লিখতে বসে বেশ গুরুগম্ভীর ভূমিকা লিখব ভাবছিলাম। ফ্যাসিবাদ, মানুষের অধিকার নিয়ে বড়সড় কিছু লিখব ভাবছিলাম। হল না। তাই যা দেখেছি তাই লিখেছি। ব্যক্তি মানুষের দেখার চোখের কিছু ভুল ত্রুটি থেকে গেল হয়তো।
কুড়ি মার্চ বিকেলে প্রেস ক্লাব প্রথম যাই। হোলির সপ্তাহ। পরিবারের সাথে সময় কাটাবো বলে তিনটে দিন ছুটি নিয়েছিলাম। একুশ তারিখ নেহাত ই উৎসুক হয়ে দেখতে গেছিলাম এস এস সি র অনশন মঞ্চে। শোস্যাল মিডিয়া তে কদিন ধরে বিভিন্ন পোস্ট থেকে অনশন র কারণ অথবা এই কদিনে অনশনের জন্য বিভিন্ন দুর্ভোগের কথা কানে আসছিল।
দেখতে গিয়ে দেখলাম একটা মঞ্চ হয়েছে। সেখানে নামকরা লোকেরা এসেছেন বক্তব্য রাখতে। কিছু ছেলেমেয়ে ফুটপাথ জুড়ে অস্থায়ী ছাউনি করে শুয়ে বসে আছে। একটা গণ কনভেনশন চলছে। ইতিউতি কিছু রিপোর্টার। আমার ই মত উৎসাহী জনতার ভীড়। কেউ অতি উৎসাহী হয়ে ছোটাছুটি করছে তো কেউ বুঝে নিতে চাইছে ব্যাপার টা। সেই চেনা বক্তব্য, সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতির বিরোধিতা নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য। সুযোগ বুঝে কেউ একের পর বেসুরো গান গাইছেন। কেউ একের পর এক কবিতা পড়ে চলেছেন। শ্রোতা হিসেবে কিছু উস্কখুস্ক চেহারার যুবক যুবতী।সত্যি বলতে গোটা ব্যাপারটা থেকে তখনো ব্যাপার টার গভীরতা আঁচ করতে পারিনি। আর পাঁচজনের মত আমিও আধ ঘন্টা থাকার পর পরিচিত একজনের সাথে দেখা করে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। এমন সময় দেখি একটা হই হট্টগোল। কিছু মানুষ একজন কে ধরাধরি করে অ্যাম্বুলান্সে তুলে দিচ্ছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজের কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে এগিয়ে গেলাম। শুনলাম একজন অচৈতন্য হয়ে গেছে। তাকে হাসপাতাল এ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উপস্থিত একটা মেডিক্যাল টিম কে জানতে চাইলাম ক্যাপিলারি গ্লুকোজ র লেভেল কত। কোন উত্তর এল না। প্রমাদ গুনলাম। অনশন মঞ্চে নূন্যতম মেডিক্যাল কেয়ারের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। সত্যি বলতে কি নিজের ওপর ভীষণ লজ্জা হল যে আমি একুশ দিনের পর এসেছি। এই আমার নাগরিক সচেতনতা। একটা অত্যন্ত গ্লানিধোধ থেকে মনে হল অন্ততঃ একটা সিবিজি মেশিন যদি জোগাড় করে দিতে পারি। ফোন করলাম ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ কে। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের অন্যতম কাণ্ডারী কে ফোন করে একটা আশার আলো পেলাম। জানলাম এর আগেরদিন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এখানে ক্যাম্প করে গেছে। সঙ্গে কুশল ছিল। কুশল শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের সাথে যুক্ত। ফোন করে বাগড়ি মার্কেট থেকে একঘন্টার মধ্যে একটা মেশিন জোগাড় হল। কথা হল পরদিন সকাল থেকে পুণ্যব্রত দার সহযোগিতায় ওখানে এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু করব।
একুশে মার্চ স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু করে পরিস্থিতি র ভয়াবহতা টের পেলাম। ইতিমধ্যে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি।
ইতিমধ্যে একজনের গর্ভপাত হয়েছে। কয়েকজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। চর্মরোগ এ ভরে গিয়েছে সারা গা।
মহিলা যারা আছেন তাদের শৌচালয় সংক্রান্ত সমস্যা আছে। ইতিমধ্যেই অনেকের শরীর বাসা বেঁধেছে ক্ষতিকর ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনেফেকশন। কারো কারো সিভিয়ার oliguria দেখা দিয়েছে। জল খেলেও সেই ভাবে ইউরিন হচ্ছে না।
কারুর বুকে বাসা বেঁধেছে ইনফেকশন।আগেরদিন যে অজ্ঞান হয়েগেছিলেন। সেই অর্পিতা দাসের pallor দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। ভয়ানক রক্তাল্পতা দেখা দিয়েছে। শুধু অর্পিতা দাস নয় মহিলা অনশনকারীদের অনেকেই রক্তাল্পতায় ভুগছেন। এই কদিনে তা আরো বেড়েছে।
কোন কোন অনশনকারীর ব্লাড প্রেসার ভীষণ কম। উঠে বসতে গেলে যা কিছু হতে পারে।
সবাই মোটামুটি ভয়ানক আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নীচে। কোন কোন প্রার্থী ভয়ানক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। তাকে মানসিক ভাবে সাপোর্ট দেওয়া কতটা দরকার না গেলে বুঝতাম না। সবার রক্তে শর্করার পরিমাণ কম। যে কোন সময় গতকালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তবু সবকিছু অতিক্রম করে ওরা লড়াই করছেন। খোলা আকাশের নীচে, দূষিত পরিবেশে, অপরিষ্কার শৌচালয় ব্যবহার করে, মশার কামড় খেয়ে শুয়ে আছেন। একবার এসে ওদের কথা রাষ্ট্র শুনবে এই আশায়।
ঠিক হল আমি রবিবার পর্যন্ত রোজ সকালে যাব। দুপুরে কুশল আসবে। প্রথম দিনের চেক আপের পর একটা ওষুধের তালিকা তৈরী হল।
বাইশে মার্চ অর্পিতা শ্রমজীবী হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে আসল। সকাল থেকে ওষুধ দিতে শুরু করলাম।
কারোর বাড়িতে বাবা অসুস্থ কারোর সব চৈতালী ফসল বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। চাকরী টা না পেলে জীবন অন্ধকার। সকলের একটাই কথা হয় চাকরী পাব নয়তো মৃতদেহ বাড়ি যাবে। সত্যি বলতে সান্ত্বনা দেব সেই ভাষা ছিল না। এর মধ্যে শুধু দেখছি এক একটা রাজনৈতিক আসছে আর তার পেছন পেছন মিডিয়া। ক্লান্ত লোকগুলো র চোখে একটু আশার আলো। যারা চলে গেলে শশ্মানের শূন্যতা গ্রাস করছে গোটা চত্বর টায়। পাশের প্রেস ক্লাবে বসন্ত উৎসবের গানবাজনা আর ঠিক পাশেই বিবর্ণ বসন্ত। কি অদ্ভুত আমাদের নাগরিক বোধ।
শুক্রবার সন্ধে বেলা ভীষণ ঝড় এলো। তবু ওরা ওঠেনি। শুধু একের পর ছেলেমেয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমরা ডায়েরিয়া, সর্দি কাশি, চর্মরোগ র ওষুধ দিলেও। ওদের অদম্য অনশনের জোর অবাক হয়ে বসে বসে দেখেছি।
তেইশে মার্চ সকালে তানিয়া শেঠের ব্লাড প্রেসার তখন খুব অল্প। শুয়ে থাকার উপদেশ ছাড়া আমাদের আর কিছু বলার ছিল না। এমন সময় একটা বড় রাজনৈতিক দল এলো দেখা করতে। চারপাশে ঘিরে মিডিয়া। নেতারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু নিরাপদ দূরত্ব থেকে কথা শুনলেন, শাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথা বললেন। কিন্তু এর বেশী খুব কিছু সাহায্যের আশ্বাস আমার মত রাজনীতি বিষয়ে অজ্ঞ মানুষের মাথায় ঢুকল না। এর মাঝে যেটা হল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, প্ল্যাকার্ড মাথার ওপর তুলে থেকে তানিয়া ও অজ্ঞান হয়ে গেল। মিডিয়া অনেককিছু তুলে নিয়ে গেল। টিভি খুলে বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না। শুধু শোনা গেল পুলিশ এসে হুমকী দিয়েছে তুলে দেওয়ার।
আজ চব্বিশ মার্চ গেছিলাম সকালে। ইতিমধ্যে আমাদের মেডিকাল টিম বড় হয়েছে। কিশলয় দা, বিশ্বজিত দা, পুণ্য দা নিজে, সঞ্জয় দা সবাই আসতে শুরু করেছে। কিছু সংস্থা ওষুধ নিয়ে এসেছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন জোগাড় হয়েছে। আজকে সকালে যখন গেলাম তখন মনে হল ওরা আমার কত দিনের পরিচিত। নিজেরা না খেয়ে। আমাকেই জিজ্ঞাসা করল আপনি খেয়ে এসেছেন?
হ্যাঁ ওরাই আমাদের হবু শিক্ষক। একদিন কোন শিক্ষকের হাতে যেমন আমরা তৈরী হয়েছিলাম। ওরাও মানুষ তৈরির কারিগর। ভদ্র সভ্য ঘরের মেয়েরা খোলা আকাশের নীচে, নোংরা জল খেয়ে, নোংরা বাথরুম ব্যবহার করে দিন কাটাচ্ছে। এক বছর আগে মাথায় আঘাত লেগে একমাস আইসিউ তে থেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা ছেলেটি খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছে।
আমার প্রশ্ন সহজ। যখন দু হাজার টাকা দিয়ে সিভিক টিচার নিয়োগ করা হয়। তখন এসএসসি তে উত্তীর্ণ হওয়া এই ছাত্রছাত্রীদের এই সামান্য দাবী, যে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী তাদরে কাজ দেওয়া হোক, শুধুমাত্র সহমর্মীতার দিক থেকে সত্যি কি বিচার করে দেখতে পারে না সরকার? ওরা তো রাষ্ট্রের শত্রু না। ওরা রাষ্ট্রের কাছেই তো সহানুভূতি চাইছে। ওরা কাজ চাইছে। বাঁচতে চাইছে। সবাই কে ষড়যন্ত্রকারী, শত্রু ভেবে কি প্রাপ্তি হয় দিনের শেষে? ওদের কাছে এসে একবার ওদের কথা শুনলে খুব সম্মানহানী হবে? জানি না। খুব কষ্ট হচ্ছে কাল থেকে আর যেতে পারব না। ছুটি শেষ। নিজের কাজে ফেরার সময়। খুব কষ্ট হচ্ছে ওরা এখনো এভাবেই শুয়ে থাকবে। নিজের লেখা একটা কবিতা লিখে শেষ করি।
নতুনের বীজ সবুজ ফেরাবে বলে
কংক্রিট জুড়ে স্বপ্ন কে বুনেছিলে
তুমি বুক ভরা অভিমান নিয়ে একা
লড়াই টা তবু শুরু করেছিলে।
দানব বোঝে না অভিমান কাকে বলে।
হিংস্র পোষ্য খুঁজছে নতুন খাদ্য।
অলস শহরে ধর্ষিত হয় রোজ নারীর শরীর, নতুন লেখা পদ্য।
প্রতিদিন মন অনশন করে যেনো।
ভালোবাসা আর একটু আদর নেই।
তুমি বুকভরা অভিমান নিয়ে শুয়ে আছো একা।
কোনদিন যেনো মানুষ বদলাবেই।
আশা করি ওদের কথা একটা না একটা সময় সরকার শুনবে। একটা সময় মানুষ ওদের পাশে নেমে রাজপথ ভরাবে। শুধু যেন দেরী না হয়ে যায়। শুধু বলি যে ডাক্তারদের পিশাচ ছাড়া কিছু ভাবেনা সেই কিছু অসুর কালকে ও থাকবে ওদের পাশে। সীমিত সাহায্য নিয়ে। আপনি একবার গিয়ে একটু দেখে আসুন না ভাইবোন গুলোকে। ওরা যে বড্ড কষ্টে আছে।