কেন এমন হয় আজকাল। বুকের ভেতরে খুব ঠান্ডা কিছুর ছোঁয়া যেন। মাঘমাসের কুয়াশাজড়ানো ভোরে পুকুরের জল যেমন, সে রকম কিছু বুকের ভেতরে খেলা করে। সমস্ত শরীরজুড়ে সেই শৈত্য মহাধমনী হয়ে কোষে কোষে পৌঁছে যায়। শরীর আড়ষ্ট হয়ে আসে। শুধু মনে হয় কোথাও মহাপরিণাম অপেক্ষা করে আছে। সংসারের চলমানতাকে থামিয়ে দেবে বলে, জীবন থেকে সমস্ত উষ্ণতা কেড়ে নেবে বলে, পৃথিবীর সব সবুজ লাবণ্যকে হলুদ করে দেবে বলে কোথাও খুব গোপনে কাজ চলছে।
অরূপ প্রথমে ভেবেছিল কম্পিউটারে বেশিক্ষণ কাজ করার জন্য চোখে ব্যথা হচ্ছে। সবাই যেমন বলে, টানা কিছুক্ষণ কাজ করার পর একটু বিশ্রাম, সবুজ গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকা – সে রকম করতে শুরু করেছিল। তারপর একদিন দোল-পূর্ণিমার রাতে ছাদে বসে নীপার সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল – ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান। হঠাৎ আকাশে তাকিয়ে সে দেখতে পেয়েছিল চাঁদের চারপাশে রামধনুর সাত রং নিয়ে একটা বৃত্ত। সে কথা শুনে নীপা খুব অবাক হয়ে বলেছিল – কই, না তো। তারপর একদিন বাসের হেডলাইটের চারপাশে সে রকম রঙিন বৃত্ত দেখল। কিন্তু অরূপ খুব অবাক হয় যে, এই রামধনু নীপা দেখতে পায় না।
এক রাতে অরূপের চোখে অসহ্য ব্যথা শুরু হলে হঠাৎ অরূপের মনে হল এই ব্যথার সঙ্গে আলোর চারপাশে রঙিন বলয় দেখার কোনও সম্পর্ক আছে। পরদিনই সে নীপাকে কিছু না জানিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। জানতে পেরেছিল রক্তের চাপের মত চোখের ভেতরের তরলেরও চাপ তৈরি হয়। কোনও কারণে সেই তরলের চলাচলের পথ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে দৃশ্যের অনুভূতি বহনকারী নার্ভগুলো অকেজো হয়ে যায়। অন্ধ হয়ে যায় মানুষ। এই অসুখের নাম গ্লকোমা। তার বাঁ চোখ প্রায় অকেজো হয়ে এসেছে। ডানচোখটাও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত। তার দু’চোখের তরলের চাপ অস্বাভাবিক বেশি।
আশ্চর্য ! সে এতদিন কিছুই টের পায়নি। মাঝে মাঝে মনে হত বটে বাঁ দিকের কিছু যেন সে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সে ভেবেছিল সাময়িক কোনও সমস্যা হয়তো। এখানে, বিভিন্ন পরীক্ষার পর যে ছবিগুলো পাওয়া গেল, ডাক্তার সেনগুপ্ত দেখিয়ে দিলেন – এই দেখুন ফিল্ড ভিশান টেস্টের রিপোর্ট। যতটুকু ভিশান নষ্ট হয়েছে, সে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। যতটুকু আছে, আমাদের এখন চেষ্টা করতে হবে সেটুকু রক্ষা করা। এত কেয়ারলেস কী করে হলেন আপনি। অনেক দেরি করে ফেলেছেন আপনি।
প্রথমে লেসার ট্রিটমেন্ট করা হ’ল। এক একটি আলোর কণা বুলেটের মত ছুটে এসে জল বেরিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করার চেষ্টা করছিল। তারপর প্রেশার মেপে দেখা গিয়েছিল লাভ হয়নি। শেষ উপায় ছুরি চালিয়ে জল বেরিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করা। তাই করা হ’ল। সেপ্টেম্বরের দশ তারিখে অরূপের চোখে অপারেশন হ’ল। যতটুকু দৃষ্টিশক্তি অবশিষ্ট ছিল, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এ ছাড়া পথ ছিল না। অরূপের দু’চোখে ব্যান্ডেজ। আজ সকালে সে নার্সিং হোম থেকে বাড়িতে এসেছে। শুয়ে ছিল। পাশে নীপা। তখন সে টের পেল বুকের ভেতরে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ।
শব্দ বন্ধ করে টিভি দেখছিল নীপা। চামচ দিয়ে অরূপকে খাইয়ে দিয়েছে। ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর অরূপ তাকে ব্যাপারটা খুলে বলেছিল। তখন নীপার মনে পড়েছিল কী ভাবে একদিন অরূপ তাকে বেশ জোরে ধাক্কা দিয়ে বলেছিল – সরি, একদম খেয়াল করিনি। টেবিলের বাঁ দিকে জলের গ্লাস দেখতে না পেয়ে তাকে বকাবকি করেছিল। সেদিন নীপা তাকে বলেছিল – অন্ধ নাকি। এই তো গ্লাস এখানে রয়েছে। সত্যি তা হলে অরূপ দেখতে পায়নি। ডাক্তার সেনগুপ্তের কথা মনে পড়ল। গ্লকোমা ঠিক সময়ে ধরতে না পারলে ফেটাল। অবধারিত ব্লাইন্ডনেস। শুনে নীপার বুক কেঁপে উঠেছিল। যেটুকু লস হয়েছে, কিছু করার নেই। বাকিটা অ্যারেস্ট হয়ে যাবে। তবু নীপার ভয়ে কাটেনি। আশ্চর্য ! লোকটা নিজে বুঝতে পারেনি তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। অফিসেও সেই কম্পিউটার নিয়ে কাজ। বাড়িতে এসে আবার কম্পিউটার। টাইপ করে যাচ্ছে, না হয় গুগল্ সার্চ করে যাচ্ছে। উত্তেজিত হয়ে তাকে ডেকে বলছে – নীপা, দেখে যাও। এই দ্যাখো আমাদের শহর। দাঁড়াও, আরও ক্লোজ করছি। ওই যে ট্রায়াঙ্গেলটা লক্ষ করো, আমাদের সুকান্তপল্লী।
অরূপ মাথা নেড়েছিল। তাদের বংশে কারও গ্লকোমা ছিল কিনা, তার জানা নেই। ডাক্তার সেনগুপ্ত অনেকগুলো কারণ বলেছিলেন। হতে পারে অল্প আলোয় কিংবা ভুল পশ্চারে বসে দীর্ঘক্ষণ বই পড়ার জন্যই তার এই অসুখ। নাকি ডাক্তারবাবু মানুষের শরীরের যে রহস্যময়তার কথা বলেছিলেন, অজানা এক বিশাল কর্মজগৎ, কার্যকারণ সম্পর্কহীন কত ঘটনা ঘটে যায়, স্ক্যান, এম আর আই, এক্স-রে, মাইক্রোস্কোপ যার নাগাল পায় না – সে রকম কিছু ঘটেছে তার চোখের ভেতরে। তার চোখের সামনের নাবাল জমি জল থইথই। অ্যাকোয়াস হিউমারের প্রচন্ড চাপে স্নায়ুপথ ভেঙে পড়েছে। সে আর বাইরের দৃশ্য মগজে পৌঁছে দিতে পারছে না। মানুষ তো আসলে মগজ দিয়েই দ্যাখে। চোখদুটো তো খোলা জানালা শুধু।
অ্যাই, শুনছ – বলতে গিয়েও নীপা থেকে গেল। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন ক’টা দিন যেন কোনও রকম শারীরিক বা মানসিক উত্তেজনা না ঘটে। মানে কোনও এক্সাইটমেন্ট। নীপা মাথা নিচূ করে ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল ডাক্তারবাবু কী বলতে চাইছেন। অতিরিক্ত জল বার করে দেবার জন্য ডাক্তারবাবু ছুরি চালিয়ে খাল কেটে দিয়েছেন। এ সময়ে উত্তেজনা কুমির ডেকে আনতে পারে।
নীপা প্রথমে ভেবেছিল টিভিতে মজার দৃশ্য হচ্ছে। এ রকম অনুষ্ঠান সে আগেও ক’বার দেখেছে। আছাড় খেয়ে পড়া, বাড়ি ভেঙে পড়া, কার-অ্যাক্সিডেন্ট, বিমান-দুর্ঘটনা। এসব দেখে নীপা কখনও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে, কখনও একা একাই হেসেছে। অরূপ হয়তো তখন কম্পিউটারের সামনে বসে গল্প লিখে চলেছে।
নীপা দেখল এরোপ্লেনটা সোজা বিশাল উঁচু বাড়িটার পেটের ভেতরে গোত্তা মারল। বাড়িটা ভেঙে পড়ছে। তাসের ঘরের মত বাড়িটা ধ্বসে পড়ছে। কুয়াশার মত ধুলো ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। আতঙ্কে দিশাহারা মানুষজন দৌড়ে পালাচ্ছে। এটা নতুন দৃশ্য। এই দৃশ্য এর আগে টিভিতে নীপা কোনও দিন দ্যাখেনি। নরম মাখনের ভেতরে যেমন একটা ধাতব ছুরি অক্লেশে ঢুকে যায়, ঠিক তেমন করে একটা অনেক উঁচু বাড়ির ভেতরে প্লেনটা ঢুকে পড়ছে।
নীপা তখনও জানত না ওই বাড়িটাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। সে বুঝতে পারছিল না, এটা কি সত্যি কোনও ঘটনা, নাকি যান্ত্রিক কলাকুশলতায় তৈরি মিথ্যে কোনও ছবি। ছবিটা বারে বারে দেখানো হচ্ছিল। তখন থেকেই নীপা টের পেতে শুরু করে তার শরীর কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। চ্যানেল পালটে সে আপাত-নিরাপদ একটা নিউজ চ্যানেলে এসে টিভির শব্দ আবার খুলে দিল। এবার অরূপ শুনতে পেল জঙ্গী আক্রমণে টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়ার কথা। পেন্টাগনের ওপর আত্মঘাতী হামলা, এমন কী একটুর জন্য হোয়াইট হাউস রক্ষা পাওয়ার কথা। উঠে বসল অরূপ।
-- নীপা, শুনছ ?
-- উঠলে কেন ?
নীপা বলতে পারল না সেও দেখেছে। প্রত্যেক চ্যানেলে এখন ক্রমাগত একই ছবি দেখিয়ে চলেছে।
-- ভল্যুমটা একটু বাড়িয়ে দাও না। নিশ্চয় ছবিও দেখাচ্ছে। বলো নীপা, তুমি তো দেখতে পাচ্ছ। প্লিজ বলো, কেমন করে ভেঙে পড়ছে টুইন-টাওয়ার। রিলে করো নীপা।
-- তোমার এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে। চোখের ক্ষতি হতে পারে। আমি বরং টিভি বন্ধ করে দিচ্ছি। তুমি শুয়ে পড়ো।
-- না। টিভি বন্ধ করবে না। দেখতে পাচ্ছি না বলে কি তোমাদের সংসার থেকে আমাকে বাতিল করে দেবে ?
নীপা টের পেল শুধু অভিমান নয়, অরূপের কথাগুলোর ভেতর এক রকম আক্রোশ লুকিয়ে আছে। নীপার নরম শরীরের ভেতরে এক রকম ধাতব-শীতল তীক্ষ্ণতা নিয়ে শব্দগুলো ঢুকে পড়ল।
-- রেগে যাচ্ছে কেন, তোমার ভালোর জন্যই তো বললাম। আর, খবর তো শুনতেই পেলে। আমেরিকার অনেকগুলো জায়গায় আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। ওদের অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক দম্ভের মিনারগুলো টার্গেট ছিল। কয়েক হাজার লিটার পেট্রোল নিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পেটের ভেতরে ঢুকে পড়েছে প্লেন। সব চ্যানেলে বার বার দেখাচ্ছে।
-- ইশ নীপা, আমিই দেখতে পেলাম না। এমন সময়েই আমার চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হল ...
-- বলো যে এমন সময়েই ঘটনাটা ঘটল। দু’দিন আগে বা পরে হলেই দেখতে পেতে।
-- সান্ত্বনা দিচ্ছ আমাকে ? আমি যা বলব, তার ওপর তোমার একটা মন্তব্য করতেই হবে। নইলে মনে করো হেরে যাচ্ছ। তুমি কি ভাবছ আমি অন্ধ হয়ে গেছি ? এ লোকটার ইচ্ছে-অনিচ্ছে, কোনও কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার এখন আর কোনও দরকার নেই।
-- তুমি কি চাইছ ? তোমার চোখের ব্যান্ডেজ আমি খুলে দেব ? যাতে তুমি ওই ভেঙে পড়ার ছবি দেখতে পাও। ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছ না ? আমি তো পাচ্ছি।
রাতেও চামচ দিয়ে অরূপকে খাইয়ে দিল নীপা। হাত ধরে বাথরুমে পৌঁছে দিল। পোশাক পালটে দিতে গেলে অরূপ গম্ভীর হয়ে বলল – থাক, আমি পারব। শোয়ার পর অরূপের চোখে সাদা ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে খুব সাবধানে আঙুল বুলিয়ে দিলে অরূপ আপত্তি করল না। তারপর নীপার যখন মনে হল অরূপ বোধহয় ঘুমিয়েছে, নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে টিভি চালিয়ে দিল। শব্দ নেই, শুধু ছবি। সমস্ত চ্যানেলজুড়ে সেই এক ছবি। একই দৃশ্য। জ্বালানিভরা একটা ধাতব তীক্ষ্ণতা বিশাল উঁচু অহংকারের মত টুইন-টাওয়ারকে বিদ্ধ করছে। একরাশ কুয়াশার মত ধুলো আর ধোঁয়া।
দেখতে দেখতে তার কেমন মোহ আসে। মুগ্ধতায় আবিষ্ট হতে থাকে নীপা। আর কী আশ্চর্য ! প্রথমবার এই দৃশ্য দেখার সময় তার শরীর যেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল, ঘাম হচ্ছিল – তেমন হচ্ছে আবার। মাখনের পিন্ডের ভেতরে ছুরি ঢুকছে। মাখন গলে গলে পড়ছে। ধুলো হয়ে যাচ্ছে মাখনের ঘরবাড়ি। নীপা অরূপের চুলের ভেতরে বিলি কাটছে এখন।
সে এখন কী করবে ? নীপা চাইছিল অরূপকে জাগাতে। মনে হচ্ছিল অরূপের শরীরের সঙ্গে একটা চূড়ান্ত সংঘর্ষের জন্য তার শরীর ক্রমশ ভয়ঙ্কর ভাবে জেগে উঠতে চাইছে। অথচ কোনও উপায় নেই। গতকাল রাতেই তার চোখে অপারেশন হয়েছে। আজ যে কোনও রকম উত্তেজনায় অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ডাক্তারবাবু ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন।
ওদের দু’জনের মাঝখান দিয়ে অন্ধ সময় বয়ে যায়। সুচতুর বাতাস বয়ে যায়। কাল যখন অন্ধ, স্থান এবং পাত্রকেও সে অন্ধ করে দিতে চায়। বন্ধ্যা হোক অরূপ-নীপার বিছানা। পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ জন্মবীজ নিয়ে, পৃথিবীর সব নারী জন্মাধার নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকুক অনন্তকাল।
আরও পর, রাত যখন আরও ঘন, যখন অরূপের মনে হল নীপা নিশ্চয় ঘুমিয়েছে, বিছানা ছেড়ে উঠে হাতড়ে হাতড়ে রিমোট খুঁজে বার করল অরূপ। টিভি চালিয়ে দিল। পরিচিত পথে গিয়ে স্ক্রিনের ওপর হাত রাখল। মিউট করেনি, শব্দ শোনা যাচ্ছিল। একটু আগে যেমন নীপা তার চোখে, চুলে, বুকে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছিল, ঠিক তেমন করে সে টিভির স্ক্রিনের ওপর হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। তার পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হয়ে উঠছিল। অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে।
গাঁক গাঁক করে কেউ ইংরেজিতে কথা বলছে। ঘুম ভাঙতেই নীপা দেখল অরূপ টিভির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে মনিটরের ওপর সে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। দেখুক – মনে মনে ভাবল নীপা। তার মনেই ছিল না অরূপ এখন কিছু দেখতে পাচ্ছে না।