আলফার ইতিহাস পর্যায় (হীরকজ্যোতি)
ধুবরীর নেপাল দাসের দোকানের জলবোমা সাঁটিয়ে বাসে উঠেছিলাম। ফকিরাগ্রাম যাবো, সেখান থেকে ট্রেন ধরে গৌহাটি। জল ধোওয়া সবুজ দেখতে দেখতে ঝিমুনি এসে গেছিল। চলন্ত বাস দাঁড়িয়ে পড়লে শরীরেও সেই অনুভূতি সঞ্চারিত হয়। কনডাক্টর গৌরীপুর হাঁকতেই কোষগুলো সুতীক্ষ্ন হয়ে ওঠে। কতবার ভেবেছি গৌরীপুর আসবো। প্রমথেশ বরুয়া, লালজীর ভিটে দেখার চাইতেও প্রতিমা পাণ্ডের মাহুত বন্ধুর টান। তাছাড়া এখানেই আমার বাবার শৈশব। মামার বাড়ি। কপাল ঠুকে নেমে পড়বো নাকি ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে মুখ বাড়াতেই চোখে পড়লো দেয়াল জোড়া শ্লোগান। "তেজ দিম, তেল নিদিওঁ"। তেজ, মানে রক্ত দেবো, তেল দেবো না। কিন্তু গৌরীপুরে তেল কোথা, ভাবতে ভাবতেই বাস ছেড়ে দিল। আর সারাটা পথ জুড়ে দেয়ালে, দেয়ালে রক্ত দেবার অঙ্গীকার..."তেজ দিম, তেল নিদিওঁ"।
ফকিরাগ্রাম পৌঁছে গেল বাস। ফকিরাগ্রাম স্টেশনের সেটা বোধহয় পেছন দিক ছিল ।সারা দেয়াল জুড়ে আলকাতরা দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা... না এতক্ষণ দেখা দেওয়াল লিপির থেকে সামান্য আলাদা শ্লোগান। "তেজ ও নিদিওঁ, তেল ও নিদিওঁ"। রক্ত ও দেবো না তেল ও দেবোনা। একা একাই প্রবল হাসছিলাম। এই হলো আসল শ্লোগান। খামোখা রক্তই বা দেবো কেন? তেল ও দেবো না, তেজ ও দেবো না। হাসতে হাসতেই স্টেশনে ঢুকেছিলাম। কিন্তু হাসি মুছে গেল স্টেশনের ভেতরের অ্যালা রং এর দেয়াল জুড়ে অন্য একটি দেওয়াললিপি দেখে।
"নিমাত নিস্তব্ধ হৈ থকা মানুহর আত্মবিশ্বাস উভরাই আনাই এতিয়া আমার মূল লক্ষ্য"।
মূক এবং নিস্তব্ধ মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনাই এখন আমার মূল লক্ষ্য।
কেন যেন অকস্মাৎমাথার ভিতরে ভূমিকম্প শুরু হলো। আমাদের রবিঠাকুর যেন আমার কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন...
"এই সব মূঢ়, মূক, ম্লানমুখে দিতে হবে ভাষা, এইসব ভগ্ন শুষ্ক বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা..."।
আমি আমার রাজনৈতিক এবং পরবর্তী সামাজিক জীবনে এরকম কোন শ্লোগান কখনও দেখিনি শুনিনি। সেই প্রথম ও শেষ। মানুষ নিমাত এবং নিস্তব্ধ হয়ে থাকবে আর তাদের হয়ে আমরা, ভ্যানগার্ডরা, তাদের মুক্তি এনে দেবো। আলফা নামের স্বল্প পরিচিত সংগঠনটি আমাকে নতুন দিশা তো দেখাতে শুরু করলোই। না না আমি আলফার রাজনীতি কস্মিনকালেও সমর্থন করিনি। করার মত দমও ছিল না আমার।
হয়তো কাকতালীয় কিন্তু এইদিন গৌহাটি পৌঁছে আমি প্রথম হীরকজ্যোতি মোহান্তের নাম শুনি। হীরকজ্যোতি মোহান্ত, ডেপুটি কমাণ্ডার ইন চীফ আলফা।
আমি সবসময় একটু পিছিয়ে থাকা মানুষ। ভ্যানগার্ড হওয়া এ জন্মে হলো না। বুরহান ওয়ানীর নাম আমি শুনেছিলাম বুরহানের মৃত্যুর পর। এমনই জনপ্রিয় এবং আপনজন হয়ে উঠেছিলেন বুরহান ওয়ানী যে শোনা যায় তার এনকাউন্টারের খবর ছড়াতেই সারা ভ্যালি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। একজন টেররিস্ট এতটা জনপ্রিয় হবেন কেন? সমস্যা হচ্ছে মিলিট্যান্টের জীবন পর্যায় এমনই হয়। টেররিস্ট বলেই তার এনকাউন্টার হয় আবার শহীদ বলেই তার মৃত্যুতে জনপদ উদ্বেল হয়ে ওঠে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এই নিয়মের কোনও ব্যত্যয় নেই। কী পায় তারা এই মৃত্যুকে বরণ করে? রূপকথা হয়ে যায় তারা। মিথ। হীরকজ্যোতি মিথ হয়ে আছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মানুষের মনে। ইতিহাসের পাতায়। তাকে বাদ দিয়ে হিস্ট্রি অব আসাম লেখাই যাবে না।
বুরহান ওয়ানী কে আমি বুঝতে পারি। কেননা আলফার ডেপুটি কমান্ডার ইন চীফ হীরকজ্যোতির গল্পও এক। ভারতবর্ষ নামক ভূখন্ডের দুই প্রান্তের দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী মনে করতো বৃটিশ তাদের ঘাড় ধরে ভারতের মানচিত্রে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র চায়। ফলে ভারতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রাম। কাশ্মীর বা আসাম কারও আলাদা রাষ্ট্রের দাবীর যাথার্থ্য বিষয়ে আলোচনা করতে বসিনি। আমি এ বিষয়ে যোগ্য লোকও নই। আমি শুধু বলতে এসেছি মৃত্যুকালে বুরহানের চেয়ে সাত আট বছরের বড় হীরকও আর্মি এনকাউন্টারে মারা গেছিল এবং মেরুদন্ড ভেঙ্গে গিয়েছিল আলফা আন্দোলনের। বয়সে আমার সমসাময়িক ছিল হীরক। আর রাজনীতিতে বিরোধী হলেও আমি ছিলাম তার গুণমুগ্ধ। হীরককে এনকাউন্টার করার মত এত বড় সাফল্য আসামে ভারতীয় আর্মি পায় নি। কেননা হীরক ছিল শত্রুর সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা, সমঝোতা বা আপোষের বিরোধী। আলোচনাপন্থী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তীব্র সমালোচক ছিল হীরক। এবং তার জীবদ্দশায় তাকে অগ্রাহ্য করে আলোচনায় বসার ঔদ্ধত্য কেউ দেখায় নি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা বড় অংশের কাছেই হীরকের উল্কাসদৃশ উত্থান বিপজ্জনক মনে হচ্ছিল। শোনা যায় হীরককে ধরিয়ে দেওয়ার নীলনক্সা তখনই রচিত হয়ে যায়।
আলফার ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ হীরকজ্যোতি মোহান্ত ১৯৮০ সালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। এসব কাহিনীতে যেমন হয়, একটি সুখী স্বচ্ছল পরিবার, একটি উজ্জ্বল ছাত্র, তরুণ এবং সুদর্শন হীরক সার্বভৌম আসাম গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দলে যোগ দেয, এবং দ্রুত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে পছন্দসই, সম্মানিত এবং প্রভাবশালী বিপ্লবী নেতা হয়ে ওঠে। তার গেরিলা কৌশলের জন্য তিনি যুবকদের একটি আইকন হয়ে ওঠেন এবং হাজারো অসমীয়া যুবক তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগ দেয়। আলফা হয়ে ওঠে আসামের জনগণের ভালোবাসার সংগঠন।
এমত পরিস্থিতিতে দিল্লী নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় রাষ্ট্র তো চুপ করে বসে থাকতে পারে না। বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে, ১৯৯০ সালে আসামে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে নেমে পড়ে। অপারেশন বজরং। আসামের জনগণের জন্য সে এক ভয়ঙ্কর সময়। প্রবল অত্যাচার, অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন এর ঘটনা, নিত্য ধর্ষণ, হত্যা এবং নির্যাতন। নিরপরাধ নাগরিকেরাও রেহাই পায় না।
পাশাপাশি হীরক জ্যোতি মোহান্তের কৌশল এবং আলফার ক্যাডারদের উপর তার প্রভাবও বাড়তে শুরু করে। ১৯৯০ সালের নভেম্বরে তিনসুকিয়ার লখীপাথারে আর্মি বনাম আলফার মধ্যে প্রথম বন্দুক যুদ্ধ, এবং মোহান্তের সাহস ও গেরিলা রণকৌশল এর কথকতা দাবানলের মত ছড়ায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য হীরকের পাতা বুবিট্র্যাপ, বুনো ফাঁদের গেরিলা কৌশল, জলমুখে ভূমিবাঁধ এবং বাঁশের তৈরি মাটির ফাঁদ এসব কাহিনী সর্বস্তরের ক্যাডারদের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
(ক্রমশঃ)