নতুন এপার্টমেন্টে ওঠার পর আমার অস্বস্তি লাগার পরিবর্তে কিছুটা ভালো লাগছিল এই কারণে যে এই এলাকাটা বেশ নির্জন। বিশেষত রাতের বেলায়। শহরের মধ্যে এমন নিরিবিলি জায়গায় থাকতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি দশতলার তিনটা রুম নিয়ে ছিলাম। আমার পাশে, সামনে এবং নিচে আরো অনেকেই ছিলেন এবং তাঁদের কাউকেই আমি চিনি না। কারো সাথেই কথা হয় নি।
শুধুমাত্র চিলেকোঠায় থাকায় সেই লোকটা ছাড়া। এই লোকটার সাথে প্রথমদিন সকালেই আমার কথা হয়েছিল। আমি সকালে কাপভর্তি চা হাতে নিয়ে ছাদে গিয়েছিলাম। সকালের রোদে ভিটামিন ডি আছে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন প্রথম ‘রোদে ভিটামিন ডি আছে’ ব্যাপারটা জানতে পারি আমার দাদীর কাছ থেকে। আমার দাদী বেশ বুদ্ধিমান মহিলা ছিলেন। তিনি সকালের রোদে বসে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প করতেন। তাঁর মৃত্যুও হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। কিন্তু সেটা ঠিক কীভাবে তা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। বড় হবার পর আমাকে জানানো হয় নি এবং আমিও জানার চেষ্টা করিনি।
যাইহোক, আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছাদে গিয়ে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাপে শব্দ করে চুমুক দিচ্ছিলাম তখন পিছন থেকে লোকটি বলে উঠল, এখানে নতুন এসেছেন?
তাঁর কণ্ঠস্বর মধুর ও মায়াবী।
আমি মাথা ঘুরিয়ে লোকটিকে দেখতে পাই। চিলেকোঠার সামনে সে বসে আছে। হাতে খুব হালকা একটি লাঠি। তার কোঁকড়া চুল, কপালে ভাঁজ, পরনে খয়েরি রঙের আলখাল্লা জাতীয় পোশাক।
আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। গতকাল এসেছি। আপনি কি এই ঘরেই থাকেন?
লোকটি জবাব দিল, হ্যাঁ। এই চিলেকোঠায়। এটাই আমার ঘর।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন ধরে আছেন?
লোকটি গম্ভীর হয়ে বলল, অনেকদিন।
এই প্রথম তার সাথে আমার কথা হয়। এর পর যখনই ছাদে যেতাম তখন তার সাথে বিভিন্ন রকমের গল্প হত। আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতাম তাই সাধারণত সকাল বেলা চায়ের কাপ হাতেই ছাদে যেতাম বেশি। ছুটির দিনে কখনো কখনো বিকেলের দিকে। বিকেলের আকাশ আমার খুব ভালো লাগে। এই সময়ে আকাশ আস্তে আস্তে রং বদলায়। এর বৈজ্ঞানিক কিছু কারণ আছে। সূর্যরশ্মির বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্ছুরণ।। কিন্তু ওসব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। বিকেলের পশ্চিম আকাশ যখন নিজের রং বদলাতে বদলাতে সন্ধ্যার দিকে ধাবিত তখন আমার একে মনে হয় কিছু মধ্যবিত্ত অসম্পূর্ণ স্বপ্নের অব্যক্ত প্রগাঢ় বেদনার সম্মিলিত রূপ। যখন সময় পেতাম তখন আমি এই বেদনার গাঢ় রং বোঝার চেষ্টা করতাম, যদিও আমার জীবনযাপনের সাথে এর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
বিকেলেও আমি যখন দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশ দেখতাম তখন লোকটা এসে বিভিন্ন কথা জুড়ে দিত।
একবার বলল, আপনি কি ফ্রয়েড পড়েছেন?
আমি বললাম, না। তবে নাম শুনেছি।
লোকটি বলল, ফ্রয়েডের মতে আমাদের এক অবচেতন সত্তা আছে। সেখানে আমাদের অপূর্ণ সব ইচ্ছা সমস্ত শক্তি নিয়ে জমা থাকে। তারপর কোন এক ফাঁকতালে সচেতন মনে প্রবেশ করে ঘটায় বিস্ফোরণ।
লোকটা বেশ শব্দ করে হাসল এই কথা বলে।
তারপর আস্তে করে বলল, আসলে ব্যাপার কী জানেন, আমার এরকম একটা ইচ্ছা অবচেতন মনে সেই কবে থেকে জমা হয়ে আছে। দিন দিন তার শক্তি বাড়ছে। আর ইদানিং সচেতন মনে আসারও চেষ্টা করছে। আর আমি সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিয়ে চলেছি।
আমার বেশ আগ্রহ হল। জিজ্ঞেস করলাম, ইচ্ছাটা কী?
লোকটি মুখভঙ্গি পরিবর্তন না করে ছাদের রেলিং ধরে নিচে তাকিয়ে বলল, এখান থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ার ইচ্ছা।
আমার মনে হল লোকটা মজা করছে। হয়ত অন্য কোন ইচ্ছা যা সে আমাকে বলতে চায় না। অবচেতন মনের ইচ্ছা বলে বেড়ানোর মত ব্যাপার না নিশ্চয়ই। তাই আমি আর জানতে চাইলাম না।
সেদিন এরকমই আরো অনেক কথাবার্তা হয়েছিল আমাদের। সে তার পরিবারের অনেকে, বন্ধুদের অনেকে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে কিংবা কেউ পানিতে ডুবে, কেউ বাঘের আক্রমণে মরেছে তার গল্প মজার ভাষায় বর্ণনা করতে লাগল।
মনে আছে সেদিন সন্ধ্যা নামার অনেক পরে আমি রুমে ফিরেছিলাম।
এরপরের একদিন সকালে চায়ের কাপ নিয়ে রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। আমার কোন উচ্চতাভীতি নেই তাই নিচে দাঁড়িয়ে লোকজন, গাড়ি ইত্যাদি দেখছিলাম এমন সময় পিছন থেকে লোকটা কথা বলে আমাকে এতই চমকে দিল যে হাত থেকে চায়ের কাপ নিচে পড়ে গেল।
লোকটা জিজ্ঞেস করেছিল, এখানের উচ্চতা কত হবে বলতে পারেন?
হঠাৎ করে কথা শুনে আমি চমকে উঠি। হয়ত কোন চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলাম। লোকটার কোন দোষ নেই। তবুও সে লজ্জিত মুখে স্যরি স্যরি বলল কয়েকবার। তাতে আমারই খারাপ লাগছিল।
তাকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, ঠিক আছে। আমিই আসলে অন্যমনস্ক ছিলাম। তা কী জিজ্ঞেস করেছিলেন যেন? উচ্চতা? এখানের উচ্চতা প্রায় ১২০ ফিট তো হবেই। কী বলেন?
লোকটার মুখ স্বাভাবিক হয়ে উঠল। সূর্যের নির্মল আলো পড়ছিল তার বয়সের রেখাযুক্ত মুখে। তাকে দেখাচ্ছিল একজন জ্ঞানীর মত। আমার তখন মনে হয়েছিল, এরকম একজন জ্ঞানীর কাছেই হয়ত বিড়ালের মত ঘাপটি মেরে বসে জীবনের পরম কিছু জ্ঞান।
লোকটা বলল, লাফ দেয়া যায় অবশ্য। ১২০ ফিট খারাপ উচ্চতা না। আপনি সিসিফাস কে চিনেন?
আমি বললাম, না। ইনি কে?
লোকটা হাসিমুখে বলল, এই যে, আমি! এবং আপনিও। আর আপনি আপনার চারপাশে যত মানুষজন দেখেন সবাই একেকজন সিসিফাস। গ্রীক মিথলজিতে সিসিফাসকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। বিশাল এক পাহাড়ে বড় সাইজের পাথর গড়িয়ে পড়ছে, সিসিফাস সর্বশক্তি দিয়ে একে উপরে তুলছে। উপরে তোলার পর সে একটু দাঁড়ালেই পাথর আবার গড়িয়ে নিচে পড়বে, সিসিফাস বারবার একে টেলে তুলতে থাকবে। অনন্তকাল। এটা তার শাস্তি। আমাদের সবার জীবনের সাথে সিসিফাস মিথের বিস্ময়কর মিল আছে। আমরা অদৃশ্য এক পাহাড়ে অদৃশ্য বিরাট পাথরকে টেনে তুলছি নিরন্তর। কী মনে হয় আপনার, ঠিক না ?
আমি বললাম, খারাপ বলেন নি।
সেদিন আর বেশি কথা হয়নি। আমার অফিস ছিল। এরপর আমি এই বিল্ডিংয়ে ছিলাম তিনমাস। বাকিদিন গুলোর প্রতিদিনই একবার আমি তার কাছে যেতাম। সে চিলেকোঠায় থাকলে ডেকে বের করে আনতাম। সেদিনের সূর্যালোক আমার সামনে যেন লোকটিকে অন্যরকম ভাবে উদ্ভাসিত করেছিল।
আমি তার কাছে গিয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতাম। আমার দিনযাপনের কথা, ইট সিমেন্ট এবং কর্পোরেট দুনিয়ার মানুষদের কথা, পেট্রোল পোড়া গন্ধ এবং কপট সময়ের গল্প। সে বলত তার কথা। কীভাবে এখান থেকে লাফ দেয়া যায়, লাফ দিয়ে নিচে পড়তে পড়তে সে কী চিন্তা করবে, তার ওজনহীন অনুভূতি হবে কি না, লাফ দিলে সে অনন্তকাল নিচে পড়তে থাকবেই কি না- ইত্যাদি নানা ধরনের কথাবার্তা। আমি তার কথাগুলো নিয়ে প্রায়ই ভাবতাম অনেক রাত পর্যন্ত।
তারপর আজ সকালে গিয়ে দেখতে পেলাম রেলিঙের ধারে সে লাফিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সকালের সূর্যের আলোতে আমার মনে হল এ যেন বৃদ্ধ এক মহাজ্ঞানী, যিনি বোধিলাভের পর মহাশূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার ভেতরে এক ধরনের শূন্যতার বোধ হল। খাঁ খাঁ শূন্যতা।
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ঐ ঘরকে চিলেকোঠা কেন বলে জানেন?
আমি উত্তর দিলাম, না।
লোকটা বলল, প্রথম যিনি এ ধরনের ঘর তৈরী করেন তিনি তা বানিয়েছিলেন চিলদের থাকার জন্য। তাঁর ছিল কয়েকটি পোষা শঙ্খচিল। ওই ঘরে থাকার সময় আমার মাঝে মাঝে নিজেকে মনে হত শঙ্খচিল। আজ দেখা যাক উড়তে পারি কি না।
আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে মায়াবী একটা হাসি দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ল। আমি নিচে তাকিয়ে দেখলাম লোকটা কিছুদূর নিচে নামার পর আটকে আছে। বিস্ময়ে দম বন্ধ হয়ে এল।
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম আমি। কী করব ভেবে না পেয়ে রেলিঙের উপর উঠে লাফিয়ে পড়লাম নিচে।
এখন আমি পড়ে আছি এই বিল্ডিং এর সামনে। চারপাশে মানুষ ভিড় করেছে। পুলিশ এসেছে। আর আমি মরে গেছি। লোকটাকে দেখেছি চিল হয়ে উড়ে যেতে। এবং মরার ঠিক আগ মুহূর্তে আমার মনে পড়েছে, আমার দাদীও এভাবে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন।