এই সেদিন চোখের সামনে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের যাত্রা শুরু হল। ২০০৭ সাল থেকে আজকে ২০১৮ সালে এমন কোন আহামরি কিছু করে ফেলেনি দলটা। এশিয়া কাপ জেতার আগে দেশের বহু মানুষ জানতই না নারী ক্রিকেট দল বলে কিছু আছে বাংলাদেশের। পুরুষের প্রবল আধিপত্যে নারী দল স্রেফ ছায়া হয়ে ছিল এতদিন। যেহেতু কারোই কোন নজর ছিল না, তাই এই দলের খেলোয়াড়রা কিভাবে খেলছে, কিভাবে চলছে তা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে স্বয়ং বোর্ড পর্যন্ত উদাসীন ছিল। থাকতে হয় তাই আছে, খেলতে হয় তাই খেলছে, বিদেশে দল পাঠাতে হয় তাই পাঠাচ্ছে!! মনোভাব অনেকটাই এমন ছিল সবার।
বাংলাদেশে নারীদের পথ খুব একটা সোজা না। নারী কে প্রতি পদে পদে প্রমাণ করে তারপর তার ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হয়। একজন নারী এগিয়ে যাবে আর তার সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা আসবে না এমন তো শুধু বাংলাদেশে না, পুরো দুনিয়া জুড়েই হয় না। কম আর বেশি, নারীর অবস্থা করুণ। যেখানে সোজা রাস্তায় হেঁটে গেলে কথা শুনতে হয় সেখানে একজন নারী খেলবে ক্রিকেট? এশিয়া কাপ জেতার পরে এখনো অকল্পনীয় মনে হয় ব্যাপারটাকে। যারা ওই সব প্রবল বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে তারা জয়ী হবে না তো কে হবে?
ধর্মীয়, সামাজিক সহ নানা ধরনের বাঁধা নারীদের ক্রিকেট খেলার পথে এসেছে। মেয়ে মানুষ ক্রিকেট খেলবে? দেশে ভূমিকম্প কি আর এমনেই হয়! নানান ফতুয়া, নারীকে ক্লাস ফাইভের বেশি পড়ানো যাবে না, ঘরের বাইরে বের হতে দেওয়া যাবে না ব্লা ব্লা ব্লা….. নারীকে ঠিক কোথায় রাখতে পারলে তাদের মন পুত হবে তা তারাও ঠিক মত জানে কিনা কে জানে। সমাজ তো আছেই ঠিকাদারি করতে, কে কি করবে না করবে তা কি আর নারীর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপরে নির্ভর করে? তা নির্ধারণ করবে সমাজ। সমাজের চক্ষে নারীর ক্রিকেট খেলা চলবে না, ব্যাস, এরপর আর কথা কি!! সমাজের হাত পা মাথা নেই, আমরাই সমাজ, আমরাই প্রবল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছি নারীর সামনে, চিৎকার করে বলেছি, খেলা যাবে না। নারীর খেলা দেখলে আমাদের সমস্যা হয়। তা নারীর হাঁটা চলা দেখলে যাদের সমস্যা হয়, নারীর পোশাক আশাকে যখন পুরুষের সমস্যা হয় তখন নারীর ক্রিকেট খেলায় যে সমস্যা হবে তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?
বাংলাদেশের পুরুষদের অবস্থা নিয়ে চরম উদাস একটা অনবদ্য গল্প লিখেছেন। গল্পটা একটু বলি, অবস্থা বুঝতে সুবিধা হবে। একদিন ঈশ্বরের কাছে গিয়ে অ্যাডাম হাজির, কি সমস্যা? সমস্যা ইভের চাল চলন ভাল না, বড় বেশি খোলামেলা ঘুরে। ওরে একটু পোশাক আসাক পরতে বলে দিন। ইভ পোশাক পরল। কয়দিন পড়ে আবার হাজির ঈশ্বরের কাছে। এবার কি? ওর পোশাকেরও সমস্যা, ওরে কালো কাপড়ে ঢেকে দিন। দেওয়া হল। কিন্তু না, সমস্যা শেষ হয়নি। এবার আবদার হচ্ছে ওকে ছালার বস্তায় ভরে রেখে দিন। তাই করা হল। দুই দিন যেতেই দরবারে আবার হাজির অ্যাডাম। এবার হচ্ছে ছালার বস্তায়ও উনার সমস্যা হচ্ছে, একটা সিন্দুকে ভরে রাখুন উনাকে। সিন্দুকেই রাখা হল। এরপরেও যখন অ্যাডাম আবার নালিশ নিয়ে হাজির হল তখন ঈশ্বর অবাক। এবার কি? অ্যাডামের উত্তর হচ্ছে, সিন্দুকটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন, সিন্দুকটা বড় বেশি মনোহর!!!
নারীরা খেলা শুরু করার পর সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি যে জিনিস নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল( এখনো আছে এই আগ্রহ) তা নারীরা খেলতে পারে কিনা বা ব্যাট করতে পারে কিনা এসব না। আগ্রহ তৈরি হত পারত নারীরা কিভাবে বল করে তা নিয়ে, বলের গতি কেমন হয় তা নিয়েও কথা হতে পারত। কিন্তু এসব না হয়ে সব চেয়ে বেশী যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা হচ্ছে নারীরা কি ছেলেদের মত গার্ডার পরে? এত চমৎকার একটা রসালো বিষয় নিয়ে আলাপ জমে উঠবে না তো কি নিয়ে উঠবে? নারীরা কি গার্ডার পরে? কেন পরে? কই পরে? তারপরেই দাঁত বের করে হাঁসি!! নারী যে ভোগ্য বস্তু থেকে আজো মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি, নারী কে আমরা আজো বিছানায় শয্যা সঙ্গী ছাড়া আর কিছু ভাবতে শিখিনী। তাই আমাদের আগ্রহ নারী কি গার্ডার পরে?
এই সব ধর্মীয় আর সামাজিক বাঁধার আগে আসে সবচেয়ে বড় বাঁধা। পরিবার। কয়টা পরিবার নিজের মেয়ে ক্রিকেট খেলতে পাঠাবে মাঠে? যেখানে পুরুষ দলই পায়ে নিচে মাটি খুঁজে ফিরছে এখনো সেখানে কে সাহস দেখাবে নিজে মেয়ে কে ক্রিকেটার বানানোর? আত্মীয় স্বজনের বাঁকা কথা কে শুনবে সাধ করে? যেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে নিজের ইচ্ছায় পছন্দের বিষয়ে পড়াশুনা করতে পারে না, সেখানে নারী বলবে সে ক্রিকেটার হবে? তা হলেই হয়েছে!!
যারা যারা নারী ক্রিকেটার হয়েছে তাদের প্রত্যেকের পরিবারের চিন্তা চেতনা একটু অন্য রকম ছিল। তারা একটু অন্য রকম করে ভাবতে পেরেছে বলেই আজকে এশিয়া কাপ জয়ের আনন্দে ভাসতে পারছে দেশ। তাদের উপর দিয়ে কি পরিমাণ ঝড় ঝাপটা গিয়েছে তা একটু সোজা চোখে তাকালেই দেখা যাবে। তার জন্য অনুসন্ধানী চোখের প্রয়োজন হবে না।
এই দেশ থেকে নারী যাবে ক্রিকেট খেলতে। এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কি হতে পারে? শত বাঁধা অতিক্রম করে তারপরেও নারীরা খেলা শুরু করল। ধর্মীয় চোখ রাঙ্গানো, সামাজিক বাঁধা কে পাসে ঠেলে সামনে আসল তখনও তাদের পাসে কেউ নেই। যে মেয়েটা ইচ্ছা করলেই হাঁড়িপাতিল নিয়ে জীবন পার করে দিতে পারত সে যখন ভাজা কাঁঠির পরিবর্তে ব্যাট হাতে তুলে নিলো তখন বুঝতে হবে তারা অন্য কোন কিছুর আর পরোয়া করে না। জাতীয় পর্যায়ে একজন নারী ক্রিকেটার কে টাকা দেওয়া হয় অবিশ্বাস্য রকমের অল্প। জাতীয় লীগ খেলে মেয়েদের কে দেওয়া হয় ৬০০ টাকা ম্যাচ ফি। এ ক্যাটাগরির একজন নারী পায় মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা। প্রিমিয়ার লীগে কিছু টাকার দেখা পায় এই নারী ক্রিকেটাররা। তাও হাস্যকর রকমের একটা অঙ্ক। তবুও যেহেতু ক্লাব দেয় তাই এক সাথে খেলোয়াড় ভেদে ২/৩ লাখ টাকা পায়। এই দিয়ে আমরা আমাদের মেয়েদের পাঠাচ্ছি তাদের কে হারাতে যাদের এ ক্যাটাগরির একজন নারী ক্রিকেটারের মাসিক বেতন ৫০ লাখ টাকা!!
নারী দল যখন দক্ষিণ আফ্রিকা যায় তখন দারুণ একটা খবর প্রকাশ পেল। ক্রিকেটার রুমানার ব্যাট হারিয়ে গেছে। তামিম ইকবাল তার নিজের একটা ব্যাট রুমানাকে দিয়েছে। তামিমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলের। কিন্তু খবরটা যে কতখানি লজ্জার তা আমাদের খুব অল্প মানুষের বোধেই এসেছে। রুমানার একটা ব্যাট হারালে তামিমের ব্যাট কেন দিতে হবে? কারন সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের খেলোয়াড় হয়েও চার পাঁচটা ব্যাট সব সময় সঙ্গে রাখার মত অবস্থা রুমানার ছিল না। হুট কর ব্যাট হারিয়ে বিপদেই পরে গিয়েছিল রুমানা। আমরা কত ভালই না রেখেছি আমাদের নারী ক্রিকেট দল কে!
তবে এশিয়া কাপ জয় অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। বিসিবিকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে মেয়েদের কে নিয়ে। আলাদা স্পন্সর বা পুরুষ দলের সাথে যোগ্য অংশীদার দিয়ে মেয়েদের দল কে আরেকটু স্বাবলম্বী করা হবে হয়ত অচিরেই। বেতন ত্রিশ কে পঞ্চাশ করার ঘোষণা এসে গেছে ইতিমধ্যে।যাদের কে কোন খোঁজ খবর নিত না বিসিবি তাদের কে ঈদ সামনে বিসিবির নিজস্ব গাড়ি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছে। যারা সামনে হয়ত বেতন পাবে পঞ্চাশ হাজার তাদের কে ঈদ বোনাস দেওয়া হয়েছে এবার পঞ্চাশ হাজার টাকা। সুবাতাস হয়ত এরপর বইবে অবিরল ভাবেই। এই জয় তাই খুব জরুরি আর খুব উপকারী হয়ে এসেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের জন্য। আশা করি আর রুমানাদের ব্যাট হারালে বিপদে পড়তে হবে না। পত্রিকার এক কোনায় কোন ছবি ছাড়া এক কলামের খবর আর দেখতে চাই না, রঙ্গিন ছবি সহ দেখতে চাই আমার বোনের মুখ। স্বপ্ন দেখি এশিয়ার পর বিশ্ব জয়ের। স্বপ্ন দেখতেই পাড়ি আমরা কারন অন্য দলের মত না আমাদের দল। একেকজন জন্ম থেকে ফাইটার। বাংলাদেশের মেয়েরা ফাইটার হতে পেরেছে বলেই এখন অব্দই এসেছে।
বারবার নারী ক্রিকেট দল বলছি। অথচ ছেলেদের বেলায় কোন দিন বলিনি পুরুষ ক্রিকেট দল। মগজ যে আমরাও পুরুষের। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনোই নারীকে সমান ভাবতে শেখায় নি আমাদের। তাই সেই দিনের স্বপ্নও দেখি যখন দুই দলই জাতীয় দল বলে পরিচয় পাবে। দুই দলই জাতীয় দলের সমান মর্যাদা পাবে।