"মাংসের ঝোলটা আজকের দুপুরে রাজযোটক, বল? তার ওপর সাথে বেগুনপোড়া। সেটাও আবার অফিস যাবার আগে বাবা নুন-লঙ্কা-পেয়াঁজকুচি - সর্ষের তেলে জম্পেশ মেখেছে। বাবা ভর্তা বানালেই স্বাদ এমনিই কেমন 'জ্যানা- গাণা- ম্যানা : দেশভক্তি'র রুল ফলো করে।" হাত ধুতে ধুতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল অনুভব।
আকাশ হল অনুভব মানে অনুর সৎ ভাই। মা মারা যাওয়ার পর বাবা মামণিকে নিয়ে এলেও ওর অত রাগ হয়নি যেমন চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতে আকাশের আবির্ভাবে হয়েছিল। তার ওপর বাবার এক্সট্রা আদিখ্যেতা বরাদ্দ আছে ভাইয়ের জন্য, দেখলেই পিত্তির মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ছে কেউ মনে হয়। তা সে বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ হঠাৎ আকাশের শরীর খারাপ-শ্বাসকষ্টের জন্যই হবে হয়ত, কখনও ইনহেলার কখনওবা গুচ্ছের ওষুধ: কিছুতেই ব্যাটাকে বাগে আনা যায় না। তবু গুমোট গুমোট মেঘমার্কা কাশির দমকটা পর্যন্ত অনুর কোমিসারেশন কোটায় একটা পুঁট ফেলতে পারেনি কুড়ি বছরে। খাওয়ার সময় আকাশের পাতে পড়া মাংসের পিসটায় আধা ইঞ্চি মশলা বেশি উঠলেও অনুর মাথায় গুগল সার্চ কিলবিলিয়ে ওঠে, "হাউ টু প্রুভ ইওরসেল্ফ অ্যাজ আ প্যাট্রোফিল"
"নিচে নামবি?" দাদার অতর্কিত প্রস্তাবে আকাশের কপালে হঠাৎ রোদ্দুর। সারাদিন নিজের মত ব্যস্ত থাকে অনু। একসাথে আড্ডা- খেলা কোনোটাই হয়না তেমন। আজ হঠাৎ?! কী ব্যাপার কে জানে! দাদা অবশ্য বরাবরই একটু মুডি - রগচটা। আজ বোধহয় চাপ নেই আর এই বেগুনপোড়া - মাংস কম্বিনেশন তো ওর সর্বকালীন প্যানাসিয়া।
-"জগার দোকান খোলা আছে? একটা সিগারেট নিয়ে আয় তো! ধারে নিস। আমার নাম করে।"
-" তুমি এসব শুরু করেছ, বাবা জানে?"
ব্যাস! আগুনে ঘৃতাহুতি। এখন এই সেন্টুতে সুড়সুড়ি দেওয়া দু'আনার মহানাগরিক উঁকিসর্বস্ব কলেবরের থেকেও পিতৃভক্তি শিখতে হবে! ঠাসিয়ে থাপ্পড় মারল ভাইয়ের গালে। শুধু ভাই হলেও কথা ছিল, এ তো বাবার 'সৎ' প্রচেষ্টা। অতএব আরও কয়েক চড়- থাপ্পড়ের বৃষ্টিতে মুখ থুবড়ে না পড়া পর্যন্ত অনুভব লীলা চলতেই থাকে। কাত হয়ে, আকাশ, পালানোর চেষ্টা করতেই একটা পাথর ছুঁড়ে মারে পেছন থেকে অনু। বেরোনোর আগে ছুরিটা নিয়েইছিল। তবে দু' পা ফেলতে না ফেলতেই যে তার এমন অতর্কিত শমন জারি হবে, তা জানা ছিল না। বুলেট ট্রেনের স্পিডে প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢোকাল সে। এই ছুরি দিয়েই বেগুনের পেয়াঁজটা কুচি করেছিল না, বাবা? আকাশের পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুরিটা টানল মাখনের মত, সরলরৈখিক ঘচাং ফুঃ।
অনু অবশ্য একটা ভিডিও করলে ভাল করত। এটা পিতৃভক্তির কেস, বাকি মার্কেটে ছড়িয়ে দেশভক্তির কেস। একই ব্যাপার। পিতৃ - মাতৃ : তৃ(ত্রি)ফলা কারবার। দেশই পিতা, গরু মাতা। চোদ্দ বছরের ভাইপো আর বছর এগারোর মেয়ে জোগাড় করা অবশ্য ল্যাভিশ ব্যাপার। তাদের সামনে আবার বক্তৃতা দিতে দিতে মাথা থেঁতলানো, সাথে 'জয় শ্রীরাম' রঙের জামা আর 'শান্তির প্রতীক' মার্কা প্যান্ট পরে ইকুইঅ্যানিমিটির আস্ফালন - এ অবশ্য অফিস চত্বরে লাইফটাইম ফ্রি ক্রেডিট কার্ড বিলি লেভেলের শিল্প : 'আচ্ছে দিন' এর নামে সুড়সুড় করে দেশটাকে বিলিয়ে দেওয়ার 'চাড্ডি' কারখানা বস্তাচাপা রেখে ধর্মের হুজুগে আম আদমিকে মাতিয়ে দিয়ে 'মন কি বাত' শোনানো: এসব আলাদাই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। পাবলিককে নিউজ চ্যানেলগুলো খবর দেবে কি বিক্রি হবার পর যতটুকু 'নিরপেক্ষ' দেখনদারি বাকি থাকে তাতে খবর শোনানোর চেয়ে খবর খাওয়ানোর ব্যবস্থা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মুশকিলটা হয় এই 'ফেসবুক' নামক জুকুবাবুর কাঠিবাজিতে। তাতে আজকাল বলা নেই, কওয়া নেই, 'ভাইরাল' ফিভার নামে চপশিল্পের মতন। যদিও বা রেখে ঢেকে খবরের প্ল্যানিং-প্লটিং হল, দুমদাড়াক্কা জ্বরে কম্বল সরিয়ে মুখ দেখাতে গিয়ে বগলের নিচে রাখা রসুন কালপ্রিটটি পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটালেই কেলো, কিছু পাবলিকের চক্করে তখন খবর 'খাওয়ানো'র বাজেটকে কেটে ছেঁটে ফোরকাস্টিং এ নামাতে হয় থার্মোমিটার ঝাঁকানোর গতিতে। এই যে লাখ লাখ আইডি খোলা হল, ফেকেন্দ্র মোদীর অনুপ্রেরণায়, তারা দিনরাত যতই 'চাড্ডি পেহেনকে fool খিলা হ্যায়' বলুক না কেন, মাঝে মধ্যেই অতি উৎসাহে ভাম টাম মেরে হোক বা ফটোশপড ছবির বাইরে ব্রেক নিতে এসব ভিডিও আপলোডিয়ে হোক, জ্বর বাধিয়ে ফেলে। তাতে যদিও কিছু লোকজন আহারে - উহুরে করে বটে, তবে ও তিন চার দিন। আবার কোথাও কেউ বাবার বিপক্ষে মুখ খোলার খপ্পরে পড়ে মারা টারা যায়। হাত-পা ভেঙে মুখ-টুখ থুবড়ে নাড়ি-ভুঁড়ি ছিটকে গুলি টুলিও খায়। এসব খবরে মনোনিবেশ করতে করতেই আবার ব্যাকগ্রাউন্ডে চেরি-পিকিং চলে 'মুসলমান বাছতে দেশ উজাড়' প্রকল্পের। মাঝে মধ্যে পাকিস্তান আর জওয়ান এ উৎসাহ থিতিয়ে এলে বাবার ছেলেপুলেরা মহড়া গায় : আমি 'চিন' ই গো 'চিন'ই তোমায়, ও 'গো জননী'।
