আলফার ইতিহাস পর্যায় (হীরকজ্যোতি).... শেষাংশ
সেই সময়ে হীরকজ্যোতি মোহান্তের রবিন হুডের ইমেজ। ভারতীয় ইউনিয়নের প্রয়োজন ছিল শুধু তাকেই নয়, তার প্রভাব ও সম্মানকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা। অতএব ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া, হীরককে অপসারণের একটি পরিকল্পনা তৈরী করলেন। হীরকের প্রধান সহযোগীরা তাকে সবসময় ঘিরে থাকতো। হীরক নিজেও ছিল গেরিলা সমর বিশেষজ্ঞ। শোনা যায় সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনী নেতৃত্বের একাংশকে ট্র্যাপ করে। মেনস্ট্রীমে ফেরা অথবা বিদেশে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। শীর্ষ নেতৃত্বের কোনও একজন বা একাধিকজন যে হীরকের গতিবিধি আর্মিকে জানিয়ে দিয়েছিল, এই বিষয়ে আসামের মানুষের মনে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে যে নামগুলি উঠে আসে, এত বছর পর সেগুলি আর উল্লেখ করলাম না। তবে শুনেছি আলফার চীফ অব স্টাফ পরেশ বরুয়া শেষ মুহূর্তে এই বিশ্বাসঘাতকতার আঁচ পান, এবং তৎক্ষণাৎ সব কাজ ফেলে হীরককে বাংলাদেশে চলে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।
১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিকেল। হীরক জ্যোতি মোহান্ত আসাম থেকে বের হতে পারার ঠিক আগে। গীতানগর এলাকায় হীরকদের ঘিরে ফেলে আর্মি। শত্রুপক্ষের হাত থেকে পালাবার পথ ছিল না এতই আটঘাট বেঁধে এসেছিল তারা। ধরা পড়ে ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চীফ হীরক আর তার সহযোগী অকন বৈশ্য এবং ধ্রুব তালুকদার। জীবিত তিনজনকে এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে আর্মি এবং গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ফেক এনকাউন্টার সাজিয়ে হীরক জ্যোতি মোহান্ত কে হত্যা করার জন্য সেনাবাহিনী কোনও সময় নষ্ট করেনি। সেদিন রাতে সারা ভারতের মিডিয়া হাউসগুলি একবার অন্তত সচকিত হয়ে উঠেছিল। স্টপ প্রেস, স্টপ প্রেস... "সেনাবাহিনীর হেফাজত থেকে পালাবার চেষ্টা করে আলফার ডেপুটি চিফ ইন কমান্ড হীরক জ্যোতি মোহান্ত ওরফে জয়ন্ত মেধি ওরফে নরেন ডেকা চন্দ্রপুরে আর্মি এনকাউন্টারে নিহত। সেনা বাহিনী চাঁদপুরের পাহাড় এলাকায় ভূগর্ভস্থ বিপুল সংখ্যক অস্ত্র উদ্ধার করেছে।"
কিন্তু শো তখনও শেষ হয় নি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ হীরকজ্যোতি মোহান্তকে হত্যা করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। হীরকের মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ পর, একজন নারী মৃত হীরকজ্যোতি মোহান্তের বাড়িতে এসে হাজির হন এবং পরিবারের সদস্যদের কাছে তার স্ত্রী হওয়ার দাবি করেন। অসমের লোকেরা, সিনিয়র ক্যাডারদের পরিবারের সদস্যরা এবং সংশ্লিষ্ট সবাই এই আতঙ্কে সিঁটিয়ে ছিল যে হীরকের মৃত্যুতেই ষড়যন্ত্রের শেষ নয়। ভারতীয় ইউনিয়নের মূল প্রয়োজন হীরকের ইমেজকেও খুন করা। গেরিলাদের কঠোর জীবনযাপনে বিশ্বাসী হীরক ছিলেন আত্মগোপনকারী ক্যাডারদের বিয়েরও বিরোধী। যদিও শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই এই প্রথা মানেন নি এবং তাঁদের কাছে হীরক অপ্রিয় হয়ে উঠছিল। তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা নেতৃত্বের কাছে বিপদবার্তা বয়ে আনছিল। তার ওপর হীরক ছিল প্রবলভাবে আলোচনা বিরোধী। তাই মৃত্যুতেও হীরক এপিসোড শেষ হয় নি। হীরকজ্যোতি মোহান্ত সবসময় একটি কঠোর অনুশাসনে ক্যাডারদের বিয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর পরপরই সন্তান সহ এই মহিলার আবির্ভাব প্রিয় নেতার দ্বিচারিতা হিসাবেই প্রতিভাত হয়, এবং ব্যাপক হতাশা গ্রাস করে তার অনুগামীদের। এই সময়ে মৃত হীরকের সমর্থনে নেতৃত্বও কোন কথা বলে নি। হীরকের মৃত্যুর পর পরই হাজার হাজার যুবক আত্মসমর্পণ করে।
হীরকের স্ত্রী বলে দাবি করা এই মহিলা শোনা যায় ভারতীয় রাষ্ট্রের প্ল্যান্ট করা। কথিত আছে প্রকৃতপক্ষে তিনি হীরকের ভ্রাতৃবধূ এবং তার সন্তান প্রকৃতপক্ষে হীরকের ভাইএর সন্তান। কিন্তু এই ধরনের অদ্ভুত ব্যক্তিগত আক্রমণগুলি এতই বিশ্বাস্য হয় (বিশেষত অভিযুক্ত যখন মৃত) যে, কেউই এসব ক্ষেত্রে প্রমাণের অপেক্ষা করে না। এমনকি হীরকের বাবা ঐ ভদ্রমহিলার বিরুদ্ধে কেস করলেও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ হয় না। এটি একটি দুঃখজনক অধ্যায়। অবিশ্বাস, অভিযোগ ও ব্যক্তিগত আক্রমণের একটি অধ্যায়। ভারত সরকার এবং তার সৈন্যবাহিনী দলের মধ্যে এবং বাইরে হীরকের প্রভাবকে শেষ করার জন্য তাদের অভিযানে সফল হয়েছিল। হীরকের মৃত্যুতে নয় তার জনপ্রিয়তার মৃত্যুতেই ছিল অভিযানের সাফল্য।
ভারতীয় ইউনিয়ন হীরক জ্যোতি মোহান্তকে ধ্বংস করতে সফল হলেও আসামের ইতিহাস থেকে তাকে বাদ দিতে কিন্তু ব্যর্থ। কিছু নাম নিজেই বিপ্লবের সমার্থক হয়ে ওঠে, আইকন হয়ে যায়। মৃত্যুর সাতাশ বছর পর নতুন করে হীরকের খোঁজ করতে গিয়ে দেখেছি আসামের পত্রপত্রিকা, সাহিত্যসংস্কৃতি রাজনীতি সর্বত্র আলফা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। ভারতীয় রাষ্ট্র আবার স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন করেছে। তাদের সঙ্গেই শর্তহীন আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হচ্ছে এককালের আগুনখেকো বিপ্লবীরা। কেউ কংগ্রেসে, কেউ বিজেপিতে নাম লেখাচ্ছে। মাঝখান থেকে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেল দুটি দশক আর সহস্র সহস্র যুবক যুবতীর লাশ।
হীরক জ্যোতি মোহান্ত কিন্তু প্রবলভাবে বেঁচে আছে। তার সম্বন্ধে তালু গল্পগাছার কিছু বিশ্বাস করেছি, বেশীর ভাগ অবিশ্বাস করেছি। কিন্তু এটা বুঝেছি যে হীরক একটা মিথ। মিথ মিথই। তার সত্যাসত্য বিচার অকারণ। বিপ্লব আসলে এক রোমান্টিকতা। যাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকে তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন। দশকের পর দশক জুড়ে। চেগুয়েভারার মত, বুরহান ওয়ানীর মতো, পরাগ কুমার দাসের মত, নকশাল আন্দোলনের সময়ে পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উজ্জ্বল শবের মত। হীরকজ্যোতি মোহান্ত নামটির জন্যও আসামের ইতিহাস একটি অধ্যায় ধার্য করেছে। যেখানে ব্যক্তি হীরক নয়, তার সংগ্রাম, তার আদর্শ, তার স্বপ্ন, আসলে একটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করে।
কিন্তু আজ এতদিন পরে হঠাৎ হীরকের গল্প বলতে বসলাম কেন? কেন না আমার মনে হয়েছে এনার্সি বিষয়ে ইতিহাস চর্চায় সচেতনভাবে আলফার অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র, তার পোষা মিডিয়া, রজাঘরিয়া বুদ্ধিজীবি, পরজীবি রাজনীতিবিদ কেউ চায়না আলফা প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে। অথচ আমার হিসেবে ভাষা সাম্প্রদায়িকতার প্রকোপ (মূলত বাঙালী অসমীয়ার দ্বন্দ্ব) ঐ সময়েই ধীরে ধীরে কমে আসছিল। যদিও বিচ্ছিন্ন ভাবে বিহারী আক্রমণের ঘটনা দুধে চোনা ফেলে দিয়েছে তো বটেই। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ক্রমশ অবদমিত হচ্ছিল আলফাযুগে। ব্যতিক্রম তো আছেই, থাকেই। তবে তা ব্যতিক্রমই। আজ সব নতুন করে প্রবলভাবে মাথা চাড়া দিচ্ছে। কিন্তু ঐ যে বল্লাম রাষ্ট্রযন্ত্র, তার পোষা মিডিয়া, রজাঘরিয়া বুদ্ধিজীবি, পরজীবি রাজনীতিবিদ কেউ চায়না আলফা প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে। তাহলেও তো প্যান্ডোরার বাক্স খুলবে।
আমি মাঝেমাঝে ভাবতে চেষ্টা করি, ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে যখন শেষ লড়াই চলছে হীরকদের, তখন কী ভাবছিল সে? কিংবা সেই শান্ত নির্জন পাহাড়ে যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হচ্ছিল তাকে ? কয়েক মুহূর্ত বাদেই তো সব আবারও শান্ত হয়ে যাবে। কিসের স্বপ্ন দেখছেল আই অহমের ডেকা লরা? স্বাধীন আসামের স্বপ্ন না আলফা পতাকার উদীয়মান সূর্য? ভেবেছিল আবার আগের মত হিংস্র প্রবল নিষ্ঠুরতা ফিরে আসবে রমরম করে? ভেবেছিল এই দিল্লী নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রযন্ত্র আবারও শাসন করবে আসামের মাটি? আজ ঐ যারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলছে তাকে মুছে দিতে, তাদেরই মালা চন্দনে বরণ করে নেবে আই অহমের ভূমিপুত্রেরা? আজ যাদের সে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে আসামের ক্ষমতা অলিন্দে, কাল তারাই তার/তাদের অস্তিত্বকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেবে, মুছে দেবার চেষ্টা করবে ইতিহাসের পাতা থেকে। হায় স্বাধীন সার্বভৌম আসাম গড়ার মৃত্যুমরীচিকা। হায় আই অহম।
ফকিরাগ্রামের স্টেশনের দেয়ালে লেখা দেখেছিলাম "নিমাত নিস্তব্ধ হৈ থকা মানুহর আত্মবিশ্বাস উভরাই আনাই এতিয়া আমার মূল লক্ষ্য"। আলফার শ্লোগান। সেই দেয়াললিপি মুছে গেছে। এখন মূক মূঢ় ম্লানমুখে নতশির চল্লিশ লক্ষ মানুষের অস্তিত্বই মুছে দিতে উদগ্রীব ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র। আসামভূমি জুড়ে না-মানুষদের গন্তব্যহীন মিছিল। এই প্রাপ্তির জন্য হীরক? এর জন্য ফেক এনকাউন্টার? এর জন্য শহীদ হয়েছিল, এর জন্য বলি হয়েছিল কয়েক সহস্র প্রাণ? এর জন্য হীরক?
[টাইমস অব আসাম, বুধবার, ইন্টারনেট আহরিত তথ্য কিছু বহু পুরাতন সাক্ষাৎকারের স্মৃতি এবং কিছু ব্যক্তিগত কথোপকথন]