বিজয় দাদা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পরে, দিদির বিয়ে ক্যানসেল হয়ে গেল। সংসারটা কেমন যেন হয়ে গেল। আমি প্রায় ১২ বছর পরে এই কিছুদিন আগে সকলের খোঁজ খবর নিতে টিকিয়া পাড়ার সেই জয়সোয়ালদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এই বাড়িতে দুটো ঘরে আমি বহুদিন খাওয়া পড়া’র লোক হিসাবে কাজ করেছি। আমার ছোট বেলার সেই সব কথা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। জানেন আমাকে ওনারা সোফায় বসতে দিয়েছিলেন। কাপে করে চা দিয়েছিলেন। শুনলাম আমি কাজ ছেড়ে দেওয়ার বছর পাঁচেক পরে বিজয় দাদার মা,আমার প্রথম মালকিনের ক্যানসার ধরা পড়ে – মারা গেছেন। বড় দিদির পরে বিয়ে হয়েছিল। আর ছোট মেয়ে যে নাকি অন্য জাতের লোক কে বিয়ে করে এই বাড়ির নাম ডুবিয়েছে, সেই এখন সেই বউ ছেলে হারা বাবার দেখাশোনা করে। আমারও আর ওই বাড়িতে কাজ করতে মন করতনা। সত্যি কথা বলতে কি খাওয়া পড়ার কষ্ট ছাড়া ওই পরিবারে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার খুব একটা হয়নি। কিন্তু সেই তো গ্রামের মতই খাওয়া পড়ার ভীষণ কষ্ট। প্রায় একবছর ওই বাড়িতে আমি কাজ করেছিলাম,এই এক বছরে আমাকে মাত্র একটা ফ্রক কিনে দেওয়া হয়েছিল আর ১০০ টাকা মাস মাইনে। সুন্দরবন থেকে পালিয়ে আসার এক বছর পরে বাবার হাত ধরে গ্রামে ফিরলাম। এক বছরের মজুরি হিসাবে আমি তখন ১০০০ টাকার মালিক। আজ থেকে ১৬ বছর আগে আমাদের গ্রামে ১০০০ টাকা তখন অনেক টাকা।
গ্রামে খাওয়া পড়ার এত কষ্ট,স্কুলে পড়ার পয়সা নেই, নিজেই আয় করব, নিজের পয়সায় বই কিনব বলে ৯ বছর বয়েসে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। সেই আমি ছোট আলপনা এক বছরে ১০০০ টাকা আয় করেছি। কিছুটা হিন্দি শিখেছি। মোটর গাড়ি, ট্রেন গাড়ি, ট্রাম, বাস দেখেছি। ইলেকট্রিক দেখেছি এমনকি টি ভি কি জিনিস তাও দেখেছি। বাড়িতে ফিরলে আমার ছোট ভাই,বোন আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাত – আর ঘুম না আসা পর্যন্ত অবাক হয়ে কলকাতার গল্প শুনত আর মাঝে মাঝেই গলা জড়িয়ে ‘এই দিদি আর কলকাতায় যাবিনা তো? বলনা’।
‘আমায় কোলে নিবিত? বলনা।’ আমার সেই ছোট ভাইয়ের এখন সংসার হয়েছে,তাকেও এখন ছোট বাচ্চা ছেড়ে পয়সার জন্য দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে হয়। আমাদের দেশে সব আছে কিন্তু কোন কাজ নেই, টাকা নেই,পয়সা নেই। আমাদের তাই লোকের বাড়ি কাজ করা বা অন্যের জমির ধান কাটার কাজ করতে ভিন দেশে যেতেই হয়। আমার বাবা এক পরিবারে অনেকদিন ছিলেন এমনকি বাড়ির মেয়েদের পায়খানার জল তুলে দেওয়ার কাজও করেছেন। বিয়ের আগে আমার মা’ও কলকাতায় লোকের বাড়ি কাজ করেছে। আমরা হতভাগা,বাবুদের এঁঠো কাঠা, গালি, মারধোর, অপমান খাওয়ার জন্যই জন্মেছি বলে মনে হয়।
এই দফায় মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে আমার গ্রামে থাকার সুখের সময় শেষ হল। এই এক বছর বাবা আমাকে দেশের খবর কিছুই জানান নি। দেশে ফিরে দেখি আমার বাবার অন্যপক্ষের ছেলে বড়দা,মেজদা আলাদা সংসার পেতেছে । আমরা পরের পক্ষের তিন ভাই বোন আর বাবা মা তখন আলাদা। বাবা ততদিনে বেশ বুড়ো হয়েছেন। আমাদের ভিটে বাড়িটুকু ছাড়া একফোঁটা জমি নেই। অন্যের জমিতে জন মজুর খেটে খেতে হয়। এখন বুড়ো বাবা তিনটে ছোট ছোট বাচ্চা মানুষ করবে কী ভাবে? অনেক ভাবলাম। রাতের পর রাত ভাবলাম। আমি যদি পড়াশুনা শুরু করি, নিজের আয়ের পয়সায় ছাত্রবন্ধু কিনি, স্কুলে আবার ভর্তি হই, গ্রামে থেকে যাই,তবে বাবা মা ভাই বোনের খুব আনন্দ হবে। কিন্তু বয়স্ক বাবা, আমার শান্ত মা’কে তিন ভাই বোনের খাওয়া পড়া, লেখাপড়া শেখাতে প্রানের ওপর দিয়ে পরিশ্রম করতে হবে। রোজ রাত্তিরে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতাম। দেশের জন্য, ছোট ভাই বোনের কথা ভেবে একলা কাঁদতাম আবার বুঝ দিতাম যদি আমার আয়ের টাকায় সংসারে কিছু সুবিধা হয়, বৃদ্ধ বাবার একটু কম পরিশ্রম হবে, বোনেদের পড়াশুনা হবে, আলপনা দেশের কথা ভেবে কাঁদলে তো হবেনা। আমি এইরকমই, সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে,একবার ওইদিক ভাবি আরেকবার অন্যদিক কিন্ত একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে সেই সিধান্তে টিকে থাকি – অনেকবার সেই সব সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে, অনেক ক্ষতি হয়েছে,অনেক বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছি কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকি। সিদ্ধান্ত নিলাম ভাই বোন পড়ুক আমি বাবাকে যতটা পারি সাহায্য করার চেষ্টা করি। আমার তখন মাত্র ১০ বছর বয়স – কিন্তু কী হয়েছে আমি তো আয় করতে শিখে গেছি। ছাত্রবন্ধু,পড়াশোনা পরে কোনদিন হবে খন।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এই কিছুদিন আগে আমি সুরাটে গিয়েছিলাম। রাজ্য,শহর,রাজধানী আমার কেমন সব গুলিয়ে যায়। তাই আমার সাথী যখন বললেন সুরাট গুজরাটের মধ্যে পরে আমি ঠিক বুঝলাম না। তবে সুরাট যে অনেক দূরে তা আমি জানি। সুরাটে এই নিয়ে আমার দুবার। প্রথম বার গিয়েছিলাম আজ থেকে দশ বছর আগে শাড়ি কারখানার লেবার হিসাবে। দু দিন না তিনদিন ট্রেনে না চান করে না ঘুমিয়ে সাধারণ কামরায় মাটিতে বসে বসে যাওয়া। সঙ্গী বলতে আমাদেরই গ্রামের লোকেরা, দেশে কাজ নেই সুরাটে নাকি অঢেল কাজ, অনেক পয়সা। আমরা যখন সুরাটে পৌছালাম ট্রেন লেট করতে করতে প্রায় মাঝ রাত, আমাদের যে দালালের কারখানায় নিয়ে যাওয়ার কথা সে তখন কোথায় কে জানে। বাড়ি থেকে এত দুরে,ভাষা জানিনা অসহায় আমরা চার পাঁচজনের দল কোথায় যাই? আমাদের মাতব্বরের কাছে বাংলায় ঠিকানা লেখা ছিল আর একটা ফোন নম্বর। এ দোকানে দেখায়, ওই দোকানে দেখায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বোঝানোর চেষ্টা চালায় – কিন্তু কোন কাজে আসেনা। শেষে একজন ভালো মানুষ বললেন আপনারা এদিক সেদিক রাত কাটান,সকালে খুঁজতে সুবিধা হবে। সুরাট স্টেসানের উল্টোদিকে দেখলাম এখন ব্রিজ মত হয়েছে তখন ব্রিজ মনে হয় ছিলোনা – সেখানেই এক দোকানের নিচে,ফুটপাথে তিন দিন ধরে ট্রেনের ধকলে সেই সুন্দরবন থেকে কাজের আশায় আসা আমরা গরীব মানুষের দল জল খেয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে পড়লাম। বিদেশে কেউ যদি দলছুট হয়ে যায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
তার পরে কী করে আমরা কাজ পেলাম। অন্য দালালকে দিয়ে অন্য কারখানায় গিয়ে কাজ জোটালাম। সুরাটে রাস্তা হারিয়ে ফেলে পাগলের মত সারা দিন ঠিকানা খুঁজে ফিরলাম। একমাত্র সোনার চেন বিক্রি করে দিয়ে কয়েক মাস পরে একা একা অচেনা রাস্তায় ট্রেন বদল করে করে দেশে ফিরলাম সেই সব গল্প, আমাদের মত কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো সেই সব বেপরোয়া মানুষদের গল্প অন্য দিন শোনাবো। কিন্তু জমাট অন্ধকারের মধ্যেও যেমন একটু হলেও আলো থাকে, পশুরা যেমন অন্ধকারেও দেখতে পায় আমরাও তেমন মরিনা। আমরা আয়লায় মরিনা। আমরা না খেতে পেলেও মরিনা। আমাদের সমস্ত কিছু চিটফান্ড ঠকালেও মরিনা। আমরা হাজারে হাজারে নদীর ওপারের মানুষ বাবুদের বাড়ি কাজ করি, সুরাটে শাড়ী কারখানায় চুমকি বসাই, তামিলনাড়ুতে গেঞ্জি কারখানায় কাজ করি। কেরালায় ইট বই। বিহারে আলুর গুদাম বানাই। এই সমস্ত কাজ আমি নিজে করেছি। আমিও মরিনি।
দশ বছর পরে এইবার সুরাট গেলাম প্লেনে করে। জীবনে প্রথমবার। আমেদাবাদ থেকে সুরাটে পৌঁছালাম সেই মাঝরাতেই প্রায়। আমাকে একজন নিয়ে গিয়েছিলেন নতুন কাজ শেখানোর ট্রেনিং দিতে। কখন পৌঁছালাম টেরই পেলাম না। উঠেছিলাম সেই সুরাট স্টেসানের কাছেই লিফট আছে এই রকম এক হোটেলে। সেখানে সকালের খাওয়াও ফ্রি। জানেন অনেকক্ষণ ধরে হেঁটে হেঁটে খুঁজে বেড়ালাম আমার সেই দশ বছর আগে একই শহরে একই এলাকায় ফুটপাথে রাত কাটানোর জায়গা টা। দেখলাম আমারই মত কত আলপনা এখনো ফুটপাথে শুয়ে আছে – কে জানে তারাও সুন্দরবন থেকে কিনা।
সুরাটে ...
