এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • মামাবাড়ি ভারি মজা

    শঙ্খ কর ভৌমিক লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৪ নভেম্বর ২০১১ | ১১৩৭ বার পঠিত
  • সেকালে মামাবাড়ি বলে একটা জিনিস ছিল- সব বাঙালীর অন্তত একটা করে, কারো কারো কয়েকটা করে থাকত। আর যেহেতু আমি একজন বাঙালী এবং খুব একটা একালের নই, আমারও একটা ছিল। তবে আমার মামা আমাদেরই শহরে থেকে চাকরি করতেন বলে, আমাদের কাছে সেটা মামাবাড়ির বদলে "দাদুভাইয়ের বাড়ি' নামে পরিচিত ছিল।

    পূজোর ছুটি বা গরমের ছুটিতে সেখানে যেতাম। কয়লার ইঞ্জিনে টানা রেলগাড়ি করে যেতে হত। ট্রেনের জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালে চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়ার ভয় ছিল। মাঝে মাঝে ইঞ্জিনের জল ফুরিয়ে গেলে বগিশুদ্ধ যাত্রীদের মাঝপথে ফেলে রেখে ইঞ্জিন যেত জল ভরতে। মোবাইল ফোন, এমনকি এমনি ফোনও ছিল না বলে "পৌঁছতে দেরি হবে' এই খবর দেওয়ার উপায় ছিল না। তবু, দুপুরের বদলে সন্ধ্যেয় কিংবা সন্ধ্যের জায়গায় পরদিন সকালে মামাবাড়ির স্টেশনে নেমে রিকশায় চেপে একটা খাল, একটা ব্রিজ, গোটা তিনেক মাঠ আর একটা ছায়া ছায়া রাস্তার শেষে যখন মামাবাড়ি এসে হাজির হতাম- প্রত্যেকবারই গেটের কাছে দাদুভাইকে হাসি হাসি মুখে অপেক্ষা করতে দেখতাম। দেরির জন্য দুশ্চিন্তার কোনো ছাপ চোখে মুখে থাকত না- হয়তো তখনকার মানুষ খারাপের আশঙ্কার চেয়ে ভালোর আশাটাই বেশি করত।

    রিকশা থেকে নেমে দাদু দিদাকে একপ্রস্থ প্রণাম। একে একে মা, বাবা, আমি, ভাই এবং রিকশাওয়ালা (বেশিরভাগ সময় তার নাম মনিরুদ্দি, বা জোনেব আলি, বা মকবুল, বা হরিপদ, বা খালেক)- পাঁচজোড়া প্রণামের পর মা বাবাকে মাসীর, তারপর মাসীকে আমার প্রণাম এইসবের পর বাড়ির ভেতরে যাওয়া। আজকাল বাচ্চারা প্রণাম করতে এলে বড়রা যেরকম "না না, প্রণাম আবার কেন? সেকি, এইটুকু বাচ্চা-' এইসব বলে হাহাকার করে ওঠেন সেসবের পাট ছিল না।

    দাদুদের কাছে চিরকালই নানারকম গল্পের অফুরন্ত ভান্ডার থাকে। তার ওপর আমার মাতামহের জীবন ছিল ঘটনাবহুল। তিনি স্বদেশী যুগের একজন প্রাক্তন বিপ্লবী, তিনি নিজের হাতে বন্দুক ছুঁড়ে বাঘ মেরেছেন, দুর্ঘটনায় দু ফাঁক হয়ে যাওয়া পোষা কুকুরের পেট নিজের হাতে সেলাই করেছেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জেরে স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে মৃদু হাতাহাতি করেছেন, এমনকি বাঘ পোষার পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন এককালে- দুই বাঘের ছানা কোলে আমার মায়ের ছোটবেলার ছবি শেষ জীবনেও তাঁর কাছে সযত্নে রাখা ছিল। আর ছিল একটা পুরনো ট্রাঙ্কে নানান বিচিত্র জিনিস- বুনো শুওরের দাঁত, সজারুর কাঁটা, বাঘের কন্ঠার দুÖপ্রাপ্য হাড়, নাম না জানা কত যন্ত্রপাতি। তার মধ্যে একটা ছিল হাতির দাঁতের বাঁটওয়ালা কম্পাস যা পরবর্তীকালে আমি নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ব্যবহার করেছিলাম।

    অবশ্য, সফল সংসারী গৃহস্থ বলতে যা বোঝায় আমার মাতামহ তা ছিলেন না। স্বদেশী ব্যবসা (দেশলাই থেকে গোলাপজল সবই আছে তার মধ্যে) করতে গিয়ে একাধিকবার ফেল মেরেছেন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতান্তরের ফলে অগুন্তিবার চা বাগানের চাকরি ছেড়ে আমার দিদা এবং আমার মা-মাসি-মামাকে যথেষ্ট আর্থিক অনটনের মধ্যে ফেলেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু তাঁর এই বাউন্ডুলে স্বভাবের জন্য দিদার মধ্যে অনুযোগের বদলে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব লক্ষ্য করেছি। তবে, শেষ জীবনে দিদার মাথায় আমার মামাতো ভাইকে নিয়ে চিন্তা ঢুকেছিল- দাদুর মত না হয়ে যায়।

    আমার বাবা এবং মাতামহের মধ্যে বেশ একটা প্রতিযোগিতা ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, দাদুভাইয়ের করে দেখানো সব কটা কীর্তিকলাপই বাবা কোন না কোন সময় করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইংরেজ ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল বলে, আর কাছাকাছি শিকার করার মত কোন বাঘ ছিল না বলে, বা আমাদের কোনো পোষা কুকুর কখনো বন্যবরাহের আক্রমণে আহত হয়নি বলে, বাবা হার মেনে নিয়েছেন।

    আমাদের প্রজন্মের সব বাঙালীর কাছেই মামাবাড়ির একটা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল- দাদুভাইয়ের গল্প ছিল, বাড়ির পেছনে নদীর ঘাট (পরে জানতে পেরেছি ওটা নদী নয়, খাল ছিল) ছিল, সেই নদীতে স্টিমার ছিল, দাদুর হাত ধরে বেড়ানো ছিল, আর ছিল সেই প্রশ্রয়, যে জন্য "মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই' কথাটার সৃষ্টি হয়েছে।

    আমার বাবা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিরকালই খুব সাবধানী। তার ফলে, সাইকেল চড়া থেকে সাঁতার- সবই আমি শিখেছি নির্ধারিত বয়েসের চেয়ে অনেক দেরিতে। পৃথিবীর ইতিহাসে আমিই সম্ভবত: একমাত্র মানুষ, যে ভারত মহাসাগরের জল মগে করে মাথায় ঢেলে স্নান করেছে। এহেন আমি মামাবাড়ি যাওয়াটাকে স্বাভাবিকভাবেই বহুবিধ অ্যাডভেঞ্চারের ছাড়পত্র পাওয়া বলে ধরে নিতাম। দাদুভাইয়ের প্রশ্রয়ে এবং উৎসাহে যেসব জিনিস জীবনে প্রথমবার করেছি তার মধ্যে ছিল সত্যিকারের খেলনা স্টিম ইঞ্জিন তৈরী করা, অন্ধকার ঘরে লন্ঠন জ্বেলে শ্যাডোগ্রাফি, মাটি দিয়ে ব্লক বানিয়ে খেলনা ছাপাখানা, নিজের হাতে তুবড়ি জ্বালানো। এমনকি একবার বাঁশ আর কাঠ দিয়ে নিজের হাতে বানিয়েছিলাম আস্ত একটা ঘর যার মধ্যে আমি নিজে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতাম। বাবাকে নিজের হাতে চিঠি লেখাও ওই মামাবাড়ি থেকেই প্রথম।

    আর ছিল বই। মায়েদের ছোটবেলার সন্দেশ, মৌচাক, শিশুসাথী আর এমন সব পুরনো বই যেগুলো এখন তো বটেই, তখনকার দিনেও আউট অফ প্রিন্ট। খেলা, গল্প, বেড়ানো আর দুপুরবেলায় উপুড় হয়ে শুয়ে সেসব বই পড়া- সেই ছুটির দিনগুলো আমার জীবনে তো আর ফিরে আসবেই না, দু:খের বিষয় আমার মেয়ের জীবনেও কোনোদিন আসবে না।

    যে বছর মাসীর বিয়ে হল, সেবার এইরকম এক দুপুরে, মামাবাড়ির এক আলমারি ঘেঁটে পেয়ে গেলাম "ছোটদের মেঘদূত'- লেখকের নাম মনে নেই, আমার মামার ছোটবেলার উপহার পাওয়া বই। অত পুরনো বই, কিন্তু কি সুন্দর কাগজ আর বাঁধাই আর তেমনই সুন্দর ঝকঝকে ছাপা। আর সবচেয়ে যা চোখ টানে, তা হল হালকা নীলচে কাগজের ওপর মেঘের টেক্সচার।

    যদিও তখন মেঘদূত পড়ার বয়স হয় নি, কাগজ, ছাপা আর ছবির গুণে সেই বই মনপ্রাণ কেড়ে নিল। শেষপর্যন্ত দাদুভাই ঠিক করলেন বইটা আমাকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু মায়ের ভয় ছিল কয়েকদিন পর আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেললে বইটার অযত্ন হতে পারে। সুতরাং, "বড় হলে পড়বে' বলে আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আলমারিতে তুলে রাখা হল "ছোটদের মেঘদূত'।

    সেই আমার শেষ মামাবাড়ি যাওয়া। সেবারের পর আমার মা-মাসী আর মামা এই তিন ভাইবোনের দেখা হয়েছে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে সাকুল্যে তিনবার। অনেক পরে, আমার দাদু অন্য শহরে যে ভাড়াবাড়িতে মারা যান, তার পেছনে কোন নদীর ঘাট ছিল না। অনেক বছর পর, দাদুভাইয়ের মতোই একখানা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী বাগাতে সক্ষম হই এবং তারপর মোবাইল ফোনের ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে চিমনি তৈরির ঠিকেদারী ইত্যাদি বিচিত্র পেশায় ভাগ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে আমার বেহিসাবী অথচ প্রতিভাবান, দু:সাহসী, স্বপ্নদর্শী বেদুইন মাতামহের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলাম। সজারুর কাঁটা থেকে শুরু করে "ছোটদের মেঘদূত', অনেক কিছুরই আর কোনদিন খোঁজ পাওয়া যায় নি। আমি নিজে পুরনো বইওয়ালাদের কাছে সেই বই অনেক খুঁজেও পাই নি।

    এতদিন পরেও এখনো আকাশে যখন সেই পুরনো বইয়ের পাতার মত মেঘ দেখি, নিশ্চিত বুঝতে পারি বৃষ্টি নামবে। তবে, অবিকল সেইরকম দেখতে মেঘ আর কোনোদিনও দেখতে পেলাম না। আর কোন মেঘও আমাকে কোনদিন ঠিক সেইরকমভাবে দেখতে পাবে না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ১৪ নভেম্বর ২০১১ | ১১৩৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন