এ এক অদ্ভুত কাল। চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ক্ষমতাসীন, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং ছক বাঁধা রাজনীতির বাইরের মানুষও একই সাথে ‘অভয়ার ন্যায়বিচারের’ দাবিতে রাস্তায়। বর্তমান প্রবল বিক্ষুব্ধ সময়েই, অভূতপূর্ব এক আহ্বান নাড়া দিয়ে গেছে দেশের উঠোন পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে– ‘মেয়েরা রাত দখল কর’। স্বাধীনতার রাতে নারী, ভিন্ন যৌনতার, লিঙ্গ-পরিবর্তনকামী, কুইয়্যার মানুষদের ডাকে, শহর কলকাতার বহু জায়গায়, বহু শহরে জড়ো হয়েছে, শ্লোগানে মুখর হয়েছে সহস্র মানুষ। ক্ষমতা দখলের দলীয় রাজনীতিকে পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়ে বঙ্গ জুড়ে এক অভূতপূর্ব, অনন্য সাধারন যে নাছোড়, রাগী নাগরিক কণ্ঠস্বর উঠে এসে রাস্তার দখল নিয়েছে এবং সময়ের সাথে যা নিভে যাওয়ার বদলে ক্রমেই আরও উচ্চকিত হয়ে উঠেছে দিনে দিনে, তাতে কুৎসিত, ব্যক্তিস্বার্থ পরিবৃত দলীয় রাজনীতি শঙ্কিত, দিশেহারা। শহর কলকাতা শুধু নয়, বিভিন্ন মফস্বলে, বহু রাজ্যের নানান স্থানে, এমন কি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জায়গায়, লিঙ্গ নির্বিশেষে, সমাজের নানান অংশের সাধারণ মানুষের এমন প্রতিবাদ প্রায় একই সাথে, একই সুরে ধ্বনিত হয়েছে এমন নজির নিতান্তই অপ্রতুল।
সামগ্রিকভাবে, এদেশের নারী, বিশেষত রূপান্তরকামী, ভিন্ন যৌনতার মানুষদের প্রতি ঘৃণ্য সামাজিক বিরূপতা তথা পারিবারিক এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, নির্যাতনের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই সামগ্রিক সামাজিক কণ্ঠস্বর অবশ্যই নতুন রাজনৈতিক বোধের জন্ম দেয়, যা ঠিক ক্ষমতাসীন কোনও দল বিশেষের বিরুদ্ধে নয়, বরং সামগ্রিকভাবে প্রচলিত রাজনৈতিক পরিসরের সমস্ত ক্ষমতান্ধ দলগুলো এবং প্রচলিত পুরুষ আধিপত্যবাদী সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, পিতৃতান্ত্রিক, সর্বনিয়ন্ত্রক ক্ষমতার ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে এক গণ প্রতিবাদ। প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বাইরে অজস্র সামাজিক সংগঠন, নারী অধিকার সংগঠন, মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠন, বিশেষত চিকিৎসকদের সংগঠন, এমন কি প্রান্তিক মানুষের আওয়াজ, সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে, প্রকৃত দোষীদের শাস্তির দাবিতে, সর্বোপরি প্রচলিত সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত স্বর তুলেছে, প্রায় প্রতিদিনই মিছিল নিয়ে পথের দখল নিচ্ছে।
এমন বিসদৃশ, অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলা গণ বিক্ষোভের আঁচে দিশেহারা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ অধিবেশন ডেকে, ধর্ষকের কঠোর শাস্তির জন্য বিধানসভায় বিশেষ একটি বিল (Aparajita Woman and Child (West Bengal Criminal Laws Amendment) Bill, 2024) পাশ করালেন ৩রা সেপ্টেম্বরে। মজার ব্যাপার, তিলমাত্র বিতণ্ডা না করে সভার উভয় পক্ষই সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাশ করেছে। বিরোধী বিজেপিরও দেখানো দরকার ছিল ধর্ষণ অপরাধ কমাতে তারাও কতো উদগ্রীব। কারণ, সম্প্রতি অসরকারী সংস্থা এডিআর-এর প্রকাশিত তথ্যে, সারা দেশের নিরিখে বিজেপির এমএলএ, এমপিরাই (১৩৪ জনের মধ্যে ৪৪ জন) যে সর্বাধিক নারী নির্যাতনে অভিযুক্ত। মোদীর সময়কালে (২০১৪ থেকে ২০২২), সারা দেশে নারী নির্যাতনের হার ৩১% বেড়েছে [১]। প্রশ্ন হচ্ছে, বিলটির প্রয়োজন কি ছিল? ধর্ষণ অপরাধীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল না প্রচলিত আইনে, নাকি কঠোর শাস্তির আইনের অভাবেই নিত্য নারী নির্যাতন হচ্ছে রাজ্যে? এর অভাবেই কি সরকারের প্রশাসন নারী নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনার প্রতিরোধে, প্রতিবিধানে সেভাবে কাজ করতে কাজ করতে পারছিল না? প্রশ্নগুলোয় যাওয়ার আগে দেখে নিই কি বিশেষত্ব রয়েছে এই বিলে।
সাজা বৃদ্ধি – (১) বিলের ৪ নম্বর ধারায় যেকোনও ধর্ষণের ঘটনায় সাজা হবে দোষীর যাবজ্জীবন (আমৃত্যু) কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড [ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় (বিএনএস) ৬৪ ও ৬৫ ধারাগুলিতে, তা আছে অর্থদণ্ডসহ ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নিগৃহীতা ১৬ বছরের নিচে হলে সাজা ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন, নিগৃহীতা ১২ বছরের নিচে হলে সাজা ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যু], (২) বিলের ৬ নম্বর ধারায় নিগৃহীতার মৃত্যু হলে বা তিনি স্থায়ী কোমায় চলে গেলে, সাজা হবে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড [বিএনএস-এ ৬৬ ধারায় আছে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যু], (৩) বিলের ৭ নম্বর ধারায় গণধর্ষণের ক্ষেত্রে সাজা হবে দোষীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড [বিএনএস-এ ৭০ ধারায় তা আছে ২০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, নিগৃহীতা ১৮ বছরের নিচে হলে সাজা অর্থদণ্ডসহ যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যু], (৪) নির্যাতিতার পরিচয় প্রকাশ করলে (ধারা ৯) এবং কোর্টে মামলা চলাকালীন সে তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করলে (ধারা ১০) সাজা হবে অর্থদণ্ডসহ কারাবাস হবে ৩ থেকে ৫ বছরের (বিএনএস-এ আছে অর্থদণ্ডসহ ২ বছরের কারাবাস)।
তদন্তের সময় কমানো – দ্রুত তদন্ত এবং মামলা নিস্পত্তির জন্যে, ২১ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে তা আরও ১৫ দিন বাড়ানো যেতে পারে, আদালতে চার্জশিট ফাইল করার পর ৩০ দিনের মধ্যে ট্রায়াল শেষ করতে হবে [ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় (১৯৩ ধারা) রয়েছে পুলিশকে ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দিতে হবে, আদালতে ৬০ দিনের মধ্যে ট্রায়াল (৩৪৬ ধারা) শেষ করতে হবে, প্রয়োজনে তা বাড়াতে পারবে আদালত)।
বিশেষ আদালত, বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন – এই মামলা বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠন করা হবে (যার বিধি ইতিমধ্যেই প্রচলিত আইনে রয়েছে), দ্রুত তদন্তের জন্য জেলাস্তরে মহিলা পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে ‘অপরাজিতা টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হবে, তদন্তকারী দল মৌখিক অথবা লিখিতভাবে কোনও রকম সহায়তা বা তথ্য চাইলে যেকোনো ব্যক্তিকে (সরকারী বা সাধারণ) তা দ্রুত দিতে হবে, দেরি করলে বা উপেক্ষা করলে তার ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড (বা উভয়ই) শাস্তি হবে। মোটামুটি এইই হল নতুন আইনের নির্যাস[২]।
বাস্তবে, কিছুক্ষেত্রে ক্ষেত্রে সাজা বৃদ্ধি, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার সময় কমানো আর বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন ছাড়া নতুন কিছু করা হয় নি, মুখ্যমন্ত্রী কথিত এই ‘ঐতিহাসিক’ বিলে। একটি নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিক্রিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ‘প্রথাগত দলীয় রাজনীতির’ বাইরে প্রবল এবং নাছোড় নাগরিক আন্দোলনে দিশেহারা সরকারকে ‘কিছু করে দেখানোর’ উদগ্র বাসনায় বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে অতি দ্রুততার সঙ্গে এই বিল পাশ করাতে হল। যেন, এইটুকুর জন্যই তদন্ত, ন্যায় বিচার, দোষীদের শাস্তি আটকেছিল। ‘রাজনৈতিক’ ফয়দার লক্ষ্যে আনা এই বিলে সঙ্গত কিছু প্রশ্ন উঠে আসে।
প্রথমত, বিল আইনে পরিণত হলে (যদি হয়), আইনটি জারি হওয়ার পর থেকে ঘটা অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন আইনের ধারা বলবৎ হবে, অথচ আজকের আন্দোলন চলছে মূলত ৯ই আগস্টে (২০২৪) ঘটে যাওয়া অপরাধটির ন্যায় বিচারের দাবিতে, স্বাস্থ্যপ্রশাসনে প্রবল দুর্নীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালন, হুমকি সংস্কৃতির অবসানে, এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গসাম্য, পথে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নারী, ভিন্ন যৌনতার মানুষদের উপযুক্ত সম্মান ও সুরক্ষার দাবীতে, তাদের বিরুদ্ধে ঘটা যৌন অপরাধ প্রতিরোধ, প্রতিবিধানের জন্য, সব ক্ষেত্রে সিণ্ডিকেট রাজ অবসানের জন্য। দ্বিতীয়ত, বর্তমান ভারতীয় ফৌজদারি আইনে (বিএনএস) ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে সাধারণভাবে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা নেই (দুটি বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া) এবং কোনও ধারতেই ‘একমাত্র মৃত্যুদণ্ডের’ ব্যবস্থা নেই, অথচ নতুন বিলে ধর্ষণের সাজার বন্দোবস্ত করা হল নূন্যতম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড এবং একটি ক্ষেত্রে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। শুধু এ রাজ্যেই কেন, একই অপরাধে, বিশেষ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হল তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। তৃতীয়ত, নিরপেক্ষ, দ্রুত তদন্ত এবং ন্যায় বিচারের দাবী সঙ্গত, কিন্তু অতি দ্রুত তদন্ত, অতি দ্রুত ট্রায়াল, ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়াকে প্রায় ক্যাঙ্গারু কোর্টে পরিণত করার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয় অতি দ্রুত দায়সারা তদন্তের ফলে, উচ্চ আদালতে মামলা না টেঁকার সম্ভাবনা বাড়ল। চতুর্থত, ফাস্ট ট্র্যাক স্পেশাল কোর্ট গঠন তো বাজেট বরাদ্দসহ দেশের প্রচলিত আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাতেই আছে, তার জন্য আবার নতুন কোনও আইনের প্রয়োজন তো নেই। পঞ্চমত, নারীর বিরুদ্ধে যৌন অপরাধ দমনে ‘অপরাজিতা টাস্ক ফোর্স’ গঠন করতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশই যথেষ্ট, এজন্য বিশেষ আইন করার কি প্রয়োজন তা খোদায় মালুম। আর ধর্ষণ ছাড়াও নারীর বিরুদ্ধে অহরহ ঘটে চলেছে নানান নির্যাতনের ঘটনা, ভিন্ন যৌনতার মানুষদের উপরে প্রতিনিয়ত অসম্মান, নিপীড়ন চলছে, তা প্রতিরোধে, প্রতিবিধানের জন্য একটি বাক্যও চোখে পড়েনি। আরও অজস্র সংগত প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা নেই।
সংবিধানের ২৫৪ (১) ধারা অনুযায়ী, রাজ্যের আইনসভায় পাশ করা বিলের কোনও ধারা যদি দেশের সংসদ প্রণীত কোনও আইনের কোনও ধারার সরাসরি বিরোধিতা থাকে, সেক্ষেত্রে রাজ্যের বিলটি বা তার নির্দিষ্ট ধারাটি বাতিল বলে গণ্য হবে। অবশ্য, রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্ষমতা বলে সেই বিল বা তার নির্দিষ্ট ধারা শুধুমাত্র সেই রাজ্যে চালু করানোর জন্য অনুমোদন দিতে পারেন [২৫৪(২) ধারা]। এক্ষেত্রে, বিলটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সুতরাং সব বিরোধিতা দূরে সরিয়ে অর্থহীন একটি বিলকে বিশেষ অধিকার বলে রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিতেও পারেন।
অপরপক্ষে, ইতিপূর্বে সুপ্রিম কোর্ট ‘একমাত্র সাজা মৃত্যুদণ্ডের’ ধারাকে [ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩০৩ ধারা], সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করেছিল[৩]। লক্ষণীয়, অপরাজিতা বিলের ৬ নম্বর ধারায় শাস্তি হিসেবে ‘একমাত্র মৃত্যুদণ্ডের’ ব্যবস্থা আছে, যা সংবিধান বিরোধী। বিখ্যাত বচন সিং বনাম স্টেট অফ পাঞ্জাব মামলায় [৪] শীর্ষ আদালত নির্ধারিত করে দিয়েছিল একমাত্র ‘বিরল থেকে বিরলতম’ অপরাধের ক্ষেত্রেই বিবেচিত হবে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ ধরণের (খুনের) অপরাধকে ‘বিরল থেকে বিরলতম’ বলে নির্দিষ্টও করে দেওয়া হয়েছিল[৫]। পরবর্তীকালে, আর একটি মামলায়[৬], সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড দিতে গেলে, অপরাধটি কেন বিরল থেকে বিরলতম তা বাখ্যা করতে হবে এবং মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য শাস্তি কেন সুপ্রযুক্ত নয় তাও ব্যাখ্যা করতে হবে। সুতরাং, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় বিলটি অনুমোদন পেলেও, এই রায়গুলোর প্রেক্ষিতে নতুন আইনের ধারাগুলো আদালতে টিকবে কিনা সন্দেহ।
দণ্ডশাস্ত্রে অপরাধের গুরুত্বের ভিত্তিতে অপরাধীর শাস্তির প্রবলতা নির্ধারিত হওয়া উচিত, বলেছিলেন অস্ট্রিয়ান অধ্যাপক কার্ট বায়ার। যে অপরাধের নির্দিষ্ট শাস্তি দেশের আইনেই রয়েছে, তাহলে হঠাৎ কেন একই ধরণের অপরাধে এই রাজ্যে শাস্তি বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ল? একই অপরাধ সারা দেশের তুলনায় এই রাজ্যে কি অধিক বা তার প্রকৃতি কি আলাদা? তার কোনও ব্যাখ্যা বিলে নেই।
NCRB রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে ধর্ষণ অপরাধে পশ্চিমবঙ্গ ছিল চতুর্থ উচ্চতম স্থানে (৩৪৭৩৮টি), সারা দেশের (৬৫.৪%) তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হারও (৭১.৮%) ছিল অধিক। আগের দু বছরেও (২০২০তে ৩৬৪৩৯টি এবং ২০২১শে ৩৫৮৮৪টি) এমন অপরাধের পরিমাণ যথেষ্ট উপরের দিকেই ছিল। অন্যদিকে, এই অপরাধে এ রাজ্যে শাস্তির হার ৮.৯% মাত্র, যা সারা দেশের হারের (২৫.৩%) তুলনায় অত্যন্ত লজ্জাজনক। অসরকারী প্রতিষ্ঠান, ইন্ডিয়া চাইল্ড প্রটেকশনের সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে [৭], শিশু, নারী, প্রবীণদের বিরুদ্ধে ঘটা এবং অন্যান্য জঘন্য অপরাধের মামলা দ্রুত বিচারের জন্য সারা দেশে তৈরি হয়েছিল বিশেষ আদালত (ফাস্ট ট্র্যাক স্পেশাল কোর্ট)। পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ ১২৩টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মধ্যে মাত্র ৩টি কার্যকরী হয়েছে। আর ডিসেম্বরের ২০২৩-এর হিসেব অনুযায়ী, বছরে আদালত প্রতি মামলার নিস্পত্তির হারে পশ্চিমবঙ্গ (৪%) সব চেয়ে পিছিয়ে আছে সারা দেশের (৭১%) তুলনায়। পড়ে থাকা মামলার পাহাড় জমেছে এই আদালতগুলোতে, বিচারাধীন মামলার (গড়ে আদালত প্রতি ৯৮৩টি) ভিত্তিতে এ রাজ্য সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। সংবাদে প্রকাশ নারী নির্যাতনের মোকাবিলায় কঠোর আইন এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার ব্যবস্থার জন্য মুখ্যমন্ত্রী ২২শে আগস্ট (২০২৪) চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। অথচ, তাঁর দলের অন্যতম সাংসদ সায়নী ঘোষের প্রশ্নের উত্তরে, মাত্র কয়েক দিন আগে, ৯ই আগস্ট (২০২৪), দেশের আইনমন্ত্রী এই বিশেষ আদালত সম্পর্কে বিশদ তথ্য (প্রতিটি রাজ্যের) দিয়েছিলেন[৮]। কিন্তু, তারপরেও প্রশাসনিক অদক্ষতা ঢাকতে আর জনগণকে বোকা বানাতেই কি মুখ্যমন্ত্রীর এহেন চিঠি?
সুতরাং, দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, নারী নির্যাতন অপরাধের ন্যায় বিচারের জন্য নতুন কঠোর আইন নয় বরং দ্রুত, পক্ষপাতহীন তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য দরকার ছিল সরকারের সদিচ্ছা এবং নিরপেক্ষতা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসন চালানো।
দেখা যাক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাজ্যের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী কি কি উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁর দীর্ঘ ১২ বছরের রাজ্য সরকার পরিচালনায়। তিনি ক্ষমতায় আসার পরের বছর দিল্লীর ভয়াবহ ‘নির্ভয়া’ কাণ্ডের প্রেক্ষিতে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল ভার্মা কমিশন (২০১৩)। মোট ২০টি সুপারিশ করেছিল, তার কয়টি তিনি বাস্তবায়িত করেছেন, সে সম্পর্কে প্রকাশিত কোনও তথ্য নেই। আজ পর্যন্ত এ নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেন নি। রাজ্যের প্রতিটি সরকারী দফতরের/প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এখনও পর্যন্ত ‘আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি’ তৈরি হয়েছে কিনা তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। ইউজিসির প্রজ্ঞাপন (২০১৬) অনুসারে, প্রত্যেকটি প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি’ (ICC)এবং ‘যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লিঙ্গ সংবেদনশীলতা কমিটি’ (GSCASH) গড়ার কথা, তার তথ্য সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে না। ২০১৯ সালে সমাজে ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সচেতনতার জন্য ১৬টি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জানিয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিশেষ সংস্থা ইউএন-উইমেন। এনিয়ে তিনি কোনও কালে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে শোনা যায় নি। ভিন্ন যৌনতা, লিঙ্গ-পরিবর্তনকামী মানুষদের উপর রাজ্যে নিরন্তর ঘটে চলা যৌন হয়রানি, নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি শব্দও ব্যয় করেন নি, নেন নি প্রতিবিধানের কোনও ব্যবস্থাও। বরং, তিনি রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, কাটোয়া, হাঁসখালি ইত্যাদি স্থানে ঘটে যাওয়া জঘন্য ধর্ষণের ঘটনাগুলো নিয়ে নিগৃহীতাদের সম্পর্কে কদর্য উক্তি থেকে তাঁর রুচির পরিচয়ও দিয়েছেন। একজন নারী হয়ে, নারীর সম্মানের প্রতি তাঁর সীমাহীন অবমাননা প্রকাশ পেয়েছে। এরফলে, তাঁর দলের ‘দুষ্টু ছেলেরা’ প্রশ্রয় পেয়েছে আর ধর্ষণ, নারী নির্যাতন সংস্কৃতির চাষ বেড়েছে এ রাজ্যে।
অগ্রণী মানবাধিকার সংগঠন, পিইউসিএল, এপিডিআর, মাসুম, তাদের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর, মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ওকালতি করা, এই বিলের বিরুদ্ধে। সারা পৃথিবী থেকে যখন অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের জন্য মানবাধিকার আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। এমন এক সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মৃত্যুদণ্ডের জন্য সওয়াল করে বিল আনলেন। এই মুহূর্তে পৃথিবীর ১১২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করা হয়েছে সমস্ত ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে, ৯টি দেশে শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে চালু আছে, ৯টি দেশে বিগত ১০ বছরে একটিও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় নি। মাত্র ৫৫টি দেশ এখনও নিয়মিত মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চলেছে[৯]। প্রতি বছরই কয়েকটি দেশ মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলোপের ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ভারত ইতিমধ্যেই ‘নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র’ গ্রহণ করেছে (১০ই এপ্রিল ১৯৭৯), ‘নির্যাতন, নিষ্ঠুর আচরণ, অমানবিক ও মর্যাদাহানিকর আচরণ এবং শাস্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে’ সাক্ষর করেছে (১৪ই অক্টোবর ১৯৯৭), যেগুলোতে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের সুনির্দিষ্ট আহ্বান ছিল। কিন্তু, দুঃখের বিষয় এখনও পর্যন্ত এদেশে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের কথা ভাবা হয় নি। বরং, দেশের বর্তমান ইউনিয়ন সরকার ভারতীয় দণ্ড বিধি বাতিল করে আনিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় আরও অন্তত ১৫টি অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা রেখেছে। আর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, নিজের অক্ষমতা ঢাকতে, মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করে, ‘চোখের বদলে চোখ’ নীতি নিয়ে একটি নৃশংস আইন করতে চলেছেন। মনে রাখতে হবে, (১) মৃত্যুদণ্ড অন্য সমস্ত শাস্তির তুলনায় নৃশংসতম, (২) এর ফলে, পরবর্তীকালে বিচার পর্বের ত্রুটির ক্ষতিপূরণ অসম্ভব, দণ্ডপ্রাপ্তের প্রাণ তো ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, আর ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় যথেষ্ট বিত্তের সংস্থান না থাকলে সঠিক পদ্ধতিতে ধারাবাহিক আইনি লড়াই সম্ভব নয় (ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসী তার অন্যতম নজির[১০]), (৩) পৃথিবীতে আজ অবধি কোনও গবেষণায় প্রমাণিত হয় নি অপরাধ দমনে এই শাস্তির কোনও প্রতিরোধক (deterrent) ভুমিকা আছে, (৪) এই দণ্ডের ফলে আধুনিক ন্যায় ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য অপরাধীর সংশোধন এবং পুনর্বাসনের কোনও সুযোগই আর থাকে না, (৫) সর্বোপরি এই সর্বোচ্চ শাস্তি মানবতার বিশ্বজনীন মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
মৃত্যুদণ্ড প্রতিশোধমূলক বিচারব্যবস্থার (retributive justice system) অংশ, আর আধুনিককালের বিচারব্যবস্থা সংশোধনমূলক (corrective justice system)। বর্তমানে বিশ্বে এই দণ্ড ধ্বংসাত্মক এবং মানবাধিকার বিরোধী জননীতি হিসেবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক বিরোধী, দলিত, প্রান্তিক মানুষ, নিপীড়িত ভিন্ন জাতি, অধিকৃত দেশের মানুষ, ভিন্ন ধর্মের প্রতি বৈরিতায়, বিপক্ষকে শায়েস্তা করতে, ব্যক্তিগত, জাতিগত ক্রোধের বদলা নেওয়ার একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ধর্ষণ ব্যবহৃত হয়েছে, হচ্ছে সারা পৃথিবীতেই। উপমহাদেশীয় পুরুষ আধিপত্যবাদী সমাজে, নারীর সাজ-পোশাক, আচরণকে দায়ী করা হয়ে থাকে, যা আরও বেড়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শাসনকালে। গবেষণায়[১১] দেখা গেছে, এর পিছনে রয়েছে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, নানান মানসিক বিকৃতি, উপযুক্ত শিক্ষা, সচেতনতার অভাব, পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী ভাবনা, নারী সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা, নারীদের প্রয়োজন, ইচ্ছা ও যৌন চাহিদা সম্পর্কে সামাজিক নিয়ন্ত্রন, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিগৃহীতাকে দোষারোপ করার মতো সমাজ-রাজনৈতিক অজস্র জটিল কারণ। অন্যদিকে, নিগৃহীতার সামাজিক অসম্মান, সামাজিক বয়কট, তীব্র ভয়, ক্ষয়প্রাপ্ত আত্মবিশ্বাস, মানসিক অস্থিরতা, ট্রমা, পেশাগত সক্ষমতার হ্রাসের মতো বেদনাময় তথ্য উঠে এসেছে নানান গবেষণায়[১২]। ধর্ষণ সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিবিধানের ক্ষেত্রে, সুস্থ সমাজ সচেতনতার শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধের প্রসার, নাবালকদের যৌন শিক্ষায় লিঙ্গ সচেতনতা বৃদ্ধি, বিপরীত এবং ভিন্ন যৌনতার মানুষের প্রতি সম্মান দিতে শেখা, মানবিক আচরণ শিক্ষার প্রচলন অনেক বেশি জরুরী। রাস্তাঘাট, দফতর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, গণপরিবহণ ইত্যাদি সমস্ত জন-পরিসরে সঠিক নজরদারী, জন সচেতনতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রনকামী মানসিকতার আমূল পরিবর্তন জরুরী। (প্রমাণসাপেক্ষে) কিছু অপরাধীকে কঠোর সাজা দিয়ে বা নিকেশ করে এমন অপরাধের প্রতিবিধান, নিয়ন্ত্রন কখনই হয় নি, হবেও না।
বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, এ নাকি এক ‘ঐতিহাসিক’ বিল। তবে, বাস্তবে, নৈতিক বোধ, সদিচ্ছার অভাব এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা, হিমালয়সম দুর্নীতির জঞ্জাল ঢাকা দেওয়ার এ এক অক্ষম প্রচেষ্টা, বলা ভাল, জনগণের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক ধাপ্পা।
সূত্র:
[১] 'Beti Bachao': The Times BJP Has Supported Sexual Assault Accused, The Wire, 03/05/2024,
[২] West Bengal Assembly passes anti-rape bill prescribing death penalty for convicts - Bar and Bench 03/09/24
[৩] Mithu Singh vs State of Punjab AIR 1983, SC 473,
[৪] AIR 1980, SC 957,
[৫] Machhi Singh vs. State of Punjab, AIR 1983, SC 957,
[৬] Santosh Bariyar v. State of Maharashtra, (2009) 2 SCC (Cri) 1150,
[৭] Fast Tracking Justice: Role of the Fast Track Special Courts in Reducing Case Backlogs, Sept 2024,
[৮] Unstarred Question No.3144, Answered On – 09/08/2024, Lok Sabha,
[৯] Death Penalty Report- 2022, Amnesty International,
[১০] আদালত, মিডিয়া, সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসী, দেবাশিস সেনগুপ্ত, প্রবাল চৌধুরী, পরমেশ গোস্বামী, গুরুচণ্ডা৯,
[১১] Socio-cultural and psychological aspects of rape, by Reshma & others, Department of Psychology, Central University of Karnataka, 2022,
[১২] Mental health assessment of rape offenders, Jaydip Sarkar, Indian Psychiatric Journal, 2013