
আলফার ইতিহাস পর্যায় (পরাগ দাস)
আসামের ইতিহাসের প্রবল চর্চা শুরু হয়েছে এনার্সি দ্বিতীয় খসড়া বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে। বৃটিশ আমল থেকে বিজেপি আমল, অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে ফেলে ব্যবচ্ছেদ চলছে দিবারাত্র। চল্লিশ লক্ষ দেশহীন নাগরিকের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হৃদকম্পে, হাহাকার আর উল্লাসধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। ভাল ভাল। ইতিহাস চর্চা স্বাস্থের পক্ষে ভাল।
কিন্তু এর মধ্যে ছোট্ট একটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। আসামের ইতিহাসের প্রক্ষাপটে এক বিশাল কৃষ্ণগহ্বর থেকে যাচ্ছে যে। অস্বস্তিকর বোধে তাকে সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এক অন্ধকার সময়ের বা উজ্জ্বল অন্ধকার (সৌমেনদা বাক্যবন্ধটি ধার নিলাম) সময়ের ইতিকথা। ৩২ বছর বড় কম সময় নয়। যে সময়ে আসামে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছিল প্রতিটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল এবং তাদের ক্রীড়নক প্রফুল্ল মহান্ত থেকে হিতেশ্বর শইকিয়ার পুতুল সরকারগুলি। আসামে বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তখন দুটি দল মাত্র। আলফা বনাম ভারতীয় সেনাবাহিনী। অসমীয়া মানুষ বনাম ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র।
ইতিহাস চর্চা যখন শুরু হয়েছে, তখন পুরোটাই হোক। কেবল আসু এবং বিজেপিই যে আসামের ভাগ্যনিয়ন্ত্রা নয়, সে ইতিহাসও প্রকাশ্যে আসুক। কিন্তু কোথা থেকে শুরু হবে? আলোচনাপন্থী অরবিন্দ রাজখোয়াকে দিয়ে? আলোচনা বিরোধী পরেশ বরুয়া দিয়ে? না অন্য কেউ? আমি মানবাধিকার কর্মী সাংবাদিক পরাগ কুমার দাস কে দিয়ে কথারম্ভ চাই।
১৯৯৬ এর ১৭ই মে। আলফা আন্দোলনে তখন ভাঁটার টান শুরু হয়েছে। হিতেশ্বরের কুশলী প্রয়োগে আলফা ভাগ হচ্ছে। আত্মসমর্পন পন্থী আলফারা তৈরী করেছে সালফা। সারেন্ডারড আলফা। স্কুটারে চড়ে ছোট ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন পরাগ। অসমীয়া ভাষায় সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক অসমীয়া প্রতিদিনের সম্পাদক। গৌহাটির চাঁদমারীতে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে গুলি করে মারে চারজন সালফা সদস্য। সিবিআই চার্জশিট দেয়। ছয় জন অভিযুক্তের মধ্যে তিন জন মৃত। দু জনের বিরুদ্ধে চার্জশিটই জমা পড়েনা। আর একমাত্র মৃদুল ফুকন ওরফে সমর কাকতি তেরো বছর কেস চলার পর প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
পরাগ আমার পরিচিত, আমার সমসাময়িক। কোলকাতার এক পরিচিত সাংবাদিকের সৌজন্যে পরিচয়। দু একবারই সাক্ষাৎ হয়েছে। তার মধ্যে একবার আমার কোলকাতা বাসের জন্য উপার্জন প্রয়োজন শুনে ওখান থেকেই এক বন্ধুর কাছে চাকরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। যদিও সে চাকরী আমার করা হয় নি। কিন্তু পরাগের কাগজ বুধবারের আমি অনেক আসামবাসীর মত নিয়মিত পাঠক ছিলাম। পরাগ খুন হবার পর কোলকাতায় একটা প্রতিবাদ সভাও করেছিল একটি মানবাধিকার সংগঠন। আমি সেই সভায় বুধবার পত্রিকা থেকে পাঠও করেছিলাম। আমি পরাগের গুণমুগ্ধ তাই পরাগকে দিয়ে শুরু করতে চাইলাম। কিন্তু আমি কী বলবো পরাগের কথা? দেশকে ভূমিকে মানুষকে ভালবাসা পরাগের লেখা পড়ে শেখা, এটা লিখবো?
কী লিখবো কৃষ্ণগহ্বরের ইতিহাস? "আমি যি কথা কৈছিলো", "পরাগর কিছু প্রশ্ন কিছু উত্তর", "স্বাধীন অসমর অর্থনীতি", "মোক স্বাধীনতা লাগে, "রাষ্ট্রদ্রোহীর দিনলিপি", আর সবচেয়ে জনপ্রিয় "ছাংলট ফেনলা"। পরাগের এই বইগুলির উল্লেখ ফেসবুক আর পোর্টালের ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদেরা কখনও করেন না অস্বস্তিকর প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে ভেবে। অস্বস্তিকর কেননা পরাগদের, এবং সে সময়ের আলফার সংগ্রামীদের যুদ্ধ ছিল ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে আর আজ সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের পাপেট রা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে চল্লিশ লক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে। বিরানব্বই সালের ছয় ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর হোজাই টাউনে এবং অন্যত্রও দাঙ্গা প্রতিরোধে জনতা কার্ফু ডিক্লেয়ার করে খোলা জিপে আর্মস উঁচিয়ে ফ্ল্যাগমার্চ করেছিল, আর্মি নয় আলফা জঙ্গীরা, যার জন্য দাঙ্গার উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছিল মুহূর্তে। আর আজ সেই বিজেপি সরকার আসামে, তাদের সঙ্গেই আলোচনার টেবিলে একদল, আর আসামের ইতিহাস থেকে মুছে যাচ্ছে কয়েক দশকের ইতিহাস। পরাগরেণুর ইতিহাস।
আমি কোনদিন আলফার সমর্থক ছিলাম না। আজও হত্যায় আমার বিবমিষা।কিন্তু তাই বলে কৃষ্ণগহ্বরকে পাশ কাটিয়ে যাবো এই পাণ্ডিত্য নেই আমার। ইতিহাস চর্চা হলে তার পূর্ণাঙ্গ চর্চা হোক। ইয়াণ্ডাবুর সন্ধি থেকে এনআরসি পর্যন্ত। সেই চর্চায় পরাগের ইতিহাসও জায়গা করে নিক। আসামের এক বন্ধু বল্লো পরাগের ওপর তথ্যচিত্রটি টিউবে পাওয়া যাচ্ছে। খুঁজে পেতে সেটি বার করা গেছে। লিংক দিলাম। এবার আপনাদের ওপর সামান্য দায়িত্ব। এ ইতিহাস সবাইকে জানানোর দেখানোর। পরাগের ইতিহাস আসলে আসামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আত্মত্যাগের ইতিহাস। কৃষ্ণগহ্বরের ইতিহাস।
(ক্রমশঃ)
| পরের পর্ব |
pi | unkwn.***.*** | ৩১ আগস্ট ২০১৮ ০৮:০২84576
Du | unkwn.***.*** | ৩১ আগস্ট ২০১৮ ১০:৩২84577