পূর্ববর্তী আলোচনায় আশা করি চিহ্নিত করা গেছে যে রোহিঙ্গা আসলে কারা। এ পর্বে রোহিঙ্গা সংকটের সুলুক সন্ধানের চেষ্টা থাকবে। ১৭৮৫ সালে তিরিশ হাজার সৈন্য নিয়ে বার্মার আলাংপায়া বংশের রাজা বোধপায়া আরাকান আক্রমণ করে ক্ষমতা দখল করেন। আরাকানবাসী তখন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বর্মীবাহিনীকে স্বাগত জানায়। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বোধপায়ার নীতির কারণে বর্মীবাহিনী ও আরকানিদের মধ্যে শুরু হয় ঠান্ডা লড়াই। এ লড়াইয়ের কারণ নানাবিধ। শুরু হয় আরকানিদের ওপর বর্মীবাহিনীর নিপীড়ন। বোধপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে বহু রাখাইন পাড়ি দেয় বাংলাদেশে। তাদের অনেকেই এখনো চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীতে অবস্থান করছে।
. ১৮২৫ সালে বৃটিশদের দখলে চলে যায় আরাকান। বাংলাদেশে যেসব আরাকানি আশ্রয় নিয়েছিল, বৃটিশদের নীতির কারণে তাদের কিছু অংশ আবার আরাকানে ফিরে যায়। এই ফিরে যাওয়া মানুষদের মধ্যে রাখাইনরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল রোহিঙ্গারাও। বৃটিশদের শাসনামলে রোহিঙ্গারা তুলনামূলক সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল। এই কারণে বৃটিশদের প্রতি ছিল তাদের আনুগত্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা উপমহাদেশজুড়ে বৃটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে বার্মার থাকিন পার্টির নেতা-কর্মীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। বার্মার থাকিন পার্টিকে সমর্থন দেয় আরাকানের মগ জাতির নেতারাও। কিন্তু যোগ দিল না রোহিঙ্গারা। কারণ আগেই বলেছি, তারা বৃটিশদের কাছ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছিল। ফলে সৃষ্টি হলো বর্মী থাকিন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দূরুত্ব। এই দুরুত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে।
. এরই মধ্যে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানের আক্রমণের মুখে ১৯৪২ সালে বৃটিশরা আরাকান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বৃটিশদের সুযোগ-সুবিধাপুষ্ট রোহিঙ্গারা হয়ে পড়ল অসহায়। জাপান বাহিনীর সহায়তায় বার্মা ইন্ডিপেন্ডেট আর্মি (বিআইএ) রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়, যা ৪২-এর ম্যাসাকার হিসেবে খ্যাত। এ সময় প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য লাখ লাখ রোহিঙ্গা গিরিপথ দিয়ে উত্তর আরাকানে পালানোর সময় অনেকে মারা যায়। নাফ নদীতে ভাসতে থাকে রোহিঙ্গাদের লাশ। এ সময় অনেকে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পালিয়ে যায়। বৃটিশরা রংপুরের সুবীর নগরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য শিবির স্থাপন করে, যা এখনো রিফিউজি ঘোনা নামে পরিচিত।
. এরপর শুরু হলো জাপানিদের বিরুদ্ধে বর্মীদের আন্দোলন। গঠিত হয় এন্টি-ফ্যাসিস্ট অর্গানাইজেশন (এএফও)। ওদিকে বিএনএর সর্বাধিনায়ক জেনারেল অং সান তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। বিএনএ যোগ দিল বৃটিশ বাহিনীর সঙ্গে। ১৯৪৫ সালে সমগ্র বার্মা বৃটিশদের দখলে চলে এলো। এই যুদ্ধে এএফও, বিএনএ ও বৃটিশ বাহিনীকে নানাভাবে সহায়তা করে রোহিঙ্গারাও। কারণ তারা তখনো বৃটিশদের সুযোগ-সুবিধার কথা ভুলে যায়নি। জাপানিদের চেয়ে তারা বৃটিশদেরকেই আপন মনে করেছিল।
. ১৯৪৮ সালে বার্মা আবার বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। রোহিঙ্গারাও এই স্বাধীনতা আন্দোলনে জেনারেল অং সানকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু বর্মীবাহিনীর মধ্যে থেকে যায় সেই পুরনো ক্ষোভ―রোহিঙ্গারা একদা বৃটিশদের সর্বাত্মকভাবে সমর্থন দিয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সাময়িকভাবে মগ-রোহিঙ্গা দূরত্ব কমে এলেও স্বাধীনতার পর উভয়পক্ষের মধ্যে আবার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দূরত্বের কারণ সেই পুরনো ক্ষোভ। ১৯৪৭ সালে নতুন শাসনতন্ত্রিক পরিষদ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রণীত ভোটার তালিকায় আরাকানের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনপদগুলোকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে আবারও শুরু হয় সংঘাত। ১৯৪৮ সালে আবারও রোহিঙ্গারা হত্যাকা-ের শিকার হয়।
. তবে মো. মাহফুজুর রহমান তার ‘রোহিঙ্গা সমস্যা’ গ্রন্থে হাবিব উল্লাহকৃত ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’ গ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন, ‘মূলত বৃটিশ কর্তৃপক্ষই সাম্প্রদায়িক বিভেদের সূচনা করেছিল। রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গারা বৃটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করে জাপানিদের তাড়িয়ে দিলেও তারা প্রচার করে, Burma for the budhist burmans Ges Burmese এবং muslims are foreign immigrants or kalas. আরাকানে রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বিরুদ্ধে মগ সম্প্রদায় স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই প্রচারণাকে তুঙ্গে তুলতে থাকলে বর্মী সরকার পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ অভিযানে নামে। ফলে রোহিঙ্গারা আরাকানের বৈধ নাগরিক হয়েও বার্মার সংবিধানে নৃতাত্ত্বিক বা বুনিয়াদি জাতি হিসেবে তালিকাভুক্তির দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়।’ হাবিব উল্লাহর এই বক্তব্য বিচার-বিবেচনার অবকাশ আছে। বৃটিশ সরকারই যদি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে ১৯৪২ ও ১৯৪৮ সালে রোহিঙ্গারা কেন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল? তার মানে এই বিভেদের জন্য সম্পূর্ণভাবে বৃটিশদের দায়ী করা চলে না। এই বিভেদের শিকড় আরো গভীরে নিহত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে রোহিঙ্গারা যোগ না দেওয়াটাই বিভেদের মূল কারণ।
. এর পরের ইতিহাস কেবলই বঞ্ছনা, লাঞ্ছনা ও রক্তপাতের ইতিহাস। ১৯৪২ সালের রোহিঙ্গা গণহত্যার ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিজ বসতবাড়িতে পুনর্বাসেরন ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানালে, বর্মী সরকার রোহিঙ্গাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। সরকারি চাকরি থেকে রোহিঙ্গাদের অপসারণ করে মগদের নিয়োগ শুরু করে। ফলে রোহিঙ্গারা ধীরে ধীরে আন্দোলনমুখী ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আকিয়াব নিবাসী মোহাম্মদ জাফর হুসাইন ওরফে জাফর কাওয়াল এই আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি কাওয়ালি গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি সূচনা করেন ‘মুজাহিদ পার্টি।’ এই পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা শুরু করে আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে ১৯৫৪ সালে প্রধানমন্ত্রী উ নু রেডিওর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে স্বদেশী হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গারা প্রথম ভোটাধিকার লাভ করে সাতটি আসনে বিজয়ী হয়।
. ১৯৬০ সালে জেনারেল নে উইন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে এসে আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন। তখন প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে পালিয়ে আসে। পরে পাকিস্তান-বার্মার আলোচনার ভিত্তিতে উদ্বাস্তুরা আবার ফিরেও যায়। প্রধানমন্ত্রী উ নু-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৬১ সালে রোহিঙ্গা মুজাহিদরা অস্ত্র সমর্পণ করে। কিন্তু পরবর্তীকালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের ওপর আবারও নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ। অব্যাহত নিপীড়নের মুখে ১৯৭৩-’৭৪ সালে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর সংগঠতি হয় আপারেশন সেব, অপারেশন নাগামিন। সৃষ্টি হয় বর্মীবাহিনী ও তাদের সহযোগী মগদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আরো বেশি দূরত্ব। বর্মীবাহিনী ও তাদের সহযোগিরা হয়ে ওঠে আরো বেশি মারমুখ। পাল্লা দিয়ে রোহিঙ্গারাও মারমুখী হয়ে ওঠে। উভয়পক্ষের মারমুখীতা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যেতে থাকে। স্বাভাবিক কারণেই সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা হারতে থাকে। দেশ ছেড়ে পালাতে থাকে। ২০১৭ সালে এসেও চলছে সেই সংঘাত, সেই পলায়ন।
(চলবে)