কালোয়ার পট্টির শুরুতেই সরু গলির মধ্যে জয়সোয়ালদের বিরাট বাড়ি । চারতলা বাড়িতে অনেক ঘর । ১৩ -১৪ জন ভাই ,কাকা ,জ্যাঠা ইত্যাদি দের ফ্যামিলি । কিন্তু প্রায় সকলেরই ব্যবসা ,কারখানা ,সংসার আলাদা । আমার যে পরিবারে জয়েনিং হল তিনি খুব একটা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন না ,ছোটই বলতে হবে । ভাগে মাত্র দুটো ঘর আর একটা রান্না ঘর । মালিকের এক ছেলে প্রায় ২২-২৩ বছর বয়েস বিজয় দাদা , আর দুটো মেয়ে । ছোট মেয়ে নাকি জয়সোয়াল পরিবারের মুখে কালি দিয়ে কোন এক ছোট জাতের প্রোফেসরের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করে সল্টলেকের দিকে থাকে - তার নাম কেউ নিতনা । আমার ঠিকানা হল রান্না ঘরে , মেঝেতে চটের বস্তা ,তার ওপর পুরানো ক্যাথা দিয়ে একটা বিছানা । তাতে অসুবিধা ছিলোনা ,গ্রামে আমাদের মাটির বাড়িতে কোন খাটে ঘুমাতাম ? কিন্তু জীবনে প্রথম মা ,বোন , ছোট ভাই কে ছেড়ে একা একা ,এক অচেনা শহরে অচেনা পরিবারে আলো নিভতেই গ্রামের কথা ,আমার শান্ত মায়ের কথা ,আমাদের গরু গুলোর কথা মনে পড়তে লাগলো । আমার ছোট বোন আমাকে না দেখতে পেয়ে কী করছে ? ছোট অবুঝ ভাইয়ের কথা মনে পড়তে লাগলো । এই প্রথম আমার ডুকরে ডুকরে কান্না করতে ইচ্ছা করল । এতক্ষণে ছাত্রবন্ধু না পাওয়ার রাগে ,দুঃখে ,প্রতিবাদে বাড়ি ছেড়ে চলে আসা আমি আলপনা , আমার কেমন অসহায় লাগতে লাগল । কেমন যেন একটা বুক কাঁপানো ভয় চেপে বসতে থাকল । মাকে জড়িয়ে ধরতে মন করল । একা একা কেঁদেই চললাম । খুব খুব কষ্ট হতে থাকল ।
কালোয়ার পট্টির জয়সোয়াল পরিবারের এক শরিকের ছোট রান্নাঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি ছোট্ট আলপনা কখনো আমার গ্রামের স্কুলে দইওয়ালা নাটকের আমার পার্ট ,কখনো মাঠে গরু চরানোর স্মৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে থাকলাম আর যত গ্রামের কথা মনে পড়তে থাকলো তত বেশি বেশি করে কান্না চেপে বসল । আমার মা’ও কেঁদেছিল । খাল বিল নদী মাঠে ঘাটে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমাকে না পেয়ে সেও ভাত জল না খেয়ে ছিলো । আমি জীবনে কখনো অন্যের সামনে কাঁদিনি । অনেক অপমান ,দুঃখে ,অভাবেও নয় । চড় খেয়েও নয় । বাথরুমে ,একলা ঘরে ,পার্কে বসে কেঁদেছি ।সকলে কেন জানবে আমার দুর্বলতার কথা ? কিন্তু কেবল একজন কি করে যেন জানতে পারে আমি কান্না করছি কিনা ।
