ভোরবেলা দুটো বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে। তাদের পিছু নিয়েছে একটা উটকো লোক।
সাদা সাদা কুয়াশা। মিহি কুয়াশা, ঠান্ডা, ভেজা ভেজা কুয়াশার মধ্য দিয়ে। ঢলঢলে হাফপ্যান্ট আর বেঢপ ফ্রক পরে। হাফপ্যান্টটা আবার এক হাতে ধরে আছে, যাতে খুলে না যায়।
ছেলেটা ভ্যাবলামত। মাঝে মাঝেই এটা-সেটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্যান্ট ধরে থাকা হাতের বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে দেয়। নেমে আসা প্যান্টটাকে আবার টেনেটেনে তোলে। মেয়েটা দু -তিন পা পিছিয়ে আসে, ছেলেটার ব্যাগ ধরে টান লাগায়। ছেলেটা ফের হাঁটা শুরু করে।
পিচঢালাই উঁচু রাস্তায় এই সকালবেলায় গাড়িঘোড়ার আনাগোনা কম। পথের দুধারে টিনের আর টালির চালের ঘরবাড়ি আর অনেক পুকুর। কখনো কখনো ধানক্ষেত। একটা বাঁশঝাড়ও আছে। পুকুরে একটা বক বসে আছে। আর একটা বক কোথা থেকে এসে সেটার পাশে বসতেই প্রথমটা উড়ে গেল, ঝুপ করে একটু দূরে গিয়ে বসল। ছেলেটা হঠাৎ করে একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে প্রথম বকটার দিকে তাক করে ছুঁড়ল- বকটা বিশেষ পাত্তা দিল না, একটু ডানা ঝটপট করল শুধু। তাই দেখে বাচ্চা মেয়েটার মুখে একটা ব্যাঙ্গের হাসি খেলে গেল।
খানিকটা এগিয়ে রাস্তার বাঁ পাশে একটা মরা গাছের গুঁড়ি। তাতে অজস্র ব্যাঙের ছাতা গজিয়েছে। আবার অবাক হয়ে মুখে আঙুল পোরা, ব্যাগে হ্যাঁচকা টান, আবার চলা শুরু।
সময়মত স্কুলে পৌঁছনোর জন্য এদের কোন তাড়া নেই মনে হয়। ঘন ঘন দাঁড়িয়ে পড়ছে, মুখে আঙুল পুরছে, প্যান্ট টেনে টেনে তুলছে, ধীরে সুস্থে হাঁটছে। স্কুলটাও মনে হয় অনেক দূরে, এরই মধ্যে দিনের আলো বেশ ভালোরকম ফুটে গেছে।
উল্টোদিক থেকে চারটে দুষ্টু ছেলের একটা দল আসছে। এরা অন্য স্কুলের। ছেলেমেয়ে দুটোর পাশ দিয়ে যাবার সময় কি যেন বলতে বলতে আর হাসতে হাসতে গেল। এরা দুজন একটু অস্বস্তির সঙ্গে পা চালিয়ে ওদের চারজনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে নিল। নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে ছেলেটা পেছন ফিরে দুষ্টু ছেলেদের দলটার দিকে তাকায়, চোখে রাগ। এবার আর ব্যাগ ধরে কেউ টানল না। ছেলেটা সামনে তাকিয়ে দেখল তার সঙ্গী অনেকটা এগিয়ে গেছে। ছেলেটা হনহন করে হেঁটে দূরত্বটা পূরণ করল। কিছু বলার চেষ্টা করছে। অন্যজন চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল।
একটু পরে, দুজন টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে। ছেলেটার পিঠে নিজের ব্যাগ, এক হাতে প্যান্ট ধরা, অন্য হাতে মেয়েটার টিনের বাক্স, বইখাতা রাখার। রাস্তার ধারে একটা বাড়ির দরজার দুপাশে দুটো বেড়ালের মত দেখতে সিংহ। দুজন অবাক হয়ে দেখছে। পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে একজন অচেনা লোক বলল- "ডাক্তার ডাকার আগেই সব শেষ"।
