এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • কালো টাকার ওপর সার্জিকাল স্ট্রাইক না পাবলিকের স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেটিং?

    দেবর্ষি দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৯ জানুয়ারি ২০১৭ | ১৬০৩ বার পঠিত
  • এই লেখা সম্পাদকীয় দপ্তরে এসেছিল ৩০ ডিসেম্বরের আগেই। লেখাটি সেইভাবেই প্রকাশিত হল। 

    ৮ই নভেম্বর, ২০১৬ মোদিজি নোট বাতিলের ঘোষণা করেছিলেন। তারপর প্রায় ৪৫ দিন কেটে গেছে। খুব শিগগিরি ৩০ ডিসেম্বর আসতে চলেছে। দুটো কারণে ৩০ ডিসেম্বর তারিখ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব বাতিল ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে জমা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মোদিজি এক বিখ্যাত বক্তৃতায় দেশবাসীকে বলেছেন, আমাকে ৫০ দিন সময় দিন।1  ৫০ দিন পর যদি কোনো খামতি বা দুর্নীতি আমার কাজে পান, শাস্তি দেবেন আমায়। মাথা পেতে নেব। তো মোদিজির ৫০ দিনের মেয়াদ ৩০ ডিসেম্বরের আশেপাশে খতম হচ্ছে। এই ৪৫ দিন থেকে কী জানতে পারলাম? ৩০ ডিসেম্বরের পরই বা কপালে কী আছে?

    ৪৫ দিনের অরাজকতার কিছুটা অবশ্য আগেই আঁচ করা গেছিল। এতো বড় পরিমাণে নোট বাতিলের প্রভাব ব্যাপক হওয়ার কথা। মানতে বাধা নেই, অর্থব্যবস্থার গলিঘুঁজিতে যে পরিমাণে গণ্ডগোল ছড়িয়েছে তাতে সমালোচকরাও হকচকিয়ে গেছেন। এতোখানি ও এতোভাবে গোলমাল হবে আঁচ করা যায় নি। তার পেছনে দুটো কারণ আছে প্রধানত। এক, এই ঘটনা নজিরবিহীন; দুই, সরকার ও রিসার্ভ ব্যাঙ্কের প্রস্তুতির অভাব।

    নোট বাতিলের ঘটনাটা সত্যিই নজিরবিহীন। যতদূর জানা যায় ভারতের মত বিরাট কোনো অর্থব্যবস্থায় এতো ব্যাপক পরিমাণে নগদ এর আগে বাতিল হয় নি। বর্মা সরকার ১৯৮৭ সালে ৮০% নগদ বাতিল করে।2  কিন্তু সে ভারতের তুলনায় ছোট অর্থনীতি। ফল খুব পদের হয় নি। বাতিলের পরপরই রাজনৈতিক প্রতিবাদ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তার মাথায় ডান্ডা মারে বর্মার ফৌজি সরকার।3  তারপর থেকে বর্মার মুদ্রানীতিতে বারবার আচমকা পরিবর্তন হয়েছে।4  সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৯১ সালে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নোট বাতিল করে। মনে রাখতে হবে সময়টা সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে মোটেই ভাল যাচ্ছিল না। নোট বাতিলের উদ্দেশ্য ছিল কালো ব্যবসাকে ধাক্কা দেওয়া আর রুবলের দাম স্থিতিশীল করা। এর কোনোটাই হাসিল হয় নি। কয়েক বছর দেশটাই থাকল না।

    নোট বাতিলের জন্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল এরকম দাবি করছি না। তবে এটুকুই হয়তো আন্দাজ করা ভুল হবে না, ব্যাপকস্তরে নোট বাতিলের মত দেশকে উল্টোপাল্টা করে দেওয়ার নীতি একটা দেশ সাধ করে নেয় না। আপৎকালে নেয়। মরীয়া কোনো সরকার, সম্ভবত স্বৈরাচারী শাসক, এরকম নীতি নেয়। কিন্তু দান অনেক সময়েই উলটো পড়ে যায়। নাইজেরিয়া আর জাইরেতে নোট বাতিলের পরপরই ক্যু হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার কথা ওপরেই বললাম।

     অর্থর অর্থ

    টাকার সাথে টক্করে গেলে রাষ্ট্রের হাত পোড়ে কেন? জিনিসটাকে একটু বুঝে নেওয়া যাক। কাগুজে নোটের কথা ধরুন। এক টুকরো কাগজ বই তো নয়। নোটের নিজের কোনো মূল্য নেই। ওপরে যে মূল্য ছাপা আছে তার তুলনায় কাগজের মূল্য অতি সামান্য। সেদিক থেকে ভাবলে, নোট রাখা বেশ ঝুঁকির কাজ। তাও রাখি কেন? কেননা অন্যরা নোটকে মূল্য দেয়। আর কেউ ১০০ টাকার নোটকে ১০০ টাকার মূল্যের না ভাবলে আমার কাছেও ওটা কাগজের টুকরো মাত্র।

    ‘এই নোট লইয়া কী করিব’ প্রশ্নটার জবাব তাহলে এই, আর সকলে মূল্য দেয় তাই উহা মূল্যবান। কিন্তু জবাব আরেক সমস্যার জন্ম দিলঃ আর সকলে মূল্য দেবে তার কী নিশ্চয়তা আছে? যদি না দেয় আমি কিছুই করতে পারি না যাতে দেয়। অথচ না দিলে ফাঁপড়ে পড়ব আমিই, কেননা আমার সম্পদ টম্পদ নোট ধারণ করে বসে আছে। মূল্যের অনিশ্চয়তা নগদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অথচ, নগদ ছাড়া, মানে বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়া, অর্থব্যবস্থা এগোতে পারে না, লেনদেন আটকে যায়। মজুরি হিসেবে ১০০ টাকার নোট কেউ দিতে চাইলে তখনই নেব যদি চালডালতেল কিনি যার থেকে সেও ১০০ টাকার নোটগুলো নেয়। কীভাবে জানব সে নেবেই?

     আধুনিক সমাজে এই অনিশ্চয়তাকে দূর করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান; সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে কমবেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি দেয় যে একটা ১০০ টাকার নোটের মূল্য ১০০ টাকা। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্যারান্টি এটা। এর ফলে নোট ‘লিগাল টেন্ডার’ মান্যতা পায়, মূল্যে স্থিরতা আসে। আমি নোট গ্রহণ করছি কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মত রাষ্ট্রের এক প্রধান প্রতিষ্ঠান নোটের মূল্য সুনিশ্চিত করছে। আসলে, যুক্তিটা আরেকটু গভীর। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গ্যারান্টির ফলে আমার নিজের উৎকণ্ঠা মিটছে; উপরন্তু আশা করছি আর সবাই আমার মতই নিশ্চিন্দি হয়েছে। বাজারে জিনিস কিনতে গেলে সমস্যায় পড়ব না, দোকানদার রিসার্ভ ব্যাঙ্কের গ্যারান্টিওয়ালা নোট নিয়ে নেবে। লক্ষ্য করুন, পাবলিকের কেন্ত্রীয় ব্যাঙ্ক বা সরকারের ওপর ভরসা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। যদি ভরসা না থাকে, তাহলে গ্যারান্টিকে কেউ পাত্তা দেবে না। আর ভরসা আজ যদি থাকে, কাল নাও থাকতে পারে। নির্ভর করবে পাবলিকের রাষ্ট্রের প্রতি কতখানি আস্থা আছে। 

    নোটের লিগাল টেন্ডার মান্যতা বাতিল করলে জনগণের সরকারের ওপর ভরসা চোট খায়, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্ত্রীয় ব্যাঙ্কের বিশ্বাসযোগ্যতাও মার খায়। নোট বাতিল প্রতিশ্রুতিভঙ্গ – যে প্রতিশ্রুতি দেশের জনগণের কাছে রাষ্ট্র করেছিল। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, যে দেশগুলো নোট বাতিল করেছে তাদের সরকার ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো নোট বাতিলের খড়কুটো আঁকড়াতে চাইছিল। এতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই যে নোটবাতিলের পরে গোলমাল আরো বেড়েছিল। প্রতিষ্ঠানের ওপর পাবলিকের ভরসা চলে গেলে তার বৈধতাও চলে যায়। তাকে উলটে দেওয়া সহজ হয়।5  তাই নোটবাতিলের আইনি বৈধতাকে যে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে তা অপ্রত্যাশিত নয়।6  প্রশ্ন ওঠে, মোদি সরকার কোনো গুরুতর সংকটে পড়ে নি, সংসদে যথেষ্ট পরিমাণ  আসন আছে, কী দরকার ছিল নোট বাতিল করার?

    নরেনের কী হৈল অন্তরে...

    নোট বাতিলের ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলো এতোটাই বিশ্বাসের অযোগ্য যে বাজারে নানান ধরনের ‘আসল’ উদ্দেশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিছু আছে – কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাটকে আমজনতাকে লাগিয়ে দেওয়া, যাতে দেশভক্তির জোয়ারে ভাজপার লাভ হয়; ভোটের প্রস্তুতিরত বিরোধি দলগুলোর তহবিল বিগড়ে দেওয়া। আবার আর্থিক উদ্দেশ্যও আছে – ব্যাঙ্কগুলো কর্পোরেট সংস্থাদের ধার দিয়ে টাকা ফেরত পাচ্ছে না, মুমূর্ষু অবস্থা, তাদের আমানত এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দেওয়া। জল্পনাগুলোতে সত্যতা থাকতে পারে। তবে আরেকটা সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবঃ বৈদ্যুতিন মাধ্যমে কেনাকাটার (ডিজিটাল পেমেন্ট) প্রসার।  

    ২০১২ সালে এদেশের মোট কেনাকাটার মাত্র ৬.৮% বৈদ্যুতিন মাধ্যমে হয়েছিল (ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, নেট ব্যাঙ্কিং, ই-ওয়ালেট ইত্যাদি)। তবে বৈদ্যুতিন কেনাকাটার বৃদ্ধি চড়া হারে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ২০০৭ সালেই বৈদ্যুতিন লেনদেনের ভাগ ছিল মাত্র ২.৬%।7  অন্য দেশের তুলনায় ভারতের বৈদ্যুতিন লেনদেনের বাজার বেশ ছোট। উদাহরণ হিসেবে, ২% ভারতীয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করেছেন, নাইজেরিয়ায় সংখ্যাটা ১১%। অর্থাৎ ভারতে ডিজিটাল অর্থনীতি খুব বেশি প্রসার এখনো পায়নি। কিন্তু এর মানে এও যে বিরাট এক সম্ভাবনা বর্তমান – উদ্যোগী ব্যবসায়ীদের জন্য পর্বতপ্রমাণ মুনাফা অপেক্ষা করছে। কী পরিমাণের মুনাফা কামানো যেতে পারে তার ছোট্ট একটা হিসেব করা যাক।  

    এই বছর বস্টন কন্সাল্টেন্সি গ্রুপ নামের আন্তর্জাতিক কন্সাল্টেন্সি ফার্ম ভারতে ২০২০ সালের মধ্যে ডিজিটাল কেনাকাটার কেমন প্রসার হতে পারে তার রিপোর্ট বার করেছে। হিসেব অনুযায়ী ২০২০ সালে মোট ৩৫ লাখ কোটি টাকা ডিজিটাল কেনাবেচা হবে (প্রতি বছরে)। এখন এই লেনদেন যে কম্পানির মাধ্যমে হয় তারা আয় করবে। যদি ধরি মোট ব্যবসার ১% আয় করবে তাহলে কম্পানিগুলোর আয় হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। হিসেব বলছে আজকের তুলনায় ২০২০ সালে এই ক্ষেত্রের ১০ গুণ বৃদ্ধি হবে (১০ গুণ বৃদ্ধি যে কোনো স্থানকালপাত্রে লোভনীয়)। ২০২৩ নাগাদ দেশের মোট লেনদেনে নগদ লেনদেনের ভাগ অর্ধেকের কম হয়ে যাবে। অ-নগদ লেনদেনের মধ্যে ডিজিটাল কেনাকাটার বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হতে চলেছে। ডিজিটালের মধ্যে ক্রেতা থেকে বিক্রেতা (person to merchant, P2M) অংশ সব থেকে চড়া হারে বাড়বে।8  ম্যানেজমেন্ট গুরুরা বলেন, পিরামিডের গোড়াতে অঢেল ধনসম্পদ রয়েছে (অস্যার্থ, এক্কেবারে আম আদমিদের সাথে ব্যবসায়ে লক্ষ্মীলাভ) – তারই যেন প্রতিধ্বনি পাই। মনে রাখা ভাল, ৪ বছরে ১০ গুণ বৃদ্ধির হিসেব বস্টনবাবুরা করেছেন ৮ই নভেম্বরের ভূমিকম্পের আগে। পরে করলে বৃদ্ধির সংখ্যাগুলোকে কয়েকধাপ ওপরে রাখতেন। 

    তাহলে ইঙ্গিত পাচ্ছি আমজনতার দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাথে লগ্নি পুঁজি (finance capital) ওতপ্রোত জড়িয়ে যেতে চলেছে। লগ্নি পুঁজির যোগ বোঝার জন্য নগদ কেনা আর ডিজিটাল কেনার তুলনা করে দেখা যাক। নগদে কিনলে মাত্র দুটো লোক যুক্ত হচ্ছে প্রক্রিয়ার মধ্যে – ক্রেতা আর বিক্রেতা।9  অন্যদিকে ডিজিটালে ক্রেতা বিক্রেতা ছাড়া আর কিছু পক্ষ জুড়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, নেট ব্যাঙ্কিং-এ ক্রেতার ব্যাঙ্ক বিক্রেতাকে টাকা দিচ্ছে। দিচ্ছে কেননা ক্রেতার ওই ব্যাঙ্কে এ্যাকাউন্ট আছে, এ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ  টাকা আছে। এখন এই কাজ ব্যাঙ্ক এমনি এমনি করে না, সচরাচর একটা কমিশন কেটে নেয়, যা লগ্নি পুঁজির আয়। ই-ওয়ালেট কেনাকাটার ক্ষেত্রে ক্রেতা বিক্রেতা ছাড়া অন্তত দুটো অতিরিক্ত পক্ষ জুড়ে যাচ্ছে – ব্যাঙ্ক ও ই-ওয়ালেট কম্পানি। এইসব মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা নিজেদের পাওয়া বুঝে নেবেই। 

    ভারতে পেটিএম নামে ই-ওয়ালেট কম্পানি বেশ প্রচার করছে। পেটিএমের ভ্যালুয়েশন ১৮ মাসে পাঁচগুণ বেড়েছে। পেটিএমকে আর্থিক লগ্নি যোগাচ্ছে বৃহৎ চীনা কর্পোরেট সংস্থা আলিবাবা।10  পেটিএম ছাড়াও কিন্তু বাজারে আরো খেলোয়াড় আছে। ৮ই নভেম্বরের পর দেখতে পাচ্ছি বৃহৎ ভারতীয় পুঁজি এই বাজারে পটাপট ঢুকে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে মুকেশ আম্বানির রিয়ায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিস খুলেছে জিও মানি মার্চেন্ট সলিউশন। কী করবে এই সংস্থা? খুচরো ব্যবসা, রেস্টরান্ট, পরিবহণ ক্ষেত্রে ডিজিটাল পেমেন্ট নিয়ে আসবে। আগামী দিনে ১ কোটি বিক্রেতাকে নিজেদের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসার উচ্চাশা জিও মানির।11  প্রসঙ্গত বস্টন গ্রুপও বলছে ২০২০ সালে ১ কোটি বিক্রেতা ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবসা করবেন। এয়ারটেলও এয়ারটেল পেমেন্ট ব্যাঙ্ক খুলে ফেলেছে ইতিমধ্যে। উদ্দেশ্য ৩০ লাখ বিক্রেতার ‘ইকোসিস্টেম’ তৈরি করা যাঁরা ফোনে পাঠানো ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ করবেন। এই বিক্রেতার মধ্যে মুদি দোকান, খুদে দোকানদারদেরও রাখছে এয়ারটেল।12  সংক্ষেপে, ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিরা, যাদের মূল ব্যবসা হয়তো পেট্রোকেমিকাল বা টেলিকম, হুড়মুড়িয়ে খুচরো ব্যবসায়ের লগ্নি পুঁজিতে ঢুকছে। 

    বৃহৎ পুঁজি বৈদ্যুতিন কেনাকাটার বাজারে ঢুকছে বোঝা গেল; তো সরকার কী করছে? সরকারের কাজকম্ম দেখে সন্দেহ হয় সরকার বৃহৎ পুঁজির জন্য মুনাফার খেত প্রস্তুত করছে। নোট বাতিলের ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলো বিশ্বাসের অযোগ্য। দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, জাল নোট, কর ফাঁকি – নোট বাতিলে কোনোটারই বিশেষ ক্ষতি হওয়ার নয়। লক্ষ্যনীয়, যাঁরা সার্জিকাল স্ট্রাইক চালিয়েছেন সেই নেতা আমলারাও আর উদ্দেশ্যগুলো নিয়ে তেমন মুখ খুলছেন না। আগে নিশানায় ছিল কালা ধন আর আতঙ্কবাদী। অধুনা মা ‘নগদবিহীন অর্থনীতি’ (ক্যাশলেস ইকনমি) হইয়াছেন। এই ৪৫ দিনে এটুকু পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ব্যাঙ্কের কাছে পর্যাপ্ত নগদ নেই। নগদের আকালকে বাড়িয়ে তুলেছে ব্যাঙ্ক বা এটিএম থেকে দিনপ্রতি, সপ্তাহপ্রতি নগদ তোলার ঊর্ধ্বসীমা। নগদের আকালই সমস্যার মূল। ব্যাঙ্কে লম্বা লাইন, মৃত্যু, আত্মহত্যা, ব্যবসা বা উৎপাদনে মন্দা এসবকিছুর পেছনে রয়েছে নগদের ঘাটতি। অথচ, অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন যত মূল্যের নগদ বাতিল করা হয়েছে সে পরিমাণের নগদ বাজারে ছাড়া হবে না।13  তারমানে আকাল শিগগিরি যাওয়ার নয়। সন্দেহ জাগে এই পাগলামির পেছনে কি কোনো পরিকল্পনা বর্তমান আছে? কোনো দুর্বুদ্ধিযুক্ত পরিকল্পনা?14  

    স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেটে জনগণ

    ভিয়েতনাম আর মালয় যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট জঙ্গিদের শায়েস্তা করতে এক সামরিক কৌশল উদ্ভাবন করা হয় যাকে বলে স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেটিং। জঙ্গি সাধারণ পাবলিকের সাথে মিশে আছে, ‘মাছ যেমন সাগরে থাকে’, তাকে কবজা করা শক্ত। সাধারণ জনগণই হয়তো লুকিয়ে জঙ্গিকে মদত দিচ্ছে। জনতাকে ধরে এনে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পুরে দাও। শিবির বা ছোট গাঁ বা হ্যামলেটে বন্দী পাবলিক জঙ্গিকে মদত দিতে পারবে না। জঙ্গলে ঢুকে জঙ্গি পাকড়াও করাও সোজা হবে, সে জনগণের মধ্যে লুকোতে পারবে না। আমাদের সরকার বাহাদুর এই কৌশল ষাটের দশকে মিজোরাম, নাগাল্যান্ডে সামরিক অভিযান চালাতে গিয়ে ব্যবহার করেন।15  সম্প্রতি সালওয়া জুদুমের সাহায্য নিয়ে ছত্তিসগড়ে একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। 

    কালা ধনের ওপর সার্জিকাল স্ট্রাইকের পেছনে গপ্পোটা বোধহয় সাধারণ পাবলিককে স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেট করার। হয়রানি, হত্যা করে নগদের আশ্রয় থেকে তাদের তাড়ানো হচ্ছে। শিবিরে বন্দী পাবলিক থাকবে পেটিএম, জিও মানি, এয়ারটেল পেমেন্ট ব্যাঙ্কদের অতন্দ্র প্রহরায়। পাবলিক যখন শিবিরে আটক তাদের পকেট হাল্কা করে নিচ্ছে লগ্নি পুঁজি। আতঙ্কবাদী ও কালা ধন শিকারের আষাঢ়ে গল্পের পেছনে এই ছকটা হয়তো গোড়ার থেকেই ছিল?


    1. http://www.hindustantimes.com/india-news/modi-turns-emotional-as-he-speaks-on-demonetisation-says-has-more-such-steps-in-mind/story-naFFmlHrFbhqbdUrj6ALBK.html
    2. http://www.joc.com/burma-demonetizes-80-percent-currency_19870908.html
    3. http://www.businessinsider.in/PM-Modi-take-note-These-countries-failed-at-demonetization/articleshow/55460537.cms
    4. http://asia.nikkei.com/Politics-Economy/Economy/New-kyat-note-brings-back-bad-memories
    5. জিনিসপত্রের দাম হুড়হুড় করে বাড়ছে এমন অবস্থায় নোট বাতিল কাজ দিতে পারে। এই অবস্থায়, যাকে বলে হাইপার ইনফ্লেশন, টাকার দামের মাথামুণ্ডু এমনিতেই নেই। জনগণের কাছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে টাকার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় শূন্য। সরকার তখন পুরনো টাকার জঞ্জাল সরিয়ে নতুন নোট ছাড়তে পারে। বলা বাহুল্য এমন পরিস্থিতি ভারতে হয় নি।  
    6. https://thewire.in/81325/demonetisation-legally-unsound/
    7. http://fletcher.tufts.edu/~/media/Fletcher/Microsites/Cost%20of%20Cash/IBGC%20WP13-01%20Cash%20Outlook%20India.pdf
    8. http://image-src.bcg.com/BCG_COM/BCG-Google%20Digital%20Payments%202020-July%202016_tcm21-39245.pdf
    9. নগদ, যা দিয়ে কেনাবেচা হচ্ছে, যোগাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। কেন্ত্রীয় ব্যাঙ্ককে ৩য় পক্ষ ধরা যায়। তবে ৩য় পক্ষের ভূমিকা সচরাচর নীরব। 
    10. http://economictimes.indiatimes.com/news/politics-and-nation/rss-wing-to-study-paytm-ties-with-chinese-company-alibaba/articleshow/55656191.cms
    11. https://www.mobileworldlive.com/money/news-money/reliance-industries-to-launch-mobile-wallet/
    12. http://www.financialexpress.com/economy/airtel-payments-bank-to-educate-indians-about-digital-payments-cashless-economy/472975/
    13. http://www.indiatimes.com/news/india/not-all-scrapped-currency-will-be-remonetised-hints-finance-minister-arun-jaitley-267620.html
    14. http://indianexpress.com/article/blogs/demonetisation-implementation-cash-crunch-digital-payments-cashless-transactions-4435312/ 
    15. http://agrarianstudies.macmillan.yale.edu/sites/default/files/files/colloqpapers/22sundar.pdf

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৯ জানুয়ারি ২০১৭ | ১৬০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন