"দিদুন, আমার এবার একটা লিপস্টিক চাই। আর আইলাইনার, নেলপলিসও। আমার সব বন্ধুরা পরে। শুধু তুমিই আমাকে কিচ্ছু পরতে দাও না। এবার পরীক্ষার পরে আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাব। সিনেমা দেখব, রেস্তরাঁতে খাব – মাম্মাও পারমিশন দিয়েছে। সেদিন আমি খুব সাজব। প্লীজ দিদুন!"
"সাজবি তো খুব ভালো কথা দিদিভাই। কিন্তু সেজন্য লিপস্টিক বা আইলাইনার বা নেলপলিস লাগবে কেন? ওগুলো ছাড়া কি সাজ হয় না?"
"বাঃরে ওগুলো ছাড়া ফিচারগুলো ডিফাইন করবো কি করে? সব সিনেমা স্টারদের দেখো না – কি সুন্দর করে চোখ গুলো সাজায় তুলির টানে, নিখুঁত ঠোঁট আঁকে – তবেই না অত সুন্দর লাগে! তোমার সুচিত্রা সেন কি আর মেকআপ করতেন না?"
" সুচিত্রা সেন অভিনয় করতেন। অভিনয়ের প্রয়োজনে তাঁকে সাজতে হয়েছিল বৈকি! কিন্তু তুই, আমি তো আর অভিনয় করি না – তাহলে? "
"তাহলে আবার কি? "
" আচ্ছা দিদিভাই, তুই তো ক্লাস এইটে পড়িস। অনেকটাই বড় হয়েছিস। সাজতেও ভালবাসিস। আয়নায় ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখিস। কিন্তু বল দেখি তুই কেন সাজতে ভালবাসিস?"
"বাঃ দেখতে সুন্দর লাগে বলে! সেজে গুজে যখন আয়নায় নিজেকে দেখি, কি সুন্দর লাগছে, তখন কনফিডেন্স লেভেলটা একদম বদলে যায়। তার উপর সেজে গুজে যখন কোথাও যাই, সবাই বলে কি সুন্দর, কি সুন্দর, তখনও তো কি ভালই না লাগে!"
"ঠিক কথা, কিন্তু এই যে সুন্দর মনে হওয়া – এটা কেন হয়? মানে ঠোঁটটি রঙ্গিন হলেই সুন্দরী বা ঠিক মত ডিফাইনড হলেই সুন্দরী আর সেটা না হলেই নয় – এটা কি ভাবে শিখলি?"
"তুমিই নিজেও সাজো না , আমাকেও সাজতে দাও না – কিন্তু আর সবাই তো কি সুন্দর সাজে। বনিদিদি তো শ্যামবর্ণ – সে কি সুন্দর ডার্ক চকোলেট রং এর লিপস্টিক লাগায় – কি ভালো লাগে দেখতে! আর সুতপা কাকীমা সেদিন লাল পাড় গরদের সঙ্গে টুকটুকে লাল লিপস্টিকে, টানা চোখদুটোকে আই-লাইনার দিয়ে সাজিয়েছিল – একদম দুগগা ঠাকুরের মত লাগছিল। আর নতুন মামীমা যখন সেজে ওঠেন, দেখো তো একটাও ফ্রেকলসের দাগ থাকে না – একদম নিদাগ, নিটোল ঝকঝকে হয়ে যায় গালের চামড়াটা – দেখলেই কি মিষ্টি লাগে! আমি তো ওদের দেখে দেখেই শিখেছি।"
"তাই? আচ্ছা তাহলে তোর যখন সেবার ডেঙ্গু হয়েছিল, তোর মাম্মাও তো তখন কলকাতায় ছিল না - এই যায় যায় অবস্থা হয়েছিল – সাত দিন ধরে তোর নতুন মামীমা বাড়ি আর হাসপাতাল করতে করতে নাওয়া-খাওয়ারও সময় পায় নি, সাজা তো অনেক পরের কথা- তখন তোর নতুন মামীমাকে নিশ্চয় বিচ্ছিরি লেগেছিল!"
"তুমি খালি উল্টোপাল্টা কথা বলছ কিন্তু! নতুন মামীমা আমাকে কত ভালবাসেন, তাঁকে আমার বিচ্ছিরি লাগবে কেন? সে তিনি সাজুন আর নাই সাজুন – সব সময়েই ভাল। "
"আচ্ছা তার মানে তুই যদি একবার বুঝে যাস যে কেউ তোকে ভালোবাসে, তাহলে তার আর না সাজলেও চলে" – হেসে ফেলে বলেন দিদুন।
"তুমিই তো বল দিদুন যে চেনা বামুনের পৈতে লাগে না।"
"ঠিক ঠিক, তাহলে কি বাইরের লোকের জন্য সাজগোজের দরকার? "
"হ্যাঁ তা বলতে পারো। নিজেকে ঠিক মত করে প্রেজেন্ট করতে হয় তো।"
"হুম তোর কোথাও মনে হয় না যে এই যেটাকে তুই প্রেজেন্টেবিলিটি বলছিস, সেটা আসলে একটা সোশ্যাল কন্ডিশনিং? এবং মুলতঃ কসমেটিকস কোম্পানিগুলোর তৈরি করে দেওয়া নর্ম মেনে চলা? ক্রমাগত তাদের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে তৈরি করা একটা মিথ যে ঠিক এমনটি করলেই তুমি বাইরের সমাজের জন্য উপযুক্ত হলে, না হলে নয়? আর সেই পথে চলতে গিয়ে কেমন তোদের সবাইকে একই রকম চিড়িতন, হরতন, ইস্কাবনের মতন লাগে যে! "
"ওঃ দিদুন! তুমি না ইনকরিজিবল! আমাদের চিড়িতন, হরতন, ইস্কাবনের মতন দেখতে লাগে?"
" কি জানি! আমার তো বয়স হচ্ছে – চোখে হাই পাওয়ারের চশমা – আমার চোখে তো সব এক ধাঁচের লাগে! ওই যে সেদিন তোর তুলিদিদির এনগেজমেন্টের পার্টি ছিল, আমি তো এক জায়গায় বসে বসে দেখছিলাম – সবাই কেমন একই রকমের ঢেউ খেলান চুল, একই রকমের মেকআপ, ঝকঝকে দামী শাড়ী- গয়না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল – আমার তো সবাইকেই এক রকম লাগছিল। সবই ছিল – সবার ঝকঝকে মুখ, তকতকে চেহারা – কিন্তু কেমন মেকিয়ানা, নকলনবিসি - নিজস্বতা ব্যাপারটা খুঁজে পেলাম না রে!"
" তুমি না আমার সব কেমন ঘেঁটে দিচ্ছ! তুমি বলছ আমরা কসমেটিকস কোম্পানি গুলোর অন্ধ অনুসরণ করি!"
"একদম। আর জানিস-ই তো কসমেটিকস তৈরি করতে, তার টেস্টিং করতে কত কত নিরীহ প্রাণী মারা যায়। তারপরেও তোরা তাদের বয়কট করিস না। অবশ্য শুধু কসমেটিকস কোম্পানিই তো নয়, সে দলে আছে সব গয়নার কোম্পানি, জামা কাপড়ের, অ্যাক্সেসরিজের ব্র্যান্ড, হেয়ার স্টাইলিং এর ব্র্যান্ড – সবাই। একজন বলল, হীরে হল মেয়েদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু – ব্যস অমনি সবার হীরের গয়না কেনার হিড়িক পড়ে গেল। মোটে একজোড়া করে দুল পরলে কানের দুলের বিক্রি বাড়ে না – চালু করে দাও এক কানে পাঁচটা করে দুল পরা – বিক্রি বাড়বে হুড়মুড়িয়ে। তারপর একজন বলল, বিয়ের আসরে বরের বন্ধুদের এই কোম্পানির জামাই পরতে হয় – ব্যস সব বিয়ে বাড়ীতে সেটাই নিয়ম হয়ে গেল। আমাদের হয়েছে সেই ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনের’ দশা। ট্রেন্ড ফলো করতে করতেই জীবন গেল! আর আমার তো আরো মনে হয় যে এই যে নিজে যেমন না, তেমন ভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত ভয় আছে- কি জানি যদি আমার সত্যিকারের আমি কে কেউ পছন্দ না করে, আর আছে খানিকটা মানসিক অসততা, নিজে যা নই সেভাবে নিজেকে দেখানোর চেষ্টা।
" শেষ কথাটা খুব ভাল বুঝলাম না – তবে বাকীটা হয়তো তুমি খানিকটা ঠিকই বলছ। আমার কয়েকজন বন্ধুকেও দেখেছি , অন্ধের মত ট্রেন্ড ফলো করতে! তাতে তাকে ভালো লাগছে কি লাগছে না এ সব ভাবেই না। আর লং- টার্মে শারীরিক ক্ষতির কথা তো ভাবেই না কেউ প্রায়! তোমার শ্রীরূপাকে মনে আছে, সেই ক্লাস থ্রিতে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল? ওর কি হয়েছে জান ! ওর খুব দুঃখ ছিল ও শ্যামলা বলে। তো একটা বড় নাম করা কোম্পানির ফরসা হওয়ার ক্রিম মাখতে শুরু করেছিল – বেশ কিছু দিন মাখার পরে ওর ভয়ানক পিম্পল হতে শুরু করে। রোদ্দুরে বেরোলেই গায়ে চুলকাত, জ্বালা করত। বেশ ঝামেলা শুরু হয়েছিল। ডাক্তার টাক্তার দেখিয়ে তারপর জানতে পারে যে খুব সম্ভবত: ওই ক্রিমটাই দোষী। অনেক ওষুধ খেয়ে ঠিক হয়েছে এখন। তো ডাক্তার নাকি ওকে বলেছেন যে ওর কপাল ভাল অল্পের উপর দিয়ে গেছে। ওই সব ক্রিমে নাকি হাইড্রোকুইনন থাকতো আগে – তার থেকে ক্যান্সার হয়। এখন সেটা ব্যান করেছে। মার্কারিও থাকে। সেটা অনেকদিন ধরে শরীরে জমলে ব্রেন আর কিডনির ক্ষতি করতে পারে। বোঝো! ফরসা হতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা।"
"তবেই বোঝ! আর মজা কি জানিস তো। আমাদের দেশে যদি দেখিস তো এই ফরসা রঙের জন্য হ্যাংলামিটা কিন্তু খুব পুরোনো নয়। অনেক আগে কিন্তু কৃষ্ণা মেয়েদের সৌন্দর্যের কদর ছিল। দ্রৌপদী তো শ্যামা ছিলেন। আর আমাদের কেষ্ট-ঠাকুরকেও কোন ফেয়ার অ্যান্ড হান্ডসাম লাগাতে হয় নি। কালো রং নিয়ে তিনি এত বছর ধরে রাজত্ব করছেন। মুলতঃ ব্রিটিশ আমলেই এই গায়ের রং নিয়ে বিচার করাটা বেশি বেশি শুরু হয়। তারপর দেখ দেহের গড়ন – কালিদাসের আমলে যে গুরু-নিতম্বিনী, স্তন-ভারে-আনত মেয়েদের রূপের খ্যাতি ছিল আজকের দিনে জিরো-ফিগার সুন্দরীদের দলে সে অচল। আর এখন তো সব কিছুর জন্যেই আমরা পশ্চিমমুখো হয়ে থাকি – তাদের হাঁটা-বসা-চলাফেরা-সাজগোজ সব নকল করি। তাই নিজের চামড়াটাকেও ঘেন্না করতে শিখেছি!"
"যাই বল আর তাই বল দিদুন, ফর্সা মেয়েদেরই দেখতে বেশি ভালো লাগে। অনেক বেশি ক্যারিসমাটিক উপস্থিতি হয়।"
" তাই বলছিস? সেদিন যে শুভ মহরৎ দেখলি, নন্দিতা দাসকে কেমন লেগেছিল? কম ক্যারিসমাটিক মনে হয়েছিল? বা তুই তো স্মিতা পাতিলের সিনেমাও দেখেছিস – কেমন স্ক্রিন প্রেজেন্স দেখেছিস? আসলে সৌন্দর্য অনুভব করারও অনেক স্তর থাকে – শুধু গায়ের রং, মেকআপ, দেহগত মাপ এসব দিয়ে যে সৌন্দর্য সেটা খুব সহজবোধ্য – কিন্তু বড্ড ক্ষণস্থায়ী, বড্ড নশ্বর। কিন্তু তার আড়ালে বেড়ে ওঠে যে চারিত্রিক সৌন্দর্য তাকে তৈরি করতে হয় নিজের জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে, জীবনবোধের মধ্যে দিয়ে। সেই তৈরি করার পর্বটা অনেক কঠিন তো, তাই সবাই সেই পথ নিতে পারে না। আবার অনেকে সেটার সন্ধানও পায় না সারা জীবনে। তারা তখন ওই দেহগত সৌন্দর্য নিয়ে বেজায় ব্যস্ত হয়ে পরে - আর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেটা যেই কমতে শুরু করে অমনি পাগলের মত অ্যান্টি-রিঙ্কল ক্রিম, বোটক্স- ফিলার বা কসমেটিক সার্জারির খোঁজে ছোটে। জিরো-সাইজ ফিগারের জন্য প্রাণপাত করে। উর্বশী, রম্ভার মত চিরযৌবনা হয়ে থাকার চেষ্টা করে।"
হেসে ফেলে দিদিভাইটি। " বয়স বাড়াটা কেই বা চায় দিদুন? ভাল লাগে নাকি ঝুলে পড়া চামড়া, সাদা চুল দেখতে?"
" সে তুই পুরুষতন্ত্রের চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখতে শিখেছিস তাই। তাই তোর বয়স বাড়লে দাম কমে যাবে বলে মনে হচ্ছে। আসলে সব বয়সের-ই তো নিজস্ব সৌন্দর্য থাকে – সেইটাকে খুঁজে বার করতে হয়। আর ওই দেহের সৌন্দর্য ছাপিয়ে দেহাতীত সৌন্দর্য দেখার চোখ তৈরি হলেই আর তখন যৌবন ধরে রাখার চেষ্টা করবি না। আর জোর করে যৌবন ধরে রাখার চেষ্টায় কত বিপত্তি হতে পারে জানিস? বোটক্স-ফিলারের থেকে অ্যালার্জি হতেই পারে। ক্র্যাশ ডায়েট করে রোগা থাকার কত সাইড-এফেক্ট সে তো জানিস। বিভিন্ন ধরণের কসমেটিক সার্জারিরও অনেক সাইড এফেক্ট থাকে। এক তো তুই ঠিক যেমনটা চাইছিস সেটা হল না – তাছাড়াও অ্যানাস্থেসিয়ার থেকে ঝামেলা হতে পারে, ইনফেকশন থেকে শুরু করে ডিপ ভেন থ্রম্বসিস অনেক কিছুই হতে পারে। তাই ভাল করে ডাক্তারের সঙ্গে সব কিছু আলোচনা না করে এ পথে হাঁটাই উচিত না।"
" বুঝলাম – তবে এসব নিয়ে আমার এখন না ভাবলেও চলবে। আমি যখন বুড়ো হব ততদিনে ঠিক একটা পিল বেরিয়ে যাবে যেটা খেলেই আমি উর্বশী, উর্বশী হয়ে যাব। " – বলেই গান গেয়ে ওঠে ‘Urvashi, Urvashi, take it easy Urvashi’ আর সঙ্গে সঙ্গে দুপাক নেচেও নেয়।
হেসে ফেলেন দিদুনও। "হ্যাঁ তুমি ওই take it easy policy নিয়েই থাক। আমি আমার কাজ সারতে যাই।"
" এক মিনিট দিদুন – যাওয়ার আগে একটা কথা বল , সাজটা যে একটা ক্রিয়েটিভ ব্যাপার সেটা কি তুমি অস্বীকার করবে? যারা নতুন নতুন ট্রেন্ড তৈরি করেন, তারা কিন্তু খুবই ক্রিয়েটিভ।"
"হুম এই একটা কথা অস্বীকার করি কি করে! যারা ট্রেন্ড সেটার, তারা অবশ্যই ক্রিয়েটিভ হন।"
"গ্রেট! ক্রিয়েটিভিটি তো আর সাধনা ছাড়া পারফেকশনে পৌঁছায় না – আমার এখন সেই সাধনার সময়। ব্যস এবার দাও দেখি সব মেকআপের সরঞ্জাম!" – মিচকি হেসে বলে দিদিভাইটি।
"তবে রে দুষ্টু! সেই ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান!"
( শেষ হল না। এ সংলাপ শেষ হওয়ার নয়। তবে এই ‘দিদিভাই’টির সৌভাগ্য যে সে তার দিদুনকে পেয়েছে সব আলোচনার সঙ্গী করে, মেন্টর হিসেবে। এমনটা হলে খুব ভালো হত যে পৃথিবীর সব কোণায় সব বেড়ে ওঠার বয়েসে সন্তানেরা এমন একজন প্রাজ্ঞ মানুষকে পাশে পেত জীবনের সব ওঠাপড়ার গল্প ভাগ করে নেওয়ার জন্য – তাঁর অভিজ্ঞতার উত্তাপে সে নিজের জীবনকে সেঁকে নিয়ে পারত। )