আমরা প্রান্তিকতা নিয়ে কথা বলি, কিন্তু প্রান্তিকের কন্ঠস্বর তেমন শুনিনা। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে এই ধারাবাহিকটি প্রকাশ করতে পেরে গুরুচন্ডা৯ গর্বিত। সঙ্গে আশা এইটুকুই, যে, অদূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন এইসব লেখাকে আর ব্যতিক্রম বলে পরিচয় করিয়ে দিতে হবেনা।
আমি আলপনা,আলপনা মন্ডল, ইস্কুল কলেজে পড়ার দিক দিয়ে দেখতে গেলে অশিক্ষিত। দাদার সংসারে ক্লাস ফোর এ ছাত্রবন্ধু কিনে দেয়নি বলে অভিমানে লেখা পড়া ছেড়ে ৯বছর বয়েসে কলকাতা পালিয়েছিলাম।আর পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি , আমি আর কোনদিন ছাত্রবন্ধু কিনে উঠতে পারিনি। আমার কম্পিউটার নেই,চালাতেও পারিনা, আধুনিক ফোনও নেই (তবে জিও আছে) এমনকি আপনাদের এই সভায় আমার প্রথম পোস্ট টি লিখতেও কেউ আমাকে সাহায্য করছেন। তবে শিখে যাব,পারবই। গুরুচণ্ডা৯ নাম দেখে আগ্রহ জেগেছিল, কিন্তু গ্রুপে সবাই দেখলাম বামুন/কায়েত তবুও আমার মত চণ্ডাল -অশিক্ষিতা কে জায়গাবদল করবার আমার কথা বলবার সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ। আমাদের কথা কেউ মনেও রাখেনা। আমি এখনও নিজে কম্পিউটার চালাতে জানিনা, কম্পিউটারে কী করে টাইপ করতে হয় জানিনা। আধুনিক ফোন নেই তবে জিও আছে । আমি বলি,ব্যাঁকা ট্যারা করে রুল টানা কাগজে লিখি, কাটি, মুছি, কেউ আমাকে সাহায্য করেন,তিনি সাজান গোছান, আমাকে পড়ান, মতামত নেন তারপর পোস্ট করেন। এখনো আমি পুরোপুরি লেখিকা নই কিন্তু কথা আমার । আমার নিজের জীবনের ।
------------------------------
সেদিন ভীষণ বৃষ্টি ছিল,২৭শে আশ্বিন ১৯৮..সাল। সন্ধে বেলায় ঘন অন্ধকারে'র মধ্যে আমার জন্ম। আমাদের গ্রামে আজকেও কারেন্ট পৌছায়নি। গেল ভোটে কয়েকটা খুঁটি পোতা হয়েছে মাত্র। আমাদের জন্ম তাই কুপির আলোতে অন্ধকারেই হয়। জানেন আমার জন্য কোন ষষ্ঠী পুজো হয়নি।মুখেভাত হয়নি। গরিব হলেও, ছোট করে হলেও আমাদের চণ্ডাল সমাজে বাচ্চার এবং মায়ের মংগল কামনায় ষষ্ঠী পুজো হয়। কিন্তু আমার জন্মের আগে আমার মায়ের তিনটি সন্তান জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়।বড় জন যিনি বেচে থাকলে আমার বড়দাদা হতেন প্রায় ৮মাস বেঁচে ছিলেন, শুনেছি ডায়েরিয়া হয়েছিল।বাচ্চা এসেই চলে যায় এইরকম মেয়ের ষষ্ঠী পুজো কেবল পয়সা নষ্ট এই বোধ থেকে হয়ত হবে। কিন্তু জানেন আমি টিঁকে গেলাম। যম আমাকে বহুবার টানাটানি করেছে ছোট বেলায় কিন্তু আমার ভীষণ জেদ,চণ্ডালের রাগের কাছে হার মেনে ফিরে গেছে।
আমার পিঠে একটা কালো জড়ুল আছে,বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে,আর সেই জড়ুল আমার বেঁচে থাকার অন্যতম কারণ। আমাদের গ্রাম দেশে মানুষ বিশ্বাস করে ছোট বাচ্চা যদি জন্মের মুহূর্তে অথবা জন্মের কিছুদিনের মধ্যে মারা যায় সে আবার সেই মায়ের কোলেই ফিরে আসে। তা আমার আগের ভাই জন্মের তিন দিনের মধ্যেই মারা গেলে আমার বুড়ি ঠাকুমা মরা শরীর মাটি দেওয়ার আগে তার পিঠে গরম শিকের ছ্যাঁক দিয়েছিল,কান ফুটো করে দিয়েছিল কী জানি যদি ফিরে আসে চেনা যাবে। আর কী অদ্ভুত আমি কানে ফুটো আর পিঠে কালো দাগ নিয়েই জন্মেছি। আপনাদের হাসি পেলেও সেই কালো দাগ আর কানে ফুটো কিন্তু আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
আমি যখন যমের মুখে ছাই দিয়ে ছয় মাস টিঁকে গেলাম সকলের বিশ্বাস হয়ে গেল আমি সেই পিঠে লোহার শিকের ছ্যাঁকা দেওয়া মরা বাচ্চা ফিরে এসেছি। আমার তখন খুব যত্নআত্তি, আমার বাবারা ৬ভাই তাদের প্রত্যেকের তিন চারটে বাচ্চা,তাদের স্ত্রী আমার কাকি, জেঠি, ঠাকুমা সকলের চোখের মণি হয়ে গেলাম আমি আলপনা। কু সংস্কার অনেক ক্ষতি করে দেখেছি কিন্তু আমার ক্ষেত্রে গেরামের কু সংস্কার আমাকে যমের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।সকলে যত্ন করেছে আমি ছোট বেলায় অসম্ভব ভালোবাসা পেয়েছি-যদিও সেটা বেশিদিনের জন্য ছিলনা কিন্তু তবুও নমঃশূদ্রের ঘরের মেয়ে হিসাবে অনেক অনেক বেশি।
আপনারা যদি সাইন্স সিটির কাছে মমতার উড়ালপুলে উঠে পুব দিকে মুখ করে ডান হাত বরাবর একটু তেরছা করে একটা সোজা লাইন টানেন,আর সেই সোজা লাইন যদি বাংলাদেশ বর্ডারের একটু আগে নদীর এ পারে থামিয়ে দেন আমার দেশের বাড়ি পৌঁছে যাবেন।গেরামের নাম ছোট মোল্লাখালি,জেলা দক্ষিণ ২৪পরগনা,কোস্টাল থানা। আমরা বলি কোস্টা থানা।আমি যদি পাখি হতাম খুব বেশি হলে ৪০কিলোমিটারের উড়ান।ঘণ্টা খানেকের পথ। কিন্তু আজকেও গেরামে পৌঁছাতে সময় লাগে পাক্কা সাড়ে চার ঘন্টা।
আমাদের গেরামে যাওয়ার দুটি রাস্তা একটা নিচের পথ একটা ওপরের। নিচের পথ ধরে যেতে গেলে বাসন্তী হাইওয়ে ধরে প্রথমে চুনাখালি পৌঁছাতে হবে তার পরে ভটভটি। আড়াই ঘন্টা ধরে ডিজেল ইঞ্জিনের ভট ভট শুনতে শুনতে নদীপথে চুপচাপ বসে থেকে আপনি যখন খুব বিরক্ত ঠিক তখন আমাদের গেরামের ঘাট দেখা যাবে।ঘাটে নেমে ভ্যান ধরে বাড়ি পৌঁছাতে আরও আধা ঘন্টা। আমি পারতপক্ষে এই পথে যাইনা। ভটভটির শব্দে মোবাইলের গান শোনা দূরে থাক গেরামের মানুষের সাথে কথা বলাও চাপ।
আমি যাই ওপরের পথে,ট্রেনে ক্যানিং,ক্যানিং থেকে ম্যাজিক গাড়ি ধরে বাসন্তী,বাসন্তী থেকে তিন বার নদী পার করে,হাতে চটি নিয়ে কাদায় হেঁটে,মোটর ভ্যানধরে সাতজেলিয়া পার করে গ্রামে পৌঁছানো। রাস্তা ঝক্কির হলেও নদী পথের ছোলো জীবন নেই,ভটভটির একঘেয়ে বিরক্তকরা শব্দ নেই।দরকারে বাসন্তী থেকে টুক করে কিছু চটপটা কিনে নিলাম।আসলে জীবনে ওই,আপনারা যাকে সেটল হওয়া বলেন -অসহ্য।
আমাদের গ্রামে তো পৌঁছালেন কিন্তু বাড়ি চিনবেন কী করে? বলবেন বড় মাতব্বরের বাড়ি যাব।আমার বাবা প্রায় বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মাতব্বর ছিলেন। খুব নাম ডাক। মাতব্বর অর্থে জন মজুরের সর্দার। আপনাদের দুর্গা,কালি পুজোয় এইযে সব মস্ত মস্ত ঠাকুর কুমারটুলি’র পাতলা গলি থেকে বিভিন্ন প্যান্ডেলে ্ঠিকঠাক অবস্থায় পৌঁছানো, তার বিসর্জন এই সমস্ত কাজ যে সমস্ত নাম না জানা চোয়াল বসে যাওয়া জন মজুর’রা অদ্ভুত ভালোভাবে করে থাকে তাদের সব্বাই আমাদের নদীর এপারের লোক। আমার বাবা এইরকম একদলের সর্দার ছিলেন। বাবা ৪০জনের দল নিয়ে ডাকাতের মত চটপট বিঘার পর বিঘার ধান কেটে,ঝাড়াই করে,একেবারে বাবুদের গোলায় তুলে দিয়ে আসতেন।মাতব্বরের খুব দায়িত্ব-গ্রামের লোকেদের দূরের দেশে কাজে নিয়ে গিয়ে সুস্থ আর খুশি করে দেশে ফিরিয়ে না আনতে পারলে ভারি বদনাম আর ফিরিয়ে আনতে পারলে কেবল সুনাম। বাবা মাতব্বরি ছেড়ে দিয়েছেন বছর দশেক হোল কিন্তু এখনো তিরিশ মাইল দূরে আপনেরা যদি কাউকে বলেন বড় মাতব্বরের বাড়ি যাব আপনি নিশ্চিন্তে পৌঁছে যাবেন। খুব সুনাম।
মাতব্বরের সমান ভাগ, সমান অর্থ, বাবুরা চুক্তি অনুযায়ী পয়সা না দিলে গ্যাঁট গরছা কিন্তু অসম্ভব পরিশ্রম। বাবুদের সাথে যোগাযোগ রাখা,কুমারটুলি’র গদি মালিকের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা। দর দাম করা। সময়ে বিঘার পর বিঘার ধান কেটে ঝাড়াই বাছাই করে গোলায় তুলে দেওয়া। বিশাল ঝক্কি। কিন্তু ওই -চ্যালেঞ্জ, চুপচাপ বসে না যাওয়ার আনন্দ। তখন বাবার ওপর ভীষণ রাগ হত এখন গর্ব হয়। আমার বাবা কখনো বনগাঁ, কখনো জয়নগর,নদীয়া,হুগলি দাপিয়ে বিঘার পর বিঘা ভোর রাত থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ধান কেটে হাসিমুখে অল্প বিস্তর টাকা কিন্তু জেতার হাসি নিয়ে বছরের পর বছর বাড়ি ফিরেছেন। আমরা অবাক হয়ে বাবার মুখে নানা দেশের গল্প শুনেছি।
এখন যখন শুনি বাবুরা কী সব প্রোজেক্ট করতে বিদেশ যান, অনেক টাকা পান আমি অবাক হই, কিন্তু আমার বাবাতো এই রকম কত কত প্রোজেক্ট আমার জন্মের আগের থেকে বছরের পর বছর ধরে একবারও ফেল না খেয়ে করে এসেছেন কিন্তু টাকা তো পাননি।
বিঘার পর বিঘা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ধান কাটা,প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সময়ে ঠাকুর একটুও চোট না খাইয়ে পৌঁছে দেওয়া প্রোজেক্ট নয় বুঝি?
আমি আলপনা, সেই বড় মাতব্বরের সুনামে কালি লেপে, মাতব্বরের মেয়ে ওপরের রাস্তায় বাড়ি থেকে পালালাম ৯ বছর বয়েসে। কী করতাম বলুন?আমি তৃতীয় শ্রেণীতে সেকেন্ড হয়েছিলাম, মাস্টার বলেছিল চতুর্থ শ্রেণীতে অবশ্যই ‘ছাত্রবন্ধু' নিয়ে আসবে।বাবা সেই সময়ে ভিনদেশে ধান কাটতে গেছে। বড়দা'র জিম্মায় সংসার। বড়দা মানে বাবার আগেরপক্ষের ছেলে। ছাত্রবন্ধু কিনেই দেয়না,আমারও স্কুলে যাওয়া হয়না। একদিন শুনলাম পয়সার অভাব,ছাত্রবন্ধু কিনে দিলে বোনের স্কুলের ফি দেওয়া যাবেনা।একা একা খুব কাঁদলাম। পরে ভাবলাম বোনের পড়া হবেনা,এত অভাব, ছাত্রবন্ধু কেনারও পয়সা নেই। স্থির করলাম আমি নিজেই উপার্জন করব। নিজের ছাত্রবন্ধু নিজেই কিনব।।মেজ পিসির সাথে চক্রান্ত করে বাড়ি থেকে পালালাম।মেজ পিসি সেই সময়ে কলকাতায় বাবুদের বাড়ির কাজ থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছিল।ফেরার পথে মাত্র দুটো জামা নিয়ে আমি সাথ ধরলাম।
আমি আর ছাত্রবন্ধু কিনে উঠতে পারিনি।ছাত্রবন্ধু আজও আমার নেই।
ছোট মোল্লাখালি'র ঘাট, আমার গ্রাম আস্তে আস্তে ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যেতে থাকলো।নৌকায় নদীর ঢেউ লাগার শব্দ,বৈঠার আওয়াজ কেবল।আশেপাশে সবাই কেমন যেন চুপচাপ।সবাই কি আমার মত গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি দিচ্ছে?
ছোট পিসি বলেছিল স্কুলের ব্যাগের মধ্যে জামা কাপড় নিয়ে মোল্লাখালি বাজারের কাছে অপেক্ষা করতে।আমার বাবারা ৬ভাই,তাদের ছেলে,মেয়ে,নাতি পুতি মিলিয়ে গ্রামে আমার ২৮জনা ভাই।।কেউ যদি এই পথে আসে আর গল্প শুরু করে এই আলপনা স্কুলের ব্যাগ নিয়ে বাজারে'র ধারে কী করছিস?আমার তাহলে তো আর কলকাতা যাওয়া হয়ে উঠবেনা-এই টেনশন ঘাম ছুটিয়ে ছাড়লো।পিসি আর আসেনা। টেনশন যখন রাগে হওয়ার মুখে তখন পিসি এলেন।আমরা খেয়ায় গিয়ে উঠলাম।
তখনো ক্যানিং নদীর ওপর সেতু হয়নি,আমাদের গ্রাম থেকে কলকাতা আসার পথ ছিল চুনাখালি হয়ে। চুনাখালি থেকে ট্রেকারে ক্যানিং ঘাট,সেখান থেকে নদী পার হয়ে ক্যানিং,ক্যানিং থেকে ট্রেনে কলকাতা। চুনাখালি এখনো গঞ্জ তখ্ন আরও গঞ্জ ছিল,আমাদের ছোট মোল্লাখালি থেকে খুব একটা আলাদা নয়। কিন্তু চুনাখালি তে আমি প্রথম মোটর গাড়ি -ট্রেকার দেখলাম।বাবা কাকার মুখে মোটরে গাড়ি চলে শুনেছিলাম কিন্তু চোখে দেখা সেই প্রথমবার।সেই আমার অবাক হওয়ার শুরু। ক্যানিং নদী পার হওয়ার সময়ে দূর থেকে ক্যানিং ঘাট লাগোয়া পাকা,ছাদ দেওয়া একতলা দুইতলা বাড়ি দেখে আবার অবাক হলাম,এই রকম বাড়ী হয়? কী ভাবে বানায়? কত প্রশ্ন, কিন্তু কে আর অবাক হয়ে যাওয়া বাচ্চার প্রশ্নের জবাব দেয়। আমার অবাক হওয়ার পালা ক্যানিং স্টেশানে যখন প্রথম ট্রেন দেখলাম।এত বড় গাড়ি ঘুরবে কী করে? কোথায় চালক?হু হু করে ফাঁকা মাঠ পিছনে ফেলে ট্রেন কলকাতার দিকে আর আমি অবাক আলপনা ভুলে যেতে থাকলাম গ্রামের কথা।
শেষ অব্দি সোনারপুর এল,ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে,খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে পেট। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়তে থাকলো।আমার শান্ত মা এতক্ষনে মাঠ থেকে জন মজুরি খেটে বাড়ি ফিরে এসে আমাকে না দেখতে পেয়ে কী করছে? একটা অপরাধ বোধ মতন হতে থাকলো আমার ছোট্ট মনে। সেই রাত্তিরে আমরা সোনারপুরে এক দাদার বাড়িতে থাকলাম।পাকা ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেয় চাদর পেতে দেওয়া মাত্র আমি সারাদিনের ওঠাবসার ধকলে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমাদের কাকভোরে ওঠা অভ্যেস।গোয়াল থেকে গরু বার করা,গোবর ছড়া দেওয়া,বাড়ির বড় মেয়ে হিসাবে আমি সেই কবে থেকে করে আসছি।সেই অভ্যেস আমার আজও আছে ।আমরা সোনারপুর থেকে কলকাতার প্রথম বাস ধরলাম।কত চওড়া পিচ বাধানো রাস্তা,কত লম্বা লম্বা বাড়ি, কত আলো, আমি এক অজ গেরামের বাচ্চা অবাক হতে হতে হাওড়ার দিকে -জীবনের অচেনা রাস্তায় হাঁটতে থাকলাম। নিজের অবাক করা সব প্রশ্ন নিজেই মনে মনে জবাব দিতে দিতে হাওড়া ব্রিজে উঠতেই ভয়ে লাগল -ভেঙে পড়ে যাবেনাতো?হাওড়া ময়দান থেকে টিকিয়া পাড়া ফাড়ির কাছে একটা ছোট মন্দিরের পাশের গলিতে জোয়সোয়াল নিবাস'র নিচের তলায় এক ভাইয়ের পরিবারে আমি সব সময়ের কাজের লোক হিসাবে খাওয়া পড়া একশো টাকা মাইনায় ভর্তি হলাম।
আমি বড় মাতব্বরের বড় মেয়ে আলপনা -কলকাতায় ছাত্র বন্ধু কেনার আশায় একশো টাকা মাইনার কাজের লোক হয়ে গেলাম।
(নিচের ছবিটি কলকাতায় আসার ৭মাস পরে কেউ তুলেছিল রান্না ঘরে বাসুন মাজা অবস্থায়)
তারিখ ,সাল কিছুই এখন আর মনে নেই ঠিক কবে কলকাতায় জয়সোয়াল পরিবারে এসে উঠেছিলাম ,তবে মোটামুটি আজ থেকে ১৭ -১৮ বছর আগে । মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আমি আলপনা , ছোট মোল্লাখালির মাঠে ,ঘাটে আদিবাসী পাড়ায় গোরু চরাতে চরাতে টুসু নাচ শিখে নেওয়া ছোট্ট ্মেয়ে ছাত্রবন্ধু কিনবো বলে হঠাৎ আপনাদের কোলকাতায় কাজের মেয়ে হয়ে গেলাম । আমার আর ছাত্রবন্ধু কিনে বাড়ি ফেরা হলনা।
টিকিয়া পাড়া ফাঁড়ি পেছনে রেখে পুব দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডান হাতে মুসলমান পট্টি । কাঁচা ড্রেন ,গলির পর গলি ,গায়ে গায়ে সব পাকা বাড়ি। দমবন্ধ হয়ে যায়। তারই মধ্যে ছোট ছোট কারখানা , লেদ মেশিন আরও কী কী সব মেশিন । আর ফাঁড়ির বাঁ হাতের এলাকা কালোয়ার পট্টি । লোহা’র বড় বড় পাত ,পাইপ ,সারাদিন ঠেলা , ছোট গাড়ীর ঘন ঘন যাওয়াআসা আর রাত্তিরে বড় বড় লরির ঘর্ঘর আওয়াজে ঘুমাতে পারিনা । কালোয়ার পট্টি আর মুসলমান এলাকার মধ্যে সীমানা বলতে একটা ছোট্ট মন্দির আর মন্দিরের গায়েই নোংরা ফেলার বিশাল ভ্যাট । প্রায় ১৬-১৭ বছর পরে আমার প্রথম কাজের বাড়ি জয়সোয়াল পরিবারের লোকেদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম এই কয়েকদিন আগে । আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ গাড়ি করে নিজের সময় খরচ করে নিয়ে গিয়েছিলেন । দেখলাম কালোয়ার পট্টি সেই ছোট মন্দির আর নোংরা ফেলার ভ্যাট সমেত একই রকম আছে ।
আসলে আপনারা আপনাদের বাড়ির কাজের লোকেদের মনে না রাখলেও আমরা কিন্তু আপনাদের মনে রাখি । ব্রেকফাস্টে চায়ের সাথে বাসি রুটি খেতে দিলেও মনে রাখি । বেলা চারটেয় কেবল ডাল ভাত আর একটা তরকারি দিলেও মনে রাকি । মাত্র ৯ বছর বয়েসে লুচি ভাজতে না পারার অপরাধে গায়ে গরম তেল ছিটিয়ে দিলেও মনে রাখি । শীতের রাত্তিরে ছাদের ঘরে একলা বন্ধ করে রাখলেও মনে রাখি । আসলে একসাথে থাকলে এক ধরনের সম্পর্ক গড়েই ওঠে বলুন ? আমারও জয়সোয়াল পরিবারের সাথে নিজের অজান্তে এইরকম এক মনের টান উঠেছিল -আর সেই সূত্রেই কাজ ছেড়ে দেওয়ার প্রায় বারো বছর পরে কেবল কেমন আছে সবাই জানতে এই কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম আমার প্রথম কাজের জায়গায় ।