যাক গে, ভিডিও না থাক বাকি কাজ এমনিই সারা যেতে পারে। টু শব্দটুকুও নেই ওদিকে। এক ছুট লাগল অনু বাড়ির দিকে। সিঁড়ির ঘরেই কেরোসিনের ব্যারেলটা রাখা থাকে। ছিপি খুলে পাশের প্লাস্টিকের মগে একটু তেল ঢালল। মগটা নিয়েই আবার ছুট। সৎ ভাবে শুয়ে 'ভাই', মুন্ডুটাু আলগা। হুড়হুড় করে তেল ছড়াল আকাশের শরীরে। সিগারেটের জন্য দেশলাই বাঁ দিকের বুকপকেটে থাকে সবসময়। শিকারীর মুখের ছোঁ মার্কা হাত চালাল অনু। কাঠি ধরিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলল আকাশের গায়ে। ওমনি আকাশ পুড়তে শুরু করল দাউদাউ - প্রশ্নচিহ্নের সাথে।
ফুটপাথে কি একটা লোকও ছিল? থাকলে রেকর্ড করতে পারত গোটা ঘটনা। আগে লোক জলে ডুবে যাক- ঢেউয়ে ভেসে যাক : মজা নিত দাঁড়িয়ে ( দু' এক জন রবিনহুড অবশ্য সবসময় থাকত সে ভিড়ে) আর এখন সবাই খুব বাধ্য, পিঁপড়ের সারির মত নিয়ম মানে মেপে মেপে। একজন মোবাইল বের করলেই চারিদিকে খুচ-খাচ আওয়াজ শুরু হয়ে যায়, মিনি রেডকার্পেটের পাপরাৎজি যেন, সামনে বিপদ না অনুষ্ঠান ঘটছে, বোঝা দায়। 'বাইট' থেকে 'লাইক' এর ইভোলিউশন উত্তরণ। রেকর্ডিংটা থাকলে অবশ্য অনেক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। প্রথমে একটা ভিডিও : "আমি যা করেছি, দেশ থুড়ি বাবার স্বার্থে করেছি। বাবার সম্মানে আমি থাকতে অন্য কেউ প্রশ্ন তোলার সামান্য 'সৎ' প্রচেষ্টা করলেও আমি ছেড়ে কথা বলব না" গোত্রের কিছু বিবৃতি-উদ্ধৃতি। সে চক্করে কপাল ভাল থাকলে নেতা-মন্ত্রী-পুলিশ-সান্ত্রীদের চোখে পড়ে গেলে লিখন ফুলে কলাগাছ। এর মাঝেই টুক করে ভাষণমন্ত্রী অনুপ্রেরিত আইডি মারফৎ একটা অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস ছড়াতে পারলেই কেল্লাফতে। তাতে লাখ লাখ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত চলে আসতে পারে। সেন্টুর পাল খুলে যেতে পারে সন্দেহ হলে অবশ্য পুলিশ দু-এক জনকে অতিথি আপ্যায়ন করতেই পারে বলে , "দিবি দে, তাই বলে এত টাকা দিবি? এত মাঝি উঠে গেলে নৌকায়, সামলাবে কোন পালের গোদা?" এতে কাজ নাহলে চ্যালাবেলারা আদালত অব্দি যাবে। তার মাথায় চেপে বসাটাও আর্ট, প্রথমে মসজিদ, তারপর আদালত...যুগে যুগে পদোন্নতির লক্ষণ। সাথে আবার পতাকা ওড়ানো, ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক 'রং দে তু মোহে গেরুয়া' - মুন্ডুতে চেপে এমন খেল দেখানো যায় ভাবলে কেকের ওপর মিহি চেরির টপিংসও লজ্জাবতী লতা হত। যাক গে, সেসব চ্যালা-পুলিশের ব্যাপার আর এ 'অনুভব' এর ব্যাপার। এমন 'অণু' সাইজের 'ভব' লীলার মতিগতি হল গিয়ে শেয়ার বাজারের ষাঁড়। কখন কোনদিকে শিং ঘোরাবে একমাত্র 'বাবা' ই জানে। আপাতত আকাশ পুড়ছে - অনুভব পোড়াচ্ছে : সে ধোঁয়ার সুবাস বেগুনভর্তার চেয়েও মনোরম, বাবা এবার বুঝুক সৎ - অসৎ গুরুত্ব।