ও দিদিমা তোমার নাতি রোজ রাত্তিরে এ ঘরে এসে জ্বালায় -আজ থেকে আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমাব।
চুপ কর বেআদব ।
গরু ছাগলের মত বেচাকেনা ঠিক বলবনা আমার মতামতের তোয়াক্কা না করে হাত বদল হতে হতে আমি তখন এক মারোয়াড়ী পরিবারে বুড়ো বুড়ির দেখভালের জন্য খাওয়া পড়ার লোক । জয়েন্ট ফ্যামিলি ,বড় বাড়ি , টিকিয়া পাড়ার জয়সোয়াল পরিবারের মত খাওয়া পড়ার কষ্ট নেই । সবাই ব্যস্ত ,বুড়ো বুড়ি এক কোনায় থাকে আর আমি তাদের খাবার দেওয়া ,ওষুধ দেওয়া ,পা টিপে দেওয়া ,ফাইফরমাশ খাটা ,বিছানা পাতা ইত্যাদি করে থাকি -খাটে বুড়ো আর বুড়ি আমি মেঝেতে । রাত্তিরে যদি কাউকে ডাকতে হয় , বুড়োর যদি হাঁপানির টান বেড়ে যায় ,বাড়ির লোক কে খবর দিতে হবে -আমি তো দরজার ছিটকানি হাত পাইনা তাই দরজা খোলা রাখার নিয়ম ,আর এই নিয়মের ফাঁকে ঢুকে পড়ে লোভী ,ভীতু ,শুয়োরের বাচ্চারা ।
রাজাবাজার না পার্কসার্কাসের সেই অদ্ভুত বাড়ি থেকে ফিরে আত্মাদের ভর থেকে বেরোতে আমার প্রায় তিনমাস সময় লেগেছিল । তবে এই তিনমাস তো আর বিছানায় শুয়ে থাকতাম না,চরম অভাবের সংসারে রোজগেরে মেয়ের সেই সুযোগ থাকেনা । খাল বিলের ধার থেকে নলখাগড়ার ডাল ভেঙ্গে শুকিয়ে নিতাম -সারা বছরের জ্বালানী ,আর রোজ গজগজ করতাম । কাদা মাখতে আমার জন্মের অরুচি । মাঠ থেকে গোবর কুড়িয়ে কাঠিতে লাগিয়ে লম্বা লম্বা লাঠি বানাতাম -আমার মা তা দিয়ে খুদ জোগাড় করে এনে আমাদের খাওয়াত । বাবা তো ভিনদেশে প্রোজেক্টের কাজ নিয়ে -বিঘার পর বিঘা ধান কাটতে গেছে । অভাব কাকে বলে সেই বিষয়ে আমার পাঠক বন্ধুদের কারো কারো ধারণা থাকতে পারে কিন্তু চরম অভাবেও আমার মাকে যেভাবে মাথা উঁচু করে হাসি মুখে আমাদের মানুষ করতে দেখেছি সেই শক্তির কিছুটাও যেন ভগবান আমাকে দেন । দেশে আমাদের তখন চরম অভাব , একজনের খাবার তিন ভাই বোন ভাগ করে একবেলা খাওয়া ,আমি আস্তে আস্তে অজানা ভয় থেকে বেরিয়ে আসছি। আবার কাজের খোঁজে এলাম কোলকাতা । এইবার এসে উঠলাম মানিকতলায় এক মারোয়াড়ী পরিবারে । বিরাট বাড়ি ,আমরা দুজন সবসময়ের কাজের লোক । টিকিয়াপাড়ার মত রান্নাঘরের মেঝেতে নয় ছাদের ওপর আমাদের থাকবার আলাদা ঘর ,বাথরুম । মাসে মাইনে ১৫০টাকা । কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল গোরু ছাগলের মত হাতবদল । মালিকের এক বন্ধুর বাড়ির কাজের লোক দেশে গিয়ে আর ফিরছেনা ।
'আলপনা কালসে তুম হামার এক দোস্ত কা ঘর মে কাম পে লাগ যাও ‘।
সেই দোস্তের বাড়িতে আমি একদিন ভুল করে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । কাজ থেকে এসে মালিক আমাকে সোফায় ঘুমাতে দেখে কাঁচা ঘুম থেকে তুলে ফাঁকা ছাদে আটকে রেখেছিল সারা রাত । আমি কিন্তু ভয় পাইনি ,কিছুক্ষণ ছাদ থেকে কলকাতার উঁচু উঁচু বাড়ি ,রাস্তার গাড়ি দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । বৃষ্টি না হলে ছাদ মন্দ কি ? সোফার থেকে অনেক ভালো ।
সেই বাড়িতে মাস দুয়েক কাজ করবার পড়ে আবার এক বাড়িতে হাতবদল । এইভাবে ছয়মাসের মধ্যে চার বাড়ি বদল করে এসে উঠলাম বুড়ো বুড়ির বাড়ি ।
আমি তখন মাত্র ১০বছর কয়েকমাসের মেয়ে । গ্রামে তো সবার মতই আদুল গায়েই ঘুরে বেড়াতাম । শহরে কেবল ফ্রক বা টেপ জামা । শরীরের নিয়ে কোন বোধই তৈরি হয়নি । হঠাৎ একদিন ঘুমের মধ্যে মনে হল শরীরে কার যেন হাত । ভয়ে গুটিয়ে গেলাম -ভেজানো দরজা খুলে কে যেন চলে গেল। খালি পায়ে কুকুরের গু মাড়িয়ে দিলে যেমন একটা ঘিনঘিনে মনে হয় ,হাজার বার টিউকলের তলায় পা ধুলেও যেমন সেই মনে হওয়া লেগে থাকে অনেকক্ষণ আমার কেন জানিনা সেই ঘিনঘিনে ভাব হতে থাকলো । ঘুমই এলোনা সারা রাত্তির । ওদিকে খাটে বুড়ো বুড়ি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে । দু একদিন পড়ে যখন প্রায় ভুলে যেতে বসেছি ঘটনাটা -আবার সেই ঘিনঘিনে হাত । আমার চণ্ডাল রাগ খপ করে চেপে ধরলো সেই হাত -কিন্তু শক্তিতে দুর্বল ধরে রাখতে পারলোনা বেশিক্ষণ । আমার নিজের ওপরই রাগ হতে থাকলো ,নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা হল । কিন্তু এইভাবে হেরে যেতে আমি পারবোনা । একটা ঘিনঘিনে ভাব ,অদ্ভুত ভয় নিয়ে কি করে কাটাবো সারাদিন ? এর একটা বিচার দরকার । আমার মনের একদিকে তখন ভয় আমি যদি চ্যাঁচামেচি করি আমার ১৫০টাকার চাকরি তক্ষুনি যাবে । আবার সেই সুন্দরবনের খুদ কুড়োর পান্তা খাওয়া ,আবার বোনের স্কুলের মাইনে বন্ধ হওয়া ,মাঠে মাঠে গোবর কুড়ানো । কিন্তু আমার মনের অন্যদিক তখন চণ্ডাল রাগে ফুটছে,'সাটার পাটা’ যদি না ফেলে দিয়েছি আমি শালা বড় মাতব্বরের মেয়ে নই । কিন্তু কী করি -ফাঁদ তো পাততে পারি ? দিদিমা নাতি বিষয়ে অন্ধ ,সে যে একটি লোভী ,ভীতু ,শুয়োরের বাচ্চা সে বিষয়ে দিদিমা আমার মত এক কাজের মেয়ের কথা বিশ্বাস করবে কেন ? দাদুকে গিয়ে ধরলাম ।
একদিন পা টেপার ফাঁকে বললাম
দাদু তোমার নাতি রাত্তিরে আমাকে জ্বালায় । লুকিয়ে ঘরে ঢুকে গায়ে হাত দেয় ।
ক্যায়া বোল রহি হ্যায় আলপনা ?
ঘটনা গুলো বললাম, দাদুর কেন জানিনা কিছুটা বিশ্বাস হোল , দিদিমাকে বললেন…
গুড়িয়া ইতনা বোল রহি হ্যায় -তুম আজ আলপনা কা সাথ শো যাও । দেখো তো সহি
বুড়ি নিমরাজি হয়ে ,রাগে গজগজ করতে করতে আমার বিছানায় মেঝেতে এসে শুলেন আর আমি ভয়ে চিন্তায় জেগে থাকলাম । আজকে যদি সেই নোংরা হাত না আসে তবে বুড়ি আমায় আস্ত রাখবেনা । নাতির নামে মিথ্যা নিন্দা বুড়ি আমাকে মেরেই ফেলবে । অনেক রাত্তির তখন ,ভেজানো দরজা খুলে গেল ,আমি উত্তেজনায় প্রায় উঠে বসতে গেলাম ,ঠাকুর কথা শুনেছে । আজকে হয় এদিক না হয় ওদিক । সেই ঘিনঘিনে হাত অন্ধকারে ঠাওর করতে না পেরে হাত বাড়াল , আমার জায়গায় তখন বুড়ি শুয়ে আছে বুড়ির বুকের কাছে হাত পড়তেই সেই ঘিনঘিনে হাত বুঝে গেছে সে ধরা পড়ে গেছে -এক ছুটে দরজা খুলে রেখেই পালাল আর বুড়ি ধড়মড় করে জেগে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনুরোধের ভাষায় বললেন - 'আলপনা তুম সহি থি -কিসিকো মৎ বোলনা '। আমি কি জিতে গেলাম ? অন্তত আমি যে সত্যি বলেছিলাম তা তো প্রমাণ হোল । কিন্তু আমি যে জয়ী হইনি তা আমি আজকেও বুঝতে পারি -বাসে -ট্রেনে- কাজের বাড়িতে সবখানে লোভী শয়তান ঘিনঘিনে মানুষেরা । ছোটলোকদের ভাষা আমি বুঝি ,তাদের সাথে বোঝাপড়া আমি তাদের ভাষাতেই করতে শিখেছি - কিন্তু বেশিরভাগ আমার দেখা বড়লোক পরিষ্কার জামা পড়া আসলে শুয়োরের বাচ্চা । আমি তখন ছোট অন্য বাড়িতে কাজ করি এক মালিক বৌদি না থাকলেই লুঙ্গি পড়ে আমাকে দিয়ে পা টেপাত । আমি বুঝতাম কিন্তু অভাবের কথা ভেবে ,অপমানে ,ব্যাথায় ,অন্যদিকে তাকিয়ে কান্না করতে করতে মনে মনে বলতাম বৌদি তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো আমাকে বাঁচাও । সেই থেকে ভদ্রলোক ,বড়লোক দেখলেই আমার কেমন যেন ঘিনঘিনে একটা অনুভূতি হয় সেই খালি পায়ে কুকুরের গু মাড়িয়ে দেওয়ার মত । যতই হাসি মুখে কথা বলি কেমন যেন মাথার মধ্যে আমার ১১ বছর বয়সে সেই মারোয়াড়ী পরিবারে ঘিনঘিনে হাতের কথা টিক টিক করে । আর মনে পড়ে বুড়ির কথা - 'আলপনা তুম সহি থি -কিসিকো মৎ বোলনা '। কিন্তু আমার ধারণা যেন মিথ্যা হয় আমি যেন সবসময় 'সহি 'না হই সব ভদ্রলোক যেন ঘিনঘিনে হাত , লোভী ,ভিতু না হন ।
গরীবের বেলায় বিচার অন্য হয় সবাই জানে ,আমার বেলাতেও একই হোল - হাতে নাতে অপরাধী ধরা পড়ার পড়েও , 'আলপনা তুম সহি থি ‘ জানার পড়েও বিচারে আমার ফাঁসি হোল । পরের দিন আমার চাকরি চলে গেল । হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিয়ে বুড়ি আমাকে চুপি চুপি কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করে দিলেন । সেই অপরাধী পরে আরও কী কী করেছে আমি জানিনা -কিন্তু আমি হারিনি এই বিচারে আমার বয়েই গেল । আবার অভাব ,আবার খাওয়া পড়ার কষ্ট ,হাড়ভাঙ্গা খাটুনি কিন্তু আমি মাথা উঁচু করে বাড়ি ফিরলাম । আমি মাতব্বরের মেয়ে ‘সাটার পাটা’ ফেলে তবে বাড়ি এসেছি ।
মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আবার কলকাতায় । আবার সেই টিকিয়া পাড়ার জয়সোয়াল বাড়ি । কিন্তু এইবার পরিবার অন্য ,নিচের তলার বদলে ওপর তলায় । আগামী চার -পাঁচ বছর আমি এই বাড়িতেই ছিলাম । টিকিয়াপাড়া আমার চেনা বাড়ি ,চেনা পরিবেশ ,অনেক চেনা কাজের মেয়ে, আনন্দে কাজে লেগে গেলাম । আমি ততদিনে পাকা কাজের মেয়ে ,ছোট হলেও অভিজ্ঞতায় শক্ত । মাইনে বেড়ে হল ২৫০ টাকা । কিন্তু যে ছাত্রবন্ধু কিনবো বলে ঘর ছেড়েছিলাম তা প্রায় ভুলে গেছি ততদিনে । চরম অভাবের সংসারে আমার ছোট হাত যদি কিছু কাজে লাগে .....