এক
দাঁত খুঁটতে খুঁটতে অচিন্ত্য বোস জিজ্ঞাসা করলো, কবে জয়েন করলে যেন?
আজ্ঞে, হপ্তাখানেক হয়ে গেল। বাংলা পনেরোই কার্তিক, বুধোবার। হাত কচলে হাসতে চেষ্টা করলো গৌর মিদ্যে। হাসি আর ভয় মিলেমিশে মুখখানি ক্রমশ ভাবলেশহীন।
টেবিলের নিচ দিয়ে টানটান করে দিল অচিন্ত্য তার সবুট দুই পা। জুতোর ডগা যেন সামনে দাঁড়ানো গৌর মিদ্যের হাওয়াই চটির অগ্রভার ছুঁয়ে আঙ্গুল স্পর্শ করলো। তাতে নতুন ডি-গ্রুপ কর্মচারী, পিওন না পারছে সরতে, না পারছে বলতে, টের পেয়েও অচিন্ত্য পা সরায় না, হেসে বলল, লগ্ন্ রাশি বিচার করেই ঢুকেছো, তবে বাবা এ হল গভমেন্ট অফিস, ওসব বাংলা কারবার এখানে চলে না।
গৌর মিদ্যে সামান্য নড়লো যেন, অতি সন্তর্পণে অচিন্ত্যর নর্থস্টারের ডগার নিচ থেকে সরিয়ে নিল তার বাঁ পায়ের পাতা। ইউ.ডি. বাবু কি বলেন শুনতে হবে তাকে।
অচিন্ত্য বোস ব্যাগ থেকে খবরের কাগজ বের করে পা টেনে নিল স্বাভাবিকভাবেই। গম্ভীর হয়ে বললো, ' এক গ্লাস জল আনো দেখি, তুমি এ টেবিলের পিওন, ডাকা মাত্র হাজির থাকবে।'
গৌর মিনমিন করে বললো, ' আঁজ্ঞে, দিদিমুণিও ঝেন বলেচেন এই কথা।'
দিদিমণি এ অফিসের এল.ডি বন্দনা চ্যাটার্জি, তাকে অচিন্ত্যর না-পসন্দ। কথাটা কানে না নিয়ে ফের পা বাড়িয়ে দিল, ' সরে দাঁড়াও, অত ঝুঁকে দাঁড়াবে না, গায়ে পা লাগছে, জল নিয়ে এসো। '
অফিসটা মফসলিগঞ্জে। গঞ্জ এখন শহর হওয়ার মুখে। এ অফিসে ইউ.ডি. অচিন্ত্য বোসের দাপট খুব। জয়নগরে বাড়ি, জমি,পুকুর বাগান সবই পৈতৃক। যায় মাসে একবার। এখন সেই গঞ্জে দোতলা বাড়ি হাঁকিয়ে একতলার জন্য ভালো ভাড়াটে খুঁজছে, যে বললেই উঠে যাবে, ভাড়া আর সেলামি দেবে বেশি। গিয়েছিল দক্ষিণ ভারত ট্যুরে, ছুটির মধ্যেই নতুন চাকরি পাওয়া পিওন জয়েন করেছে।
বাড়ি কোথায়? অচিন্ত্য জল ঢকঢক করে খেয়ে গৌরের দিকে তাকায়।
আঁজ্ঞে কাছেই, মাঠেমাঠে হেটি গেলি সাত মাইল, পুরন্দরপুর, থানা মগরাহাট।
হেটে আসা হয় ?
হ্যহ। বর্ষাকালে একটু অসুবিধে হবে। গৌর মিদ্যের মুখে যেন হাসি ধরে না।
তা চাকরিটা পেলি কী করে ? অচিন্ত্য আর তুমি বলার প্রয়ােজন বােধ করে না, এ বেটা খাঁটি চাষা, হাল দিয়ে যেন মাঠ থেকে উঠে এসেছে সরকারি অফিসে।
গৌর বলল, আঁজ্ঞে সার, মধুবাবু করি দেছেন।
কে মধুবাবু ? অচিন্ত্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে।
অজ্ঞে মধুসূদন ঘােষ, যাঁর ছেলে বিকাশদা, ব্যাঙ্কে চাকরি করে, পঞ্চাতে মেম্বার হলাে ওর পরের ভাই বিমলদা, মটোর সাইকেলে নেচে বেড়ায়।
চেনে না অচিন্ত্য বােস। এ থানার লােক নয়। তবে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল নিশ্চয়ই। এ বাজারে পিয়নের চাকরিরও কম দাম নয়। জেনে নেওয়া ভাল কার লােক এই গৌর মিদ্যে, সেইমত কাজে লাগাতে হবে। না হলে হঠাৎ যদি ফোঁস করে পার্টির জোরে।
কত টাকা লাগল চাকরি পেতে?
মাথা নাড়ে গৌর, ‘আঁজ্ঞে লাগেনি, তিনি খুব ভালমানুষ, আমরা তাঁর সাতপুরুষের ভাগচাষী’।
কথা বলতে বলতে গৌর মিদ্যে খালি চেয়ারটায় বসবে বসবে করেও বসতে সাহস পায় না। এ চেয়ার বাইরের পার্টির জন্য, তারা অচিন্ত্যবাবুর সামনে এসে বসবে, ফুসফাস করবে, সিগারেটের প্যাকেট দেবে। অচিন্ত্য গৌরকে বসতে বলায় সে অভিভূত প্রায়, না বসে হাত কচলে বলল, আর এক গিলাস জল দেব?
মাথা নাড়ে অচিন্ত্য, তারপর আচমকাই জিজ্ঞেস করে, ‘ইয়ের চাকরি’?
আঁজ্ঞে! গৌর যেন হকচকিয়ে যায়।
ইয়ে মানে বুঝিস না? অচিন্ত্যর নাকমুখ কুঁচকে যায়।
আঁজ্ঞে আমরা হচ্ছি গে চাষা, পুনড ক্ষত্তিয়াে। গৌর যেন বুঝতে চেষ্টা করছে।
তাহলে আর কী, টুকলি পিয়ন হয়ে, বেরােবি আমার উপরঅলা হয়ে।
গৌর চেয়ারে বসতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় অপরাধীর মত। বিপন্ন মুখে হাসতে চেষ্টা করে, ' কি যে বলেন সার, তা কি কখনো হয়, এমন অধম্ম ভগবানেও সহ্য করবে না, আপনারা দিলেন বলেই তো চাকরি পালাম, আমাদ্দের চোদ্দ পুরুষি কেউ কোনোদিন চাকরি পায় নি।'
গৌরের কথার ভিতরেই অন্য প্রান্ত থেকে ডাক এল মিহিন নারীকণ্ঠের, 'গোউর!'
বন্দনা চ্যাটার্জি এই এলেন। গৌর ছুটলো। এখন জল দিতে হবে, চা দিতে হবে, টেবিল মুছতে হবে, আর যদি তিনি ইচ্ছে করেন তো ব্যাগ থেকে দু'টি একটি ফাইল- ইচ্ছে ওঁর হয়না তেমন একটা। শীত এখনো পড়েনি বটে, তাই ওঁর অনেক কাজ। শীতের হাত থেকে লোকজনকে রক্ষা করার সব দায়িত্ব যেন ওঁর কাঁধে। গৌরের ইচ্ছে হয় জানতে যে এত সোয়েটার কি একজন গায়ে দেবে?
গৌর খাটতে পারে খুব। খাটতে খাটতে জিভ বেরিয়ে গেলেও খাটবে। একবারে চরকির মত ছুটে বেড়ায়। চাকরি করার আনন্দই যে আলাদা। এই আনলো অচিন্ত্য বাবুর সিগারেট, তো বন্দনা দিদিমনির পান। পানের পর দত্তবাবুর মাথা ধরার ট্যাবলেট, তারপর ঝর্না দিদিমনির টিফিন, আলু কষা আর পরোটা, দেখে আনতে হবে, খারাপ হলে উপায় নেই, তার মুখ খুব খারাপ, রাখঢাক কম। এতসবের পরে এ চিঠি ও টেবিলে, ও ফাইল এ টেবিলে, এসব আনা নেওয়া তো আছেই। আর আছে অচিন্ত্য বোসের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের বাবুর টেবিলের সামনে নিয়ে আসা।আরো বাড়তি কাজ বন্দনা দিদিমনির সিনেমার টিকিট, কালীবাবুর জন্য কেরোসিন আনা কত কি। যদি কেউ বলে, 'রাগ করছো না তো গৌর।'
' না, না, রাগ করলে কি চাকরি করা হবে? তা বাবু আজ একটু শিগগিরই ছাড়বেন। '
'কেন'? অচিন্ত্য বোসের ভ্রূ বঙ্কিম হয়ে যায়, হাত কচলায় গৌর মিদ্যে, ' আজ্ঞে ডিলারের ঘর থে সার তুলতি হবে। '
'সার! সার কি হবে?'
'আজ্ঞে, কপি পালঙে লাগবে।' গৌর বলে।
'সে তো জানি, কিসে কি লাগে, কিন্তু তোর কি হবে তা? '
' আজ্ঞে চাষ আছে তো, আমি চাকরি পাবার পরে ভাই করে, তবে ছুটিছাটায় আমিও হাত লাগাই, ভাগের জমি সব। '
অচিন্ত্য পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করে গৌর মিদ্যেকে, চাষার ভাব অত সহজে যাওয়ার নয়, তিন পুরুষ চাকরি করা দরকার।
গৌর বিড়বিড় করে, আঁজ্ঞে এক অন্নে আছি সব, বাপ আছে মাথার পরে, আপনাদের আশীব্বাদে চলে যাচ্ছে, চাকরি পালাম, এবার যদি ইঁট কেটে কোঠা বানাতে পারি। বলতে বলতে গৌর মিদ্যের চোখ দুটি বেশ বড় হয়ে যায়। সরল পুঁটির গায়ের মত যেন আঁশ চকচক করে। কোঠা বাড়ি মানে, দেওয়ালটা ইঁটের, কাদায় গাঁথনি দিয়ে দেবে, উপরে টালি, মেঝে মাটিরই থাকবে। তবে কি না খুব খরচ, মাইনের টাকা যদি রাখা যেত- ভিটে সারাতেই হবে বাবু, এ বছরদা অভাবে গেল, বোশেখ, জস্টিতে নোতন ছাওনি দেওয়া হল না।
বন্দনা চ্যাটার্জি ডাকে, গৌর।
যাই। দিদিমণির ডাক এল।
ডাকলেই ছুটতে হবে? অচিন্ত্য দাঁড় করায় ওকে।
গৌর ভ্যাবাচেকা মেরে যায়, বলল,' এই যা, জল চাইলো, আমি আপনার সংগে কথা বোলতি গে ভুলি গিছি।'
অচিন্ত্য বলল, দিদিমণিকে বল, একটা সোয়েটার বানিয়ে দিতে।
বুলেচি। হাসলো গৌর।
এরমধ্যে বলা হয়ে গেছে! অচিন্ত্যর মুখ কঠিন হাসিতে প্রায়,' তুই পারবি'।
কী পারবো? গৌর অস্ফুট গলায় জিজ্ঞেস করে,
গুছিয়ে নিতে। সিনেমার ম্যাগাজিন খুললো অচিন্ত্য।
গৌর মিদ্যে মাথা নাড়ে, কিন্তু 'দিদিমণি যে না করে দিয়েচে, বাবার জন্যি বলিলাম, সে বুড়ার খুব ঠান্ডার ধাত, বললাম, উল কিনে দিচ্ছি, করে দেন।'
অচিন্ত্য ম্যাগাজিনের লাস্যময়ী নায়িকার শরীরচিত্র থেকে মুখ তোলে, গৌর না সরলে আরোও দুঃসাহসিকাদের গোপন চিত্রগুলির পাতা খুলতে পারছে না, বলল, 'যা দেখি এখন, দিদিমনির খুব ডিম্যান্ড, সেবা কর, তবে তো হবে।'
গৌর হাসলো। ' সব সময় তো উনি উল বোনেন, এডাই ওর চাকরি কী বলেন।'
অচিন্ত্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকে গৌরের দিকে। কেমন যেন লাগে ওর। হেলে চাষার ছেলে হেলে চাষা। অফিসে চাকরি করতে আসে যে কেন? তার জয়নগরের জমিতে এরকম তিনটে লোক খাটে। তারা কিন্তু কথা বলে না একদম। গৌর কথা বলে একটু বেশি।
অচিন্ত্য ধমকে ওঠে। যা এখান থেকে। ডাকলে আসবি।
দুই
বাড়ি করে অচিন্ত্যর একটু হাতটান যাচ্ছে। আগের ডি-গ্রুপ, পিয়ন নরেন দাস ছিল খুব এক্সপার্ট। পার্টি ধরা, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা, এসবে ছিল তুখোড়। কথাবার্তায় পালিশ, জামাকাপড় দেখে ফোর্থগ্রেড বলে বোঝার উপায় ছিল না। অচিন্ত্যর হাত দিয়ে লোন স্যাংশান হয়, দশ বিশ পঁচিশ হাজার, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, পাম্পসেট কেনার ঋণ। টেন পার্সেন্ট অচিন্ত্য নেয়। ঋণ তো শোধ করে না কেউ। তারপর ওই টাকার অর্ধেক থাকে সাবসিডি, সুতরাং অচিন্ত্য কেন পাবে না শেয়ার। সে তো পার্টিকে বুঝিয়ে দেয় কী কী পথে গেলে ঋণ শোধ না করেও আরামে থাকা যায়, অন্যভাবে আবার সরকারের টাকা নেওয়া যায়।
অচিন্ত্য বলে, শোন গৌর, যা বলবো তাই করবি, অন্যথা যেন না হয়।
গৌর ঘাড় কাত করে, আমার বাবা ওই উপদেশই দেয় বাবু। আপনারা যা বলবেন তাই যেন করি, সেবা করি যেন, বাড়িতি গে সব তো বলতি হয়।
অচিন্ত্য অবাক, 'বলতে হয় মানে?'
কী র'মভাবে আপনাদের কাজ করি বলতি হয়, কী কী হল আপিসে বলতি হয়, কোন বাবু কী র'ম, দিদিমনি কেমন উল বোনে সব বলতি হয়।
কে শোনে?
কেন বাপ শোনে, আপনার বৌমা শোনে, মা শোনে, আপনার বৌমার খুব শখ দিদিমণিরে দেখার, জিজ্ঞেস করে, রঙ ফসসা না কালো, আমি বলি বড় ঘরের বামুন ঘরের মেয়ে কী কালো হবে তোর মত।
আচিন্ত্য হা হা করে হাসে, জিজ্ঞেস তো করবেই, তোর ঘরে তো কেউ আর চাকরি করে নি কোনোদিন।
হ্যাঁ বাবু। গৌর হাত কচলায়।
অচিন্ত্য ভাবছিলো একে দিয়ে হবে কি না। না হলেও হওয়াতে হবে। বোকাসোকা ছেলে। গা দিয়ে ধানের গন্ধ যায় নি এখনো। নরেন দাসটা ছিলো অতি চালাক। শেষে নীলমণি পাত্রের কাছ থেকে পাওয়া ৫০০ টাকা দিলোই না, স্রেফ বলে দিলো পাওয়া যায় নি। তার দুদিন বাদেই রিনিজ নিয়ে নিলো বদলির অর্ডারে। পরে জানা গেল মিথ্যে বলেছে।
অচিন্ত্য বলল, ' শোন, রতন মুখার্জি বলে যে লোকটা আসে...।
ওই ফর্সাবাবু?
হ্যাঁ, তোকে একটা কাজ করতে হবে।
অচিন্ত্য গৌরকে বোঝাতে থাকে। গৌর নিবিষ্ট হয়ে শোনে। শোনে, আর মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ, বুঝতেচি। রতন বাবুর কানে কথাটা তুলতে হবে, হাজার টাকা ছাড়া ও ফাইল নড়বেই না। তারপর টাকাটা আদায় করে আনতে হবে।
গৌর কথা বুঝতে বুঝতে টক করে বলে, ' আঁজ্ঞে, একে ঘুষ বলে তো!'
অচিন্ত্য হাসে, 'এই তো বুঝেছিস।'
আজ্ঞে বাবু আপনি ঘুষ লিবেন?
অচিন্ত্য গম্ভীর হয়ে, 'এত কথা বলিস কেন, যা বলছি তাই করবি।'
গৌর যেন চিন্তিত হয়, বিড়বিড়িয়ে বলে, ' আজ্ঞে, আপনি উচ্চ বংশ, বড় ঘরের লোক, খাঁটি কুলীন কায়েত, ঘুষ লিবেন?'
অচিন্ত্য হতভম্ব, হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে গৌর মিদ্যের দিকে। ছোট ছোট দুটি চোখের পাতা অনবরত ফেলছে, মুখখানিতে কোনোরকম ভাব নেই। কথাটা ভেবে বললো, নাকি বলার তাই বলে ফেললো। তার হঠাৎ রাগ হয়ে যায়। ' শালা, চাষাই রয়ে গেলি। কথা বলতে শিখিস নি।'
গৌর এসব ভয় পায় যেন, হাত কচলে বলে, 'না না বাবু, আমার মনে হল তাই বললাম। ভুল হতি পারে, লেখাপড়া শিখিনি, আমি হলাম চাষার ব্যাটা, কুণ্ড ক্ষত্রিয়, মনে কিছু করবেন না।'
অচিন্ত্য আরো রাগে, " থাম, শালা, আমরা গাছে কি আর আম ফলে, যা বলছি তাই করবি। "
গৌর মিদ্যের মুখ কালো হয়ে যায়। ভয়ে কাঁপে, তারপরে বলে, ' ঠিক আছে বাবু, আমি করবো। যা বলতেছেন, তাই করবো।'
অচিন্ত্যর মুখে হাসি ফোটে। নরেন দাসটা শেয়ার নিত অনেক, গৌর মিদ্যেকে নিয়ে ভাবনা নেই।
তিন
ক'দিন বাদে গৌর অচিন্ত্যকে বলল, 'আপনি খুব ভালো মানুষ। '
অচিন্ত্য অবাক, কেন?
এই যে হাজার টাকা ঘুষ পালেন, তার থেকে পঁয়তাল্লিশ টাকা আমাকে দেলেন, বেতনের উপরি, বাড়িতি বলতি আপনার বউমা বললে, টাকা মানে লক্ষ্মী, যে ভাবে আসুক না কেন, সত্যনারায়ণ দেবে।
বাড়িতে সব বললি?
বাহ্, বলবো না, লুকুবার উপায় আছে, বাপ তো শুধু শুনতি চায় বাবুদের আপিসে কি'রম কাজ করি আমি।
অফিসের কাউকে বলেছিস?
জিভ কেটে গৌর, না বাবু, বন্দনাদি খুব জিগ্যেস করতিলেন, আপনার পাম্মিশান ছাড়া কি বলতে পারি!'
অচিন্ত্য তবুও যেন নিশ্চিন্ত হতে পারে না। বললে কী আর হবে, বন্দনা চ্যাটার্জি এসে বলবে, শ' দুই টাকা ধার দেবেন অচিন্ত্যবাবু, ও মাসেই দিয়ে দেব। মহিলা খুব চতুর। সামনে ঝুঁকে পড়ে আঁচল একবারে ফেলে দেবে প্রায়, বলবে, আপনার হাতে তো এখন টাকা আছে-
গৌরকে ঠিকমতো ট্রেনিং দেওয়া দরকার। সামনের চেয়ার দেখালো অচিন্ত্য। গৌর যেন যন্ত্রচালিত পুতুলের মত বসল। অচিন্ত্য ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, টের পেতে চেষ্টা করতে লাগল, আসলে ছেলেটা কী রকম! দুদিন বাদে বেশি দাবি করে বসবে না তো। গাঁ গঞ্জ থেকে মাঝে মধ্যে এই রকম দু একটা চাষার ছেলে চাকরি পাচ্ছে ইদানীং, খুবই কম। তারা প্রথমে এই রকমই থাকে, পরে হয় বিভীষণ। আর যদি কেউ কেরানি হয় তো দেখতে হবে না, কী চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। আরে বাবা চাকরিটা তো পেয়েছিস আমাদের কৃপায়। অচিন্ত্য বোস একটু স্নেহের স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিস?'
আজ্ঞে, সিক্স, সার্টিফিকেট অবিশ্যি এইট পাসের আছে।
তবে! সিক্স পর্যন্ত পড়ে পিয়নের চাকরি পেলি, হেলথে একটা বি,এ পাস পিয়ন আছে, জানিস ?
জানি সার। গৌর দাঁত বের করে হাসল, ‘মধুবাবু না করি দিলে তো হত না’।
তবে দ্যাখ, অন্যলোকে তোর চাকরি করে দিল, আমার ভাইটা এম. এ., তাকে ঢোকাতে কত কষ্ট হয়েছিল জানিস?
গৌর মিদ্যে আবার হাসে, 'ধরা করার লোক আছে আপনাদের, এই ধরেন মধুবাবুর ছেলে বিকাশদা, তিন বার ফেল করিল এইচ.এস. এ, তারপর পাস হলো, ওর এক জ্যাঠার ছেলে এমেলে হইলো, সেই পাস করায়ে দিল, বিকাশদা বি. এ পাসও করলো এরপর, এখন ব্যাঙ্কে ঢুকে গেছে, কী লোন না নেচ্ছে ব্যাঙ্ক থে।
সে তো তুই সিক্স পাস, এইট পাসের সার্টিফিকেট পেয়েছিস ধরে করে।
আঁজ্ঞে বাপ পড়াতি পারলে আমি এগারো কেলাসও পেরুয়ে যেতাম, ধরাকরার লোকও নেই, টাকাও নেই।
এইবারে তোকে ধরবে তোর আত্মীয়েরা।
গৌর গাল ভরে হাসে, আমি তো পিয়ন, অবিশ্যি তার বেশি হবে কী করে, ধরাকরা লোক হতি এখনো চার পুরুষ লাগপে, সবে তো একজন চাকরি পালাম, আমরা বাবু হাতে পায়ে ধরতি পারি খুব, একবার থানার ও.সি পেরায় চালান করি দেয় আর কী, ডাকাতি হচ্ছিল পাশের গাঁয়ে, আচ্ছা আমায় দেখলি কী ডাকাত মনে হয়?
কী করলি তখন? অচিন্ত্যর হাতে কাজ নেই। টাকা পেলে সে কাজ করে, নতুবা এইভাবে কাটিয়ে দেয় আট ঘন্টা।
পায়ে ধরলাম, তবে দুটো কুক্ড়াও নেল দারোগাবাবু।
অচিন্ত্য সিগারেট ধরায়। বিড়বিড়িয়ে বলে, ' পুলিশের চাকরিই সব চেয়ে ভালো, টাকার দরকার হলেই বেরিয়ে পড়'।'
হ্যাঁ। গৌর কথাটা শুনতে পেয়ে বলে, 'থানার ও.সি. ওরম'ই করেন।'
খুব অন্যায়। অচিন্ত্য যেন সম্বিতে ফেরে।
কেন? গৌর প্রতিবাদ করে, 'দারোগা পুলিশ তো লেয়ই, কুকড়া লেবে তো অন্যায় কী আছে?
কিছু বলতে পারিসনি? অচিন্ত্য গলায় একটু দার্ঢ্য আনে যেন।
বাহ্ বলবো কেন, বলতি গে মরি, তবে হ্যাঁ আমাদের গাঁর সাধু কাপালীর ছেলে যুধিষ্ঠির কাপালী, সে একবার রুখি দাঁড়াইলো, মুখ ফসকে বলি ফেলিলো, ডাকাতদের আপনি খুব চেনেন দারোগাবাবু, তবে শুদুমুদু আমাদের ধরতি আসেন কেন?
তারপর? অচিন্ত্য যেন গল্পের স্বাদ পায়।
আবার কী, তারে তুলে নে চালান করি দিল, সাধুকাপালী তখন মধুবাবুর পায়ে পড়ি গেল, বাবু বাঁচান, তিনির শালীর ছেলে হলো দারোগাবাবুর উপরে এস. ডি. পি. ও., ছাড় পেলো যুধিষ্ঠির, তবে খুব মার খেইলো, কিন্তু পরের বারও সেই এক কান্ড, তখন মধুবাবুই রেগে কাঁই, যত বড় মুখ না ততো বড় কথা, শালারে পিটানো দরকার। কথা বলতে বলতে গৌর মিদ্যে যেন হাঁপাতে লাগলো। ঘেমে গেল শীতের ভিতর। চোখ দুটি থরথর করতে লাগলো উত্তেজনায়।
থামলি কেন? অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করে।
বলতিছি, হাঁপ লেগে যাচ্ছে বলতি, তা বাবু তখন যুধিষ্ঠিরের বাপ সাধু কাপালী কারে আর ধরবে, তার কেন আমাদ্দের সবার ধরার লোক তো ওই মধুবাবু, যুধিষ্ঠিরটারে থানায় পিটোয়ে মেরেই ফেলে দিল, বললো হাটফেল হই গেছে, দ্যাখেন মধুবাবুর কথা যদি শুনতো যুধিষ্ঠির তো মরত না, তিনি তো লোক ভালো, কত ক্ষ্যামতা, ওই যে বিকাশদার কথা বলছিলাম, তিনি আমাদ্দের তাঁতি ঘরের এটটা মেয়েরে ধরে কালীপুজোর রাতে জোর করে ধরে টেনে নিয়ে গেল আমবাগানে-
বন্দনা চ্যাটার্জি ডেকে উঠল, 'গোউর'।
অচিন্ত্য হাত বাড়িয়ে বসায় গৌরকে, গল্পটা এখন জমে উঠেছে। আমবাগানে টেনে নিয়ে গেছে তাঁতীঘরের মেয়েকে মধুবাবুর ছেলে বিকাশ। এ সময় গৌরকে উঠতে দেওয়া যায় না, বলল, 'শেষ করে যা।'
বিকাশদা রেপ করল, তাতে কী হলো, দারোগা এল গেল, তাঁতীরা খুব হম্বিতম্বি করল। তাতে গলা মিলালো আরো অনেকে, তবু ধরল না বিকাশদারে, কেন বলেন দেখি?
কেন?
ওই যে বললাম, আপনাদের চিনাজানা অনেক আছে, ধরা করার লোক অনেক আছে, এস. ডি. পি. ও. হলো বিকাশদার মাসতুতো দাদা, আপনাদের কত আত্মীয়, আপিসে কাছারিতে মন্ত্রীতে সব আপনাদের আত্মীয়...
অচিন্ত্য চুপ করে থাকে, কথাগুলো আর ভালো লাগছে না। রেপের লাইনে না গিয়ে গৌর মিদ্যে আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে। কিন্তু তাকে থামায় কে ? ওদিকে বন্দনা আবার ডাকল,তবু কানে গেল না গৌরের, বিড়বিড় করছে, ' কত ধরা করার লোক, যেখেন যাবেন লতাপাতার একটা সম্পক্কো, বন্ধুবান্ধব বেরুয়ে পড়বেই, তা তো হবেই, চাকরিবাকরিতে সব লেখাপড়া জানা লোক, লেখাপড়া না জানলে হবেই না, আমাদের তা তো নেই, গাঁ ছেড়ে বেরুইনি কখনো, তবে মধুবাবু লোক ভালো, তেনার জমি বাপ ঠাউদ্দার আমল থেকে চষি আমরা, ভাগ রিকড করাইনি তেনার কথায়, আর ওই রেপের কালে আমরা চুপ করে ছিলাম, বাপ দেখিলো ব্যাপারডা, মুখ খোলেনি, তাতে তিনি খুশি হয়ে এই চাকরিডা করি দেলেন....।'
এবার অচিন্ত্য বলল, খুব অন্যায় করেছে তোর বাবা।
যে রেপ করল তার চেয়েও? হাঁ করে তাকিয়ে আছে গৌর মিদ্যে, সাক্ষী দিলি ডাকাতির কেসে চালান, জমির যে উচ্ছেদ, সেডা পোয়াতো কেডা?
বন্দনা চ্যাটার্জি আবার ডাকল, গোউর।
গৌর মিদ্যে উঠে পড়ল চট করে, ' যাই, উনার মাথা ধরার ট্যাবলিট আনতি হবে।'
অচিন্ত্য বোস ভাবছিল একবার জয়নগর যাওয়া দরকার। কেমন হল ধান? ধান কাটার সময় তো হয়ে এল। এবার গিয়ে ভাগ চাষীবুড়োর সাথে কথা বলতে হবে নরমে গরমে পার্টির লোক নিয়ে। নামটা কাটিয়ে দেওয়া যায় যদি কিছু টাকা বুড়োর হাতে ধরিয়ে।
চার
বন্দনা চ্যাটার্জি খুব ধমকাচ্ছে গৌরকে। কী হল আবার? অচিন্ত্য টয়লেটে যাবার আগে দাঁড়ায়।
গৌর হাতজোড় করে আছে, ' আঁজ্ঞে দিদিমণি, যা বলিচি ভুল বলিচি, আর কোনদিন হবে না।'
বন্দনার হাতের উলের পিন্ড টেবিলের উপর গড়িয়ে গেছে। মেরুন রঙ,দলাপাকানো কেঁচোর মত উল জড়িয়ে আছে কাঠের পাটাতন। আঁচল দু বার সামলে বন্দনা ধমকালেন গৌরকে, ' তুই ফোর্থগ্রেড, তোর চোদ্দপুরুষ চাকরি করেনি কোনোদিন,আমাকে শেখাবি কী করতে হবে, কী করা উচিত?'
আঁজ্ঞে, তা না দিদিমণি, বুড়ো দাদু রোজ ঘুরে যাচ্ছে, মাসটাক হবে।
আমার হাত ধরে বলিলো যদি আপনারে বলে দিই, টাকা দিবার ক্ষ্যামতা উনার নেই, আপনি যদি ওর কাজডা করি দেন।
বন্দনার ক্রিমঘষা তেলতেলে ফর্সা মুখখানি লাল, গর্জে উঠল, 'মিথ্যে বলছিস, আজকেই প্রথম এসেছে লোকটা। '
না দিদিমণি, আপনি ভুলি যাচ্ছেন, খুব খাটেন, উল বুনা খুব খাটনির কাজ, তাই মনে পড়তেছে না।
আমি মিথ্যে বলছি! বন্দনা রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগল। অচিন্ত্য সিগারেট ধরিয়ে টয়লেটের দিকে পা বাড়ায়। চোখমুখে জল দিয়ে ফেরার সময় দেখল, গৌর মন খারাপ করে একটি টুলে বসে আছে। বন্দনা তার উলের গোলা গুটিয়ে নিচ্ছে।
অচিন্ত্য টেবিলে ফিরতেই বন্দনা হাজির, ছেলেটা কেমন বলুন তো?
অচিন্ত্য একটু সাবধান হলো, বন্দনা কি টের পেয়ে টাকা ধার করতে এল, জেরায় কি গৌর বলে দিল সব কথা তখন!
অচিন্ত্য বলল, মোষের মত খুব খাটতে পারে।
তা পারুক, খাটবেই তো, চাকরি পেয়েছে ওর চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য, কিন্তু বাইরের লোকের সামনে আমায় বলে কি না একমাস ঘুরছে, কাজটা করে দিন দিদিমণি, কী স্পর্ধা!
বাদ দিন। অচিন্ত্য নিরীহ মুখে বলল।
আমি সোয়েটার বুনি কি ঘুমোই তা দেখার ও কে, ডি-গ্রুপ স্টাফ, সেদিন বললাম দুটো সিনেমার টিকিট কেটে এনে দে, বলে কি না পেরাই তো দেই, আজ ছেড়ে দেন, রোগী দেখতে নাকি হাসপাতাল যাবে।
অচিন্ত্য চুপ করে থাকে।
বন্দনা বকতে বকতে চলে গেল। গৌর মিদ্যে আর এদিকে এল না। অচিন্ত্য একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলো যে বন্দনা এখনো আঁচ করতে পারে নি যে গৌর মিদ্যের হাত দিয়ে অচিন্ত্য টাকা খেতে আরম্ভ করছে আবার।
দুদিন বাদে গৌর ভেঙে পড়ল হঠাৎ অচিন্ত্যর সামনে, ' বাবু আমি সব বলে দে বেপদে পড়ে গেছি।'
সব বলে দিয়েছিস মানে? অচিন্ত্যর কপালে ঘাম জমে গেল।
দিদিমনির সাথে ওসব হল, সেডা বাড়িতে বলতি বাবা খুব ভয় পেয়ে গেছে, ধরেন গে আমরা চাষামানুষ, কথাবার্তা ঠিকমতো বলতি পারি নে, তার জন্যি তো যুধিষ্ঠির কাপালী দারোগাবাবুর পিটুনি খেয়ে মলো, বাবা ভাবতেছে
ভাবতেছে আমি কাজকম্মাে করিনে তাই এসব হচ্ছে, চাকরি চলে যাবে আমার । বাবা এসে দিদিমণির হাতে পায়ে ধরে মিটোয়ে নেবে বলতেছে ।
সে কী! অচিন্ত্য অবাক উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে, তুই বন্দনাকে গিয়ে বল, তোর বাবাকে আসতে হবে কেন ?
বলতি ভরসা পাচ্ছিনে, উনি নামডা ধরে পর্যন্ত ডাকতেছেন না।
অচিন্ত্য গৌরের হয়ে বন্দনাকে বলতে যাবে ভেবেও চেয়ার থেকে উঠল না । তার কী দরকার। তাতে যদি বন্দনা সন্দেহ করে ধার চেয়ে বসে। ধার মানেই তাে শেয়ার। বন্দনা চ্যাটার্জীর স্বামী রাইটার্সে আছে, বন দপ্তরে, হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট। ক্ষমতাশালী ইউনিয়নের প্রতিপত্তিশালী লােক। ওকে ঘাটানাে ঠিক নয়।
আরাে দিনকয় বাদে অচিন্ত্য আর একটি জবাই করার মত মুরগি পায় । পাম্প সেটের জন্য লােন, শোধ তাে দিতে হয় না। মকুব হয়ে যাবে। আর পনেরাে হাজারে সাড়ে সাত হাজার হলাে সরকারি সাবসিডি।
অচিন্ত্য ডাকল, গৌর।
গৌরের হাতে ঠিকানাটা তুলে দিয়ে বলল, চলে যা, বলবি দুহাজার ছাড়া হবে না, এবার তুই একশাে পাবি।
আবার নিয়া হবে উপরি ?
কথা বলিস না, কাল অফিসে আসার আগে লােকটার বাড়ি হয়ে আসবি, বন্দনা দিদিমণিকে নিয়ে তাের ভাবতে হবে না, আমি তাে আছিই।
গৌর চলে গেল। অচিন্ত্য উত্তেজিত হয়ে রাত কাটালাে। এই কেসটা হয়ে গেলে বােঝা যাবে গৌর মিদ্যে হলাে রত্ন বিশেষ। অচিন্ত্য বােস তার হাতে পুরাে তামাকটাই খেতে পারবে। কোন ঝুঁকি থাকবে না।
পরের দিন গৌর এসে বলল, হলাে না বাবু।
কেন? অচিন্ত্য চাপা গলায় তেজ ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করে। গরিব, খুব গরিব, পাম্পের টাকা দিয়ে মেয়ের বে দেবে।
ওসব বলে, আসলে তাে পেটে খাবে, বলিসনি দুহাজার না পেলে হবে না।
বললাম, কিন্তু ধরে পড়ল আমার হাত, চাষাঘর আমাদের মতো, ফাগুন মাসে বে’র ঠিক হয়েছে, বলল, কিছু দেব কিন্তু টাকা পালি, তবে অত দিলি বে’ আটকে যাবে। গৌর মিনমিনে গলায় বলল।
ননসেন্স, তুই জোর করে বলিসনি, যা আবার যা।
গৌর গেল আবার, ফিরেও এল শূন্য হাতে। অচিন্ত্য রাগে কাঁপতে লাগল, বলল, ‘তুই নিজে নিয়ে মিথ্যে বলছিস না তো’?
গৌর মিদ্যে দু’হাত জোড় করে, ‘অধম্মো সইবে না বাবু, আমার বাবারে মধুবা্বু বিশ হাজার টাকা লােন পাইয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বাবা লেয়নি ভয়ে, যদি শােধ না করতি পারে, যদি কোমরে দড়ি পড়ে তাতে’।
অচিন্ত্য বােস নিজের হাত কামড়াতে লাগল, নরেন দাস হলে পনেরাে হাজারে তিন হাজার গুনে নিয়ে আসত। চাষাকে নিয়ে হয়েছে বিপদ। এদিকে বউকে কথা দিয়ে ফেলেছে এপ্রিল মাসে ছেলের পরীক্ষার পর সিমলা নিয়ে যাচ্ছেই। হােটেল বুক করা দরকার এখনই। শুধু শুধু ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ভাঙতে হবে। আর নতুন কেনা ফোমের গদির টাকাও এ দিয়ে শােধ হতো। পুরােন ছােবড়ার গদিতে শুতে এখন ভাল লাগে না কারােরই। এসব কী মাইনের টাকায় হয়?
অচিন্ত্য বলল, ‘তােকে টাকাটা নিয়ে আসতেই হবে, না হলে ধরে নেব তুই নিয়ে আমাকে দিচ্ছিস না’।
গৌর মিদ্যের চোখে জল চলে এল, সে বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘বিশ্বাস করেন’।
‘টাকা নিয়ে আয় তারপর বিশ্বাসের প্রশ্ন’। অচিন্ত্য চাপা গলায় ধমকায়।
পরের দিন গৌর অফিসে আসে না বরং লােন পার্টি অচিন্ত্যর কাছে এসে দাঁড়াল ভীত মুখে, বলল, “গৌরবাবু বলেচে দেখা করতি, বিশ্বাস করেন বাবু হাত শূন্য একেবারে।
অচিন্ত্য কোনক্রমে তাদের ফেরত পাঠায়। আচ্ছা ফ্যাঁসাদ হয়েছে, অফিসুদ্ধ লােক তাকাচ্ছে, তারা আঁচ করার চেষ্টা করছে কত নিচ্ছে অচিন্ত্য বােস। বন্দনা দুবার ঘুরেও গেল। অচিন্ত্য সবাইকে সামলায়। রাগটা তার ক্রমশ বাড়তে থাকে। কী আক্কেল ছেলেটার ।
গৌর মিদ্যে দিন তিনেক বাদে অফিস এল। অচিন্ত্য দেখল সে একা নয়, সঙ্গে একটা হেঁপাে বুড়াে। নিশ্চয়ই বাবাকে নিয়ে এসেছে। ঠিক তাই। ছেড়া তালি মারা ধুতি, ময়লা শার্ট, তার উপরে খদ্দরের চাদরে শরীর লুকোন বুড়ো সােজা অচিন্ত্যর টেবিলে চলে এল, খুব ভুল করেচে বাবু, খুব ভুল করেচে আমার গৌর।
খুব ভুল করেছে দিদিমণি, সব তাে ঘরে গিয়ে বলে, ওরে মাপ করে দেন।
পাগল নাকি! অচিন্ত্য গৌরকে ধমকে উঠেছে, যাও বাবাকে পৌছে দিয়ে এস, কে আনতে বলেছিল ?
কেউ বলেনি বাবু; আমিই আলাম ওরে নে, নেশ্চয় ও কোনো কাজ করে না, তাই আপনারা এত রেগে যাচ্ছেন ওর পরে, খাটায়ে নেন, আমি আছি বসে। বুড়াে দুহাত জোড় করে বলে।
কে নড়ায় বুড়াে ফকির মিদ্যেকে। সে যাবেই না । এসেছে যখন দেখেই যাবে ছেলে কাজ করে কি না। তার বদ্ধমূল ধারণা গৌর গােলমাল করছে। অফিসের এককোণে গিয়ে আশ্রয় নিল বুড়াে। পকেট থেকে বিড়ির কৌটো বের করে কী মনে করে আবার পকেটে চালান করে দিল। বাবুদের সামনে বিড়ি খায় কী করে, তা নিজের মনেই বলতে লাগল। দুপুরভর ছেলেকে ধমকাতে লাগল, অ্যাই বসে আছিস কেন, দাঁড়া, দাঁড়ায়ে থাক, এমনি এমনি চাকরি করে দেছে তােরে মধুবাবু, জল দে বাবুরে, দিদিমণির দরকার আছে কি না দ্যাখ...
শীতের বেলা বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়। সাড়ে পাঁচটার অফিস সাড়ে চারটেয় ফৌত। বুড়াে তার ঘােলাটে চোখে দেখতে লাগল সব। বন্দনা উল ছড়িয়ে আবার দিনের আলাের মত গুটিয়ে নিল তার কাঁধ ব্যাগে। তার কাছে এক বুড়াে ঘুর ঘুর করে আবার ফিরে গেল কথার জবাব না পেয়ে। অচিন্ত্য খবরের কাগজ, সিনেমা ম্যাগাজিন এবং অফিস ফাইল সব একসঙ্গে নিয়ে আর একজনের সঙ্গে তক্কে বসল মাধুরী ভালো না জুহি ভালো, সরকার ঠিক করছে, না বেঠিক করছে, কোন সিনেমায় সেনসার বেশি উদার...
গৌর সারাদুপুর ছুটোছুটিই করল শুধু।
সাড়ে চারটের পর অচিন্ত্য উঠতে বুড়াে ফকির মিদ্যেও উঠল, বাবুরা এবার যাবেন ?
অচিন্ত্য বিরক্ত মুখে তাকায়।
বাবু, থালে ছেলেরে নে যাই আমি।
হাঁ হাঁ, আর কোনদিন এস না। অচিন্ত্য বিরক্তি চাপতে পারে না।
বুড়ো হাসল, বড় ভয় হইল বাবু, বড় ভয় হইল।
অচিন্ত্য জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। লােকটাকে দেখে তার স্বস্তি হচ্ছে না। কেমন যেন লাগছে ! বুড়ােটা সুবিধের নয়।
বড় ভয় হইল বাবু, চেরকাল খেটে অন্ন জোগাড় করিচি, শেষে গৌর কিনা বিনা কাজে পয়সা লেবে।
অচিন্ত্য কোনক্রমে বলে, হয়েছে এবার যাও।
যাচ্ছি, আপনারা ছেলেডার ভুল সংশােধন করায়ে দেন, যদি কথা না শুনে ঘাড় ধরায়ে করে নেবেন। কাজ করে নাই বলেই তাে বেপদে পড়িছে, আজ আমার পরাণ জুড়ােল। এই যে আপনারা বসি আছেন, বসে ওরে খাটাচ্ছেন এডাই লেয্য। আপনাদের জমিন, যা বলবেন তাই করবে, দরকারে জুতাে মুখে লিয়ে হাঁটপে, আপনারা বসে বসে ওরে খাটাবা তবেই না বােঝপে ওর বাপ ঠাউদা কী রম ভাবে লেয্য জেবন কাটায়ে গেছে ! বিনা খাটনিতে ভগমান অন্ন দেন না এটা ও জানুক।
অচিন্ত্য কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায়, “ঠিক আছে, এবার যাও”।
হ্যাঁ যাবাে, যাবার আগে বলি যাই, দ্যাখেন বাবু, মােরা হলাম পুনডো ক্ষত্তিয়ো চাষা, পোদ, এসব কোঠাবাড়ি বেতন লিয়ার জন্য খাড়া করা চুন-ঘরের আপিস সব তাে মধুবাবুর সম্পত্তির মতন আপনাদের সম্পত্তি, জমিন, যেমন বলবেন গৌর তেমন চষে দেবে, চষতি দেচ্ছেন সে বড় ভাগ্যি, যা বলবেন তাই করবে, থানা পুলিশি আপনাদের হয়ে সাক্ষী দেবে পেয়ােজনে, না হলি যে জমিন চলে যাবে এডা ও জানুক।
থা-থামবে ! অচিন্ত্য যেন গর্জে উঠেছে চাপা স্বরে।
হাঁ হাঁ থামতিচি বাব, তবে বলে যাই, কবে ফের দেখা হবে জানিনে, কদ্দিন বাঁচপাে জানিনে, ওই গৌর হারামজাদারে এটটু বুঝায়ে দে যাই বাপ ঠাউদ্দা কী র’ম জেবন কাটায়ে গেছে, চাষা কেমনভাবে বাঁচে, মধুবাবুর জমিন চষতি চষতি আমার বুকি দোষ হই গেল, তবু, কি কাজ বন্দ করিচি, খাটা তো এরেই বলে, খাটায়ে খাটায়ে ওর বুকি দোষ করি দেন দেখি।
অচিন্ত্য থরথর করে কেঁপে ওঠে। বুড়াে তাে থামছেই না। জানালার ধারে চলে গেছে কথা বলতে বলতে। কথা তাে বলেই যাচ্ছে। বাইরে আঁধার নেমে এল প্রায়। বুড়াের চোখ আঁধার ঘেরা পৃথিবীর পথে। অচিন্ত্য দেখল অফিস প্রায় ফাঁকা। এক প্রান্তে গৌর মিদ্যের কোমর থেকে মাথা অবধি পাথর, পায়ের পাতা থেকে কোমর অবধি ঠকঠকিয়ে কাঁপছে। তার বাপ বুড়াে ফকির মিদ্যের কথা থামছে না। বলছে, বলতে বলতে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে যেন বুড়াে।
অচিন্ত্য আবার চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি থামবে’ ?
এবার ঠকঠকানো পায়ে ছুটে এল গৌর, বলে উঠল, ‘কী হচ্ছে বাপ, তুমি থামবা, এ তুমার হেলে গরু, আর জমি লয় যে বকেই যাবা নিজির মনে, ও বাপ’।
অচিন্ত্য দ্যাখে বুড়াে তবুও থামছে না। বড় কর্কশ কণ্ঠস্বর । অচিন্ত্য দু’কানে আঙুল দেয়।
শ্রেণী বিভাজনের মারাত্মক ছবি।