কে শেষ, কখন শেষ তার বিন্দুবিসর্গ এরা বুঝতে পারল না, তবে ঘাবড়ে গিয়ে হাঁটা শুরু করল।
কারা যেন ধান সেদ্ধ করে রাস্তার ওপরেই শুকোতে দিয়েছে। দুজন লোক কাঠের তৈরি একটা কোদালের মত জিনিস দিয়ে ধানগুলো নাড়াচাড়া করছে। লুঙ্গি পরা একজন মোটামত লোক তদারকিতে ব্যস্ত। সেই মনে হয় ধানের মালিক। ওদের দেখে ধানের মালিক অপ্রসন্ন চোখে তাকায়। কোন অপরাধ না করা সত্ত্বেও ছেলেটার মুখে কাঁচুমাচু ভাব।
একটু এগিয়ে একটা খালের ওপর কাঠের সাঁকো। খালপাড়ে ওটা কি বাঁধা? আরেব্বাস, একটা সাদা ঘোড়া। ছেলেটার মনে হয় জন্তুজানোয়ার দেখলে ঢিল ছোঁড়ার স্বভাব। ঘোড়াটাকেও একটা ঢিল ছুঁড়ল অকারণে। যথারীতি লক্ষ্যভ্রষ্ট।
এবার মেয়েটা একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে ছোঁড়ে, তবে ঘোড়াটার দিকে নয়, খালের জলে। ঢিলটা নিখুঁত ব্যাংবাজি দেখিয়ে জলের ওপর তিনবার লাফাল। ছেলেটা খোসামুদের ভঙ্গিতে খুব হাততালি দেয়।
রাস্তার ধারের একটা বাড়ি থেকে একই রকম ইস্ত্রি না করা সাদা জামা আর রংজ্বলা নীল হাফপ্যান্ট পরা একই বয়েসি আরেকটা ছেলে বেরিয়ে এসে এদের সঙ্গে জুটে গেল, তবে এর প্যান্টটা প্রথম ছেলেটার মত ঢলঢলে নয়। শার্টটাও তত ময়লা নয়।
নতুন ছেলেটা খুব বকবক করছে। মেয়েটা খুব হাসছে। প্রথম ছেলেটার মুখে ক্ষুণ্ণ ভাব। হঠাৎ খেয়াল করে টিনের বাক্সটা এখনো তার হাতে। বাক্সটা মেয়েটাকে ফেরত দেয়। মেয়েটা এর হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে অম্লানবদনে অন্য ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিল। তাতে প্রথমজনের মুখের ক্ষুণ্ণ ভাবটা আরো বেড়ে গেল।
একটু পরে পথের ধারে একটা খারাপ হয়ে যাওয়া রোড রোলার। প্রথম ছেলেটা হাঁচোড়পাচোড় করে ড্রাইভারের সিটে ওঠার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে সঙ্গীরা অনেকটা এগিয়ে গেছে দেখে হাল ছেড়ে দিয়ে আবার হাঁটা লাগায়।
স্কুল মনে হয় আর বেশি দূরে নয়। রাস্তায় এদের মতই রংজ্বলা নীল হাফপ্যান্ট অথবা স্কার্ট পরা কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে এবার।
রোদ এখন বেশ চড়া। পিছু নেওয়া উটকো লোকটা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে আপনমনে পাড়াগাঁয়ের দিকে চলে আসাটা ঠিক হয় নি। এখন ফেরার জন্য গাড়িটাড়ি কিছু পাওয়া যাবে কিনা কে জানে? এই রাস্তায় বাস বা অটো চলে বলে মনে হয় না।
শহুরে লোকটা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে হাঁটা শুরু করল, মনে একরাশ বিরক্তি, নিজের ওপর। খামোকা এত দূরে আসার কি দরকার ছিল?
তাই তো! কী দরকার ছিল এতদূর আসার?
----------------------------------------------
ছবি ঃ লেখক
গল্পটি কাগুজে গুরুতে প্রকাশিত।