জানেন পশুদের সাথে আমার এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব আছে। আমি তাঁদের সাথে কথা বলি, বকা, ঝকা, ঝগড়া সবই করি। ভালোবাসি, উলটে তারাও আমাকে প্রাণের থেকে ভালোবাসে। নিউটাউনের নারকেলবাগান বৌদিদের বাড়ি কাজ করতে আমাকে অনেকটা সাইকেল চালাতে হত, মাইনেও অন্যদের থেকে কম ছিল কিন্তু বাবাল ছিল, বাবাল সেই বাড়ির কুকুরের নাম। আমাকে সে পাগলের মত ভালবাসত, আমার সাথে মারামারি করত আমিও করতাম, কথা বলতাম, আমি কোনদিন না গেলে বাবাল না খেয়ে বসে থাকতো, দশ মিনিট তাকে সময় না দিলে সে আমায় কাজ করতেই দিতনা। কাজের দিকের সুবিধা দেখতে গেলে নারকেলবাগানে রোজ সাইকেল ঠেলে আমার কাজ করতে যাওয়ারই কথা নয় কিন্তু বাবালের জন্য আমি হাজার অসুবিধা স্বত্বেও যেতাম। কিছুদিন হোল ক্যানিং লাইনে আমার নিজস্ব একটা ডেরা হয়েছে, কিন্তু কাজ কলকাতায়, রবিবার ছাড়া দেখানে যাওয়া হয়েই ওঠেনা তবুও আমার গন্ধে পাশের বাড়ির বিড়ালটা ঠিক চলে আসে। আমি তাকে কাঁটা বেছে মাছ খাওয়াই, বকা লাগাই, বাথরুমে চান করাই আর সে আমি কলকাতায় চলে আসব বলে শাড়ি পড়তে গেলেই পায়ের ওপর বসে থাকে, কুঁচি করতে দেবেনা, আমাকে চলে যেতে দেবেনা, অনেক বোঝাতে হয়। আমি যখন কাঁচা রাস্তা দিয়ে স্টেসানের দিকে হাঁটা লাগাই সে কুকুরের ভয় ভেঙ্গে সাথে সাথে কতদূর পর্যন্ত আসে।
কিন্তু আমার বড়মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি আর পুষ্যি রাখিনা। বড়মা আমার ভেড়ার পালের সবথেকে বড় ভেড়া ছিল – আমার হাতে ভেড়া খুব হত। প্রায় ১২-১৩ টা ভেড়া ছিল আমাদের, আর আমি তাদের চড়িয়ে বেড়াতাম এই মাঠ থেকে ওই মাঠ। ফাল্গুন চৈত্র মাসে যখন মাঠে ঘাস থাকেনা তখন প্রায় অর্ধেক গ্রাম চষে ফেলতাম আমি ভেড়ার পাল নিয়ে, যদি কোথায় ঘাস পাওয়া যায়, ফাঁকে ফাঁকে অন্যের জমি থেকে আলু চুরি করে শাপলা দিয়ে আলুপোড়া খেতাম। আদিবাসী পাড়া ছাড়িয়ে কোথায় কোথায় চলে যেতাম, নিজের মনে কথা বলতাম সবার সাথে আর সব থেকে বড় ভেড়াটাকে ডাকতাম বড়মা বলে। প্রত্যেকে আমায় ভালবাসত, কথা শুনত – যতদূরেই থাকনা কেন আমি একবার বড়মা… বলে ডাকলেই সমস্ত ভেড়ার পাল বড়মাকে সামনে রেখে পৌঁছে যেত আমার নাগালে। এইরকম এক চৈত্র মাসের বেলা বসা বসা সময়ে আমি আমাদের এলাকা ছেড়ে অনেক দূরে, খাল বিলের জল তখন শুকিয়ে খটখটে – একটা খাল এই সুযোগে নতুন করে কাটানো হয়েছে। বেশ গভীর। সারাদিন গরমে ভেড়া চড়িয়ে আমি তখন বেশ ক্লান্ত, ভাবলাম নতুন কাটানো এই খালটার নিচের দিকে মাটি ঠাণ্ডা হবে, একটা গাছের ছায়াও আছে – একটু জিরিয়ে নি। বেলা পড়তে পড়তে বাড়ি পৌঁছে যাব। বড়মা কে ডেকে বললাম, আমি একটু শুলাম, তোমরা আমাকে ছেড়ে যেওনা। ভেড়ারা আপন মনে চড়ে বেড়াতে লাগলো আর আমি খালের নিচের দিকের ঠাণ্ডা মাটিতে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লাম। সন্ধে ক্রমে রাত হল আর আমি নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছি মনে করে ঘুমাতেই থাকলাম। রাত হয়ে গেল অথচ মেয়ে ভেড়ার পাল নিয়ে এখনো বাড়ি ফিরলনা দেখে আমার বাবা মা কাকা কাকি এদিক ওদিক হ্যারিকেন নিয়ে খুঁজে বেড়াতে থাকল – আমি তো তখন অনেক দূরে, অন্য এলাকার গম্ভীর মাঠের মাঝে নতুন কাটানো খালের একদম নিচের ঠাণ্ডা মাটিতে অঘোরে ঘুমাচ্ছি। ঘন অন্ধকারে, খালের ভেতরে মানুষ দেখবে কী করে? ওই খালের আশেপাশে নাকি মড়া বাচ্চাদের পুঁতে দেওয়া হত, তাদেরই কেউ আমায় নিয়ে গেল নাতো? আমাদের এলাকার পেছন দিকে সেই গম্ভীর মাঠ, মাঠের এক কোনায় সেই নতুন কাটানো খাল, আর খালের ওপারে অন্য পাড়া। এপাড়া থেকে হাঁক পাড়া হচ্ছে কেউকি আমার মেয়ে, ভেড়ার পাল দেখেছো নাকি? মাঠ পেরিয়ে ও পাড়া থেকে উত্তর আসছে কই তেমন তো কিছু দেখিনি। আমি তখন অঘোর ঘুমে, আর আমাকে ঘিরে রয়েছে বড়মা আর বাকি সব ভেড়াদের পাল। সন্ধে হলে পোষা গরু ভেড়া ছাগলের দল নিজেরাই পথ চিনে ঘরে ফেরে, আমার ভেড়ার পাল’ও ফিরে যেতে পারত, আমি তো তাদের খোটায় বেঁধে ঘুমাতে যাইনি – কিন্তু ওই, বড়মার তো তার মেয়ের প্রতি দায়িত্ব আছে। তারা সবাই শেয়ালের ভয় ভেঙ্গে আমাকে গোল করে ঘিরে ধরে পাহারা দিচ্ছে ওই যে আমি বলেছিলাম 'আমি একটু শুলাম তোমরা আমাকে ছেড়ে যেওনা'। ওই পাড়ার এক মাস্টার মশাই তখন খালের পার দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, অনেক রাত – চারিদিকে চিৎকার, খোঁজাখুঁজি দেখে তিনিও খুঁজতে থাকলেন আর নতুন কাটা খালের ভেতর থেকে শুনতে পেলেন ভেড়াদের ডাক। আমার বাবা, মা যখন আমাকে সেই খালের ভেতর থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে আনলেন তখনো সমস্ত ভেড়ারা গোল হয়ে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। এর বেশ কিছুদিন পড়ে কী একটা কারণে আমি একদিন ভেড়া নিয়ে বেরোইনি – আমার কাকার ছেলে তাদের চরাতে নিয়েছিল, কেউ গরু বাঁধার খোটা দিয়ে মেরেছিল বড়মার মাথায় – গল গল করে রক্ত পড়ছিল বড়মার চোখ বেয়ে। কত কষ্ট পেয়ে মরেছিল আমার বড়মা – সেই থেকে আমি আর পোষ্য রাখতেই পারিনা – আমার কেবল বড়মার কথা মনে পড়ে। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে আসা রক্তের কথা মনে পড়ে।
দশ বছর বয়েসে একা একা গ্রামে ফেরার পরে আমার মা আমাকে আর কাজে পাঠাতে চায়নি, থাকনা এখানে ডাল ভাতের ব্যবস্থা একটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কী অভাব, মাঠের শাপলা কুড়িয়ে খেতে হয়, একবেলা ভাত জোটে তো তরকারী নেই। আমি থাকা মানে একটা বাড়তি মুখ, আমি যদি কিছু আয় করতে পারি সংসারে কাজে লাগবে। এইবারে আমার গ্রামে থাকার পালা মাত্র তিন সপ্তাহে শেষ হোল। আমার বাবা একজনা কে অনেকদিন আগে কলকাতায় কাজে দিয়েছিলেন, তিনি এখন তার মেয়ে কে নিয়ে কোলকাতাতেই থাকেন – তিনি কী একটা কাজে গ্রামে এসেছিলেন, বাবার কথায় আমি তার সাথ ধরলাম। এইবার ঠিক কোথায় এসে উঠলাম আমি ঠিক তা বলতে পারবনা। তবে নিচে অনেক সেমাই, বিভিন্ন রকমের মুসলমানি খাবার দাবারের দোকান ছিল – রাজাবাজার বা পার্ক সার্কাস এলাকার কোন বাজার এলাকায় হবে। বাড়িটা আর বাড়ির মানুষেরা একটু অদ্ভুত মত ছিল। মাত্র তিনজন লোক, বিরাট বাড়ির পুরো দুতলা জুড়ে তাঁরা থাকতেন। আমার কাজ ছিল বাড়ি ঝাড়ু মোছা করা, পরিষ্কার রাখা, দেখাশুনা করা ব্যাস। প্রতিদিন সকালে তারা কুসুম বাদ দিয়ে ডিম খেতেন আর রোজ তাদের বাদ দেওয়া তিনটে করে কুসুম আমার বরাদ্দ ছিল। বেলা নটা বাজতে না বাজতেই তিনজনাই একসাথে কাজে চলে যেতেন ফিরতেন রাত্তির নটা-দশটার সময়ে। ছুটির দিন ছাড়া বাড়িতে রান্না বান্নার পাট ছিলনা। আমাকে থাকার জন্য একটা ভাঙ্গা মত পুরানো ঘর আর আলাদা বাথরুম দেওয়া হয়েছিল আমি নিজের রান্না নিজেই করে নিতাম। যাওয়ার সময়ে মেন গেট ওনারা বাইরে থেকে বন্ধ করে যেতেন, বারান্দায় যাওয়া যেত ঠিকই তবে সেখানেও গ্রিল লাগানো। বাড়ির কাজ, নিজের রান্না বেলা দশটার মধ্যে শেষ হয়ে যেত। একা একা একটা বিশাল ভুতুড়ে বাড়িতে আমার কিছুতেই সময় কাটতোনা, কতক্ষণ একা একা বারান্দায় দাঁড়ানো যায়? টিভি’র ঘর তালা দেওয়া থাকতো, ফোনের ঘরও তালা দেওয়া, কারো সাথে কথা হতনা, যেন জেলখানায় বন্দী আর মনে হত কারা যেন আমার ওপর সব সময় নজর রাখছে। বাথরুমে চান করতে করতে হঠাৎ করে চুন খসে পড়লে আমার মনে হত কেউ যেন আমাকে কিছু ছুঁড়ে মারল আমি ছুটে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতাম। ধীরে ধীরে মনে হতে লাগলো কারা যেন রাত্তিরে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আমি কষ্ট করে চোখ বুঁজে থাকতাম আর রোজ ভয়ে ফ্যাকাসে হতে থাকতাম। আমার তখন মাত্র ১০ বছর কয়েকমাস বয়স, মাথায় তখনো অত কিছু বুদ্ধি হয়নি, মা নেই বাবা নেই এমনকি বাড়ির মালিকরাও সারাদিন ধরে নেই, আমি ভয় পেলেও কারোর কাছে যাওয়ার উপায় নেই। মেন গেট বাইরে থেকে বন্ধ – একটু যে পাশের বাড়ির লোকের সাথে গল্প করব তার উপায় নেই – আমি ক্রমশ পাগল হয়ে যেতে থাকলাম – দিনের বেলা কোনরকমে কাটলেও সন্ধ্যে হলেই ভয় চেপে ধরত, একটু খুট করে আওয়াজ হলেই ভয়ে চমকে উঠতাম। রোজ রাত্তিরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ, বয়স্ক মানুষদের হাঁপানির টান, কারা যেন যন্ত্রণায় চেঁচাচ্ছে আমি পরিস্কার শুনতে পেতাম, কিছুতেই ঘুমাতে পারতামনা – দিনের পর দিন আমি ভয়ে, আতঙ্কে, না ঘুমিয়ে শুকিয়ে যেতে থাকলাম, ফ্যাকাসে হয়ে যেতে থাকলাম। যন্ত্রের মত কাজ করতাম – সারাদিন ভয়ে ভয়ে ঘরের এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসে থাকতাম, আমার যখন প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা – হঠাৎ একদিন রাত্তিরে বড়মা এলেন – আমার মাথা কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। বড়মা আমার বাবার প্রথম বৌ, তাঁকে আমি কোনদিন দেখিনি, কেবল বাবার মুখে তাঁর বিষয়ে অনেক অনেক গল্প শুনেছি। আমি জন্মাবার অনেক আগে ছোট ছোট চারটে বাচ্চা রেখে তিনি মারা গেলে বাবা বাধ্য হয়ে আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন। আমি নাকি হুবহু তাঁর মত দেখতে, তাঁর মত স্বভাব। সেই বড়মা আমায় রক্ষা করতেন, আগলে আগলে রাখতেন। কিন্তু তিনি কেবল মাঝে মাঝে গভীর রাত্তিরে আমি খুব যেদিন ভয় পেতাম সেইদিন আসতেন বাকিদিন আমি একা একা সেই অদ্ভুত আত্মাদের নজরে, অত্যাচারে ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হতাম। এর মধ্যে একদিন যিনি আমাকে কাজে দিয়েছিলেন আমার খোঁজ নিতে এলে আমি তাঁকে প্রায় হাতে পায়ে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে বললাম। সে তো অবাক – তোর কি মাথা খারাপ, এত ভাল বাড়ি কোথায় পাবি? বাড়িতে সারাদিন মালিক থাকেনা, খিটমিট করেনা, নিজের ইচ্ছা মত থাক বাড়ি যাবি কেন? আমি তাকে কি করে বোঝাই যে একা এই বাড়িতে সারাদিন আমার ওপর দিয়ে কী না অত্যাচারই চলছে বড়মা না থাকলে আমি এতদিনে পাগল হয়ে যেতাম। হঠাৎ আমার চেহারা দেখে তার কী যেন মনে হল। আমি তখন ভয়ে ভয়ে থেকে ফ্যাকাসে হয়ে গেছি, কেমন করে কথা বলছি – কী রে আলপনা তোর শরীর খারাপ নাকি? তার হয়ত ভয়ে হয়েছিল, মেয়েটা যদি মরে যায়, বাড়ির লোক তো আস্ত রাখবেনা। সে অবশ্য সেই চম্পাহাটিতে বসিয়ে রাখা লোকটার মত আমাকে শেয়ালদার বাসে তুলে দিয়ে পালিয়ে যায়নি। ক্যানিং লোকালে তুলে দিয়ে এসেছিল। আমার ওপর তখন আত্মাদের ভড়, অন্যদিকে বড়মা আমার হাত ধরে আছেন, গায়ে একশো জ্বর, চেহারা রক্ত সব শুষে নেওয়া ফ্যাকাসে। ঘোরের মধ্যে কী করে একলা ক্যানিং পৌছালাম, ক্যানিং থেকে চুনাখালি হয়ে বাড়ি পৌছালাম নিজেই জানিনা হয়ত সমস্ত রাস্তা বড়মা আমাকে আগলে রেখেছিলেন। সেই অদ্ভুত ভয় থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক হতে আমার প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল। আমাদের গ্রামের ওঝা আমাকে নাকি রোজ ঝাড়তে আসতেন। রোজ সকালে আমাকে নিমপাতার রস খাওয়ানো হত। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিলাম বলে কুলেখাড়া পাতার রস খাওয়ানো হত আর আমি রোজ বমি করতাম। একটা দশ বছরে বাচ্চা যার তখন খেলার বয়স, স্কুলে যাওয়ার বয়স তাকে যদি একলা একটা বাড়িতে দিনের পর দিন বন্দী করে রাখা হয় – তার কী হতে পারে সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে – কেবল বড়মা ছিলেন বলে আমি পাগল হয়ে যাইনি। এই দুই বড়মা আমাকে রক্ষা করেছে – কিন্তু আমি আমার এক বড়মাকেও রক্ষা করতে পারিনি – গল গল করে রক্ত পড়ছিল বড়মার চোখ বেয়ে।