এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রাষ্ট্র ও ধর্ম

    Manali Moulik লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৪৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • আজ যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে এসেছি, তার শিরোনাম দেখে অনেকে ভাবতে পারেন, এ আর নতুন কী! দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে দুটি বিষয়কে মিলেমিশে একাকার করে দেবার চেষ্টা চলছে তা থেকে ধরে নেওয়াই যায় যে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে হয়তো সত‍্যি ধর্মের সুবিশাল প্রভাব রয়েছে। আদতে আমাদের সংবিধান যতই 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি ব‍্যবহার করে থাকুক এবং মৌলিক অধিকারের ২৫-২৮ নম্বর ধারায় নিজস্ব ধর্মাচরণ, বিশ্বাস ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা ও এবিষয়ে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার কথা বলুক, বাস্তব বড়োই জটিল। Secular শব্দটি তো সংখ‍্যাগরিষ্ঠগণ এখন ব‍্যাঙ্গাত্মক অর্থে ব‍্যবহার করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে ‍যার উৎপত্তি গ্রীক শব্দ 'Saeculum'  থেকে। যার ইংরেজী অর্থ 'This time.'  এইসময় বলতে এভাবে বোঝানো যায়, "যা পূর্ববর্তী সময়ের থেকে পৃথক।"  অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় ক্ষমতার হ্রাস ও পূর্বের theocratic কাঠামো বদলে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ধর্ম থেকে আলাদা করা। মধ‍্যযুগের বৈপ্লবিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মার্সিলিও অফ পাডুয়া (১২৭০- ১৩৪০) ওনার Defensor Pacis গ্রন্থেও এই বর্ণনাই দেন। তবু শিবরাত্রি, ভূত চতুর্দশী  ইত‍্যাদির দিনে মন্দিরে যাওয়া থিকথিকে ভিড় থেকে মনে পড়ে ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতা ড. আম্বেদকরের বিখ‍্যাত উক্তি --
    "এই মন্দিরে যাওয়া ভিড় যেদিন শিক্ষাক্ষেত্রের দিকে যাবে, সেদিন থেকেই দেশের সঠিক উন্নতি শুরু হবে।" 
    ধর্মের আফিম নিয়ে কথা উঠলে আজকাল অনেকে শঠে শাঠ‍্যং বলে থাকেন, "ভক্তির ভগবান, অভক্তির অপমান।"  এই ভক্তি কতোখানি অন্তরের আর কতোখানি বাহ‍্যিক তা নিয়ে বিতর্ক আছেই। তবে প্রশ্নযুক্ত ভক্তি কিন্তু ঈশ্বরের অপমান নয়। বরং বোধ ও যুক্তি যা তিনি দিয়েছেন, তার সঠিক ব‍্যবহার।  অনেকেই বলতে পারেন, মহান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, 'যাঁর ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই, তাঁর নিজের অস্তিত্বেও বিশ্বাস নেই।" যদিও আইনস্টাইনের 'Ideas and opinions' গ্রন্থে এবিষয়ে যুক্তিসঙ্গত বিতর্ক ছাড়া কিছুই মেনে নেওয়া হয়নি। এপ্রসঙ্গে আরেকজন বিখ‍্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিন্সের উক্তি হলো, 'যদি কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেন, তবে তাঁকে আমি আমার সবকিছু দিয়ে দেবো।'
    মূল প্রশ্ন হলো এখানে দুটি --
    ১) প্রাচীনকালে আদিম মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা দেখে ভয় পেলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনা করে নিতো। কিন্তু অন্তরের পূজনীয় ঈশ্বর আলাদা কথা (তাঁর প্রতি প্রেম থাকলে নারকীয়তা, যুদ্ধ,হত‍্যা অনেকটাই কম হতো হয়তো ) বাহ‍্যিক আড়ম্বরসহ ধর্মের জাঁকিয়ে বসা অস্তিত্ব রয়ে গেল কেন?
    ২) অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থে রাজার আনুগত‍্য দ‍্যাখানোর কথা বলা হয়েছে কেন?
     
    ঠিক এইখানে বলি অপর একটি কথা। যেটি হলো, ম‍্যাক্সিম গোর্কি রচিত 'দ‍্যা মাদার' উপন‍্যাসে মা-কে করা এক পুলিশকর্মীর প্রশ্ন,  'জার আর ঈশ্বরকে যে ভক্তি করতে হয়, তা ছেলেকে শেখাতে পারোনি?'
    আমরা যদি দৃষ্টিপাত করি মঙ্গলকাব‍্যের দিকে, তাহলে দেখা যায় প্রতিটা মঙ্গলকাব‍্যের ভূমিকাতে কোনো না কোনো রাজার নাম জড়িত রয়েছে। ধরে নিন, কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তীর অম্বিকামঙ্গল কাব‍্য। 
            ধন‍্য রাজা মানসিংহ            বিষ্ণু পদাম্বুজভৃঙ্গ
                           গৌড়বঙ্গ-উৎকল অধীপ
    আবার রাধাকৃষ্ণকবির গোসানীমঙ্গলের প্রথম ছত্র হলো 
            হরেন্দ্র নারাণ রাজা            বেহারে পালেন প্রজা
                            তার যশ ঘোষে সর্বজন
    হ‍্যাঁ,  একথা অবশ‍্য বলা যেতে পারে মঙ্গলকাব‍্যের অধিকাংশ রচিত হয়েছে কোনো না কোনো রাজার পৃষ্ঠপোষকতায়। সেক্ষেত্রে রাজাদের নামোল্লেখ বাধ‍্যতামূলক। 
    নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতে, "মানুষ যখন নিজের দাবী নিয়ে সোচ্চার হবে, তখন তার মধ‍্যে কিছুটা ধর্মীয় বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হলেই যে আসল দাবী ভুলে যাবে বেমালুম।"
    রাজতন্ত্র আজ আর নেই। বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই রয়েছে গণতন্ত্র। আর তার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সম্ভবত সযত্নে মেনে চলেন বোনাপার্টের উক্তিটিই। 
    রাজতন্ত্রের দিকে আবার ফিরে তাকালেই দেখতে পাবো, অধিকাংশ রাজারাই কিন্তু রাজ‍্যশাসনের জন‍্য নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবী করেছেন। এটা অনেকটা প্রজাদের ভয় ও ভক্তির সমন্বয়ে অনুগত রাখার একটি প্রক্রিয়া বিশেষ। পৃথিবীর প্রথম আইন-প্রণেতা ব‍‍্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নির্দেশিত আইনের উপর লেখা থাকতো 
    "সূর্যপুত্র হামুরাবির নির্দেশানুযায়ী........"
    কুষাণ বংশের রাজা কণিষ্কের প্রচার চলতো নিজেকে, "দেবশাহী দেবপুত্র কণিষ্ক" হিসাবে। সুলতানি যুগের শেষভাগে হোসেনশাহী শাসক আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে বলা হতো "আল্লাহের প্রেরিত দূত।" এমনকী আধুনিক যুগের প্রধান ঘটনা ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে জানা যায়, বুঁরবো বংশের রাজারা নিজেদের মুদ্রায় উল্লেখ করতেন 
    "ঈশ্বরের ইচ্ছায় ফ্রান্স ও নাভারের রাজা।"
    রুশবিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ায় তো একটি প্রবাদ প্রচলিত ছীলো যে, "ঈশ্বর থাকেন স্বর্গে আর জার থাকেন অনেকদূরে।"
    আবারও ফিরে আসা যাক গণতন্ত্রে।
    এতোবছর পরেও, এতো উন্নতির পরেও এই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ইন্টারনেটের যুগে ধর্মের জন‍্য মানুষ হত‍্যা হলে ঐতিহাসিক হেগেলের স্বরেই বলতে ইচ্ছা করে,
    "ইতিহাসের দুর্ভাগ্য হলো আমরা ইতিহাসের থেকে কিছুই শিখি না।"
    শুধুমাত্র নিজস্ব স্বার্থের প্রয়োজনে রাষ্ট্র ও ধর্ম কতোখানি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ও সমঝোতা করে চলে তা আর কবে আমাদের বোধগম‍্যের মধ‍্যে আসবে?

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • %% | 49.206.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৫737392
  • রাষ্ট্রের ধারণা এসেছে ২০০ বছরও হয়নি। কিন্তু ধর্ম শুরু থেকেই আছে। 
  • Manali Moulik | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:১৩737395
  • %%  সেটিকেই রাষ্ট্র নব আঙ্গিকে ব‍্যবহার করেছে।
    শ্রীমল্লার, ধন‍্যবাদ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন