প্রাচীনকালে আরাকানীরা তাদের জন্মভূমিকে ‘রখইঙ্গ’ নামে অভিহিত করত। এর অর্থ দৈত্য বা রাক্ষস। তারা তাদের জন্মভূমিকে ‘রক্ষইঙ্গতঙ্গী’ বা ‘রাক্ষসভূমি’ নামে পরিচয় দিতে সংকোচ বা লজ্জাবোধ করত না। রক্ষইঙ্গ শব্দটি মুসলমান ঐতিহাসিকদের লেখায় আরখং বা রাখাংগ রূপ লাভ করে। মীর্জা নাথান, সিবাস্তিয়ান ম্যানরিকসহ অনেক ঐতিহাসিক আরাকানকে আরখং বা রাখাংগ নামে অভিহিত করেন। কারো মতে, আরাকান নামটি ইউরোপীয়দের দেওয়া, এটি রক্ষইংগ, আরখং বা রাখাংগ থেকে আরাকানে পরিণত হয়।
রোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ নানা মত প্রকাশ করেছেন। কারো মতে, রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তি রাখাইন শব্দ থেকে। যথা, রাখাইন> রোয়াং> রোহিঙ্গা। রোয়াং তিব্বতী শব্দ, যার অর্থ আরকান। এখনো চট্টগ্রাম জেলায় রোয়াং ও রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা দ্বারা আরাকান ও আরাকানের অধিবাসীকে বোঝায়। অনেক গবেষক মনে করেন, রহম থেকে রোহিঙ্গা হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীতে আরকানের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের শাসনামলে বৈশালী ছিল তাদের রাজধানী। সে-সময় চন্দ্রবংশীয় রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১১) কয়েকটি আরবীয় মুসলিম বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের পাশে বিধ্বস্ত হলে জাহাজের আরোহীরা ‘রহম রহম’ অর্থাৎ ‘দয়া দয়া’ বলে চিৎকার করে। এসময় স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে এবং আরাকানরাজ তাদেরকে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেন। আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদেরকে রহম জাতির লোক মনে করে ‘রহম’ বলে ডাকত। পরবর্তীকালে রহম শব্দটি বিকৃত হয়ে রহম> রোঁয়াই> রোয়াই> রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা রূপ নেয়।
বলে রাখা ভালো, রোহিঙ্গারা কিন্তু আরাকানের আদিম জনগোষ্ঠী নয়। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে মারু ও কামরাজগজি বংশ স্বাধীনভাবে আরাকান শাসন করে। ১৪৬ বা ১৫১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মগধ থেকে আগত চন্দ্র-সূর্য নামক এক সামন্ত সৈন্যবাহিনী চট্টগ্রাম ও আরাকানে বসবাসকারী আদিম জাতির সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে সেখানে নতুন রাজ্যের গোড়া পত্তন করে। মগধ থেকে আগত হিন্দু ও বৌদ্ধ সেনারা নতুন রাজ্যের আদিম অধিবাসীদের আর্য ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতি ও ভাষালিপিতে শিক্ষিত করে তোলে। কালক্রমে চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতি এবং আরাকানে বৌদ্ধধর্ম সংস্কৃতির উৎপত্তি হয়।
আবদুল হক চৌধুরী তাঁর ‘প্রাচীন আরাকান রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী’ বইতে উল্লেখ করেন, খৃষ্টীয় ১৩ শতক পর্যন্ত বর্তমান দক্ষিণ আরাকান ‘স্যান্ডুয়ে’ ও উত্তর আরাকান ‘আরাকান’ নামে পরিচিত ছিল। ১২৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পঁগা রাজ্যের পতন হলে আরাকানরাজ মেংদী স্যান্ডুয়ে দখল করে আরাকান রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। ১৪৬-১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে চট্টগ্রাম কখনো সম্পূর্ণ এবং কখনো আংশিকভাবে আরাকান রাজ্যভুক্ত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দে আরাকান রাজ্য স্থাপন করার সময় থেকে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বোধপায় কর্তৃক দখল হওয়ার আগ পর্যন্ত ৮টি স্থানে রাজধানী করে বিভিন্ন রাজবংশ কখনো স্বাধীন কখনো করদ রাজ্য হিসেবে আরাকান শাসন করেন। ধান্যবতীর চন্দ্র-সূর্য বংশের রাজত্বকালে এই সময় বৈশালীতেও চন্দ্র বংশের রাজারা শাসন করত।
কাজী আতাহার মুবারকপুরী তার ‘আরব ওয়া হিন্দ আহদে রেসালাত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইসলামের আবির্ভাবের ৫০ বছরের (৬১০-৬৬০) মধ্যেই আরাকান এলাকায় আরব থেকে মুসলমানদের আগমন শুরু হয়। এ সময় থেকেই মুসলমানরা আরাকান থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব চীনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত নৌ-বাণিজ্য বহর নিয়ে যাতায়াত করত। চীনের ক্যান্টনে ইসলামের নবীর একজন সাহাবির মাজার রয়েছে। আরাকান ও চীনের স্থলভাগে মুসলমানরা অনেক মসজিদ ও বাণিজ্য বন্দর স্থাপন করেছিল। চন্দ্র-সূর্য বংশের প্রথম রাজা মহৎইঙ্গচন্দ্র ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বৈশালীতে রাজধানী স্থাপন করেন এবং তার শাসনামলের শুরুতেই ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ পেয়ে আরবের মুসলিম বণিকরা রাহাম্ব্রি বন্দরসহ নৌবন্দরগুলোতে ব্যাপকভাবে বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচার মিশন পরিচালনা করে। এ অবস্থায় অষ্টম শতাব্দী থেকে আরাকান ও মেঘনা নদীর পূর্বতীরবর্তী বিস্তীর্ণ ভূভাগে আরবীয় বণিকদের কর্মতৎপরতা দেখা যায়।
গবেষক মো. মাহফুজুর রহমান ‘মাইন্ট আং, ইমদাদুল হক সরকার অনুদিত ‘বার্মায় ইসলাম’ নিবন্ধের উদ্বৃতি দিয়ে লেখেন, পিনসা বংশীয় রাজা পুন্যাখের রাজত্বকালে ১০৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পঁগা রাজবংশ আরাকান দখল করে করদরাজ্যে পরিণত করে। এ সময় থেকে কিছু কিছু মুসলমান পঁগা রাজাদের দেহরক্ষী ও সৈনিকদের কাজ করত এবং বণিক, সৈনিক ও নাবিক হিসেবে তারা আরাকানে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। তাদের জাহাজ মেরামত করার জন্য কিংবা মৌসুমী হাওয়ার অপেক্ষায় ছয় মাসের অধিককাল এখানে অবস্থান করতে হতো। দূরবর্তী বাণিজ্য মিশনে তারা স্ত্রীদের সাথে আনতো না। পক্ষান্তরে ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে অবৈধভাবে যৌন প্রয়োজন মিটানো সম্ভব ছিল না বলে তারা স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করত। স্বদেশে ফিরে যাবার সময় বার্মা আইনে স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল বলে মুসলমান বণিকগণ এখানেই দ্বিতীয় আবাস হিসেবে বসতি স্থাপন করত এবং এ সূত্রে অনেকেই স্থায়ী আবাস গড়ে তুলতো। ফলে মুসলমানদের সংখ্যা এখানে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দশম ও একাদশ শতাব্দীতে আরব বণিক ও সুফি-দরবেশদের মধ্যে বদরুদ্দিন বা বদর শাহ নামে জনৈকি পীর আরাকান অঞ্চলে আসেন এবং ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার নামানুসারে আসামের সীমা থেকে শুরু করে মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত নানা স্থানের নাম বদর মোকাম এবং এ নামে বিভিন্ন স্থানে মসজিদও নির্মিত হয়। সে সময় মুসলমানরা এতটা জনপ্রিয় ছিল যে, তারা বাণিজ্য বিস্তারের পাশাপাশি ইসলামের বাণী আরাকানের রাজশক্তি ছাড়া সব স্তরেই প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।
আগের পর্বে আলোচনা করেছি আরাকানে কীভাবে আরব থেকে মুসলমানরা এসে বসতি পত্তন করেছিল সে-বিষয়ে। এই পর্বের আলোচ্য বিষয় ভারতবর্ষ বা বাংলা মুলুকের মানুষ কীভাবে আরাকানে বসতি স্থাপন করেছিল তা নিয়ে। আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিখলা ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহের সহায়তায় হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। লংগিয়েত থেকে রাজধানী স্থানান্তর করে লেমব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। এই ‘ম্রোহং’ শব্দটি মুসলমানদের লেখায় ‘রোসাঙ্গ’ লিখিত হয় বলে গবেষক মো. মাহফুজুর রহমান গবেষক মুহাম্মদ এনামুল হক ও আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ‘আরকান রাজসভায় বাঙালা সাহিত্য’ বইয়ের উদ্বৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন। এই ম্রোহং শব্দটি মুসলমানদের লেখায় ‘রোসাংগ’ লিখিত হয়। চট্টগ্রামের অধিবাসীদের কাছে রোসাংগ শব্দটি রোয়াং বা রোহাং নামে পরিচিত। এই রোয়াং বা রোহাং শব্দটি বিকৃত হয়ে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে বলে বিভিন্নজনের উদ্বৃতি দিয়ে মাহফুজুর রহমান প্রমাণ করেছেন।'
মাহবুবুল আলম তার ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস পুরানা আমল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আরাকানরাজ নরমিখলা ১৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে অননথিউ নামক জনৈক সামন্তরাজের বোন চৌবোঙ্গিকে জোরপূর্বক গ্রহণ করলে অননথিউ বোনের প্রতি এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছায় বর্মীরাজ মেঙশোওয়াইয়ের কাছে প্রতিকার চান। তিনি ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আরাকান আক্রমণ করে রাজা নরমিখলাকে পরাজিত করেন। নরমিখলা পালিয়ে বাংলার ইলিয়াসশাহী বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সাহায্য চান।
অপরদিকে, মুহাম্মদ মাইনুল ইসলাম খানের উদ্বৃতি দিয়ে গবেষক মো. মাহফুজুর রহমান উল্লেখ করেন, নরমিখলার রাজত্বকালে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার কারণে আরাকানের শাসকদের সাথে মুসলমানদের তেমন কোনো বিরোধ ছিল না। হিন্দু ও মুসলমানদের উপস্থিতিতে বৌদ্ধরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার চেয়ে সহযোগিতার ভেতর দিয়েই স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করত। কিন্তু মুসলমানদের উত্তরোত্তর প্রভাব বৃদ্ধির ফলে বৌদ্ধরা ধীরে ধীরে মুসলমানদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। তদুপরি রাজা স্বয়ং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়েও মুসলমানদের প্রতি প্রকাশ্য সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারটা স্থানীয় বৌদ্ধরা পছন্দ করেনি। রাজা নরমিখলার মুসলিম প্রীতির কারণেই তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে এবং কয়েকজন সামন্ত রাজা নরমিখলার প্রতি আনুগত্য দেখাতে অস্বীকার করে। সব রাজ্যই আরাকানে বার্মার হস্তক্ষেপ কামনা করে।
নরমিখলার পরাজয়ের পর বর্মীরাজ তার জামাতা কামারুকে ‘অনরাটা’ উপাধি দিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসান। পরবর্তীকালে বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহের সহযোগিতায় আরাকান আক্রমণ করে পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে বসেন। নরমিখলার সাথে দুই পর্বে আরাকানে আগত বাংলার সৈন্যরা আরাকানের স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। এছাড়া নরমিখলা কর্তৃক আরাকান পুনঃরায় জয়ের পর চট্টগ্রাম থেকে অনেক মুসলমান সেখানে গিয়ে স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসত শুরু করে। তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বেশি। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীও ছিল অনেক। খেয়াল করুন, এখান থেকেই শুরু বাংলা থেকে যাওয়া মানুষদের আরাকানে বসতি পত্তনের ইতিহাস। এর আগে কিন্তু আরাকানে আরব থেকেই মুসলমানরা এসেছিল এবং বসতি পত্তন করেছিল। নরমিখলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আরাকানের মারাউক-ক-উ-রাজবংশকে অনেক গবেষক বিভিন্ন পর্যায় পর্যন্ত ‘আরাকানে মুসলিম শাসনের যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ যুগেই আরাকানে বাংলায় ভাষায় বিস্তর সাহিত্য রচিত হয়। উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে রয়েছেন দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আলাওল, মরদন, আবদুল করিম খোন্দকার, নসরুল্লাহ প্রমুখ।
এর পরের ইতিহাস মগ-ফিরিঙ্গিদের ইতিহাস। মগ-ফিরিঙ্গি দস্যুবাহিনী বাংলার উপকূল থেকে মানুষদের ধরে নিয়ে কীভাবে বিক্রি করে দিত, যদি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন, তাহলে তার একটু বিবরণ আমার লেখা ‘বেগানা’ উপন্যাস থেকে উল্লেখ করছি : “ধুলোধূসরিত পথে হাঁটতে হাঁটতে আবদুল খালেক বেটাকে ফিরিঙ্গিদের গল্প শোনাত। মেলা দিন আগে, তখন আরাকানের রাজা ছিল থিরি থু ধম্মা, পর্তুগিজরা জাহাজে চড়ে প্রথম এ দেশে আসে। আরাকানিরা তাদেরকে বলত ফিরিঙ্গি। বড় বড় নৌকা বানাতে পারত ফিরিঙ্গিরা। নৌবিদ্যা শেখবার জন্যই আরাকানিরা ফিরিঙ্গিদের এ দেশে ঠাঁই দিয়েছিল। তাদের কাছাকাছি থেকে ধীরে ধীরে নৌকার ভালো কারিগর হয়ে ওঠল আরাকানিরা। রাজার নীরব সমর্থনে এখানকার কিছু মতলববাজ মগ ফিরিঙ্গিদের সাথে আঁতাত করে পশ্চিমে দরিয়ার কূলে কূলে যেসব দেশ আছে সেসব দেশের মানুষ গুমের কারবার শুরু করল। মগ-ফিরিঙ্গিরা গ্রাম ঘেরাও করে ছেলে-বুড়ো যাকে সামনে পেত ধরে নিয়ে আসত আরাকানে। জাফর কাওয়াল বলতেন, সাক্ষী সুবেদার মির্জা নাথান ও সিবাস্টিয়ান ম্যানরিক, শুধু আরাকানেই নয়, দাক্ষিণাত্যের বন্দরে বন্দরে বন্দিদের তারা দাস হিসেবে বেচে দিত ইংরেজ, ফরাসী এবং ওলান্দাজ বণিকদের কাছেও। হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ, মাঝি-মাল্লা, ধনী-গরিব কাউকে রেয়াত দিত না। হতভাগ্য বন্দিদের হাতের তালু ছেঁদা করে তার মধ্যে পাতলা বেত চালিয়ে নৌকার পাটাতনের নিচে বেঁধে রাখত। খাবারের জন্য উপর থেকে ছুঁড়ে দেয়া হতো শুধু কিছু চাল। ক্ষুৎপিপাসায় কেউ কেউ মারা পড়ত সেখানে। শুধুই কি দাস বেচাকেনার কারবার? খুন-জখম-ধর্ষণ-ডাকাতি-লুটতরাজসহ নানা আসুরিক কাজে তাদের সমান কেউ ছিল না তখন। তাদের জীবন ছিল লাগামহীন ঘোড়ার মতো। সুবাবাংলার দক্ষিণাঞ্চল বিরান হয়ে পড়েছিল সেসব হার্মাদদের অত্যাচারে। আরাকানের প্রাচীন বট-পাকুড়ের ছাল শুঁকে দেখ, এখনো পাবে দাসদের ঘাম ও রক্তের গন্ধ।” অর্থাৎ বাংলার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যাদের ধরে নিত মগ-ফিরিঙ্গিরা, তাদের কিছু অংশকে বিক্রি করে দিত আরাকানে। তারাই পরবর্তীকালে আরাকানের স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসতি শুরু করে। এরাও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর। এদের মধ্যে মুসলমান যেমন ছিল, তেমনি হিন্দুও ছিল। খেয়াল করুন, এখন যারা রোহিঙ্গা, তাদের পূর্বপুরুষরা শুধু বাংলাদেশ থেকে যায়নি। প্রথমত আসে আরব থেকে, পরবর্তীকালে যায় বাংলা থেকে। সুতরাং যারা একতরফাভাবে রোহিঙ্গাদেরকে বাঙালি জাতভুক্ত বলে প্রচার করেন এবং রোহিঙ্গাদেরকে শুধু মুসলিম বলে প্রচার করেন, ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জানাশোনা কম। এদেরকে তর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিহত করুন।
(চলবে)