প্রথম পর্ব
-----------
ডাঃ পার্থসারথি গুপ্ত স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে আমন্ত্রিত হয়ে আমি সত্যিই সম্মানিত।
কিন্তু, একেবারে শুরুতেই একটু সাফাই গেয়ে রাখি।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি বা চিকিৎসা ও দুর্নীতি , এমন একটা গোলমেলে বিষয় নিয়ে বলার জন্যে পুণ্যদা বা জয়ন্তদা কেন আমার মতো অর্বাচীনকে বাছলেন, সেইটা আমার কাছে একেবারেই পরিষ্কার নয়। উত্তরটা ওনারাই দিতে পারবেন। সুবক্তা আমি কোনোকালে নই, কাজেই আমি তেমন গুছিয়ে বলতে পারবো না। স্পষ্টভাষায় কথাটা আগেই বলে রাখলাম, পরে দোষ দেবেন না। খুব অসহ্যবোধ হলে গালাগালিটা এঁদের দুজনকে দেবেন।
তদুপরি, বিষয়টা নিয়ে আমার জ্ঞানগম্যি নেহাতই কম। তাই এও বলে রাখি, খুব বেশী তথ্যটথ্য আমার কাছ থেকে আশা করবেন না। এরপরেও যদি শুনতে আগ্রহী হন, তাহলে আসুন, খুব জটিল না করে, একটু অগোছালোভাবেই, বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করে দেখি।
প্রথমেই, দুটো অবান্তর গল্প।
একটা চালু কথা আছে, মাছ কখন জল খায় আর রাজপুরুষ কখন ঘুষ নেন, স্বয়ং দেবতাও জানতে পারেন না, মানুষ তো কোন ছার!!
তা ধরুন, উদাহরণ হিসেবে, পুলিশের কথা বলি। পুলিশের দুর্নীতির কথা বলতে গেলে, আপনার চোখে ভাসে রাস্তার মোড়ে লরি দাঁড় করিয়ে, হাত বাড়িয়ে উৎকোচ গ্রহণ। এই ইমেজটাই সবার আগে মাথায় আসে। তাই না? আর, রাস্তায় পুলিশ লরি দাঁড় করালেই আপনার মনে হয়, দেখেছো, ব্যাটা ঘুষ নেবে!! অর্থাৎ, সব পুলিশকেই আপনি ঘুষখোর ভেবে বসেন এবং পুলিশের যেকোনো কাজের পেছনেই আপনি অসদুদ্দেশ্য খোঁজেন। মানে, পুলিশ যদি সত্যিসত্যি তল্লাশি করার জন্যেও লরি দাঁড় করান, বা গাড়ির কাগজপত্র দেখার জন্যে, আপনার ভরসা হয় না। আর, যেহেতু আপনি ধরেই নিয়েছেন যে পুলিশ মাত্রেই দুর্নীতিপরায়ণ আর তাঁদের সব কাজকম্মোই বিভিন্ন অসদুদ্দেশ্যে পরিচালিত, তাই পুলিশের উপর দুষ্কৃতিরা চড়াও হলে, আপনার বিশেষ কোনো হেলদোল হয় না। একটি ইমেজের ছাঁদে সবাইকে বাঁধতে চাইলে, বা সাধারণীকরণ করতে চাইলে, এইটাই সমস্যা।
অবস্থার ফেরে, ডাক্তারেরাও এখন সেই পরিস্থিতিতে পৌঁছেছেন। কিছু ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করানোর বিনিময়ে কমিশন পেয়ে এবং নিয়ে থাকেন, এর উপর ভিত্তি করে আপনি ধরেই নিচ্ছেন যে, ডাক্তার মাত্রেই কমিশনখোর আর পরীক্ষানিরীক্ষা মাত্রেই কমিশনের লোভে করানো। অতএব, পুরো ডাক্তারি পেশাটার উপরেই আপনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন। আর, ডাক্তার আক্রান্ত হলে, সামান্য সহানুভূতিটুকুও জাগা দূরে থাক,উল্টে,অনেকসময় মনে হচ্ছে, বেশ হয়েছে, ঠিক শায়েস্তা হয়েছে।
না, আমি একবারও বলছি না যে, ডাক্তারদের মধ্যে কেউই কমিশনের লোভে পরীক্ষানিরীক্ষা করান না, বা তাঁদের সেই কাজ নিন্দনীয় নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, একই মাপে ফেলে সবার বিচারটি দায়িত্বজ্ঞানহীন, এবং এমন ধাঁচের ভাবনার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী।
এছাড়াও, বিষয়টার অন্য পিঠটাও ভেবে দেখুন। পুলিশের দুর্নীতি বলতেই আপনি যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুষ খাওয়া বোঝেন, তাহলে আপনি পরিস্থিতির অতিসরলীকরণ করে ফেলছেন। মোক্ষম দুর্নীতির ছবিগুলো থেকে আপনার চোখ সরে আসছে। ধরুন, এই রাজ্যের কিছু উদাহরণ নিই। যেমন, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণগুলো একে একে বিনষ্ট করা। যেমন, একটি গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে আন্দোলনকেই শেষ করা। যেমন, একটি বোমা বিস্ফোরণে মানুষ মারা গেলেও, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ আসার আগেই তড়িঘড়ি জায়গা সাফ করে প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা। হ্যাঁ, এই দুর্নীতিগুলো বা এর পেছনে যে রাজনৈতিক স্বার্থ বা শ্রেণীস্বার্থ, সেইগুলো আপনার নজরে পড়ে না।
চুনোপুঁটি নিয়ে যদি আপনাকে ভুলিয়ে রাখা যায়, তাহলে রাঘববোয়ালদের ভারী সুবিধে।
সামনে বসে থাকা চিকিৎসককে চিটিংবাজ চশমখোর ভেবেই আপনার গায়ের ঝাল মিটে গেলে, বৃহত্তর সমস্যাটি আপনার নজরের বাইরে রয়ে যায়। চিকিৎসা ব্যবস্থাটিই যে গলদে ভরা, সেইটা আপনার ক্ষোভের বৃত্তের বাইরে রয়ে যায়। ডাক্তারের উপর ক্ষোভ উগরে দিতে পারলে, ডাক্তারকেই একেবারে কমিশনখোর-অর্থপিশাচ ধরে ঘেন্না করতে পারলে, আপনার ক্ষোভের তাৎক্ষণিক উপশম হচ্ছে। আর সেই সেফটি ভালভের সুবাদে বেঁচে যাচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণীস্বার্থ। ক্ষমতার মানুষেরা সেইটাই চান। আপনার এমন ভুলে থাকায় তাঁরাও খুশী, ডাক্তারকে গালি দিতে পেরে আপনিও খুশী। তাই না? একটু ভাবুন। ততোক্ষণ পরের গল্পটা বলি।
দ্বিতীয় গল্পটা একটু দূরের। আমেরিকার ফ্লোরিডায়। অবশ্য এমন ঘটনা আমাদের আশেপাশেও ঘটে, কাশ্মীর বা চেন্নাইয়ে বন্যার সময় আচমকা বিমানের ভাড়া কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো তো বেশীদিনের নয়। কিন্তু, একটু বিদেশী উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা জমকালো হয়।
তা, ফ্লোরিডায় সেবার বড়ো ধরণের ঘূর্ণিঝড় হয়। সব ভেঙেচুরে তছনছ। যাতায়াত ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ পরিষেবা সবই বিপর্যস্ত। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি। এই অসহায় সময়ে, বেশ কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী মোটা টাকা মুনাফার সন্ধানে মাঠে নামেন। জিনিসপত্রের দাম হয় আকাশছোঁয়া। এমনকি, বাড়ির উপর গাছের ডাল পড়ে থাকলে, সেই ডাল সরানোর জন্যে হাঁকা হয় চারগুণ দাম।
পরিস্থিতি এবং মানুষের ক্ষোভ হাতের বাইরে গেলে আদালত এই বর্ধিত মূল্যকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এবং সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পান।
কিন্তু, আদালতের এই বিচার কিছু অর্থনীতিবিদের পছন্দ হয় না। যাঁরা কিনা বাজার অর্থনীতি বা মুক্ত বাজারের অপার ক্ষমতায় আস্থা রাখেন, তাঁরা তো চটে লাল।
একজন বললেন, এইভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়া ভালো। দাম বাড়লে আরো বেশী মানুষ জিনিসটা বানাতে থাকবেন। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। উৎপাদন বাড়লে জিনিসের দাম কমবে। ক্রেতার ভালো। একইকথা পরিষেবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আরেকজন বললেন, বাড়তি বা লাগামছাড়া দাম আবার কী!! দাম তো একটা গতিশীল ব্যাপার। চাহিদা আর জোগানের অঙ্কেই দাম নির্ধারিত হবে। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, বেশী দাম পেলে জোগান বাড়বে, তাইতে দাম কমবে। দাম বেঁধে দেওয়াটাই একটা ভ্রান্ত ধারণা।
এসবের উত্তরে আদালতের বিচারক যে কথাটা বললেন, সেইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বললেন, মানুষ যখন বিপদে পড়ে, বা ক্রাইসিসের সময়, এইসব চাহিদা-জোগান ইত্যাদি বাজার অর্থনীতির ধারণা সেখানে প্রযোজ্য নয়। কেননা, মুক্ত বাজার বা ক্রেতার পছন্দের অধিকার সেইখানে থাকে না। মুক্ত বাজারে মানুষের দামে না পোষালে, তিনি জিনিসটা না কিনে চলে যেতে পারেন। বিপদে পড়লে, মানুষ জিনিসটা কিনতে বাধ্য, যে দামেই হোক না কেন। আর, তিনি যদি জিনিসটা কিনতে না পারেন, আর্থিক অসামর্থ্যের জন্যে, তাহলে তিনি আরো গভীর সঙ্কটে পড়েন। এইখানে বাজারকথিত চয়েসের স্বাধীনতা বা বেছে নেওয়ার অধিকার রক্ষিত হবে কেমন করে!!
ফ্লোরিডার সেই বিচারকের কথাটি আমাদের স্বাস্থ্যপরিষেবার ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তাই না? বাজার অর্থনীতির নিয়মে স্বাস্থ্যপরিষেবাকে চলতে দেওয়ার বিরুদ্ধে কয়েকটি অমোঘ যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, বাজারের অত্যাবশ্যক শর্ত, তথ্যের সাম্য। অর্থাৎ, ক্রেতা এবং বিক্রেতা দুজনেই কেনার জিনিসটা নিয়ে সমান অবগত থাকবেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে, হাজার গুগলের সহায়তা সত্ত্বেও, চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে এই তথ্যের সাম্য আসা একেবারে অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, ফ্লোরিডার বিচারকের যুক্তিটি। কেনার বাধ্যবাধকতা কাজ করলে বাজারের নিয়ম খাটে না। আপনার যদি দামে না পোষায়, এবং তদসত্ত্বেও যদি আপনি কিনতে বাধ্য হন, তাহলে বাজারের নিয়ম চললো কি? আপনি যদি সত্যিই অসুস্থ হন, তাহলে তো আপনি যেকোনো মূল্যেই, ঘটিবাটি বিক্রি করে হলেও, চিকিৎসা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতি বছর, এই দেশে কয়েকলক্ষ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাচ্ছেন, স্রেফ চিকিৎসার খরচ জোগাতে না পেরে। অন্তত খাতায়কলমে, তত্ত্বগতভাবে, বাজার অর্থনীতি কিন্তু এমন পরিস্থিতির কথা বলেন না। তৃতীয়ত, বাজারের নিয়ম অনুসারে, ক্রেতা এবং বিক্রেতার সম্পর্কটি সরাসরি এবং সেইখানে তৃতীয় ব্যক্তির সরাসরি লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রশ্ন নেই (মধ্যবর্তী মুনাফাভোগী বা দালালের প্রশ্ন আনছি না)। কিন্তু, খরচে না পোষালে একজন সংক্রামক ব্যাধির রোগী যদি চিকিৎসা না করানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ক্রেতার সেই সিদ্ধান্তের মাসুল জোগাতে হচ্ছে বৃহত্তর সমাজকে। ধরুন, টিবির চিকিৎসা।বাজারের তোয়াক্কা না করেই সরকার এখনো পর্যন্ত টিবির ওষুধ সরবরাহ করছেন বিনামূল্যে। কিন্তু, বাজার তো এমন আচরণ বরদাস্ত করে না। ধরুন যদি টিবির ওষুধ রোগীকে গাঁটের কড়ি খরচা করে কিনতে হতো?আর সেই ওষুধের দাম হতো ক্যানসারের চিকিৎসার মতোই দুর্মূল্য? তেমনটি হলে, অবশ্যম্ভাবীভাবেই, খরচ এড়াতে বেশ কিছু রোগী যদি চিকিৎসা বন্ধ রাখতেন, বা আদ্ধেক খেয়ে চিকিৎসাই ছেড়ে দিতেন?সার্বিকভাবে মাল্টিড্রাগ-রেজিস্টান্ট টিবির বিপদটি কিন্তু আমাকে বা আপনাকেও ছাড়তো না।আর, চার নম্বর যুক্তিটি, কিছুটা দর্শনের। চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে সম্পর্কটি বিশ্বাসের।পরিস্থিতির হাজার বদল সত্ত্বেও, এই বিশ্বাসের সম্পর্ক না থাকলে,আর যাই হোক, চিকিৎসা হয় না।এই বিশ্বাসের মধ্যে বাণিজ্য ঢুকলে বিশ্বাস অটুট থাকে কী? আর, বাজারের অনিবার্য নিয়ম বা শর্ত হলো, এই মুনাফা উপার্জন। আমার কথা নয়, অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো সেই ষাটের দশকের গোড়াতে, যখন স্বাস্থ্যপরিষেবায় বাজারের প্রবেশ অনিবার্য বলে ভাবানোর পদ্ধতিটি শুরু হচ্ছে, বলেছিলেন, “the very term ‘profit’ denies trust relations”. কাজেই, বাজার এবং বিশ্বাস হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। বাজারের নিয়মে স্বাস্থ্যপরিষেবা চলবে, আবার একইসাথে রোগী-চিকিৎসকের সনাতন বিশ্বাসের সম্পর্কটি অটুট থাকবে, এ ভাবনায় যথেষ্ট যুক্তি নেই।
তাহলে,স্বাস্থ্যের মতো একটি অত্যাবশ্যক বিষয়কে বাজারের সদিচ্ছার হাতে ছেড়ে দেওয়া, স্বাস্থ্যের মতো একটি জরুরী বিষয়কে পণ্য হিসেবে ভাবতে শেখানো বা স্বাস্থ্যকে শুধুই চিকিৎসার সাথে এক করে বিবেচনার অভ্যেস তৈরী করে বাণিজ্যের জমিটি তৈরী করা, এইসবের পেছনে রাষ্ট্র-কর্পোরেট যেমনভাবে একাকার হয়ে রয়েছে, আসুন সেই দুর্নীতিকে চিনতে শিখি।সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হই।
আগেই বলেছি,চুনোপুঁটি নিয়ে ভুলে থাকলে রাঘববোয়ালদের ভারী সুবিধে হয়।সত্যি বলতে কি, রাঘববোয়ালেরাই সামনের দিকে উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে রেখেছে,যাতে ওই চুনোপুঁটিরা সামনে ঘুরঘুর করে, আর আপনার নজরটি যাতে সেইখানেই আটকে থাকে।সিস্টেমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ চুনোপুঁটির উপরে উগরে দিয়ে আপনি যতোদিন সন্তুষ্ট থাকবেন, রাঘববোয়ালেরা ততোদিন করেকম্মে খেতে পারবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতি নিয়ে, বা সেই দুর্নীতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাবার জন্যে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা করতে হলে,প্রথমেই এই কথাগুলো মাথায় রাখুন।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি যে খুব পোক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে নেই, ঘোর সরকারপন্থীরাও, আশা করি, সে কথা মেনে নেবেন।স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে আমরা ক্রমশই নেমে চলেছি।থাইল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কার কথা ছেড়েই দিন, নেপাল বা বাংলাদেশও আমাদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।দেশের এই নড়বড়ে স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে ভাবতে বসে অমর্ত্য সেন তিনটি মূল ব্যর্থতার কথা বলেছেন।
এক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে চূড়ান্ত অবহেলা।
দুই, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে অত্যধিক নির্ভরতা এবং সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিকে লাটে তুলে দেওয়া। দুইয়ের মধ্যে নিবিড় সংযোগ রয়েছে।
তিন, স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন আলোচনার অভাব এবং স্বাস্থ্যকে অ্যাজেন্ডা হিসেবে তুলে আনায় অনীহা।
স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন আলোচনা শুরু করতে চাইলে উপরের কথাগুলো এড়িয়ে গেলে চলবে না। স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো সিরিয়াস আলোচনা শুরু করতে চাইলে, বা দুর্নীতিকে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি বড়ো সমস্যা হিসেবে দেখতে চাইলে,বা দুর্নীতির জন্যেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই হাল, একথা ভাবতে চাইলে, অমর্ত্য সেন নির্দেশিত তিনটি পয়েন্ট গভীরভাবে ভাবা জরুরী।
একটু অতিসরলীকরন হয়ে যাচ্ছে মেনে নিয়েও সংযোগটুকু বলি।জনস্বাস্থ্য বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগে আর্থিক লাভ নেই। রোগ না হলে চিকিৎসাজনিত বাণিজ্যিক লাভ নেই। লাভহীন পরিষেবায় বিনিয়োগ আসে না।সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা পাওয়া গেলে, মানুষ কর্পোরেট হাসপাতালে ছোটেন না।কাজেই, জনস্বাস্থ্য-প্রাথমিক স্বাস্থ্যে অবহেলা, প্রিভেন্টিভ মেডিসিনে অবহেলা, সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে অপটু করে রাখা একটি সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই রাজনীতি, এই শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার রাজনীতিকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হলে সাধারণ মানুষকে অসচেতন রাখা জরুরী। তাই, স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে যেটুকু আলোচনা নজরে আসে, সেটুকু ওই চিকিৎসায় গাফিলতি বা হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের তাকলাগানো গল্প বা বেগুন খেলে ক্যানসার হয় কিনা এইধরণের আলোচনা। আপনি যদি ন্যূনতম ব্যয়ে সংখ্যাগুরু জনসাধারণের জন্যে সর্বাধিক কার্যকরী স্বাস্থ্যব্যবস্থা কোন পথে আসতে পারে, এমন আলোচনা চান – নাঃ, দিনভর মিডিয়ার কলকাকলিতে ভরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে, এমন আলোচনার হদিশ পাবেন না।
১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাক দিয়েছিলেন, সকলের জন্যে স্বাস্থ্য। আমরা তখনও আর্থিকভাবে বা অর্থনীতিগতভাবে ততোখানি উদার হতে পারিনি। সেই অনুদার অর্থনীতিতে অভ্যস্ত আমাদের দেশ তড়িঘড়ি সবার জন্যে স্বাস্থ্যের ডাকে লিখিত সাড়াও দিয়েছিলো।কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয় নি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের কাছে স্বাস্থ্য পৌঁছানো যায় নি।যদি দুর্নীতির কথা বলতে হয়, এই প্রতিশ্রুতিভঙ্গ কি দুর্নীতি নয়?
সবার জন্যে স্বাস্থ্যের স্লোগান আজ আর লোকজনের মনে নেই। স্বাস্থ্যের জায়গায় এসেছে স্বাস্থ্য পরিষেবা।হেলথের স্থানে হেলথকেয়ার। স্বাভাবিক, শুধু স্বাস্থ্য দিয়ে ব্যবসা হয় না। পরিষেবা দিতে পারলে, তবেই দুটো পয়সার মুখ দেখা যেতে পারে। অতএব, আপনাকে বানানো হয়েছে স্বাস্থ্যসচেতন। আগে সুস্থ মানুষ বলতে বুঝতেন এমন কেউ, যাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। আর এখন? এখন সুস্থ মানুষ মানে, যিনি সকালবেলা দুটো ওষুধ খান, নিয়মিত চেক-আপ করান ডাক্তারের কাছে, আর সন্ধ্যেবেলা কাটান জিমে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে, এই বদলটার অভিঘাত বোঝা জরুরী, এই বদলের আর্থিক লাভ কার ঘরে কোন পথে পৌঁছাচ্ছে, তার ছবিটা স্পষ্ট করা জরুরী।
উচ্চরক্তচাপের সংজ্ঞা বদলে এক ধাক্কায় কয়েক কোটি মানুষ রোগীতে পরিণত হলেন। নর্মাল ব্লাড সুগারের ক্রাইটেরিয়া বদলে, কয়েক কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগতে শুরু করলেন। আর, এই সবই সম্ভব হলো, সুস্থ মানুষকেও চেক-আপে ডেকে এনে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করার মাধ্যমে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দুর্নীতি এইখানেই লুকিয়ে। আর, এই বিষবৃক্ষের চারাটি কিন্তু পোঁতা হয়েছিলো আপনার আমার চোখের সামনেই, যখন স্বাস্থ্য শব্দটির সংজ্ঞা বদলে গিয়েছিলো, যখন নীতিনির্ধারকেরা স্বাস্থ্য নামক অস্বস্তিকর শব্দটি বদলে স্বাস্থ্যপরিষেবার কথা বলতে থাকলেন। দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার সময়ে, নিজেদের দায় এড়াতে পারি কী? আপনার-আমার কি আরো সচেতন হওয়া উচিৎ ছিলো না? আর, এইজন্যেই, অমর্ত্য সেন বারবার করে বলেছেন, ইনফর্মড পাব্লিক ডিসকাশন অন হেলথকেয়ারের কথা, যেটা এদেশে একেবারেই অমিল। স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতে বসলে, আপনি ডাক্তারদের আদ্যশ্রাদ্ধ বা চেন্নাই-ভেলোর বা অ্যালোভেরা জুসের গল্প জুড়বেন, কিন্তু কেমন করে দেশের সবার জন্যে একখানা জুৎসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা যায়, এমন আলোচনার কথা তুললেই আপনার উৎসাহ নিভে যায়।
না হয় যুগের হাওয়া মেনে নিয়ে হেলথ ছেড়ে হেলথকেয়ারকেই শিরোধার্য করলাম। কিন্তু, সেই হেলথকেয়ার বা স্বাস্থ্যপরিষেবাকেও তো সবার মাঝে পৌঁছোতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেল টেদ্রস ঘেরেয়েসুস তাঁর প্রথম বার্তাটিতেই জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিষয়ে সব পথের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ একটাই – সবার জন্যে, সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা। আমাদের দেশেও তো এই একই লক্ষ্যে সরকারবাহাদুর কমিশন বসিয়েছিলেন।শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশন।সেই রিপোর্ট প্রকাশের পরে এতোগুলো বছর গড়িয়ে গেলেও সরকার যে হিরণ্ময় নীরবতাটি পালন করছেন, দুর্নীতির কথা বলতে হলে সেই নীরবতাকে এড়াবো কেমন করে?
স্বাস্থ্যের পেছনে জাতীয় আয়ের এক শতাংশ খরচ করলে যা হয়, তা-ই হয়েছে। পশ্চিমী দেশে এই বরাদ্দ চার কি পাঁচ শতাংশ, এমনকি চীনেও বরাদ্দ তিন শতাংশ।এর সাথে সাথে, ওইসব দেশের জাতীয় আয়ও আমাদের দেশের চাইতে অনেক বেশী।তাহলে, দেশের স্বাস্থ্যবাজেটের হাল সহজেই অনুমেয়। আমরা বিশ্বের উচ্চতম স্ট্যাচু তৈরীর পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারি, উচ্চতম স্ট্যাচু খাড়া করার সাথে সাথেই তার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে আরো উঁচু স্ট্যাচু তৈরির পরিকল্পনা করতে পারি, কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারি না।শুধু সরকারপক্ষের আর দোষ কী? সদ্যসমাপ্ত বিবিধ রাজ্যের নির্বাচনে, প্রধান বিরোধী দল তাঁদের ম্যানিফেস্টোয় গরুর উন্নতিকল্পে কী কী করা যেতে পারে তার হিসেব দাখিল করতে পারেন, কিন্তু জনস্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির কথা জোরগলায় উচ্চারণ করতে পারেন না।স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলতে হলে, এই বিষয়গুলো ভাবুন।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে ছিটেফোঁটাটুকু বরাদ্দ হয়, তারও কি উপযুক্ত ব্যবহার হয়? সেই টাকাই বা যাচ্ছে কোন খাতে? জনস্বাস্থ্যে বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে বরাদ্দ নামমাত্র। সিংহভাগ যাচ্ছে ব্যয়বহুল চিকিৎসার পেছনেই। এইবার নতুন ঘোষিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে সরকার রাখঢাক না করেই জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে বাকিগুলোর ব্যাপারে তাঁরা সরাসরিই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে হাত মেলাবেন। যেমন প্রয়োজন, পরিষেবা কিনবেন। অতএব, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের একটি বড়ো অংশ যে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছাবে, এ নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ আছে কি? প্রাথমিক স্বাস্থ্য সরকার নিজের হাতে রেখেছেন, না কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মতো অলাভজনক ক্ষেত্রে বেসরকারী প্রভুদের উৎসাহ থাকে না। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা নিয়ে আলোচনা চাইলে, এই প্রসঙ্গগুলো সামনে আসুক।
হালে তো পরিস্থিতি আরো চরমে পৌঁছেছে। সরকারবাহাদুর গরীবগুর্বোর চিকিৎসার দায় সরাসরি না নিয়ে চিকিৎসাবীমার হাতে ছাড়তে চলেছেন।সরকার বীমার প্রিমিয়াম ভরবেন, গরীব মানুষ কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে নেবেন, বীমা সংস্থা টাকা দেবেন। শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবটা তো অতো সরল নয়। হাসপাতাল যে বিল করবেন, বীমা সংস্থা নাকি তা-ই মেটাবেন, কেননা থার্ড পার্টি কর্তৃক বিল খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা থাকছে না, এই বীমা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল, ট্রাস্টবেসড। পরিবারপিছু বীমাকৃত টাকাটি যদি একজনের চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তীতে আরেকজন সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কি হবে, জানা নেই। বীমা কোম্পানিগুলো একসাথে বিপুল সংখ্যক ক্লায়েন্ট পেয়ে খুশী নিঃসন্দেহে, কর্পোরেট হাসপাতালগুলিরও চোখ নিশ্চয়ই চকচক করছে বাড়তি ব্যবসার আশায়,কিন্তু আমজনতার কী হবে?
(আগামী পর্বে সমাপ্য)