জয়সোয়ালদের পরিবারে আমার খুব একটা কঠিন কাজ ছিলোনা ,অন্তত আমার সেইরকম কিছু একটা মনে হতোনা । এঁটো বাসুন মাজা , তরকারী কাটা , চা বানানো ,টুকিটাকি ফাই ফরমাস একটু আধটু পা টিপে দেওয়া ,ঝাড়ু দেওয়া ঘর মোছা ইত্যাদি । রান্না মালকিন নিজেই করতেন । হয়ত ছোট জাতের হাতে খাবেন না বা আমি ওনাদের পশ্চিমা রান্না করতে পারবনা এইরকম কিছু একটা ভাবনা থেকে আমাকে রান্না করতে হতনা। ৬ বছর বয়েস থেকে এর থেকে তিনগুণ কাজ করা আমার অভ্যেস । কেবল আমার নয় আমাদের গ্রামের আমার বয়সের প্রায় সমস্ত নমঃশূদ্র পরিবারের মেয়েদের কাছে এই কাজ জলভাত ।
আমাদের দেশে খাল বিল পুকুর নদীর বিভিন্ন ধরনের মাছ ,কচুর লতি ,অল্প কিছু ধান ,জঙ্গলের মধুর অভাব না থাকলেও টাকার বড় অভাব । এদিকে টাকা ছাড়া কাপড় জামা , তেল সাবান ,ওষুধ ডাক্তার ,গাড়ি ভাড়া কিছুই হবার উপায় নেই আর তাই আমাদের দাদা ভাই বাবা কাকা’রা জন মজুর খাটতে অন্য দেশে যেতে বাধ্য হয় আর মায়েরা হয় লোকের জমিতে জন মজুরি খাটে আর নয় কোলকাতায় বাবুদের বাড়িতে খাওয়া পড়া কাজের লোক । মন খেলার দিকে থাকলেও মা জন মজুর খাটতে গেলে বাধ্য হয়ে আমরা ছোট ভাই বোনের দেখা শুনা ,অল্প বিস্তর রান্না করা ,গোবর ছড়া দেওয়া ,গোয়াল থেকে গরু ছাগল বের করা , পুকুর পারে বাসুন মাজা এমনিই শিখে যাই । আর বড় মেয়ে হলে তো কথাই নেই । জয়সোয়াল বাড়ির চারটে মানুষের কাজ আমার কাছে তাই খুব একটা শক্ত বলে মনে হতোনা । দু তিন পরে দেখলাম বাড়ি ভর্তি বিভিন্ন বয়েসের সব সময়ের কাজের লোক আর প্রায় সকলেই আমাদের নদীর ওপারের লোক । এই বাড়ির ওপরের তলায় আমার নিজের ছোড়দিও( বাবার অপর পক্ষের ) মাস খানেক আগে কাজে এসেছিল । খেলার সাথী জুটে গেল । দুপুরের দিকে কাজ সেরে খেলতে চলে যেতাম । কিন্তু ধীরে ধীরে দেখলাম দুপুরের খাওয়ার সময় পিছিয়ে যাচ্ছে । সেই সকালে মাত্র দুটো বাসি রুটি আর এক কাপ চা খাওয়ার পরে কাজ কর্ম সারতে সারতে বেলা ১২ টা বেজে যেত । খিদেয় পেট জ্বলে গেলেও খাওয়ার নাম নেই । সকলের খাওয়া হয়ে গেলে বাসুন মেজে ভাত খেতে খেতে বেলা ৩টে । জানেন অভ্যেস হয়ে গেল । প্রথম প্রথম চায়ে ভেজানো বাসি রুটি গলা দিয়ে নামতনা -গরীব হলেও ,একবেলা হলেও গ্রামে ভাত অন্তত পেতাম ,পান্তাই সই ভাত তো । রুটি জীবনে খাইনি । মন খারাপ হলেও বাধ্য হয়ে খেতাম । জয়সোয়াল'রা বাড়িতে নিরামিষ খেতেন আর আমি বাদাবনের মেয়ে , মাছ ,গুগলি ,কাঁকড়া ,চিংড়ির দেশের মেয়ে কী যে কষ্ট হোত । বিভিন্ন লোকের থেকে খবর জোগাড় করে বাবা প্রায় একমাস পরে আমার সাথে দেখা করতে এসে যখন জিজ্ঞাসা করলেন কোন কষ্ট নেইতো আলপনা ,বাড়ি যাবি ?
আমি বাবাকে মিথ্যা বলেছিলাম । কষ্ট ছিল ।খাওয়ার খুব কষ্ট ছিল কিন্তু কষ্টের কথা বললে যদি বাড়ি নিয়ে যায় আমি ছাত্র বন্ধু কিনবো কীভাবে ? আমার তো একশো টাকা মাস মাইনে ।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কিছুদিন ধরে আমি আমার নীল শিরা ওঠা শুকনো হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অবাক হচ্ছি ,কেন যেন মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ভাঙাচোরা বাড়িটার কথা । অনেক কাল আগে বাবা আমাকে একটা ভাঙ্গা বাড়ি দেখিয়ে বলেছিল এটা নীল কুঠি ছিল । আমি নীলকুঠি কী জানিনা , দেখেছিলাম ভেঙ্গে পড়া সেই বাড়িতে তখন ঘুঘু ডাকে । ইঁটের ভেতরে সাপ থাকে । চারিদিকে লতার বাঁধন । জঙ্গল গিলে নিয়েছে প্রায় সমস্তটাই । নীলকর সাহেবদের বাড়ি শেয়াল ,ভাম ,সাপেদের বাসা হয়ে গেছে । আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ কী একটা কারণে একবার আমার হাত ছুঁয়ে চমকে উঠেছিলেন -আলপনা একি এত খসখসে কেন ? কোন ক্রিম ট্রিম মাখোনা ? আমি কেবল হেসেছিলাম … প্রায় ১৬ বছর ধরে নিরমা ,সার্ফ ,ভীম বার থেকে যত রকমের সোডা সাবান দিয়ে বাসুন মেজে ,কাপড় কেচে হাত যে এখনো আছে সেই যথেষ্ট । রোদ বৃষ্টি জলে এই কাজের বাড়ি থেকে ওই কাজের বাড়ি ফুল দমে সাইকেল চালিয়ে বৌদি'দের সময়ে চা লুচি পরোটা সাপ্লাইয়ের তাড়ায় হাতের ওপরের অংশ চিতার কাঠের মত কালো ,ঝলসে যাওয়া । একটা বাড়িতে আমি যদি দু দশ মিনিট দেরি করতাম ওনারা চা না খেয়ে বসে থাকতেন তো কত কথা । হাতের তালুর রঙ ওপরের অংশের থেকে আলাদা ।জানেন আমার হাত বেশ পশমের মত নরম নরম ছিল। কিন্তু গনগনে উনুন ,গ্যাসের সামনে দু হাতে বাবুদের জন্য মাছ ,মাংস ,মিক্স ভেজিটেবল বানাতে বানাতে তারা কোথায় কবে মিলিয়ে গেছে কে জানে -জেগে আছে কেবল মোটা মোটা নীল সব শিরা ।
২৯ সে নভেম্বর ২০১৬ আমার জীবনের খুব মনে রাখার মত দিন । প্রায় ১৬ -১৭ বছর পর ওই দিন ,মাত্র এক মাস হল আমি বাবুদের বাড়ির বাসুন মাজা ,রান্না করা ,কাপড় কাচা ঠিকে ঝি এর কাজ ছেড়ে দিয়েছি । একজন আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন ,পথ দেখিয়েছেন ,সাহস যুগিয়েছেন ,নতুন কিছু করবার জন্য ট্রেনিং দিয়েছেন । আর দেখুন ছোট বেলায় দেখা সেই ভাঙ্গা বাড়িটা , নীল কুঠি , জংগল যেমন ঢেকে দিয়েছিল ঠিক একই রকমভাবে আমার হাতের নীল শিরাগুলো পশমে ঢেকে যাচ্ছে। আমার হাত আবার আগের মত নরম হয়ে যাচ্ছে।
এসব স্বত্বেও আমাদের নীল শিরা ওঠা শুকনো হাতও কেউ কেউ ধরে ,আবার ছেড়েও দেয় । কিন্তু আমার এই নীল শিরা ওঠা হাতের এই ফিরে আসা কোমলতা কি কেবল আয়নায় দেখা সূর্যের মত এক ঝলকের আলো ? আমাকে কি আবার ফিরে যেতে হবে বাসুন মাজার জগতে ? আমাদের জীবনে সুখ তো কেবল আশা - কিন্তু তারই মাঝে জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া ভাঙ্গা বাড়ি ,নীলকুঠি ভরসা জাগায় ।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
সুন্দরবন থেকে পালিয়ে কলকাতায় আসার পরে আমি যখন জয়সোয়াল পরিবারে কাজে ঢুকলাম পরিবারের একমাত্র ছেলে বিজয় দাদা তখন প্রায় ২২-২৩ বছর বয়েসের হবে । অশিক্ষিত, গ্রাম থেকে আসা ছোট কাজের মেয়ে কে প্রথম দিকে খুব একটা নজর না করলেও বয়েসের ধর্মে ,সরলতায় ধীরে ধীরে আমাকে মানুষ করবার দায়িত্ব নিয়ে নিলেন । টিকিয়া পাড়ার কালোয়ার পট্টির প্রায় সমস্ত মানুষ হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন ,আর জয়সোয়াল পরিবারের ভাষাই তো হিন্দি আর আমি সুন্দরবনের মেয়ে এক অক্ষর হিন্দি বুঝিনা । সে যে কী ভয়ানক অবস্থা । বিজয় দাদা আমাকে হিন্দি শেখানোর চেষ্টা শুরু করলেন -পানি কা মতলব -জল ,ইধার আও -এদিকে এসো ,আসমান কা মতলব -আকাশ , এই ভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছোট ছোট কাজের শব্দ সেই ছোট্ট বয়েসে ফাঁকা মাথায় চটপট শিখে গেলাম । হিন্দি বোঝা এবং বলা আমাকে শেখাতে লাগলেন কল্পনা দিদি । উনিও আমাদের দেশের লোক , বহুবছর ধরে উনি জয়সোয়ালদের বাড়িতে অন্য শরিকের ঘরে কাজ করেন । হিন্দি আমার সড়গড় হতে শুরু করল যদিও লিখতে বা পড়তে খুব একটা শিখলাম না ।
আমি কাজে ঢোকার প্রায় সাত আট মাস পরে ‘ কহোনা প্যার হ্যায় ‘ বইটা বেরোল ,চারিদিকে তখন খুব আলোচনা । সন্ধে বেলায় মেঝেতে বসে কিছুক্ষণ টিভি দেখবার অনুমতি ছিল । আমি সুন্দরবনের মেয়ে ,আজও আমাদের গ্রামে কারেন্ট পৌঁছায়নি (কিন্তু টিভি পৌঁছেছে ) তখন টিভি তো দূরের কথা -প্রথম প্রথম অবাক হয়ে দেখতাম আর ছোট মাথায় এর পিছনে কী আছে বোঝার খুব চেষ্টা করতাম ।
টিভি যাতে বেশি দেখতে না পারি এই বিষয়ে মালকিনের নজর ছিল অবাক করার মত ,পাঁচ মিনিট দেখতে না দেখতেই রান্না ঘরে অকারণে ডাক পড়ত আর আমার মেজাজ গরম হয়ে যেত , পরে রাগ করে টিভি দেখাই ছেড়ে দিলাম । তবে বিজয় দাদা ‘ কহোনা প্যার হ্যায় ‘ দেখিয়েছিল । বাড়িতে ভিডিও প্লেয়ার এলো , মেঝেতে শতরঞ্চি বিছানো হল আর কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাজিক । এই লোকটা মানুষ ? এই রকম রবারের মত শরীর ব্যাঁকায় কীভাবে । আমি প্রায় পাগলের মত গিলতে থাকলাম । আমি তখন হিন্দির সাথে সড়গড় কিন্তু গল্পে কোন আগ্রহ নেই যত আগ্রহ ওই পাগলের মত শরীর দোলানোতে । সিনেমা শেষ হল । ফিরে গেলাম রান্না ঘরের কোনে আমার বিছানায় ,কিন্তু ঋত্বিক রোশন আমার মাথায় কেমন যেন ঝড় তুলতে থাকলো । একা একা অন্ধকার রান্না ঘরে শুরু হল ঋত্বিক রোশনকে নকল করার চেষ্টা । নেশা ধরে গেল বলতে পারেন । সময় অসময়ে নেচে নিতাম -একদিন হঠাৎ বিজয় দাদা আমার নাচ দেখে হেসেই কুটোপাটি । আমি তো লজ্জায় লাল । পরের দিন বিজয় দাদা কেবল আমার জন্য আবার ভিডিও প্লেয়ার ভাড়া করে আনলেন । চুক্তি হল আমাকে ঋত্বিক রোশনের মত নেচে দেখাতে হবে । আমি রাজী । চ্যালেঞ্জ আমার প্রথম পছন্দ ।
একটা খাওয়া পড়া কাজের মেয়ের জন্য এই বাড়াবাড়ি সকলের পছন্দ না হলেও পরিবারের একমাত্র ছেলের বিরোধিতা কেউ করলেন না । আমি সেই থেকে বহুবার ‘ কহোনা প্যার হ্যায় ‘দেখেছি, আমাকে যদি কেউ সিনেমার গল্প বলতে বলেন আমি সিকি ভাগ বলতে পারবো কিনা সন্দেহ কিন্তু এখনো এত বছর পরেও নাচের প্রতিটি ছন্দ আমার মুখস্ত । আমাকে কেন যে বিজয় দাদা প্রশ্রয় দিয়েছিল আমি জানিনা । কিছু মানুষ এমন পাগল হয়ে থাকেন -নয়ত একটা কাজের মেয়েকে এই ভাবে আস্কারা কি কেউ দেয় ? একটা বাচ্চা মেয়ের আনন্দ দেখে উনি হয়ত খুশি হতেন । মানুষটা খুব ভালো ছিলেন ,মোটা মোটা বই পড়ে কীসব পরীক্ষা দিতেন একদিন শুনলাম উনি 'সি এ ' না কি যেন পরীক্ষায় এক সুযোগেই পাশ করেছেন । সকলের আনন্দ ,আমি কিছু না বুঝলেও আমারও আনন্দ । আমার বিজয় দাদা শক্ত পরীক্ষায় পাশ করেছে । বাড়িতে র্ মিষ্টি খাওয়া হোল । আমরাও খেলাম । এরই মধ্যে বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হল । ছোট মেয়ের কথা বলেছি আপনাদের ,কোন এক ভিন জাতের প্রোফেসর কে বিয়ে করে সল্ট লেকের দিকে থাকেন । এই বাড়িতে পা রাখা তো দূরের কথা নামও শুনিনি -তবে মালকিন চুপি চুপি দেখা করতেন ,আমিও অনেক পরে ওনার বাচ্চা হওয়ার সময় ওনাদের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য ট্রান্সফার হয়েছিলাম ।
যে দিদির বিয়ে ঠিক হোল তার বরের নাকি খুব বড় ব্যবসা । এত ভালো পাত্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । আমার মালিক কালোয়ার এবং জয়সোয়াল পরিবারের শরিক হলেও খুব একটা বড় ব্যবসাদার ছিলেন না । তার কত চিন্তা । অনুষ্ঠান ঠিক করে হবে কীভাবে । আমার কাজের চাপ বেড়ে গেল । প্রচুর মানুষের বাড়িতে আসা মানেই বেশি বার চা করা , এঁটো বাসুন মাজা ,ঘর পরিষ্কার রাখা । আমি অবাক হয়ে দেখতাম বিয়ে নিয়ে এত চিন্তার আছেটা কী ? আমাদের দেশে কি আর বিয়ে হয়না ? কার্ড ছাপানো ,গয়না পত্তর ,শাড়ি জামা সব কেনা হয়ে গেল -বাড়ি জমজমাট বিয়ের আর মাত্র সাত দিন বাকি । আমার দম ফেলার অবসর নেই । কাজ আর কাজ । এক দিন শুনলাম বিজয়দাদা দু তিন দিনের জন্য সব থেকে প্রিয় বন্ধুর বোনের বিয়েতে বোম্বে যাবেন । মালিক খুব রেগে গেলেন । মাত্র সাতদিন পরে নিজের বোনের বিয়ে , কত কাজ বাকি তোমার এখন বোম্বে যাওয়ার কী আছে ? শেষমেশ কি মনে হওয়ায় যাওয়ার পারমিশন দিলেন কিন্তু তিন দিন নয় দু দিনের জন্য । সময় বাঁচাতে ওনার প্লেনের টিকিট কাটা হোল ।
পরের দিন মাঝ রাত্তিরে মালকিনের কান্না’র শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো । ঘুম চোখে উঠে শুনলাম বিয়ে বাড়ি থেকে ফেরার সময় গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে -সবাই চোট পেয়ে হাসপাতালে -এক্ষুনি যেন গার্জিয়ান বম্বে পৌঁছান । বন্ধুরা সকলে বোম্বের কাছে কোন এক জায়গা থেকে নিজেরাই গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলেন । সাত জন ছিলেন গাড়িতে । একটা ট্রাকের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা লাগার পরে আর একটা ট্রাক নাকি পাস দিয়ে চেপে দিয়েছিল । তিন দিন পরে বিজয় দাদার শরীর বাড়ি ফিরলো । ট্রাক থেকে বেরিয়ে থাকা লোহার শিকের আঘাতে বিজয় দাদার শরীর চার টুকরো হয়ে গিয়েছিল তবুও বিজয় দাদা নাকি এক্সিডেন্টের পরেও চার ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন । বিয়ে বাড়ির আনন্দে পরিবারের একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর যেন একশো বাজ পড়ার মত ভয়ানক । মালিক শোকে পাথর হয়ে গেলেন । মালকিনের চোখের জল বাধা মানেনা । সেই প্রথম আমার মালকিনের জন্য দুঃখ হতে থাকল । আমি আমার বিজয় দাদার জন্য অন্ধকার রান্নাঘরে একা একা কেঁদে ভাসালাম । মনে পড়তে থাকলো আমার নাচ দেখে বিজয় দাদার হেঁসে কুটো পাটি হওয়ার কথা । যদিও আমি সামান্য কাজের লোক কিন্তু সেই আমি আমার প্রথম আশকারা দেওয়ার লোককে হারিয়ে একা একা কেঁদে ভাসালাম ।
জীবনে যেমন অনেক দুঃখ পেয়েছি , কষ্ট পেয়েছি কিন্তু কম হলেও আমি বেশ কিছু মানুষের সাহায্য , ভালোবাসাও পেয়েছি - বিজয় দাদা সেই হাতে গোনা মানুষের মধ্যে হয়ত প্রথম মানুষ ছিলেন তাই তার কথা এত বছর পরে লিখতে গিয়েও আমার চোখের কোণায় জল এল ?
জানেন ভালো মানুষেরা বেশিদিন বাঁচেন না ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।