“আমি সেই কালো গেঞ্জি নীল প্যান্ট, যার পকেটে পাঁইটের বোতলে ভরা পেট্রলের একঢোঁক, সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে পেটে চলে গিয়েছিলো। আগুন ছোঁড়ার খেলা দেখাচ্ছিলাম, ভাসানের দিন। আমার সেই প্রায় ছবি হয়ে যাওয়ার গল্প আপনারা অনেকেই পড়েছেন, বা পড়েননি। সেদিন যে লোকের শার্ট খামচে বেঁচে গেছিলাম, সে-ই গল্পটা লিখে দেয়। সবই শোনা কথা, সত্যি মিথ্যে জানিনা, পড়াশোনা আমার ধাতে নেই। হেভি লোক ছিলো, গড়িয়াহাটের মোড়ে কিছু না হলেও সেদিন কয়েক শো লোকের মধ্যে বস ঐ একজন।
সেদিন সকাল থেকেই মনটা কু গাইছিলো। কারখানা বন্ধ থাকায় কাজে যেতে হয়নি। আগের দিন মালফাল খেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরলাম। মা ফালতু বাওয়াল দিলো, যদিও ঘুমচোখে বেশিক্ষণ টের পাইনি। সকাল থেকেই মাথাটা টলছিলো। বমি। বিকেলে ওরা ডাকতে এলো, ভাসানের প্রসেশন। একটু গুমোটের মত ছিলো দিনটা, আকাশটা ঝুলে নেমে এলে যেমন হয়, মেঘলা দলা দলা চিটচিটে আকাশ। আমার জানার কথা না, জানিওনা, যে এইরকম লিকুইড বোতলে ভরে বোমা বানানো হয়। কিন্তু আমি না জানলেও ঐ লোকটা জানতো। ফিনিশ-সোভিয়েত যুদ্ধের কথা, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গান্স কম পড়ার কথা, সে সালা ঊনিশশো ঊনচল্লিশ-চল্লিশের ঘটনা। লোকটা অত জানে, তবু পুজোকালের দিকে টেলিফোন বুথে দাঁড়িয়ে টাইমপাস করছিলো। কপাল মাইরি! অথচ আমার দেখা অল্পস্বল্প পাসফাস করা লোকজন দিব্যি বউবাচ্চা নিয়ে ভাসান দেখে চাউমিন খেয়ে নালেঝোলের জীবন কাটিয়ে গেল। যাই হোক, ফিনিশ শুনে আমার হেভি হাসি পেয়েছিলো। মজার নাম, না? ফিনিশ! সেদিন আরেকটু হলেই আমিও ফিনিশ হয়ে যাচ্ছিলাম। মুখে পেট্রলটা নিয়ে সবে ছুঁড়তে যাবো, আড়চোখে দেখি বেগুনি সালোয়ার পরে একটা মেয়ে, সাধনদার শালীফালি হবে মনে হয়, হাসছে। ব্যস, পেটে চলে গেল একঢোঁক। তখনই বসের সাথে আলাপ। হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়েছিলো।
তা সে যাক, আমি তো কোনক্রমে জলটল খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে, জলে-বমিতে ভেজা জামা পরেই এগোলাম। কিন্তু একটু এগিয়েই মাথাটা ফরসা হয়ে এলে মনে পড়লো, পেট্রলের পাইঁটটা তো পড়েই আছে নর্দমার কাছে। তাই আবার ফিরে গেলাম। একগাদা লোকের ঘাম-পারফিউম নাকে ধাক্কা মারছিলো, নানারকম শরীরের খাঁজখোঁজ, নকশা, টেরিকট থেকে সিল্কের ঘস্টা খেয়ে তবে আবার নর্দমার ধারে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি সে বোতল হাওয়া। এদিক সেদিক তাকালাম, কেউ কারুর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা। জনস্রোত পিলপিল করে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে আমার পাশ দিয়ে, আমায় ছুঁয়ে। পাতলা একটা জলের ধারার মধ্যে পড়ে থাকা ছোট পাথরকুচির মত আমায় ঘিরে, ধাক্কা দিয়ে ছুটছে সবাই।”
শরীরে একটা অস্বস্তি হতে শুরু করলো মানসের। গালে একটা টানটান ভাব, যেন চামড়াটা কেউ টেনে তুলে দিতে চাইছে। জুলপিটা খসে খসে আসছে, মাথাটা হালকা হয়ে আসছে, চোখে যেন ঘোরের মতন। বোয়া কনস্ট্রিকটরের চোখের মত। ঘোলাটে নীল। সব অস্পষ্ট। অতএব থামতে হলো। থেমে, ফ্রিজ থেকে বোতল নিয়ে একটু জল খেয়ে বাথরুমে গেল মানস। চোখটা এখনও ঘোলাটে, মুখটা সাদা লাগছে। মেক-আপ করা মুখের মত, চড়া মেক-আপ। শরীরে একটা শিরশিরে মতন অনুভূতি। গলাটা কি একটু ফুলেছে?
কিন্তু লেখাটা শেষ না করলেই নয়। পুজো আসছে। মানসের অবশ্য পুজো নিয়ে কোন হেলদোল নেই। কলকাতা ও শহরতলির লোক মিলে পুজোর কটাদিন যে নরক গুলজার করে, মানস সেসব একেবারে পছন্দ করেনা। প্যাথেটিক লাগে এইসব ন্যাকামি। শুধু পেমেন্টটা ঠিকঠাক পাওয়া যায়, তাই সনৎবাবুর জন্য সে প্রতি বছর লেখে। একটা করে গল্প। সচরাচর তাতে একটু সামাজিক মোচড় থাকে, নায়ক হয় বস্তিতে থাকে নয়ত পেট্রলপাম্পে কাজ করে। অথবা দুটৈ। এবার অবশ্য ঐ জায়গাটা একটু আবছায়া মতন রাখার ইচ্ছে আছে। আচ্ছা, সনৎবাবুকে মনে আছে? সেই যে, ইউনিয়ন করতেন। এই সনৎ কিন্তু অন্য লোক।
কিন্তু মুশকিল করেছে শরীরটা। চশমাটা পড়বে নাকি? দোনামোনা করে মানস চশমাটা বের করে। খুব বেশি পাওয়ার নেই, কতকটা অপ্রয়োজনীয়ই। এইসব করেটরে, লেখা শুরু হলো –
“তখন আমার খেয়াল হলো। বস নির্ঘাৎ বোতলটা নিয়ে গেছে। যা খ্যাপা মাল, কি করে বসে কেজানে! এই ভেবে আমি খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। কিন্তু ওখানে কি সহজে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়? কত লোকের বউ, বান্ধবী, ছেলেমেয়ে, বুড়ো বাপমা এদিক ওদিক হয়ে যাচ্ছে এমন ভিড়। বিশেষ করে কাউকে খুঁজলে, পাওয়া যাচ্ছিলো না একেবারেই। মানে আছে সবাই, কিন্তু যে যেখানে থাকার,নেই। তবু, চেষ্টা তো করতে হয়। নইলে ফালতু পয়সা দিতে হবে। সন্ধেটা তো পুরো মাটি হলই, অন্তত লোকসানটা কমুক। তাই আবার টেলিফোন বুথের দিকটা গেলাম। আর গিয়েই দেখি, যা ভেবেছিলাম, আবার সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ডায়াল করছে, কানে লাগিয়ে কি শুনছে, তারপর রেখে দিচ্ছে। এরকম চলছে। বাইরে আরো তিনটে লোক। একজন অধৈর্য্য হয়ে কাচের গায়ে একবার ধাক্কা দিলো। খিস্তি বিনিময়। কিন্তু বস ভেতরেই থেকে গেল। বুথের মধ্যে তো আলো নেই, রাস্তার কেলিয়ে পড়া আলোয় ভেতরটা প্রায় অন্ধকার। সেখানে বসকে অনেক লম্বা, অনেক শক্তপোক্ত লাগছিলো।
আমি দাঁড়ালাম ওখানেই। আমায় যখন দেখতে পায়নি, থাক। আশ মিটিয়ে ফোন করে নিক। ওপারে যে আছে, নির্ঘাৎ অন্য পাবলিকের সাথে নাইট শোয়ে। নয়ত চুপ করে ফোনের পাশে বসে রং নিচ্ছে। সব জানা আছে, বাওয়া। সব সালা সিনেমার মত। শুধু নাচগানগুলো মনে মনে হয়, নইলে সব এক।
এরকম করে আরো কতক্ষণ গেল, মনে নেই। আরো তিনটে ভাসান গেল। পার্ক সার্কাসের ক্রিস্টাল আর সুধীরের সাথে দেখা হলো। সুধীরের পিঠে ইয়াব্বড়ো কুঁজ আছে, তবে বিন্দাস ছেলে। বউ আছে একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে সদ্য। ছেলের কুঁজটুজ নেই বলে সুধীরও খুশি। বললো আসছে মাসে নাকি একটা ফ্ল্যাটবাড়ির কেয়ারটেকারের কাজ পাবে। মানে পেতে পারে। তাই এখন হুল্লাট মাল খাবে এই কদিন। ক্রিস্টাল মেয়ে না ছেলে কে জানে, তবে ভালো সেজেগুজে এসেছে। ওরা একটু হেজিয়ে তারপর এগোলো। আমি আবার বসের দিকে ফিরলাম। ঘড়িতে দেখি, এগারোটা বাজে। কি ব্যাপার রে ভাই! এত রাতেও ফোন শেষ হলো না? এবার ডাকতেই হবে, আর দাঁড়ানো যাচ্ছেনা। মাথাটা আবার ঘুলিয়ে উঠছে, ভিড় বাড়ছে, যদিও আজ ভাসানের দিন, তবু লোকে দলে দলে রাস্তায়। আলোর ফুল, লতাপাতা, প্রজাপতি, কে একজন ড্রাগন করেছে টুনি দিয়ে। প্যাঁ প্যাঁ করে হিন্দি গানের সুর দুমড়ে মুচড়ে পাক খেতে খেতে জমে উঠছে লোকের মধ্যে। রাস্তায় আজ এত লোক কেন, বস? বস ফোনবুথে একা। তাই ডাকতে হলো।”
আবার থামলো মানস। গাটা কেমন যেন করছে। মনিটরের লেখা আর প্রায় পড়া যাচ্ছে না। আন্দাজে লিখতে হচ্ছে। পাওয়ার বাড়লো? তবে কি সখ করে নেওয়া চশমা প্রতিশোধ নিচ্ছে? সত্যিই চোখটা গেল? আবার বরফঠান্ডা জল। আবার বাথরুম। মানসের সামনে কাচের আয়না। খুব বেশি দাম না। এই ফ্ল্যাট, এই একাকীত্ব, ফ্রিজের স্কচ বা সামান্য খ্যাতি।
মুখটা অস্বাভাবিক খসখসে লাগছে। নানাদিক থেকে টেনে ধরেছে মুখের চামড়া। টুয়েল্ভে বায়োলজি প্র্যাক্টিকালের টোড ডিসেকশন মনে পড়ে যায়। টানটান করে পিন করা, অচেতন কুনোব্যাঙ। পুরুষ ও স্ত্রী, সারিসারি। ছাত্রছাত্রীদের চোখ ঠারাঠারি, হাসি। স্ত্রীব্যাঙ গর্ভবতী হয়েছে বলে হাসি। যদিও সব বাচ্চা মরে ধুয়ে যাবে, তবু আনন্দের কথাই। অন্তত কিশোর কিশোরীদের কাছে।
সেইরকম টানটান পিন করা মুখের চামড়া মানসের, এখন। আয়নায় ভালো দেখা যায়না। দাড়ি কাটলে কি ঠিক হবে মুখ? মানস ভাবতে থাকে। কলটা খুলে দেয়। তারপর কি ভেবে চোখেমুখে জল দিয়েই বেরিয়ে আসে। লেখাটা শেষ করা দরকার।
“বুথের কাছে গিয়ে স্যার স্যার বলে ডাকলাম। সাড়া নেই। লোকটা ডায়াল করে যাচ্ছে। তারপর কাচের গায়ে টোকা দিলাম। এইসবের মধ্যে আরেকটা ঠাকুর গেল। লরিতে ঠাকুর, সাথে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে নাচছে। এবড়ো খেবরো রাস্তায় পড়ে টলমল করে উঠলো লরিটা। লক্ষী, সরস্বতীর কোমর জড়িয়ে, কার্তিকের হাত টেনে ধরে কোনক্রমে সামলালো লরির লোকজন। ওরা দূর্ভাগা, নাচতে পেলো না। প্রসেশনটা এগোতেই আবার আমি বুথের দিকে ফিরলাম। বস কানে ধরে আছে ফোনটা। কি শুনছে? কেউ কি সাড়া দিলো। কিন্তু নাহ! আবার সালা সেই একই কেস। আবার ডায়াল, আবার – । আমি এবার বুথের দরজাটা একটু ফাঁক করে ডাকলাম বসকে। বসের হাতে একটা কয়েন, নম্বর না লাগায় ফেলা হয়নি। বস আমার দিকে ফিরলো। হাতে ধরা রিসিভারে বাজছে মেয়েলি যান্ত্রিক গলায় শারদীয় প্রীতি ও শুভেচ্ছা। উবে যাওয়ার আগে বস বললো, আজ আমার কোথাও যাওয়ার ছিলো না রে।
আমি কিন্তু সরতে পারলাম না। প্রচন্ড আওয়াজ, মাথায় কে যেন হাতুড়ির বাড়ি মারলো। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরের দিন দুপুরে হাসপাতালে জ্ঞান এলো, শুনলাম শর্ট সার্কিট না কি থেকে আগুন লেগেছিলো। আমি অবশ্য কাউকে বলিনি। চোখের সামনে দেখলাম বস ভ্যানিশ হয়ে গেল। মাইরি বলছি, আগুন ফাগুন কিস্যু না। পুলিশ এসে কিনারা না পেয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে এইসব আলবাল বকছে।”
মানস অসহ্য যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করে উঠলো। মুখ, হাত পা, গা সমস্ত চিড়বিড়ে খসখসানিতে ভরে গেছে। ল্যাপটপটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে সে এক ছুটে বেসিনের কাছে গেল। আয়নায় অস্পষ্ট লাগছে, আগের মতই সব। গালে হাত দিয়ে দেখলো, চামড়ার মত কি যেন উঠে উঠে আসছে। ধবধবে সাদা চামড়ার মত। মানস বেশ ফর্সা, তবে এতটাও নয়। পেইন্টের মত চাকলা চাকলা উঠে আসছে, খসে পড়ছে মাটিতে। বুকের কাছে অল্প জ্বালাধরা ভাব। পেটের মধ্যে কি একটা যেন পাক খেয়ে ঘুরে উঠছে, অনি:শেষ। গলায় ধোঁয়াটে গন্ধ, আয়নায় সাদাটে প্রেতের মত ছবি। আর কিছু দেখা হয়না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেমন। একটা ট্রেন হুড়মুড় করে দুশো মানুষকে নিয়ে মুছে গেল। আন্দিজের কাছে ভেঙে পড়া ফ্লাইটের মানুষেরা নরমাংস খাচ্ছে। আরো প্লেন, আরো আরো সন্ত্রাসবাদী হাইজ্যাকার রাষ্ট্র সংঘ আত্মঘাতী বোমা মলোটভ ককটেল ট্যাঙ্ক গিজগিজ করছে লার্ভার মত ছবি হয়ে। তারপর অবশ্য একসময় ধোঁয়া কেটে যায়। স্পষ্ট হয় চোখের ঘোলাটেভাব। বোয়া কনস্ট্রিকটর এখন স্বাভাবিক। ভিয়েতনাম থেকে ফিরে কিসিঞ্জার ঘোষণা করেন “পিস ইজ অ্যাট হ্যান্ড।”
পরদিন বিখ্যাত সাহিত্যিক মানস বন্দ্যোপাধ্যায়কে তার ফ্ল্যাটে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। বিছানা, ইলেকট্রনিক্সের যা যা জিনিস, কাপড় জামা সব পুড়ে ছাই। মানসের দেহ শনাক্ত করা খুব দুঃসাধ্য হয়। যদিও আধুনিক প্রযুক্তিতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকেনা, তাই কদিনের মধ্যেই জানা যাবে দেহাবশেষটি মানসেরই। বাথরুমে, ঘরের মেঝেতে সাদা টুকরো টুকরো পাতলা চামড়ার মত পাওয়া গেছে। পরে জানা যাবে সেসব আসলেই মেক আপ মেটেরিয়াল। তবে একটা চ্যাপ্টা পাঁইটের বোতল, যাতে পেট্রলের গন্ধ, সেটা কী করে এলো, বুঝতে সময় লাগবে। বলা যায় না, পুজোর হিড়িকে আদৌ বোঝা যাবেই কিনা।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ নবারুণ ভট্টাচার্য্যের “আগুনের মুখ” গল্প, উৎসর্গঃ ঐ লেখককেই।)