কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন চলে গেল। একজন রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে কিছু একটা লেখা দরকার। আমার রবীন্দ্রগবেষণার শুরু ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপস্থিতি নিয়ে এক ধ্রুপদি গবেষনার মাধ্যমে যা ২০১১ সালের মে মাসে এখানেই প্রকাশিত হয়েছিল। ধ্রুপদী শব্দের অর্থ বিজ্ঞ পাঠকেরা নিশ্চয়ই জানেন কিন্তু যদি কেউ থেকে থাকেন যিনি জানেন না তার জন্য বলছি ধ্রুপদী শব্দের অর্থ হল গুরুগম্ভীর, চিরায়ত, ক্লাসিকাল ইত্যাদি। উল্লেখ্য, শব্দের অর্থ আমি এইমাত্র অনলাইন অভিধানের সাহায্য নিয়ে জানলাম। এর আগে শব্দটির সাথে পরিচয় ছিল কবি হেলাল হাফিজের কবিতার খাতিরে,
হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয় তো গিয়েছি হেরে
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।
ধ্রুপদী অস্পষ্টতা আসলে শেষ হবার নয়। এর প্রমান, আমার পূর্বের রবীন্দ্র গবেষণা ছিল ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের রবী ঠাকুরের মধ্যে কে আসলে সঠিক রবীন্দ্রনাথ তা বুঝতে না পারার অস্পষ্টতাকে কেন্দ্র করে। সেই অস্পষ্টতার অবসান হয় নি। এর মধ্যে কত কী গড়িয়ে গেল, লাফিয়ে গেল। ফেসবুকে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের মহড়াও হয়ে গেল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সংশ্লিষ্ট ধ্রুপদী অস্পষ্টতা হল আরো আরো ধ্রুপদী। আশংকার বিষয় ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সুতরাং, কোন মতেই আশা করা যায় না এ ধ্রুপদী বিভ্রান্তির কোন অবসান হবে।
কোন মহামানব যেন বলে গিয়েছিলেন বিভ্রান্তির অবসান না হলে বিভ্রান্তি উপভোগ করাই ভদ্রলোকের কাজ। কথাটা খারাপ না। হতাশায় আশার আলো। সুতরাং, বিভ্রান্তি কিছুটা উপভোগের চেষ্টা করা যাক,
জুকারবার্গ সাহেব এখন ফেসবুক সার্চ বেশ উন্নত করেছেন। আমরা তাতে যারপরনাই মুগ্ধ। ইদানীং ফ্রি ইন্টারনেট নাকী দিচ্ছেন। ঘরের খেয়ে বনের হাতি তাড়ানোর মত ব্যাপার স্যাপার। আমরা খুশি। শুধুমাত্র নিন্দুক লোকটা মাঝে মধ্যে বলে, এক্সিকম, এনএসএ ইত্যাদি নাকী ফেসবুক ইউজারদের তথ্য নিয়ে যায়।
বেকুবের মত কথা। আরে নিন্দুক আমাদের তথ্য নিবে না। আমাদের যে পরিমাণ ফেক আইডি আছে তথ্য নিলে উলটো ঝামেলায় পড়ে মাথার কয়েকটা তার ছিঁড়ে যেতে পারে ঐ কর্তাদের। তখন তাদের একমাত্র কাজ হবে ঘরে বসে বসে হ্যাংওভার ওয়ান টু থ্রি দেখা।
যাইহোক, রবীন্দ্রনাথে ফিরে আসা যাক। বলছিলাম জুকারবার্গ যে সার্চ সুবিধা ভালো করেছেন এর সুবিধায় আরো ভালো রবীন্দ্রনাথ খোঁজা যায় এখন। খোঁজে পেলাম অনেক অনেক রবীন্দ্রনাথ। ২০১১ সালে যাদের দেখেছিলাম তাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এর অর্থ কী?
এর অর্থ হল রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে যারা বলেন তারা ভুল বলেন। রবীন্দ্র জনপ্রিয়তা এখনো খট খট করে বাড়ছে। হু হু করে না বেড়ে খট খট করে বাড়ার অর্থ হল ফেসবুকে আইডি খুলতে কীবোর্ড চাপতে হয় এবং কবি বলেছেন, তখন খটখট শব্দ হয়।
প্রথমেই ফেসবুকের যে রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে হয় তার আইডির নাম হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(রিটার্ন)। তিনি “লাইক সাপ্লায়ার” নামে একটা কোম্পানির সিইও। অর্থাৎ তিনি লাইক সাপ্লাই করে থাকেন। কীসের বিনিময়ে এই লাইক সাপ্লাই হয় কে জানে! আপনি ইচ্ছে হলে তার কাছ থেকে লাইক নিতে পারেন। ফেসবুক সেলিব্রেটি বলে জনপ্রিয় একটি ব্যাপার আছে দেশের ফেসবুক অঙ্গনে। এরা নাকী এক মিথ্যাকে কয়েকশ লাইকের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে পারেন এমন কথা শোনা যায়। আরো শোনা যায় গোয়েবলস যদি এখন জন্ম নিতেন তাহলে নাকী ফেসবুক সেলিব্রেটি হয়ে লাইক বাড়িয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে দিনিশেষে স্ট্যাটাস দিতেন, মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া!
নিন্দুক ব্যাক্তিটি বলে, ফেসবুক সেলিব্রেটিদের অনেকেই নাকী লাইক কিনেন, গ্রুপে লাইক আদান প্রদান করেন অথবা অটোলাইক নামের এক মহিমান্বিত সুলেমানি টুল ব্যবহার করেন।
আমরা নিন্দুককে থামিয়ে দিতে বলি, খামোশ!
নিন্দুক বন্ধ হয়ে যায়। কেউ খামোশ বললে সে আর কিছু বলতে পারে না। এটাই তার নিয়তি।
এখন পরের রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকানো যাক।
আইডির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভানুসিংহ)। এই রবীন্দ্রনাথ ইয়ো ইয়ো হানি সিং এর গান শুনেন। হানি সিংকে দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতের এলবাম করানোর ইচ্ছাতার আছে কী না কে জানে। ইনার বিশেষত্বটা হল তিনি ভানুসিংহ নামটাকে ছেড়ে দেন নি। ব্র্যাকেটে রেখে দিয়েছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কবিগুরু ব্লগার হলে তার নিক হত ভানুসিংহ। ছদ্মনামটা রাখার জন্য দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ছোট একটি ধন্যবাদ পাওয়ার দাবীদার।
আরেকজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রোফাইল পিকচারে শাহরুখ খানের ছবি দেয়া। লেখা দেখলাম তিনি টিটিপিতে কাজ করে। জুনিয়র অফিসার। টিটিপি কি জিনিস? ট্র্যানপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তো টিআইবি। গুগলের শরণাপন্ন হতে হল। টিটিপি মানে বের হল তেহরিক-ই-তালেবান। সুতরাং, আতংকিত অবস্থায় সেই রবীন্দ্রনাথের প্রোফাইলের ট্যাবটা বন্ধ করে দিতে হল। ইনি আগ্রাসী রবীন্দ্রনাথ। প্রাচীন প্রবাদে আছে, আগ্রাসী রবীন্দ্রনাথ থেকে শত হস্ত দূরে থাকুন।
আরেকজন রবীন্দ্রনাথ তার আইডির নাম দিয়েছেন “আমি সেই রবীন্দ্রনাথ”। কিন্তু তার প্রোফাইল পিকচারে ঝুলছে মেসির ছবি! এমন প্রকাশ্য স্ববিরোধীতা মনে হয় পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ কখনো করে নি।
আরেক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন তিনি ঠাকুর ক্যাসিনোর মালিক। কিন্তু লেখা আছে তিনি পড়ালেখা করেছেন বাগেরহাট গার্লস হাই স্কুলে। গার্লস স্কুলে তিনি কেন এবং কীভাবে অধ্যয়ন করলেন তা এক ছোটখাট রহস্য। সেই রহস্যের সমাধান হলেই হয়ত জানা যেত ঠাকুর ক্যাসিনোটা কোথায়? এবং সেখানে কী বুকোস্কি, নেরুদা এবং জীবনানন্দ দাশ একসাথে মিলে আড্ডা দেন? কিন্তু এসব রহস্য সমাধান হবার নয়।
রহস্য নিয়ে এগিয়ে গিয়ে আরেকজন রবীন্দ্রনাথ পাওয়া গেল যিনি ম্যারিড টু মৃণালিনী দেবী। এবং দেখা গেল মৃণালিনী দেবীরও ফেসবুক একাউন্ট আছে। তারা এখন একসাথে ফেসবুকে ঘর করছেন। এই মৃণালিনী দেবী পড়ালেখা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রোফাইলে দেয়া আছে ওয়ার্কস এট “রবীন্দ্রনাথের বাড়ি”। তার প্রোফাইল তথ্য মতে তিনি ২০১৪ সালের এপ্রিলের এক তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের ভদ্রলোককে বিয়ে করেন।
এই রবীন্দ্রনাথের ওয়ালে আরো দেখা গেল অনেকে জন্মদিনের উইশ করে বলছেন, “বার্থডে দাদা” কিংবা “এইচবিডি”।
আরো অনেক অনেক রবীন্দ্রনাথ আছেন। কেউ চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে মার্কেটিং এ অনার্স করছেন, কেউ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন, কেউবা কমার্স কলেজের ছাত্র। শুধুমাত্র বাংলাতেই এরকম শ খানেক রবীন্দ্রনাথ আছেন।
এবার ইংরেজিতে “Rabindranath Tagore” লিখে সার্চ দিয়ে মিচ্যুয়াল ফ্রেন্ডযুক্ত একজন রবীন্দ্রনাথের দিকে যাওয়া গেল। মিচ্যুয়াল ফ্রেন্ডটি একটি অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা। এই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষালয়ে লেখা তিনি স্কুলপলাতক। প্রোফাইল তথ্য মতে, ইনি আবার শেলী, স্কট, বালজাক ও চেখভ পড়া লোক।
আরেকজন রবীন্দ্রনাথ পাওয়া গেল যার আইডি নাম রবীন্দ্রনাথ অরিজিনাল ঠাকুর। ব্র্যাকেটে তার ডাক নাম রবি। নামের মাধ্যমেই তিনি সরাসরি দাবী করছেন তিনিই অরিজিনাল। তার বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা দেড়শোর উপরে।
আরেক রবীন্দ্রনাথের ডাকনাম হচ্ছে পাবলো নেরুদা। ব্র্যাকেটে সে নাম শোভা পাচ্ছে। তার প্রোফাইল পিকচারেও নেরুদার ছবি। তবে কভার পেজে আছে কবিগুরুর দাড়িওয়ালা ছবি। মজার ব্যাপার হল এই রবীন্দ্রনাথ হয়ত বাঙালী না। তার পোস্টগুলো অদ্ভুত এক ভাষায় দেয়া। মহান গুগল অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে জানা গেল ভাষাটা স্প্যানিশ। তিনি যেসব গ্রুপে আছেন সেগুলোও স্প্যানিশ, তার বন্ধুরাও অবাঙ্গালী।
বিদেশী রবীন্দ্রনাথ পাওয়ার পর হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু হল বিদেশীনি। অবশেষে একজন বিদেশীনিকে পেলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাগোর নামে। তিনি ফিলিপাইনে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের ওগো বিদেশীনি , চিনি গো চিনি সার্থক।
এক রবীন্দ্রনাথ থাকেন মেরিদায়। মেরিদা দেখেই ভদ্রলোকের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। ইউকাটান পেনিনসুলার শহর মেরিদা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ইউকাটান অঞ্চলের স্প্যানিশ কনকুইস্ট্রেডর মন্টেজো দ্য ইয়ংগার। তথ্যটা জানা কারণ এইসব প্রেক্ষাপটেই গ্যাডফ্লাই লিখতে হয়েছে। সুযোগমত নিজের বইয়ের নাম বলে দেয়া গবেষকদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমি বলার সাথে সাথেই নিন্দুক গর্জে উঠল, “****পনা করো?”
আমি চুপ করতে বাধ্য হলাম। ইচ্ছা ছিল গ্যাডফ্লাই নিয়ে দুয়েক লাইন লিখে ফেলব। কিন্তু নিন্দুক থাকতে তা কী আর সম্ভব?
এখন প্রশ্ন হতে পারে ****পনা কী?
বাংলাদেশের এক “কিংবদন্তী” লেখকের যেকোন লেখায় নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন করার বৈশিষ্ঠ্য প্রবল। তার নামানুসারে এই প্রবণতার একটা নাম দেয়া হয়েছে। বাংলা শব্দ ভান্ডারে যোগ হয়েছে এক নতুন শব্দ। সেই শব্দটিই হচ্ছে ****পনা। কিন্তু কে কী মনে করেন ভেবে নিন্দুকের কথাটি সেন্সর করা হয়েছে এবং এখানে বলছি না। তবে আপনার ইচ্ছে হলে অনলাইনে খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। নাম তার চার অক্ষরের। ধাঁধা হিসেবেই থাক।
“কিংবদন্তী” লেখকদের কথা বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথে ফেরা যাক। আরেক রবীন্দ্রনাথ পাওয়া গেল যিনি তুর্কি বীর কামাল পাশার দেশে থাকেন। আরেকজনের প্রোফাইল পিকচারে দেখা গেল ট্রফি হাতে হাস্যোজ্জ্বল সৌরভ গাঙ্গুলীর ছবি।
আরো শয়ে শয়ে রবীন্দ্রনাথ আছে। এবং এই শেষ না। এখানে তো “Tagore” দিয়ে সার্চ দিয়েছি। “Thakur” লিখে দিলে আরো বেরোবে। নাম আরেকটু উলটে পালটে দিলে আরো। এভাবে বেরোতেই থাকবে।
এত এত লোক রবীন্দ্রনাথের ছবি দিয়ে, তথ্য দিয়ে আইডি খুলছে! আইডি খোলাও তো কম ঝামেলার কাজ না। তথ্য গুলো দাও, নাম লিখো, পাসওয়ার্ড দাও, ইমেল ভেরিফিকেশন করো, ছবি যোগ করো ইত্যাদি ঝামেলা। তাও মানুষের রবীন্দ্রনাথ হয়ে আইডি খোলার শেষ নেই। এটা তো এমন ব্যাপার না যে তাদের খুব লাভ হয়ে যাবে, লোকজন দৌড়ে এসে বলবে, গুরুদেব পায়ের ধুলো দিন।
তবুও লোকেরা তার নামে আইডি খুলছে তার মৃত্যুর এত বছর পরেও। এটা কে কী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের এক বড় অর্জন বলা যায় না?