে আমার দুর্দশাটা প্রায় একই।

    আমার প্রিয় লেখক হোমেন বরগোঁহাইর আতংকের কারণটাও ঐ একই। তিনি চান না, তাঁর অবস্থান পাল্টে আমার কিম্বা অতুল রায়ের মতো হয়ে যাক। অর্থাৎ অসমে অসমিয়ারা বাঙালির কাছে সংখ্যালঘু হয়ে যাক। যদিও তিনি ইজরায়েলের ইহুদিদের উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন যে জ্ঞান এবং অর্থে বলীয়ান হলে সংখ্যাতেলঘু হলেও অসমিয়ার আতংকের কিছু নেই, তবু এও সত্যি যে তিনি বরাক উপত্যকাকে অসম থেকে স্বতন্ত্র করে অসমিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করবার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রয়োজনে বরাকের বিচ্ছিন্নতার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলবার আহ্বানও জানিয়েছেন। তা হলেই বুঝি নয়া-অসমিয়ারা এ রকম "ব্ল্যাকমেলিঙে'র সুযোগ পাবে না। এর অর্থতো স্পস্ট যে বরাক এবং ব্রহ্মপুত্রের হিন্দু-মুসলমান বাঙলি এক হলেই অসম বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হবে।

    শ্রী বরগোঁহাই ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রায় সমস্ত সারবত্তাকে আত্মস্থ করেছেন। তাঁর রচনাবলী পড়লেই বোঝা যায়। তাই তাঁর পক্ষে এত দূর ভাবা সম্ভব হয়েছে। নইলে কেবল মুসলমান নয়, হিন্দু বাঙালিও এতদূর দেখতে পায় না। তারা তো মুসলমানদের বাঙালি বলে কল্পনাই করতে পারে না। বাংলা আর হিন্দুত্বকে একাকার করে রেখে, তার পরে তারা কেউ কেউ মুসলমানদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা তলায় দাঁড়াবার আহ্বান জানান। সুতরাং আদৌ কোনো মিলিত বাঙালি সম্প্রদায়ের দ্বারা অসমিয়াদের বিপন্ন বোধ করবার কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবু ধরা যাক যে সমস্ত বাঙালিদের "শুভবুদ্ধির' উদয় হল, এবং তারা এক হয়ে অসমকেই আরেক বাংলা প্রদেশ বানিয়ে ছাড়লেন। তাতে কি তারা "উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদিদের' করা কাজের পুনরাবৃত্তি করবেন না? অসমিয়ারা কি এ প্রদেশে খুব নিরাপদে থাকবেন?

    ইতিহাস অন্তত, এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে দেয় না। ভাল নেই রাজবংশি এবং গোর্খারা পশ্চিম বাংলাতে। ভাল নেই ত্রিপুরার জনজাতীয়রা। ঝাড়খন্ডি আদিবাসিরা কেবল অসমেই "বেলতলার' মতো ঘটনার স্বীকার হন না, চুনি কোটালের মতো ঘটনা পশ্চিম বাংলাতে আখছার ঘটে। ২১এর বাংলাদেশে ভালো নেই চাকমারা কিম্বা বিহারি মুসলমানেরা। অসমেও স্বতন্ত্র প্রদেশ, স্বতন্ত্র দেশের দাবিতে লড়াই হচ্ছে, হয়ে থাকে। কিন্তু যে নৃশংসতায় পশ্চিম বাংলাতে আশীর দশকে দমন করা হয়েছিল ঝাড়খন্ড এবং গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলন তার কোনো তুলনা নেই। এখনো সাহস করে এবং নিরাপদে "রাজবংশি' নাম দিয়ে ঐ ভাষাতে গান-কবিতা কিম্বা সিনেমা করতে পারেন না উত্তর বাংলার রাজবংশি লোক। যারা সে গান বন্ধ করেন তারাই অনত্র গেয়ে ওঠেন সেই বিখ্যাত পল রবসনের গান, "ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না...' ! কী নির্লজ্জ স্ববিরোধ!

    তা হলে মুক্তির পথটা কোথায়? ইজরায়েল আদর্শ হতে পারে না। ইজরায়েলের মাথার উপর রয়েছে আমেরিকার আশীর্বাদ। সে কি শ্রী বরগোঁহাই জানেন না? ইহুদি নিধনের কুখ্যাতি কখোনোই হিটলার এবং তাঁর জার্মানির সঙ্গ ছাড়বে না। তেমনি আমেরিকাটা পড়ুক, ইজরায়েলের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। এবং যিশু খৃষ্টকে হত্যার অপবাদের মতো হাজারো আরবদের হত্যার দায় থেকে ইজরায়েলের ইহুদিরা কোনো দিনই মুক্তি পাবে না। সারা ইতিহাস ওদের ধিক্কার দেবে। ইতিহাসের ধিক্কার মাথায় তুলে নিয়েই কি আমাদের জাতি গঠনের কাজটা সম্পন্ন করতে হবে? এর কি কোনো অন্য পথ নেই?