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সেবার গ্রামের এক পরিচিত বাবাকে এসে জানালো সে সল্টলেকে এক গ্যারেজ ঘরে থাকে, সেই বাড়ির ওপর তলার এক বুড়ো বুড়ি অল্প বয়েসের কাজের মেয়ে খুঁজছে। খাওয়া পড়া ছাড়া মাস মাইনে ১৫০ টাকা। আমার সরল বাবা রাজি হয়ে গেলেন। কলকাতা তো এমন কিছু দূরে নয়। আগের বার না বলে পালিয়েছিলাম নিজের পয়সায় ছাত্রবন্ধু কিনব বলে আর এইবারে দেশ ছাড়লাম সংসারে সাহায্য করব বলে। আমার তখন দশ বছর বয়স। আমি যখন বাড়ি থেকে নৌকা ধরতে খেয়া ঘাটে যাচ্ছি আমার ছোট বোন ভাই কতদূর পর্যন্ত সাথে সাথে এলো। আমার বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো, হয়ত ওদেরও। ছোট মোল্লাখালির ঘাট আবার আবছা হতে শুরু করল। আমি আমার ছোট ভাই, বোন, মা কে ছেড়ে আবার কাজে চললাম। অজানা বাড়িতে। অজানা পরিবেশে। আর কী আশ্চর্য আবার চারিদিক চুপচাপ হয়ে গেল, কুয়াশা ঘিরে ধরল চারদিক, কেবল বইঠার শব্দ, নৌকায় জলের শব্দ। ছোট আলপনা বুকের মধ্যে কান্না চেপে বাবাকে সাহায্য করতে দেশ ছাড়ছে বলে তাই? গ্রামের সেই মানুষ আমাকে নিয়ে ক্যানিং থেকে কলকাতার ট্রেন ধরলেন, এইবার আমি আর অত অবাক হলাম না। ততদিনে ট্রেন কী দেখে ফেলেছি। শেয়ালদা না নেমে আমরা নামলাম চম্পাহাটি। আমাকে স্টেশানে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে, কোথাও নড়িসনা আমি এক্ষুনি আসছি বলে তিনি কোথায় চলে গেলেন। একটার পর একটা ট্রেন আসে যায়, বেলা বাড়তে বাড়তে প্রায় বিকেল হতে চলল,খিদেয় মাথায় চক্কর দিচ্ছে সেই লোকের আর দেখা নেই। আমি কী করব ভেবেই পাচ্ছিনা,জায়গা ছেড়ে নড়তেই পারছিনা যদি উনি ফিরে এসে আমাকে না পান। চুনাখালি থেকে গ্রামের ঘাটে ফেরার লাস্ট খেয়া সন্ধে ৭টায় – একবার ভাবছি ক্যানিং পথের ট্রেন ধরি, রাত হয়ে গেলে ঘাটে না হয় শুয়ে যাব। একবার ভাবছি লোকটা এই বুঝি এলো। রাগে, দুঃখে, চিন্তায়, খিদেতে মাথা ফেটে যাচ্ছে আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি এই বুঝি এলো। বেলা গড়িয়ে সন্ধে হওয়ার মুখে তিনি তাড়াহুড়ো করে কোথা থেকে এলেন – একটু দেরি হয়ে গেল চল, একজনার কাছে কটা টাকা পেতাম শালা বাড়িতে নেই। আমার তখন খিদেয়-চিন্তায়-কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছে।
গেল সপ্তাহে প্রায় ১৬ বছর পরে চম্পাহাটি গিয়েছিলাম। আমার এক বন্ধুর বৌয়ের সাথে। আমাদের এলাকায় ক্যানিং বাদে চম্পাহাটি বড় বাজার। একই স্টেশন এমনকি সেই একই বেঞ্চি যেখানে আমি আজ থেকে ১৬ বছর আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই লোকটার জন্য খিদে, দুঃখ, চিন্তা, রাগ, অভিমান, ভয় নিয়ে বসেছিলাম বন্ধুর বৌ এর সাথে বসলাম সেখানে কিছুক্ষণ। সে তো অবাক, এই আলপনা ধপ করে এই নোংরা বেঞ্চিতে বসে পড়লে কেন। হাতের ইশারায় চুপ করতে বলে আমি ফিরে যেতে চাইলাম সেই ১৬ বছর আগের দিনটায়। একটা ছোট সরল অসহায় বাচ্চার ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা অচেনা স্টেশানে খিদে জল তেষ্টা চেপে ভীষণ টেনশন নিয়ে বসে থাকার মুহূর্ত আমি আবার অনুভব করলাম। কান্না করলাম অন্যদিকে তাকিয়ে। আপনাদের কারো বাচ্চাদের সাথে যেন এমনটা না হয়।
লোকটা সত্যিই সল্টলেকে এক গ্যারেজে থাকতো। এক দিন দু দিন যায় আমার কাজ আর ঠিক হয়না, সারাদিন সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় আমি সারাদিন বদ্ধ গ্যারেজঘরে কাজের আশায় বসে থাকি। ঘরে একটাই চৌকি, আমি মেঝেতে শুই। আমার মন কেমন যেন কু ডাকতে শুরু করে। বিপদের গন্ধ কেন জানিনা আমি আগে থেকে পাই। লোকটা আমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার না করলেও কেমন যেন একটা অন্য রকম। একদিন শুনি আমাকে নাকি বোম্বেতে কোথায় পাঠানোর কথা হচ্ছে, আমার বাবাকে কলকাতায় কাজ দেবে বলে রাজি করিয়ে নিয়ে এসেছে এখন তাকে না জানিয়ে বোম্বে কেন? আমি পালাব ঠিক করলাম। লোকটা আমাকে একদিন বলল – দেখ বোম্বে তে একটা খুব ভালো কাজ আছে,মাস তিনেক করে আয়, অনেক বেশী টাকা দেবে ভালো না লাগলে আবার না হয় চলে আসবি। সেই চম্পাহাটি স্টেসানে আমাকে একলা ফেলে যে লোক কোথায় চলে যায় তার কথায় বিশ্বাস কী? আমি জেদ ধরে থাকলাম – না আমি বোম্বে যাবনা,তুমি বাবাকে কলকাতায়,সল্টলেকে কাজ দেবে বলে আমায় নিয়ে এসেছ। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করার পরেও আমি যখন রাজি হলাম না তখন রেগে মেগে সে বলল যা তাহলে মোল্লাখালি যা, না খেয়ে মর সেখানে। এতদিন পরে অতটা মনে নেই তবে এই টুকু মনে আছে সল্টলেকে একটা খাল পার করে সে আমায় একলা একটা শেয়ালদার বাসে তুলে দিয়েছিল। এখন যারা শেয়ালদা গেছেন জানেন ক্যানিং লাইন আর মেন লাইনের মধ্যে রাস্তা হয়ে গেছে,তখন দুই লাইন আলাদা ছিল, এক বাড়ির সাথে অন্য বাড়ির মধ্যে রাস্তা ছিলোনা। মাত্র দশ বছর বয়স তখন আমার, সাথে কেউ নেই,আমাকে একটা শেয়ালদার বাসে তুলে দিয়ে লোকটা কোথায় চলে গেছে। নিজেকে বললাম সবাই যদি যেতে পারে আমিও পারব। শেয়ালদা তে নেমে সবাই যেদিকে হাঁটছে সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আমি জানতাম বিপদে পড়লে,কিছু জিজ্ঞাসা করতে হলে পুলিশের কাছে যাবে, অচেনা লোক ভুলভাল বলতে পারে। একজন রেলের পুলিশের দেখা পেতেই আমি তাকে গিয়ে ধরলাম – আমি ক্যানিং যাব কিভাবে যাব একটু বলবেন। আমি এমনিতেই ছোটখাটো তখন তো বাচ্চাই বলতে গেলে আরও ছোটখাট, পুলিশের বোধহয় আমাকে দেখে মায়া হল – টিকিট কেটে একজনা কে বললেন একে ক্যানিং ট্রেনে তুলে দিয়ো। নীচের পথ দিয়ে, চুনাখালি হয়ে ছোট মোল্লাখালির ঘাট দিয়ে যখন বাড়ি ফিরছি,তখন বেলা তিনটে মত হবে – বাবা,মা একই জমিতে জন খাটছিল, দূর থেকে আমাকে দেখে মা বলছে – দেখত আমাদের মেয়ে বলে মনে হচ্ছেনা, বাবা বলছেন ধুস সে এখন এখানে কী করে আসবে। আমি আলপনা সেই দশবছর বয়েসে একা গ্রামে ফিরলাম – সেই থেকে আমার একলা পথচলার শুরু।
সেই লোকটার সাথে আমার পরে গ্রামে অনেকবার দেখা হয়েছে – আমি খুব শান্ত গলায় বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে যা করেছেন আপনার নিজের মেয়ের সাথে যদি কেউ করত? তার কাছে কোন জবাব ছিলোনা।
আপনাদের বাচ্চাদের সাথে, কারোর সাথে কখনো যেন এমনটা না হয়। একলা অচেনা এক স্টেশানে সরল অসহায় বাচ্চার ঘণ্টার পর ঘণ্টা খিদে জল তেষ্টা চেপে ভীষণ টেনশন নিয়ে বসে থাকা যেন আলপনা কে দিয়েই শেষ হয়।