রোহিঙ্গাদের উগ্র ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়েই বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দেশি-বিদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের অপতৎপরতা বাড়াতে সক্ষম হয়। রোহিঙ্গা মুক্তি আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সংগঠন ছিল রেহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও। বিশ শতকে এই সংগঠনটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ওভাবে ছিল না। সংশ্লিষ্টতা শুরু হয় একুশ শতকের গোড়া থেকে। এ শতকের গোড়া থেকেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শুরু হয় দেশি-বিদেশি নানা জঙ্গি সংগঠনের অপতৎপরতা। জামায়াতে ইসলামিও নানাভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর প্রভাব বিস্তারে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ঠিক ওভাবে সুবিধা করতে পারেনি। কারণ আদর্শিক কারণে মওদুদিবাদকে রোহিঙ্গারা নেতারা সমর্থন করে না। তাই বলে জামায়াত থেমেও থাকেনি, পরোক্ষভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সমর্থন দিয়ে গেছে, যাচ্ছে।
এক যুগ ধরে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের ওপর গবেষণা করছেন ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশে’র মহাসচিব হাসান রফিক। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে তিনি লিখেছেন কয়েকটি বই। মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছেন দীর্ঘদিন ধরে। তার গবেষণা মতে, বর্তমানে ৩০টিরও বেশি রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে সক্রিয়। কক্সবাজার ও বান্দরবানে বসবাসরত প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে টার্গেট করে পুরোদমে সক্রিয় এসব সংগঠন। উখিয়া, টেকনাফ, রামু, চকরিয়া থেকে শুরু করে বান্দরবানের অরণ্যঘেরা সীমান্ত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় রয়েছে তারা। রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিওচিত্র ও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে রোহিঙ্গাদের দলে টানার চেষ্টা করছে। এ সংগঠনগুলো পৃথক কার্যক্রম চালালেও তাদের লক্ষ্য প্রায় অভিন্ন।
আগেই লিখেছি, ‘বেগানা’ উপন্যাসটি লেখার আগে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শনে যাই আমি। কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির যখন দেখতে যাই, পরিচয় হয় রোহিঙ্গা যুবক মোখতেয়ারের সঙ্গে। তার কাছ থেকে জানতে পারি রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা ‘আরএসও’ সম্পর্কে। সে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল হাফেজ সালাহুল ইসলাম নামের এক মৌলানার কাছে, যে কিনা আরএসও স্থানীয় নেতাদের একজন। আরএসও সম্পর্কে আমি কৌতূহলী হই। মোখতেয়ারের কাছে গোপন ইচ্ছা ব্যক্ত করি : আমি আরএসও কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ভাণ্ডার দেখতে চাই। দুই হাজার টাকার লোভে আমার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেনি মোখতেয়ার। অচেনা আরো চার যুবকের সহযোগিতায় সে আমাকে নিয়ে যায় বুচি পাহাড়ে। সেই পাহাড়ের নাম বুচি পাহাড়, বলেছিল সে। আদৌ সেই পাহাড়ের নাম বুচি পাহাড় কিনা আমি নিশ্চিত নই। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার পর, রাতের অন্ধকারে। বুচি পাহাড়ের এক চাপড়াঘরে দেখেছি আরএসও অস্ত্র ভা-ার। এমজি, এলএমজি, স্টেনগান, গ্রেনেড ইত্যাদি। এখন ভেবে আশ্চর্য হই, কোন সাহসে আমি সেদিন সেই অস্ত্রভাণ্ডার দেখতে গিয়েছিলাম! আমাকে যদি তারা মেরে ফেলত! যদি তারা আমাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করত! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করতে পারছি, ২০১১ সালের চেয়ে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের অস্ত্রভাণ্ডার এখন আরো বেশি সমৃদ্ধ।
রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর লক্ষ্য কী? মোটা দাগে ৪টি লক্ষ্য : এক. আরাকানে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, দুই. রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি হিসেবে আরাকানকে স্বাধীন করা, তিন. বাংলাদেশের কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অংশ ও আরাকান নিয়ে একটি স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। চার. আরাকানে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্যে যেসব সংগঠন কাজ করছে সেগুলো হচ্ছে―রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), হরকাতুল ইয়াকিন, আকামুল মুজাহিদিন আরাকান, ফেইথ মুভমেন্ট অব আরাকান, রোহিঙ্গা আজাদি ফোর্স, জমিয়তে ইত্তেহাদুল রোহিঙ্গা, জমিয়তে ইত্তেহাদুল ইসলাম, আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন, বার্মা আরাকান অর্গানাইজেশন ইউকে, ভয়েস অব রোহিঙ্গা ইউনাইটেড, রোহিঙ্গা রিফিউজি হিউম্যান রাইটস, আরাকান পিপলস ফ্রিডম পার্টি, অ্যাসেম্বলি অব রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন, আরাকান রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট ডেমোক্রেসি অ্যাসোসিয়েশন, আরাকান ইউনাইটেড ফোর্স, আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান লিবারেশন ফ্রন্ট (এএলপি), আরাকান পিপলস আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা ফোর্স, সাওতুল্লাজিন, ইত্তেহাদুল ইসলাম প্রভৃতি।
রোহিঙ্গা ভিত্তিক এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো হচ্ছে―জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ-বি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, শহীদ হামজা ব্রিগেড, আইএস, দাওয়াতে ইসলাম, পাকিস্তানের সংগঠন জামাত-আল-পাকিস্তান, ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলে সক্রিয় পাকিস্তানের মদদপুষ্ট সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ, জুম্ম হিজাব-উল-মুজাহিদিনি, হরকাতুল জিহাদ-আই, লস্কর-ই-তৈয়বা, আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা। অপরদিকে, যারা এসব জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন তারা হচ্ছেন―মাস্টার আইয়ুব, মৌলভী নুর হোসেন, আবু বক্কর, মৌলভী শফিক, ড. ইউনুস, ড. ইউনুসের সহোদর আবু তাহের, মো. ইউনুছ, মৌলভী মো. সেলিম ওরফে আবু আবদুল্লাহ, মোস্তাক মাঝি, রুহুল আমিন, হারুন, নেজাম, জকির আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ উল্লাহ, হাসান, মো. আয়াছ, নুর আলম, আবদুল হাকিম, নজির আহমদ, বশির আহমদ, হোসেন আহমদ, কেফায়েত উল্লাহ, মাস্টার রশিদ, খোরশেদ, মাহামুদুল হাসান, দুদু মিয়া প্রমুখ। এসব রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনকে মধ্যপ্রাচ্য ও তুরস্ক ভিত্তিক নিবন্ধিত ও নিষিদ্ধ কিছু এনজিও গোপনে ও প্রকাশ্যে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে? সহযোগিতা দেওয়ার উদ্দেশ্য যতটা না মানবিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। এসব এনজিও চায় আরাকানকে কেন্দ্র করে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলাই ছিল রোহিঙ্গাদের নিয়ে গঠিত সংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় ভুল। ভুল পাঁকে পা দিয়ে সংগঠনটির নেতারা নিজেদের রোহিঙ্গা পরিচয়ের চেয়ে মুসলিম পরিচয়টাকে প্রধান করে তোলে। রোহিঙ্গা সংকট সম্পূর্ণ জাতিগত। নিজভূমিতে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিগত অর্ধ শতক ধরে যেসব সংগঠন লড়াই করছে সেসব সংগঠনকে এরইমধ্যে ইসলামি মুখোশ পরিয়ে দিতে মোটামুটি সক্ষম হয়েছে পাকিস্তানি আইএসআই, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, সামাজ্যবাদী শক্তি ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো। রোহিঙ্গা তাদের জাতিগত পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, পারছে না। এ জন্য সাধারণ রোহিঙ্গারা মোটেই দায়ী নয়, দায়ী রোহিঙ্গাদের নিয়ে গঠিত এসব জঙ্গি সংগঠনগুলো, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইসহ এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো।
একথা অস্বীকারার করার উপায় নেই যে, পৃথিবীজুড়ে মুসলিম জঙ্গিরা যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তাতে গোটা মুসলিম সমাজ এখন বিতর্কিত। মুসলমান নির্যতিত হচ্ছে―একথা বলে এখন আর বিশ্ববাসীর সিম্পেথি পাওয়া যায় না। রেহিঙ্গা একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয়ের চেয়ে যদি জাতিগত পরিচয়টিকে পরিচয় করে তুলত, তাহলে সর্বাত্মকভাবে তারা বিশ্বের অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর সমর্থন পেত। কিন্তু এখন সেভাবে পাচ্ছে না। অনেকেই মনে করছেন, রোহিঙ্গারা তো মুসলমান। খারাপ। মরুক।
অপরদিকে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গদের কখনো বলছে ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’, কখনো বলছে ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’। ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’ কিন্তু বলছে না। বললে তো আটকে যাবে। এসব মহলের ফাঁদে পা দেওয়ায় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোনোকালে হবে না। রোহিঙ্গা একটি স্বয়ম্ভূ জাতি। তারা বাংলা থেকে আরাকানে গিয়েছিল, নাকি আরব থেকে গিয়েছিল―এই বিতর্ক এখন অসার। তারা যেখান থেকেই ওখানে যাক না কেন, হাজার বছরের ব্যবধানে তারা এখন স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের সংকটকে চিহ্নিত করতে হবে জাতিগত সংকট হিসেবে, কোনোভাবেই ধর্মীয় সংকট হিসেবে নয়। তারা বাঙালি নয়, তারা রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো যে এই ভুল পাঁকে পা দিল তার প্রধান কারণ নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন তাদের কোনো নেতা না থাকা। তাদের জন্য প্রয়োজন ছিল আব্রাহাম লিংকন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহাত্মা গান্ধী বা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো একজন নেতার, যিনি রোহিঙ্গাকে একটি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে রোহিঙ্গাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন। উপরে যেসব নেতার নাম লিখেছি তাদের মধ্যে নেতৃত্বের তেমন কোনো গুণাবলী নেই। রোহিঙ্গারা তাদের কথা শোনে না। তা ছাড়া এসব নেতাদের অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে অর্থ সহায়তা আনে। কিছু অংশ রোহিঙ্গাদের দেয় আর সিংহভাগ অংশ নিজেরা আত্মসাৎ করে। নিজেদের আখের গোছায়। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের দায়ে দাণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশিম আলী যে রোহিঙ্গাদের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল একথা সবার জানা।
বাংলাদেশে যে বর্তমানে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে মোটেই ঐক্যবদ্ধ নয়। না হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, তারা তাদের বর্তমান অবস্থাতেই মোটামুটি খুশি। আরাকানে তাদেরকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করে সংসার চালাতে হয়। বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে তো পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। প্রতি মাসে মাসে বিশ্বের বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে পাচ্ছে চাল, ডাল, আটা, লবণ, তেল, সাবান ইত্যাদি। তাতে তারা অন্তত না খেয়ে থাকছে না। পরিশ্রম না করেই মোটামুটি চলে যাচ্ছে তাদের দিন। পরিশ্রম না করে যদি কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা যায়, তবে কে করতে যায় বিপ্লব? আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষরা কেবল খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যে কারণেই হোক, রোহিঙ্গাদের সেই আত্মমর্যাদা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে তারা যে অবস্থায় রয়েছে, এই অবস্থাকে তারা আরাকানের অবস্থার চেয়ে ভালো মনে করছে। পরিশ্রম না করে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে এক ধরনের আলস্য মাথাচাড়া দিয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে কোনোভাবেই স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা জাগিয়ে তোলা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদেরকে যেসব এনজিও সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছে তারাও চায় না রোহিঙ্গারা নিজদেশে ফিরে যাক। গেলে যে এসব এনজিওর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে!