জম্মু ও কাশ্মীর এবং সেখানকার মানুষদের কথা লেখা এই মুহূর্তে খুবই অর্থহীন। কারণ তাহলেই সাম্প্রতিক কথাবার্তা লিখতে হয়। বেতনভুক লেখকের দায়বদ্ধতা যেহেতু আমার নেই, তাই যেকোন লেখার মত এই লেখা শুরুর সময়ও আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন এ লেখা? খুব একটা সদুত্তর নেই। প্রথমত, জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কিত যা যা জানার তা আমাদের অনেকদিন ধরেই জানা আছে। গত এক প্রায় দেড় বছর ধরেই বহু মানুষ কাশ্মীর নামাঙ্কিত বইটা কিনেছেন, অনেকেই দাবি করেছেন পড়েছেন, সম্ভবত আরো বেশি মানুষ দাবি করেছেন পড়বেন। গুরুচন্ডালীর বইটির বাইরেও সিদ্ধার্থ গুহ রায়ের লেখা অসামান্য বই রয়েছে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে, সুতরাং পড়ালেখা করতে চাওয়া জনগোষ্ঠীর কাছে নতুন কোন কথা বলার নেই। পড়ালেখা করতে না চাওয়া যে বিপুল জনগোষ্ঠী এই মুহূর্তে ভারতীয় জনতা পার্টির সাফল্যে মশগুল, তাদের জন্যও যদিও উপরোক্ত বইগুলো লেখা হয়েছিলো, তবু তাঁরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে পড়ালেখার থেকে জাতীয়তাবাদী জিঙ্গোইজমেই বেশি উৎসাহী। তাহলে কেন এই অপচয়?
এই অপচয় জরুরি কারণ একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা যতই সাংঘাতিক হোক না কেন, সেখান থেকে শিক্ষা না নেওয়া তার থেকেও বড়ো ব্যর্থতা। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Sim Sitkin একটি চমৎকার গবেষণাপত্রে intelligent failure বলে একটা কথার উল্লেখ করেন1। এই মুহূর্তে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক মুখ বা মুখোসগুলি খসে পড়েছে। বিজেপি-আর এস এস মেরুকরণের যে প্রকল্পে নেমেছিলো তা সম্পূর্ণ। এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বুঝিয়ে ফেলা গেছে যে তাঁদের যাবতীয় সমস্যার, যাবতীয় অসুবিধের জন্য দায়ী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বুঝিয়ে ফেলা গেছে মানুষ পুড়িয়ে সেই আগুনে রুটি (বা নিদেনপক্ষে শীতার্ত হাত) সেঁকে নেওয়া যায়। বুঝিয়ে ফেলা গেছে মানবাধিকার বামপন্থীদের ব্যবহৃত একটি শব্দ, সবার মানবাধিকার প্রয়োজন হয়না। যেমন এখনও বহু মানুষ বিশ্বাস করেন যে ডিপ্রেশন স্রেফ বড়োলোকদের অসুখ বা সমকামীতা আসলেই "নিরাময়যোগ্য অসুখ"। ঠিক সেইভাবেই এখন বহু ভারতবাসী বিশ্বাস করেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকার এসব আসলে অখন্ড ভারতকে ব্যর্থ ভারত করে তোলার বামপন্থী কল। বিরোধীপক্ষে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, এর থেকে বড়ো রাজনৈতিক ব্যর্থতা সম্ভবত সাম্প্রতিক অতীতে তাঁরা দেখেন নি। তাই এই ব্যর্থতা থেকে আপাতত আমরা শিক্ষা নিতে পারি। আর কিছু না হোক, অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে রাখা থাকতে পারে এই ইতিহাস, যাতে আরেকটা ফ্যাসিবাদী সরকার আসার স্বাক্ষরগুলো চিনতে সুবিধা হয়।
শাসকের কাছে প্রজাচরিত্রের সবথেকে আকর্ষনীয় জায়গা হলো বিদ্বেষ। আর ঐতিহাসিক তিক্ততার উপর ভর করে যে জাতিগত বিদ্বেষ গড়ে ওঠে তার থেকে বড়ো অস্ত্র কু-শাসকের নেই (সুশাসকের এই অস্ত্র দরকার হওয়ার কথা নয়)। উদাহরণস্বরূপ হিন্দু-মুসলমান তিক্ততার কথা তো বলা যেতেই পারে, কিন্তু যেহেতু তা অতিব্যবহৃত উদাহরণ এবং দুটি পৃথক ধর্মের মানুষের উপস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে আরো জটিল, তাই আমরা একটি বিকল্প ও অপেক্ষাকৃত সহজ উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করবো। স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বই থেকে শুরু করে বিদগ্ধ ঐতিহাসিকের লেখাপত্র সবেতেই উল্লেখ আছে স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের অবস্থা কিরকম ছিলো। দেশীয় রাজা/নবাব দ্বারা শাসিত একগুচ্ছ প্রিন্সলি স্টেটের সমাহার, যাকে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ বলা হয়ে থাকে, সেই ভূখন্ডের মানুষেরা বহুদিন ধরেই পারষ্পরিক ঈর্ষায় বাকি পৃথিবীর থেকে আলাদা। যে পরশ্রীকাতরতার সাথে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয় সম্যকভাবে পরিচিত তার জন্য কোন বিশেষ আইডেন্টিটি দরকার হয়না। এর সাথে মনে রাখতে হবে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার কথা, যা অতি সহজেই মানুষকে শোষক হিসেবে মজবুত করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই সচ্ছল ভারতবাসীর শস্তা শ্রম নিয়ে কোন সমস্যা হয়না। ডোমেস্টিক হেল্প থেকে ড্রাইভার থেকে মিস্ত্রি সবাইকে দিয়ে দেশপ্রেমে মশগুল ভারতীয় অল্প পয়সায় কাজ করাতে উন্মুখ। ২০১৪ সাল থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি ভারতবাসীর এই মানসিকতার ফায়দা তুলছে। যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটি বিশেষ ধর্মের ছাতার তলায় থাকতে বেশি স্বচ্ছন্দ সেখানে ভোটে জেতার জন্য যে শুধু তাদের খুশি করলে চলে এটা জানার মধ্যে কোন শক্ত অঙ্ক নেই। যেখানে শক্ত অঙ্ক আছে তা হলো ইতিহাস থেকে দেখে নেওয়া যে ভারতীয়রা কোনদিন ঐক্যবদ্ধ জাতি ছিলোনা, এবং স্বদেশবাসীর ওপর সেই হিসেবের প্রয়োগ। ইংরেজদের পর সম্ভবত বিজেপি-আর এস এস নেতারাই সবথেকে ভালোভাবে ভারতের রাজনৈতিক সিস্টেমকে ব্যবহার করতে পারলেন। যে উদাসীনতায় মানুষের অসুবিধা (ক্ষেত্রবিশেষে সর্বনাশ) ঘটিয়ে বিজেপি সরকার ডিমানিটাইজেশন করেছিলো, যে উদাসীনতায় কৃষকদের আত্মহত্যা বা দলিতদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন অগ্রাহ্য করেছিলো, সেই একই উদাসীনতায় সরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। একথা অনস্বীকার্য্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুরা দুটি মনোলিথিক সম্প্রদায় না, কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে তার অনেকটাই উপরোক্ত মেরুকরণ প্রমাণ করে। কাজেই দেশের একটি রাজ্যের মানুষের দীর্ঘদিনের দুরবস্থার ওপর নতুন করে আঘাত হানার সমস্ত আয়োজন যখন প্রস্তুত, সেই আগুন ঘিরে বিপুল মানুষের উল্লাসে আমি এতটুকুও আশ্চর্য নই। কাশ্মীরে এখন থেকে বাইরের মানুষ যেতে পারবেন, জমি কিনতে পারবেন, সম্ভবত শস্তায় কাশ্মীরী মানুষও কিনে ফেলা যেতে পারে এই উল্লাসকর সম্ভাবনায় বুঁদ ভারতবাসী তাই সাফল্য উদযাপনে ব্যস্ত। এবং একথা যখন ইতিমধ্যে দল নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক নেতাই প্রমাণ করে ফেলেছেন যে বৃহত্তম গণতন্ত্রের নামে যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তা আসলে নব্য সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, তাই গণতান্ত্রিক অধিকারের মত আপদ নিয়ে আলোচনায় উল্লসিত সম্প্রদায় একেবারেই আগ্রহী নয়।
হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে এতদিনে সম্ভবত সবাই আর্টিকল ৩৭০ সম্পর্কে সবই জানেন। তবু প্রাসঙ্গিক বিষয় বলে তার পটভূমিকা একটু ফিরে দেখা যাক।
২৬শে অক্টোবর, ১৯৪৭ সালে সাক্ষরিত হলো জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির দলিল বা Instrument of Accession, যেখানে বলা হলোঃ
ক) প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা -- কেবলমাত্র এই তিনটি দপ্তরের কাজে ভারত হস্তক্ষেপ করবে, বাকি দপ্তরগুলি জম্মু ও কাশ্মীরের অধীন থাকবে।
খ) জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অন্তর্ভুক্তির প্রধানতম শর্ত। স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থাকলে তবেই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতভুক্ত হতে চায়।2
১৯৪৯ সালের অক্টোবরে স্বায়ত্তশাসনের বন্দোবস্ত মেনে নিয়ে ভারতের আইনসভা (constituent assembly) সংবিধানে 306A ধারা যুক্ত করে। সেখানে উপরোক্ত তিনটি দপ্তর বাদে বাকি বিষয়গুলি যে রাজ্য সরকারের অধীন থাকবে সেকথা ছাড়াও আরেকটি কথা বলা ছিলো। তাহলো, বন্দোবস্তটি অন্তর্বর্তীকালীন বা interim, যতদিন না জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ গণভোটে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছেন শুধু ততদিনই বলবৎ থাকবে।3
১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয়, যেখানে 306A ধারাটি নতুনরূপে 370 ধারা হিসেবে স্থান পায়।4
বলা বাহুল্য, উপরোক্ত শর্তগুলি প্রথম থেকেই ভারত সরকার নানা ছলে অমান্য করে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ করণ সিং এর আমলে জমি ক্রোক সংক্রান্ত আইনের কথা বলা যেতে পারে। জমি সংক্রান্ত আইন জম্মু-কাশ্মীরের আভ্যন্তরীন বিষয় হওয়া সত্ত্বেও করণ সিং ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন, আর ভারতও চুক্তিবহির্ভূত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও খুবই আগ্রহের সাথে সেই সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করে। করণ সিং এর আগ্রহের কারণ ছিলো। ডোগরা রাজাদের আমলে জম্মু-কাশ্মীরের হিন্দু প্রজাদের খুবই রবরবা ছিলো। অধিকাংশ জমি তাদের দখলে, ফলে সংখ্যালঘু ধনী জমিদার (যাঁরা ধর্মে হিন্দু) আর সংখ্যাগুরু মুসলমান প্রজা --এই মোটের ওপর ছিলো অবস্থা।5
শেখ আবদুল্লা জমিদারদের মোট জমির পরিমাণ বেঁধে দেন, এবং চার লক্ষ একর জমি ক্রোক করে ভূমি সংস্কার হয়, এবং ক্রোক করে নেওয়া জমির জন্য কোন ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি। স্বভাবতই ডোগরা রাজপুত এবং কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিয়ে তৈরী হিন্দু জমিদার জনগোষ্ঠী তাতে খুবই অসন্তুষ্ট হয়। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে করণ সিং খুবই আগ্রহী ছিলেন জমি ক্রোক সংক্রান্ত আইনটি পরিবর্তন করার। অন্যদিকে ভারত সরকারের প্রথম থেকেই আগ্রহ ছিলো জম্মু কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে অমান্য করার, যে কারণে নতুনরূপে 306A থেকে যখন 370 লেখা হয়, তখন কয়েকটি উপধারা যুক্ত করে রাখা হয়েছিলো যাতে দরকার মত রাজ্যের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে।5,6
এর প্রমাণ আমরা পাই ভারত সরকারের পরবর্তী কার্যক্রমে। ১৯৫০ থেকে শুরু করে ২০১৮ পর্যন্ত মোট ৪৯ টি প্রেসিডেন্শিয়াল অর্ডার পাস করা হয়েছে। এর সবগুলোতেই রাজ্য সরকারের সাথে আলোচনা করে দুপক্ষের সম্মতিক্রমেই নেওয়া হয়েছে বলে প্রকাশ।6 এইসব রাজ্য সরকারের ক্ষমতা গত কয়েকদিন ধরে জম্মু-কাশ্মীরের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থা দেখলেই অনুমান করা যায়। আর্টিকল 370 লোপ করার আগে থেকেই ওমর আবদুল্লা, ও মেহবুবা মুফতি গৃহবন্দী ছিলেন। সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন সেকথা দেশ বিদেশের সংবাদসংস্থার প্রতিবেদনে ভালোই বোঝা যায়। কোথাও অ্যাম্বুলেন্সে সন্তানের জন্ম দিতে হচ্ছে, কোথাও জানলা দিয়ে কর্তব্যরত সাংবাদিকের কাছে রোগীর অবস্থা জানতে চাইছেন আত্মীয়। বিক্ষোভ চলছে, পাথরের বিনিময়ে পেলেট গান চলছে। ৫০০ বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়েছেন, অমিত শাহ দাবি করেছেন অবস্থা শান্তিপূর্ণ। পেলেট গানের জখমে কেউ মারা না গেলেও বহু মানুষ অন্ধ হবেন বলে মহারাজ হরি সিং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। এই ধরণের খবর আমাদের কাছে সকালের দুধ-সিরিয়ালের মত, তাই অত্যাবশ্যক কথা না বাড়িয়ে একসাথে করে রাখা তথ্যসূত্রে রেখে দেওয়া থাক মোদি সরকারের শান্তিপূর্ণ অভিযানের খবরাখবর।7-20
পুরোনো অত্যাচারের কাহিনী থাকুক, বরং নতুন কিছু কথা জানা যাক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর থেকে আমরা বহু নতুন বিষয় জানতে পারছি। কয়েকটি উদাহরণঃ
(উদ্ধৃতিগুলির বানান অপরিবর্তীত)
প্রধানমন্ত্রীর শাক দিয়ে স্যুট ঢাকার প্রবণতা পুরোনো, এবং এখন আর ঠিক তেমন ভালো বিনোদনও দেয়না। বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন করে, পর্যটকদের যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বের করে দিয়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থা কেটে দিয়ে গত কদিন ধরে যা হলো তা জঘন্যতম প্রজাপীড়ন বই কিছু নয়। এখন প্রশ্ন হলো কাশ্মীরবাসীর ওপর এই জুলুমবাজি করে আর্টিকল 370 লোপ করে নতুন করে কী উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে ? আর্টিকল 370র সাথেই আরো একটি ধারার কথা খুব শোনা যাচ্ছে, আর্টিকল 35A, যা জম্মু-কাশ্মীর সরকারকে কয়েকটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার স্বাধীনতা দেয়। ধারাটি নিম্নরূপ :
"Saving of laws with respect to permanent residents and their rights. — Notwithstanding anything contained in this Constitution, no existing law in force in the State of Jammu and Kashmir, and no law hereafter enacted by the Legislature of the State:
(a) defining the classes of persons who are, or shall be, permanent residents of the State of Jammu and Kashmir; or
(b) conferring on such permanent residents any special rights and privileges or imposing upon other persons any restrictions as respects—
(i) employment under the State Government;
(ii) acquisition of immovable property in the State;
(iii) settlement in the State; or
(iv) right to scholarships and such other forms of aid as the State Government may provide,
shall be void on the ground that it is inconsistent with or takes away or abridges any rights conferred on the other citizens of India by any provision of this part."21
অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা কারা হবেন, সেখানকার জমি কারা কিনতে পারবেন, রাজ্য সরকারের পদগুলিতে কারা নিযুক্ত হবেন ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে রাজ্য সরকারের কথাই শেষ কথা হবে। এই ধারাটি আলাদা করে খুব তাৎপর্য্যপূর্ণ নয়, স্বয়ত্তশাসনের শর্তে অন্তর্ভুক্ত একটি জনপদের দাবি হিসেবে খুব ন্যায্য দাবিই বরং বলা যেতে পারে, কিন্তু 370 লোপ করে দিলে এর আর অস্তিত্ব থাকেনা - এই ব্যাপারটা খেয়াল করলে আমরা উপরোক্ত জুলুমবাজির উদ্দেশ্য বুঝতে পারি। একেবারে শুরুর দিন থেকে হিন্দু মৌলবাদী শক্তিগুলি জম্মু-কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িকতার চাষ করে এসেছে। ১৯৪৭ সালে হরি সিং এর মদতে তৈরী হয় জম্মু প্রজা পরিষদ (প্রতিষ্ঠাতা আর এস এস সদস্য বলরাজ মাধোক)। এই সংগঠনের সদস্যরা ছিলেন ক্ষুব্ধ, সদ্য জমি হারানো হিন্দু জনগোষ্ঠী। সেই সময় থেকেই জম্মু প্রজা পরিষদ এবং অন্য রাজ্যের উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলগুলি জম্মু-কাশ্মীরের "স্পেশাল স্টেটাসের" বিপক্ষে সোচ্চার হয়।5 সুতরাং আর্টিকল 370 তুলে দেওয়া যে আদপেই হিন্দুদের জমিজমার পুনর্দখল সংক্রান্ত উদ্যোগ সেক্থা হয়ত অত্যুক্তি নয়। সেই সুদূর অতীতে শুরু করা প্রকল্প (যে জন্য ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জি কাশ্মীর যান, এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে জেলে যান) তা এই ২০১৯ সালে বাস্তবায়িত হলো, কিছু প্রতিবেদনে একেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো বলা হচ্ছে। যেটা একেবারেই বলা হচ্ছে না, তাহলো 370 ধারা তুলে দিলে তা যেমন 35A কেও বিলুপ্ত করে, সেই একই আইনি সমস্যায় 370 ধারা তুলে দিলে জম্মু-কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির দলিল বা instrument of accession ও বাতিল হয়। সারা পৃথিবী যদি একটি অখন্ড জনপদ হত, এবং সেখানে যদি একটি সাধারণ আদালত থাকতো, তাহলে জম্মু-কাশ্মীরের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের এই আইন বাতিল হতে এক মিনিটও লাগতো না। এমনকি কদিন আগেই ভারতেরই সুপ্রীম কোর্ট ৩৭০ ধারাকে "permanent" বলে রায় দেয়। ২০১৮ সালের সেই রায়ে বলা হয়েছে "Article 370 of the Constitution, conferring special status on Jammu and Kashmir conferring special status on Jammu and Kashmir and limiting the Central government's power to make laws for the state, had acquired permanent status through years of existence, making its abrogation impossible".22
জম্মু ও কাশ্মীর হাইকোর্টের রায়ও উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১৫ সালের সেই রায় সম্পর্কে ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস লেখে ঃ "In a landmark judgment, the J&K High Court has observed that the Article 370 is a “permanent” provision of the Constitution and that it cannot be “abrogated, repealed or even amended”. The court has also described Article 35A as one “giving protection to existing laws”.23Instrument of Accession ব্যতীত ভারতের সাথে জম্মু-কাশ্মীরের কোন গাঁটছড়া নেই, কোনদিন ছিলোই না। এই মুহূর্তে আইনত তাই ভারত সেনা জম্মু-কাশ্মীরের একটি বহিরাগত শক্তি। পাকিস্তান বহুদিন ধরে যে অর্ধসত্যের উপর মামলা সাজিয়ে আসছে, মোদী নেতৃত্বে বিজেপি সরকার সেই মামলার চূড়ান্ত সিলমোহর দিলো। যেভাবে ডিমানিটাইজেশনের কিছুদিন পরেই ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি এবং স্কেপগোট খোঁজা শুরু হয়েছিলো, সেভাবেই সরকারকৃত এই আইনি আত্মহত্যার জন্যও কোন শাকের আঁটি বা ফ্যালনা ছাগল খোঁজা হবে কিনা তা সময়ই বলবে। যদিও এটা জানার জন্য অপেক্ষার দরকার নেই যে সবথেকে চড়া দাম দিতে হবে জম্মু-কাশ্মীরবাসীকেই।
এই বিস্তারিত বেইমানির ইতিহাস জানার পরে আমাদের হাতে তাহলে কী রইলো? যেকোন প্রকল্পের যেমন কিছু বাই-প্রোডাক্ট হয়, 370 বিলোপেরও তেমনি কিছু বাই-প্রোডাক্ট আছে। ক্রমশই দুর্বল হতে থাকা অর্থনীতি নিয়ে যাতে মানুষ বেশি ভাবতে না পারেন, ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা (যা নাকি 370 উঠে গেলেই সেরে যাবে) যাতে আমাদের খুব বিচলিত না করে, দুম করে মব লিঞ্চিং হয়ে থেঁতলে মরে যাওয়ার ভয়ে আমরা যাতে কুঁকড়ে না যাই ---সোজা কথায় মোদীরাজত্বে নাগরিকজীবনের ছোটখাটো ওঠাপড়া যেন গায়ে না লাগে তার অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম পেশ হলো 370 বিলোপের পথ ধরে। উপরি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার একটা বাজনাও বাজিয়ে ফেলা গেল। প্রসঙ্গত, ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা ঠিক কেমন মজবুত তার সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ খুব একটা দুর্লভ নয়। প্রধানমন্ত্রীর অসংখ্য বিদেশ সফরের অশ্বডিম্ব সবে ফুটতে শুরু করেছে, ফলে বিদেশী লগ্নী নেই, দেশীয় ব্যবসার হাল খারাপ, কর্মী নিয়োগ বন্ধ বা ছাঁটাই চলছে এবং আ-মরি আইটির বাজার নিম্নমুখী।23
এই লেখা শুরু হয়েছিলো এই লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে। এই নিবন্ধ এবং আরো অসংখ্য যেসব লেখাপত্র গত কয়েকদিনে লেখা ও পড়া হয়েছে -- সেসবে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের কোন উপকারই হবেনা। ভারত রাষ্ট্র হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে কোনদিনই গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি দেয়নি, মানবাধিকারের নামে প্রহসন করে এসেছে, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লোপ করার ফন্দি এঁটেছে। অতীতেও কোন আইন, কোন চুক্তি, কোন রাষ্ট্রসংঘ বা মানবাধিকার কমিশন অবাধ অত্যাচার আটকাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবেনা। কাশ্মীরই সেই ভূস্বর্গ যেখানে আফস্পায় আটক বন্দীদের নিজের গায়ের মাংস খুবলে খেতে বাধ্য করা হয়।10
গত ২৫ বছর ধরে জম্মু-কাশ্মীর জরুরি অবস্থায় বাস করে আসছে, যতদিন না কাশ্মীর উপত্যকা জনশূন্য হচ্ছে, ততদিন এরকমই চলবে। আসুন আমরা ভারতীয় ক্রিকেট দলের মত ভারতীয় জনতা পার্টির বিজয়গর্বেও উৎফুল্ল হই।
তথ্যসূত্রঃ