রোহিঙ্গা সংকটের রাজনৈতিক কারণগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি পূর্বালোচনায়। এবার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করব। আগেই বলেছি, রোহিঙ্গাদের একটি অংশের পূর্ববসতি ছিল আরবে, অন্য একটি অংশের বঙ্গে। এ কথা জানা যে, ভারতবর্ষে ইসলামের প্রসার ঘটে সুফিদের মাধ্যমে। আরবীয় ইসলাম বঙ্গে এসে বঙ্গীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নানা বিষয়ে আপোষ করতে বাধ্য হয়। এই আপোষের কথা সবাই জানেন। তবু ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি যখন ভারতে ইসলাম প্রচারে এলেন তখন ভারতবাসী নিম্নবর্ণের হিন্দুদের পোশাক ছিল ধুতি ও নেংটি। খাজা ও তার সঙ্গীদের পোষাক ছিল পায়জামা ও আলখাল্লা। খাজার এক শিষ্য একদিন খাজাকে বললেন, ‘হুজুর, হিন্দুরা তো অনৈসলামিক পোশাক ধুতি-নেংটি পরে। আপনি এদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে দিন।’
.
খাজাসাহেব শিষ্যের কথা পাত্তা তো দিলেনই না, উল্টো তিনি নিজেই ধুতি পরা ধরলেন। পায়জামা-আলখাল্লা দেখে এতদিন খাজাসাহেবকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ঠিক ওভাবে গ্রহণ করতে পারছিল না। তিনি যখন ধুতি পরা ধরলেন তারা ভাবল, আরে, খাজাসাহেব তো আমাদেরই লোক! এই যে তিনি আমাদের মতো ধুতি পরছেন! তখন নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তার অনুরাগী হতে লাগল। তার হাতে বয়েত নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। পরবর্তীকালে খাজাসাহেব তার সেই শিষ্যকে বললেন, আমি যদি প্রথমেই এদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করতাম তারা আমার কথা শুনত না। কিন্তু এখন আমি যা বলি তা-ই শুনবে।
.
বঙ্গীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আরবীয় ইসলামের আপোষ বা সমন্বয়টা ছিল ঠিক এরকম। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের মনোভাবটা নেই। হ্যাঁ, একটা অংশের ছিল। রাজা নরমিখলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আরাকানের মারাউক-উ-রাজবংশকে অনেক গবেষক বিভিন্ন পর্যায় পর্যন্ত ‘আরাকানে মুসলিম শাসনের যুগ’ বলে উল্লেখ করেছেন। সেই যুগে আরাকান রাজসভার কবিদের মধ্যে একটা সমন্বয়বাদী মানসিকতা ছিল। নইলে রাজা থিরি থু ধম্মার লস্কর উজির বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকতে পারতেন না। রাজা সান্দা থু ধম্মার প্রধানন্ত্রী মোহাম্মদ সোলায়মান থাকতে পারতেন না। এই ‘মুসলিম যুগে’র উজির-নাজির বা শাসক বা পন্ডিতরা ছিলেন অনেকটা সুফি ঘরানার। সমন্বয়বাদী। সহিষ্ণু। কবি আলাওল, কবি দৌলত কাজী, কবি কোরেশী মাগন ঠাকুর, কবি আবদুল করিম খোন্দকার, কবি নসরুল্লাহ খানরাও উগ্র ধার্মিক ছিলেন না। তাদের চর্চিত সাহিত্যেও উগ্রতা বহিঃপ্রকাশ ছিল না।
.
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এসব সমন্বয়বাদী কবিদের চর্চিত সাহিত্য আরাকানবাসী নিম্নকোটির রোহিঙ্গাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। উল্টো বরং বাংলাদেশের বাঙালিরা আরাকান রাজসভার কবিদের চর্চিত সাহিত্যকে নিজেদের করে নিয়েছে। রোহিঙ্গারা তা পারেনি। তারা সাহিত্য বোঝে না, সংগীত বোঝে না। এসব ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কোনোকালেই ছিল না। আরাকান রাজসভার উদার ও অসাম্প্রদায়িক কবিদের সমন্বয়বাদের প্রভাবও নিম্নকোটির রোহিঙ্গাদের মধ্যে পড়েনি। রাজা বোধপায়া আরাকানের ক্ষমতা লাভের পর থেকে এবং ১৯৪২ সালে জাপান বাহিনীর সহায়তায় বার্মা ইন্ডিপেন্ডেট আর্মি (বিআইএ) রোহিঙ্গাদের ওপর যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় তারপর থেকে রোহিঙ্গাদের অনেকে পাকিস্তান সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পালিয়ে যায়। এই সময় থেকে ধীরে ধীরে এসব দেশের সঙ্গে তাদের একটা গোপন সংযোগ তৈরি হতে থাকে। সেসব দেশের উগ্র সংস্কৃতি তাদের মধ্যে প্রবিষ্ট হতে থাকে। যেসব আরবীয় বণিক আরাকানে এসে বসতি পত্তন করেছিল রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে তাদের সংস্কৃতি।
.
একথা জানা যে, আরবরা সাধারণত সালাফি। কট্টরপন্থী। এই কট্টরপন্থার অনুসারী নিম্নকোটির রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থানীয় রাখাইন, মগ বা অন্যন্য জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে আপোষ করতে পারেনি। নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনি। পারলে উল্টো নানাভাবে তাদের সংস্কৃতিকে কটুক্তি করতে ছাড়েনি। খেয়াল করা দরকার, ১৯৪২ সালে আরাকানে মগ-রোহিঙ্গা যে দাঙ্গা হয়, যে দাঙ্গায় উভয় পক্ষের বহু লোক হতাহত হয়, তার কারণ ছিল রোহিঙ্গা কতৃক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধের অবমাননা। তারা কীভাবে বুদ্ধের অবমাননা করেছিল তা আমার সংগ্রহে থাকা ইতিহাসের বইগুলোতে উল্লেখ নেই। তবে ধারণা করি, তাদের এই অবমাননাটা ছিল মারাত্মক। নইলে তৎকালীন শান্তিবাদী বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এতটা ক্ষেপে ওঠার কথা নয়। যেহেতু এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, তাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। কিন্তু এ কথা সত্য যে, তখন দাঙ্গাটা হয়েছিল রোহিঙ্গা কর্তৃক গৌতম বুদ্ধকে অবমাননা বা কটুক্তির ফলেই। (দ্র. হাবিব উল্লাহকৃত ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস)
.
যত যা-ই হোক, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এখনো এক ধরনের সহিষ্ণুতা আছে। হিন্দুদের উপর বাংলাদেশে যেসব আক্রমণ হয়, তার বেশিরভাগ যতটা ধর্মীয়, তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক। ঠিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অতটা প্রকট নয়। কিন্তু প্রকট রোহিঙ্গাদের মধ্যে। ধর্মীয় অনুশাসন পালনে তারা কঠোর। আরকানের মগদেরকে তারা ‘কাফের’ ‘মুশরিক’ ছাড়া মানুষ বলেই গণ্য করতে নারাজ। রোহিঙ্গাদের চোখে এই কাফেররা ঘৃণিত। জাহান্নামি। এই ঘৃণা প্রশমনের জন্য একজন আধ্যাত্মিক নেতার প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের মধ্যে যেমন বড় কোনো রাজনৈতিক নেতা আসেনি, তেমনিভাবে আসেনি কোনো আধ্যাত্মিক নেতাও। তাদের নেতা জাফর কাওয়াল অনেকটা সহনশীল ও সমন্বয়বাদী ছিলেন। কিন্তু তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর যেসব নেতা ‘মুজাহিদ পার্টি’র নেতৃত্ব নেয় তারা ধর্মীয় দিক থেকে ছিলেন চরম গোঁড়া। মিয়ানমার সরকার দেশব্যাপী পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা তা করবে না। তারা ইচ্ছেমতো সন্তানাদির জন্ম দেবে। একেকজনের দশ-বারোটা ছেলেমেয়ে। কারো কারো তারচেয়ে বেশি। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে রোহিঙ্গাদের এই অসম্মতি স্থানীয় মগদের ভাবিয়ে তোলে। তারা ভাবে, যেভাবে রোহিঙ্গারা বংশ বিস্তার করছে, একদিন তো গোটা আরাকান তারা রোহিঙ্গা দিয়ে ভরিয়ে তুলবে! তখন আমরা হয়ে পড়ব সংখ্যালঘু। মগ-রোহিঙ্গা বিভেদের এটিও কিন্তু একটি কারণ। এই কারণকে উপেক্ষা করা যায় না।
.
বাংলাদেশে এখন প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বেশিও হতে পারে। আমি ‘বেগানা’ উপন্যাসটি লেখার সুবাদে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাই। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকে কিছুদিন চাকরির সুবাদে আমাকে কক্সবাজার থাকতে হয়েছিল। সেই সুবাদেও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়। ‘বেগানা’ লেখার আগে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে এক পরিবারের দেখা পাই। ঐ পরিবারে মেয়ের সংখ্যা আট, ছেলের সংখ্যা তিন। তাদের মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঠিকমতো খেতে পান না, এতগুলো সন্তান নিলেন কেন?’ জবাবে নারীটি তার ভাষায় বলেন, ‘ছেলেপেলে আল্লাহর দান, আমাদের কি হাত আছে? আল্লাহর হুকুমে তারা জন্ম নিচ্ছে।’ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তাদেরকে খাওয়াবেন কোত্থেকে?’ বললেন, ‘আল্লায় খাওয়াবে।’ কিন্তু না, আল্লায় খাওয়াননি। তিন মেয়েকে বাবা-মা বিক্রি করে দিয়েছে দালালের কাছে। বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়েছে। দালালরা মেয়েগুলোকে কোথায় নিয়ে গেছে তার কোনো হদিস নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঐ তিন মেয়ের জন্য আপনাদের খারাপ লাগে না?’ আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে পুরুষটি বললেন, ‘খারাপ লাগার কী আছে? আল্লাহর এত বড় দুনিয়া। তারা নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আল্লাহর উপর আমার একিন (বিশ্বাস) আছে।’ আমি আর কথা বাড়ালাম না। কারণ তার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তার মগজে ঢুকে আছে গোঁড়ামি। তাকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই।
.
শুধু পরিবার-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নয়, ধর্মের সকল অনুশাসনের ক্ষেত্রেই তারা উগ্র। তাদের মধ্যে বর্বর আরবীয় সংস্কৃতি এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, অনেক রোহিঙ্গা নেতা বাঙালি মুসলমানদেরকেও ঠিক মুসলমান বলতে নারাজ। তাদের এই উগ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে আরো উগ্র মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে শুরু করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নানা ধর্মীয় উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন। পরবর্তী পর্বে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে।