ওই বাঁশঝাড়তলে, ওই তারাবন নিয়ে কোলে, আমার শৈশব
বন্দী হয়ে শুয়ে থাকে, খেলে, ঘোরে
আস্তে আস্তে টের পাই নি যে
- কখন হলদে তালি জামা গায়ে রোদ
চুপি চুপি রাঙা মুখে বাঁশবনের মগডালে চড়ে
ঘরে ফেরা কাকের গলায় শুনি সন্ধ্যার কলরব।
২০১৮ সালের বইমেলা শুরু কবি মণীন্দ্র গুপ্তের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে। এই প্রত্যাশিত চলে যাওয়ায় যা আমাকে বিস্মিত করে - তাঁর এই সুদীর্ঘ পথ চলা। যে চলার শুরু ১৯৬৯ সালে ‘নীল পাথরের আকাশ’ আর শেষ ২০১৪ সালে ‘বাড়ির কপালে চাঁদ’। নব্বই-এর দশকে যখন কলকাতা বইমেলায় আমরা ডানা ঝাপটাতাম, তখন পরমার টেবিলে থাকতেন মণীন্দ্র গুপ্ত। লিটল ম্যাগাজিনের ছাতার তলায় থাকতেন এমন অনেক মানুষ যাদেরকে আমাদের অভিভাবক মনে হত। আমার খুব প্রিয় বই ছিল লাল স্কুলবাড়ি। বিশেষ করে চন্দ্রহাস কবিতাটি।
বাপের সুপুত্তুর নই বলে বাপমার মনে বড় দুঃখ - আমাদের
কেরানি বাপ মা, শিক্ষক বাপমা, জেল ওয়ার্ডার বাপমা
কে ফেলেনি চোখের জল
আজ ক্যাপ্টেনকে ঘিরে ছেলেরা যেমন মাঠে নামে তেমনি করে
আমাদের দুঃখী বাবা-মাদের নিয়ে আসব আমরা -
আমাদের সবচেয়ে সুন্দর জামা তাদের পরিয়ে দিয়ে
হুররা বলে চেঁচিয়ে উঠব।
জাগো! জাগো!
আজ ২৫ বছর পরে এই কবিতাটাকে উল্টো দিক থেকে দেখি। মনে হয় ঢাউস একখানা চাঁদ উঠবে রাসবিহারী মোড়ে। জেগে উঠবে আবার সেই ঘাসের ট্রামলাইন। আর আমার সন্তান আমাকে তার জমকালো জামাটা পরিয়ে হাত ধরে নিয়ে যাবে সেই কার্নিভালে।
আর ছিল কড়াক পিং-
আমরা উঁচিয়ে আছি, সমস্ত কিছুর দিকে, মারাত্মক তাগ
কড়াক পিং
আমাদের কাঁচা সীসে সরল ও অব্যর্থ হয়ে
ভেদ করে স্তম্ভ, শীর্ষনক্ষত্র এবং ম্লান ছায়া
কড়াক পিং! কড়াক পিং! কড়াক পিং!
আমরা ফুটো করছি মানুষ, জীবন ও চক্রগ্রন্থি
পেরোতে পেরোতে চলে যাচ্ছি
মধুর মত গাঢ় সময়ের দিকে –
ক্রমশঃ আমাদের নিশানার মধ্যে আসছে
অবর্ণনীয় সেই রানী মৌমাছি।
একজন সেনাছাউনি ফেরত মানুষই পারে এভাবে লিখতে। বাংলার ন্যাকা কবিতার কাননে এক দুর্লভ পৌরুষ।
খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন। এক আদিম চরাচরে তার বেড়ে ওঠা। তার আকাশ খুব ঠাণ্ডা, নীল পাথরের মতই নির্লিপ্ত।
বাচ্চাটার মা ছিল পর আর পরিদের মেয়ে।
ঠাকুমা পিসিমা বলে, যত অনাছিস্টি ভাব
এসেছে সেই কুল থেকে
ছ মাসেই মা হাসতে হাসতে ফুড়ুৎ করে ঊড়ে গেল –
তোমাদের ছেলে – এবার তোমরা বোঝো!......
এই পৃথিবীই হল রাজপুরী – তার বাবার দেশ।
তার বাবার দেশ ছেড়ে সময় হল মায়ের দেশে যাবার -
আজকাল চোখ ভিজে আসে, মায়া লাগে।
হায়! তার বাবা মা কেন একসঙ্গে থাকল না।
কেন তাদের একটাই দেশ হল না!
[পরির ছেলে / নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ]
সেনাবাহিনিতে কিছুদিন চাকরি করে ফিরে আসেন কলকাতায়। পেশায় ছিলেন যন্ত্র-নকশার শিক্ষক। বাংলা কবিতার যে কজন ব্যক্তিগত দ্বীপের অধিকারী, তিনি তাদের একজন। তার ওই ব্যারিটোন কাব্যভাষায় স্থির হয়ে থাকে এক আদিগন্ত টুং টাং নিঃশব্দতা।
অনেকদিন পর বাবা তাঁর দুঃখকষ্ট নিয়ে
আকাশে মিলিয়ে গেল
আমিও আমার দুঃখকষ্ট নিয়ে
আকাশে মিলিয়ে যাব।
মাঝখানে শুধু বত্রিশ বছরের ব্যবধান যেন
পলাতক মলিন শেষ রোদ্দুর।
মণীন্দ্রদার এই না থাকায় কোনো বেদনা নেই। হরফ আর পৃষ্ঠার রৌদ্রছায়ায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় কি অপরূপ একটুকরো আলো পড়ে আছে। আজ মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার উদযাপন। বনে আজ কনচের্টো।
বনের মধ্যে পেন্ডুলামের ডিং ডং, দুরের হাওয়ায় চেলো
পোকার গলায় বনের ঢাকের শব্দ
হঠাৎ মিষ্টি ক্ল্যারিওনেটের ট্রেমোলো
দারুণ জমেছে বনে আজ কনচের্টো
আসলে এসব ঢ্যাঙ্গা গাছ, পাখি, পোকার, হাওয়ার কান্ড।
সারাদিন বয় উদাস হাওয়ার ঢেউ-