    এমন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি গড়ে তোলা যায় না, যেখানে প্রতিজন সংখ্যালঘু, দলিত এবং জনজাতীয় মানষ নিজের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি তথা পরম্পরাকে এতোটাই সুরক্ষিত বলে ভাবতে পারে যে তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার স্বপ্ন দেখবার কোনো প্রয়োজনই না পড়ে। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরাও এমন কোনো অধিক সুবিধে ভোগ করে না যে তাদের সারাক্ষন সংখ্যালঘু হয়ে সে সুবিধে হারাবার ভয়ে আতংকিত থাকতে হয়! বোধ করি ঠিক তখনই এক প্রকৃত ঐক্যবদ্ধ অসম তথা ভারতে দাঁড়িয়ে গান করা যাবে, "সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি...'। বস্তুত পূব বাংলার হিন্দু বাঙালিরা যদি দেশভাগের আগেই এমন এক কর্ম পন্থা বের করে তাকে কাজে প্রয়োগ করতে পারতেন তবে তাদের এদেশে ওদেশে কোনো দেশেই সংখ্যালঘু হবার গ্লানি নিয়ে বাস করতে হোতো না।

    আমরা যা করছি তা যে অসমিয়া নয়, বাঙালি নয়, ভারতীয়ও নয়, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সে কথা রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন: "য়ুরোপীয় পোলিটিক্যাল ঐক্যের ভিতরে যে বিরোধের ফাঁস রহিয়াছে তাহা তাহাকে পরের বিরুদ্ধে টানিয়া রাখিতে পারে, কিন্তু নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য দিতে পারে না ... তাহারা পরস্পরের প্রতিকূল – যাহাতে কোনো পক্ষের বলবৃদ্ধি না হয়, অপর পক্ষের ইহাই প্রাণপণ সতর্ক চেষ্টা। ... হয় পরকে কাটিয়া মারিয়া খেদাইয়া নিজেদের সমাজ ও সভ্যতাকে রক্ষা করা, নয়, পরকে নিজের বিধানে সংযত করিয়া সুবিহিত শৃঙ্খলার মধ্যে স্থান করিয়া দেওয়া, এই দুই রকম হইতে পারে। য়ুরোপ প্রথম প্রণালীটি অবলম্বন করিয়া সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে বিরোধ উন্মুক্ত করিয়া রাখিয়াছে – ভারতবর্ষ দ্বিতীয় প্রণালী অবলম্বন করিয়া সকলকেই ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে আপনার করিয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছে। যদি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, যদি ধর্মকেই মানব সভ্যতার চরম আদর্শ বলিয়া স্থির করা যায়, তবে ভারতবর্ষের প্রণালীকেই শ্রেষ্ঠতা দিতে হইবে।'

    "জাতি গঠনে প্রক্রিয়া' বলে এক শব্দগুচ্ছ অসমিয়াদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় রয়েছে। "জাতি', "জাতীয়তাবাদ' শব্দগুলো বাঙালিদের মধ্যেও বৌদ্ধিক আড্ডার মুখরোচক বিষয়, হিন্দিরা তো নিজের জন্যে অন্য কোনো নামই রাখেনি। "হিন্দুস্তানি' বললে ওরা শুধু হিন্দিভাষীদেরই বুঝিয়ে থাকে। কোনো কোনো অতি পণ্ডিত ভারতীয় বা হিন্দুস্তানিদের এক সম্পূর্ণ জাতি বলে প্রচার করে বেড়ালেও (যাদের সংখ্যা হিন্দিদের মধ্যেই বেশি) বুদ্ধিমানেরা ভারতে কোনো জাতি গঠনই সম্পূর্ণ হয় নি বলে আক্ষেপ করে থাকেন। এ রকম আক্ষেপপ্রিয় বুদ্ধিজীবিদের বাঙালি, অসমিয়া নির্বিশেষে প্রায় সমস্ত ভারতীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে পাওয়া যাবে। মায় মার্ক্সবাদিদেরো অনেকে ভাবেন, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার একমাত্র নিদানই হল ভাষীক জাতিয়তাবাদ। বরাক উপত্যকার প্রতিষ্ঠিত মার্ক্সবাদি এমন কি উত্তরাধুনিক বুদ্ধিজীবিরাও এই চিন্তারই প্রতিনিধিত্ব করেন। আর আমাদের হিন্দুতবাদিদের কথা তো বলেই লাভ নেই! ওরা সব তর্কের ঊর্ধে! কিন্তু এই সবারই আদর্শ কিন্তু ইউরোপ। একটু ইউরোপ ভক্তি কমিয়ে রাখলে এরা দেখতেন পরিপূর্ণ সুগঠিত জাতি সারা পশ্চিমী বিশ্বেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখনো ওরা, "পরকে দূর করিয়া, উৎসাদন করিয়া, সমাজকে নিরাপদ রাখিতে চায়।' আমাদের ভারতভক্তি কবে হবে? কবে জাগবে আমাদের অসম প্রেম? হিন্দুত্বের থেকে আলাদা করে আমরা কবে বুঝব রবীন্দ্র কথিত ভারতবর্ষের প্রাক-ঔপনিবেশিক সেই ধর্মটিকে? কবে বুঝব যে, "স্বাজাত্যের অহমিকার থেকে মুক্তি দানের শিক্ষাই আজকের দিনের প্রধান শিক্ষা' ... !!!


    *এই উদ্যোগ বেশি দূর এগোয় নি। ক'দিন পর ওদালগুড়িতে দাংগা বেঁধে যায়, অন্য বিষয়কে কেন্দ্র করে আর এই উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপার বাংলা | ১৫ আগস্ট ২০১১ | ৮০৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন