ইপ্সিতা বলল নবারুণ পথ নিয়ে লিখতে। বেশ কিছুক্ষণ ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি, সারা পৃথিবী জুড়ে জ্ঞানীগুণী বন্ধুবান্ধবদের ফোন করেও যখন উদ্ধার হল না ‘নবারুণ পথ’টা কী, তখন বাধ্য হয়ে ইপ্সিতাকেই জিজ্ঞেস করলাম, ও এমন লেখকের লেখা চায় কিনা, যে লেখার বিষয়টা কী সেটাই জানে না। তখন খোলসা হল, ও চায় আমি নবারুণের লেখা পড়ে মেয়েদের কেমন লাগে তাই লিখি। এবার হল নতুন মুস্কিল। নবারুণের লেখা পড়ে মেয়েদের আলাদা করে কী লাগবে তা তো ভেবে দেখিনি। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, ও নিশ্চয় গালিগালাজের কথা বলছে। আর জিজ্ঞেস করিনি, লিখেই ফেললাম। দেখা যাক নবারুণ স্ত্রীপাঠ্য কিনা।
নবারুণ শেষ পড়েছি দশ বছর আগে? ফ্যাতাড়ু আর হারবার্ট ছাড়া মনে আছে ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। তাই পড়লাম নবারুণ আবার। উপন্যাস সমগ্রে ভরা ‘হারবার্ট’, ‘ভোগী’, ‘লুব্ধক’, ‘খেলনা নগর’ আর ‘কাঙাল মালসাট’। যে আমি আর ধৈর্য ধরে উপন্যাস পড়তে পারি না, পড়ে ফেললাম এতগুলো উপন্যাস। প্রত্যেকটা উপন্যাস অন্তত একটা করে লেখা দাবি করে। তাই শুরু করি সবচেয়ে পরিচিত দুটি দিয়ে।
‘হারবার্ট’ আর ‘কাঙাল মালসাট’। ‘হারবার্ট’ আমার মতে বাংলা ভাষার উপন্যাসের একটা মাইলস্টোন। সাধারণত মার্কামারা স্ত্রীপাঠ্য উপন্যাসের মধ্যে পড়ে বলে মনে হয় না। প্রসঙ্গত, ‘স্ত্রীপাঠ্য’ শব্দটি আমার গালাগাল হিসেবে ব্যবহৃত বলেই মনে হয়। কারণ আপনারা সম্ভবত জানেন, আর সন্দেহ থাকলেও সেকথা পরে হবে। এখন ‘হারবার্ট’ যে আমার বেশ সুখপাঠ্য লাগে এবং তাকে সেই লজিকে ‘স্ত্রীপাঠ্য’ এর দলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল কিনা সে আপনারা ঠিক করুন। হারবার্টের মতো কোন লোকের কাছাকাছি আসার ভাগ্য আমার হয় নি তাই সত্য-মিথ্যা-কল্পনার তুলনা দিতে পারবো না। ব্যক্তিগতভাবে বামপন্থী, যুক্তিবাদী পরিবেশে বড় হয়েছি, চিরকাল যুক্তিবাদীদের দলের পাল্লাই ভারী করেছি। কিন্তু হারবার্ট-এ যুক্তিবাদীদের অসংবেদনশীলতা ছাপ রেখে যায় আমার মনে। পাঞ্চলাইন ‘কখন কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে’ –র থেকেও বেশি। হারবার্ট নিয়ে আবার কথা হবে।
‘কাঙাল মালসাট’ কে একটু ছুঁয়ে যাই। এই ফ্যাতাড়ু “হিরো-মান্বিত” উপন্যাসটিতে না-এলিট শব্দের যথেচ্ছ চাষ, যথাযথ-ও। পুরন্দর ভাট আমার বেশ প্রিয় কবি। তিনি আমায় ফেসবুকে ভাষা যোগান। অনেক চুটকিতেই এমন কিছু পাই যা শঙ্খ ঘোষে মেলে না। এখানে একটা স্মাইলি ফেস দিলাম। এবার আসি গদ্যে। পড়তে খারাপ লাগে না, নিজের অজান্তেই মুখে হাসি আসে, কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে ক্লান্ত লাগে। হয়ত মধ্যবিত্ততা একটা কারণ। কিন্তু সবটা নয়। ভূত, প্রেত, ম্যাজিক আর নানা ধরণের রিয়েলিস্টিক ও কাল্পনিক মানুষ মিশিয়ে তাঁর (চন্দ্রবিন্দু লক্ষ্য করুন) এই লেখা এক ধরণের পাঠকদের (চন্দ্রবিন্দু নেই তাও লক্ষ্য করুন) জন্য। ভীষন টারগেটেড। প্রচণ্ড উৎসাহ পশ্চাতদেশে (আমাকে মেরে ফেললেও আমি চন্দ্রবিন্দু দেওয়া শব্দটি ব্যবহার করব না), পশ্চাতদেশ রিলেটেড শব্দ, বস্তু, বাঁকা আনন্দ সবেতেই বেশ আগ্রহ। এর সাথে রয়েছে অপরিসীম নেশা-ভাঙ। মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে মনে হয়, হয়ত বা এলিট (পড়ুন তথাকথিত পরিশীলিত) পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে, নবারুণ অনেক কাছ থেকে দেখেছেন তার ফাঁপা দিকটাকেও। চাপিয়ে দেওয়া স্ট্যান্ডার্ড আর স্বঘোষিত সুপিরিওরিটি নবারুণকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। ভাষায় বিদ্রোহ বিরাট হাতিয়ার। রয়ে যায় বহুদিন, বয়ে যায় বহুদূর। আর তিনি সফল সে কাজে। এর সাথে নবারুণ কাল্টপ্রেমী। নবারুণের ম্যাজিক রিয়েলিজম, ম্যাজিক ফিচারে ভরা, যা তিনি রকীয় ভাষার সাথে ব্যবহার করেছেন লেখ্য এবং আনুষ্ঠানিক কথ্য ভাষাকে ভেঙে দেওয়ার জন্য।
নবারুণের এই নতুন সৃষ্টিরা বই-অনুমোদিত ভাষায় কথা না বলেও বইপাড়া দাপিয়ে বেড়ায় নতুন-পুরোনো পাঠককুলের হাত ধরে। তাই ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর লেখার ‘কাল্ট’ বা ম্যাজিক রিয়েলিজ¬¬ম বা অত্যাধিক রকবাজি দ্বারা থ্রিলড না হলেও, তাঁর লেখাকে অস্বীকার করা শক্ত। না পরে ফেলে রাখা শক্ত।
নবারুণের লেখা নিয়ে লেখা কয়েক ঘন্টার কাজ নয়। নবারুণের অন্য লেখাগুলিও একটা অন্যটার মত নয়। তাছাড়াও আমার একার বক্তব্যও ঠিক, “মেয়েদের কেমন লাগে” কে রিপ্রেসেন্ট নাও করতে পারে। তাই এই লেখাটা একটা প্রজেক্টের শুরু। আমার বেশ কিছু বন্ধুকে দিয়েছি নবারুণ পড়তে। শিগগিরি ফিরে আসব তাদের নিয়ে, তাই ছেদচিহ্ন দিলাম না