আসসালামো আলাইকুম,
আশা করি ভালো আছেন।অনেকদিন ধরেই ভাবছি আপনার সাথে দুটো কথা কই, হয়ে উঠছেনা আর কি। দেখুন, পাশাপাশি আছি অনেকদিন, অথচ চেনাটাই হয়ে ওঠেনি অ্যাদ্দিন। তাই, এই গায়ে পড়েই আলাপ করতে এলুম।বিরক্ত করছি নাতো?
কি বলছেন, পরপর তিনচার লাইন টানা বাংলাতেই কথা বলছি দেখে অবাক হচ্ছেন। আজ্ঞে, আমরা বাংলাতেই কথা বলি। আব্বা,মা,খালা,খালু ইত্যাদি সম্বোধন ব্যবহার করি এবং পরপর দুদিন বিরিয়ানি খেলে আমাদেরও পেট খারাপ হয়। যাকগে,বাদ দিন সার, আপনাকে ঈদের আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি।
যদিও এই ঈদ বানান নিয়েও গুচ্ছের তক্কো আছে। এক আলাপী লিখেছেন সঠিক বানান নাকি ইদ।কিন্তু সার, ইদ শুনলেই আমার ফ্রয়েডকে মনে পড়ে। অগত্যা, ঈদ থাকুক। বিরিয়ানিতে চিকেন সহ্য করে ফেললেন আর সামান্য দীর্ঘ ঈ কে সহ্য করতে পারবেন না। কি যে বলেন সার।
এখন এক জেলাশহরে থাকি বটে,কিন্তু আমাদের পৈতৃক বাড়ি গ্রামে।এই ঈদে চলুন আপনাকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। বহরমপুর থেকে যে বাসগুলো ডোমকল বা করিমপুর যায় তার একটাতে উঠে পড়বেন। কন্ডাক্টরকে বলবেন ছয়ঘরি নামবো। দৌলতাবাদ থানা পেরোলেই বাঁদিকে খেয়াল রাখবেন কত্তা। বাস বেশিক্ষণ দাঁড়ায়না।
ছয়ঘরি নেমে টোটো। বলবেন ঘাটপাড়া যাবো।বদর মাস্টারের বাড়ি। ওটা আমার আব্বার নাম। ওই নামের সবাই ওখানে চেনে। তারপর মসজিদের পাশ দিয়ে টোটো ঢুকবে গ্রামের রাস্তায়। এখন পিচ পড়েছে। পুকুর, বাগান আর মাটির বাড়ির পাশ দিয়ে আপনার টোটো যাবে। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর দেখবেন একটা বাঁধানো কবর রাস্তার ধারে। স্মৃতিফলক আছে। ওটা উস্তাদ আবু দাউদ এর কবর। এই গ্রামেই তার ভিটে। ওইখানেই শুয়ে আছেন মুর্শিদাবাদের অন্যতম বিখ্যাত সুরসাধক।
ভিতরের বড় মসজিদ পেরিয়ে ডানে বাঁক নিয়ে অমিতদাদের বাড়ি-বাগান ছাড়িয়ে ডানহাতে আমাদের বাড়ি পড়বে।
একতলা পুরোনো ইঁটের বাড়ি। খোলা বারান্দা।সেইখানে যে বয়স্ক মানুষটি বসে আছেন তিনি আমার বড় আব্বা। ঈদের দিন এসেছেন তো। একটু তাড়াহুড়ো দেখবেন। পাঞ্জাবী পাজামা পরে একে একে সব ভাইয়েরা বেরিয়ে আসছি।মোটাসোটা ব্যস্তসমস্ত যে লোকটাকে দেখছেন সেটা আমি। ডানহাতে পাটি।তাড়াতাড়ি একটু চা-বিস্কুট খেয়ে নিন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এবার ঈদগাহের দিকে বেরোবো।মা সুর্মা পরিয়ে দিচ্ছেন চোখে।আমার প্রত্যেকটি ঈদের দিন আমার মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। বড় আব্বা হাঁটতে পারেন না বলে টোটোয় যাবেন। আমরা সবাই দল বেঁধে হাঁটবো।ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরে চশমা চোখে যে সৌম্যকান্তি মানুষটি সবার আগে যাচ্ছেন তিনি আমার আব্বা। প্রত্যেকটি বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি হাঁক দেবেন নাম ধরে। তৈরি থাকলে সাথে নেবেন।দেরি থাকলে অপেক্ষা করবেন। এই করে যখন ঈদগাহে পৌঁছাবো তখন আমরা বাচ্চা-বুড়ো মিলে একটা মস্ত দল।
জুতো খুলে ঈদগাহে ঢুকবো। বাচ্চারা বাইরে থাকবে বেশিরভাগ। নরম মাটির উপরে পাটি বিছয়ে দেবো। লাইন করে বসবো। সময় হলে মৌলানাসায়েব নামাজ শুরু করবেন।নামাজে আমরা সবার জন্যে মঙ্গলকামনা করবো। আমাদের চলে যাওয়া সবার ভালো চাইবো। যে বৃদ্ধ মানুষটি ভয় পাচ্ছেন যে আগামী ঈদের নামাজে তিনি হয়ত থাকতে পারবেন না তিনি সবার কাছে কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা চাইবেন। আমরা তার দীর্ঘ জীবন চাইবো।মৌলানা প্রতিটি মানুষের মঙ্গল চাইবেন খোদাতলার কাছে।আপনি দেখবেন এইসময় আমাদের প্রবীণ মৌলানা মানুষটি কেঁদে ফেলেন।আমার মতন উদাসীন লোকেরও বুকের বাম দিকে কোথাও হাল্কা ব্যথা শুরু হয়।
নামাজ শেষ। আসুন, এবার আমরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করি। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে। সমস্ত বৈরিতা দূর হোক। আমার-আপনার সবার কুশল হোক। এবার চলুন বাড়ির দিকে হাঁটি।আব্বার জন্য দাঁড়াতে হবেনা। উনি সবার শেষে ঈদগাহ থেকে বের হবেন। প্রত্যেকটি মানুষের সাথে আলিঙ্গন করে।
আসুন আপনার সাথে আলাপ করিয়ে দিই নাসির দাদার। এই ঋজু মানুষটির নাম নাসির আহমেদ। উস্তাদ আবু দাউদ-এর বংশের লোক। আমার রাণাপ্রতাপ নামটা উনিই দিয়েছিলেন। আশির উপর বয়স হওয়া সহাস্য এই মানুষটির বাড়িতে দীর্ঘকাল ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের চর্চা হত।আব্বার মুখে শুনেছি।
পুকুরটাকে বামহাতে রেখে আমরা হাঁটবো।দেখুন অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। ওটা গোরস্তান। যারা ওখানে ঘুমিয়ে আছেন তাদের জন্যে খানিক প্রার্থনা করবো এবার। জুতো খুলে খালি পায়ে দাঁড়ান। চিরঘুমে থাকা মানুষগুলোর জন্যে দোয়া করুন।
এবার আবার হাঁটা দিই। রাস্তায় দেখা হওয়া প্রত্যেকের সাথেই কথা বলছি বলে একটু দেরি হচ্ছে আর কি।ওই যে ডান দিকে পাড়াটা দেখছেন, ওটাকে হিন্দু পাড়া বলে। সম্পন্ন মানুষজনের বাস। সত্তরের দশকে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পুলিশ যখন আমার বাপ-চাচাদের বিরোধী রাজনীতি করার জন্যে রাতে খুঁজতে আসতো, তখন তারা লুকিয়ে থাকতেন এইসব বাড়িতেই। মজার বিষয়টা কী জানেন, এই বাড়ির কত্তারাই তখন কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতা ছিলেন এলাকায়।তাঁরাই আশ্রয় দিয়েছেন অনায়াসে।
ওই যে সোজা রাস্তাটা চলে যাচ্ছে মাঠের মধ্যে দিয়ে, ওটা যাচ্ছে হাই ইস্কুলের দিকে। যোগমায়া উচ্চ বিদ্যামন্দির। আমার আব্বার ইস্কুল। চারিদিকে গাছ দিয়ে ঘেরা। গাছের তলায় অনেক ক্লাস হয় এখনও। আর বামহাতে যে আমবাগানটা দেখছেন, সেটা আমাদের। বাগানটা দেখাশোনা করেন সুধীরকাকু। আব্বা বাগানের হাল-হকিকত নিয়ে কোনোদিনই মাথা ঘামান না। সবকিছুই দেখেন সুধীরকাকু।
জানেন, এই আমবাগানের পাশে মন্দির ছিল আমার ছোটোবেলা অব্দি। পাশেই কয়েকঘর ঠাকুর ছিলেন মন্দিরের জন্যে। রাম-সীতার মন্দির। সামনের মাঠে রাম নবমীর মেলা হত খুব ধুমধাম করে।আমরা সব্বাই ভিড় করতাম মেলায়। তারপরে একদিন মন্দিরটা উঠে গেলো। ঠাকুর মশাইরা কোথায় চলে গেলেন জমিজমা বেচে। এখনও দাঁড়ালে বেশ শূন্য লাগে।
অনেক ঘোরা হল।এই দেখুন, বাড়ির দরজায় চলে এসেছি। হাত পা ধুয়ে ঘরেই উঠবো, তার আগে একটু পিছনের বাগানে চলুন। ওখানে আমার দাদা-দাদীর কবর আছে। তাদের জন্যে দোয়া করব। বছরে সাকুল্যে দুদিন তাদের কবরের সামনে আসি। তাদের অসীম ভালোবাসাগুলো মনে পড়ে। মনে হয় তারা কোথাও থেকে ঠিকই দেখছেন আমাদের।
এইবার হাত পা ধুয়ে ঘরে উঠবো।ভাবি আপনার জন্যে নিয়ে আসবেন দুতিন রকমের হালুয়া, সিমাই আর বোঁদে। আজ বাড়িতে আসা সব অতিথিকেই আমরা এই মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ণ করবো। দুপুরে হবে বিরিয়ানি আর খাসির মাংস। শেষপাতে বাড়িতে পাতা দই।
তার আগে এই চাট্টি খেয়ে একটু গা গড়ান দিন। জানালা দিয়ে যে বাগান দেখছেন। সেটার ওপাশে বিল আছে। ঠাণ্ডা বাতাস আসে।এখানে নেট কানেকশন পাবেন না। ফোনের লাইনটাই ঠিকঠাক পাওয়া যায়না। আমি বরং আপনাকে একটা বিলের ডাইনীর গপ্পো শোনাই। সময় কাটবে আপনার।
পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা আপনাকে। আমন্ত্রণ রইলো।
আসছেন তো?
খোদা হাফেজ। ভালোবাসা নেবেন।