যতদিন না দেখা হয়, তোমাকে লিখে রাখি
বিচূর্ণ সময় প্রতিদিনকার মৃত্যু
আমার আঙিনায় বেল ফুলের ক্ষয়ক্ষতি।
শবযাত্রা
প্রতিদিন ভোরে ওঠে অমঙ্গল
সূর্যের মুখ থেকে বারান্দায়, সারাদিন জমা পড়ে
খড়িকাঠ খড়পাতা
সন্ধ্যায়-
রাত্রি তার বুঝে নেয় আগুনের দরকারি পাতাগুলি
খড়গুলি জ্বলে ওঠে সারারাত
দাহ মেনে জেগে যাই।
আগুনের হাত ধরে দেখা হয়
লিখে দিই ছাইগুলি বাতাসের।
(ছাইগুলি বাতাসের/ মোস্তাফা মঈন/ রক্ত মাংসের শ্লোক/ ডুমুর)
মরা মাছের চোখের মত তা ছিল ক্ষুদ্র ও নিষ্প্রভ, আমাদের স্কুল জীবন বা মফস্বল। মরা মাছের চোখ যায় যত দূরে, সাইকেল বুঝি কখনো অপেক্ষা করত ঠিক ততটা দূরে পার্শ্ববর্তী স্কুলের শেষ ঘন্টাটি শোনার জন্য। কার জন্য, আজও জানি না। তবে, রবিবারে ক্ষমাদি আসতেন সেতার শিখতে পাশের বাড়িটিতে, তার শাড়ি বা সালোয়ার মিশে থাকত তার পেলব ত্বকে, আজ যদি বলি সে’ই ছিল সেতার আর হাসলে ঝালা বাজত দুই বাড়ির সীমানায় থাকা কাঞ্চন ফুলের গাছে, তাহলে আজ সেই শহরের অনেকেই মেনে নেবেন, সেই ছিল আমাদের মধুবালা টু সুচিত্রা সেন। মাধ্যমিকের পর জেনেছিলাম ক্ষমাদির ছেলে পড়ে আমার থেকে এক ক্লাস নীচুতে, কাজেই দলে ভারী হওয়ারই সম্ভাবনা। গুপী ডাক্তারের মেয়ে মহাশ্বেতা ছিল আমার থেকে দুই বছরের ছোট। শান্ত মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে তর্ক করত নাওয়া-খাওয়া ভুলে, সেই JNU যাওয়ার আগে পর্যন্ত। কানগুলো লাল হতে হতে কখন যে ঝান্ডা হয়ে পতপত করে উড়ত টের পেতাম না। ভাবতাম বুঝি ম্যাজিক দেখছি, সে যে শুধু আমিই দেখতাম না তা নয়, বিজনজেঠুকে সাইকেলে নিয়ে তাদের বাড়ি যাওয়া সূত্রে; বিজনজেঠুই দেখতে পেত সকলের আগে। আমি কি ছাই সে বয়সে অত কিছু দেখতে পেতাম, আজও হয়ত পাইনে, কিন্তু মহাশ্বেতা উফফ সে এক প্রকাণ্ড কাণ্ড বটে, বিজনজেঠুর সঙ্গে তর্ক করত বেদ-উপনিষদ নিয়ে যার বিন্দুমাত্র বুঝতাম না আমি, নির্ঘাত সেসব বেদ-উপনিষদ ফ্রেঞ্চ নতুবা জার্মান ভাষার। টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আমাদের পাশের কোয়ার্টারের গায়েনকাকুর ছিল তিন মেয়ে শাশ্বতী, মহুয়া আর কাকলি। ছোটটি আমার সমবয়সি গানের গলা ছিল তারাপদ রায়ের মত। মেজটি একবছর অন্তর ফেল করে সমক্লাসী হয়েছিল, একদা। বড় মেয়ে সারা জীবনে একটা ছবিই নিদেন পক্ষে দশ হাজারবার এঁকে ছিল গুচ্ছের মোম ও জলরঙ নষ্ট করে। একটা বাঁশ যার মাথাটা মানুষের। কম্পিটিশনে-টনে ‘একটি গ্রামের দৃশ্য’ বা ‘বাংলার উৎসব’ বিষয় দেওয়া থাকলেও সে সেই হাইফান্ডার ছবিটিই আঁকত, ফলের আশা না করে। তার দেখাদেখি মেজ মেয়েটিও যখন ওই একই ছবি সকাল বিকেল প্র্যাকটিশ করতে শুরু করে সেই সময়ে আমরা কোয়ার্টার ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। আমাদের একরত্তি মফস্বলে রুমঝুম মিত্র সম্ভবত বিখ্যাত ছিল অনেক কারণেই। প্রয়াগে যেমন গঙ্গা আর যমুনাকে রঙের তারতম্যে চেনা যায় তেমনি ছিল রুমঝুমের অন্তঃ ও বহিঃবাসের তফাত। অন্তঃ বলে কিছু আদিতে থাকলেও অন্তে থাকত না। অতএব সে ছিল ডাকাবুকো। প্রেম করত তারক নামের এক মোটর মেকানিক বা গ্যারেজের মালিকের সঙ্গে। মাধ্যমিকের পর তিনমাসের ছুটির অবকাশে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলে। আমি আমার উচ্চ-মাধ্যমিকের পর দেখেছি রুমঝুম বাচ্চা কোলে নিয়ে এক হাতে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিত বুক ফুলিয়েই, বাচ্চার আড়াল থাকায় ততটা টের পাই নাই, মাইরি। আমাদের স্কুলের পাশেই গঙ্গা বরাবর হুগলি মহসীন কলেজে আমরা ক্লাস করতে যেতাম, উঁহু কোন জয়-জয়ন্তীর অপর্ণা সেন গোছের দিদিমণির জন্য নয়, সামান্য এক ছাত্রীর জন্য। ফলে ক্লাসের বিষয় ছিল গৌণ, চিত্রোপমা সেনগুপ্ত ঢের ঘটনাপ্রবণ, ফলে সব ক্লাসই ছিল দর্শনের। স্কুলের ব্যাগে একটা টি-শার্ট ভরা থাকত টানা বছর খানেক, দর্শন-শাস্ত্রে অনার্স পড়ার মামুলি পাসপোর্ট। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার চাইতে অন্য সিনেমায় প্রবেশ করতাম আমরা, আদি বাংলায় যার নাম ঝারি। এক ফুল দো মালি, মেনলি দুই বন্ধুর অভিপ্রায় বদবুদ, তার নামটা আর কবরস্থানে উল্লেখ করলাম না চারপাশে অশান্তির সংসারে বোঝা না বাড়ানই শ্রেয়, আজকাল সমতলেও ল্যান্ড স্লাইড ঘটছে ঘনঘন, ললিতা রায় বলে দিয়াছে গোরস্থানে সাবধান। ইউনিফর্ম বদলে সোজা কলেজ। এটা ছিল বেশ নিয়মিত ব্যপার, একজন অধ্যাপক আমাকে নামেও চিনতেন মনে আছে। সেই চিত্রোপমার নামডাক ছিল প্রেম ভাঙতে, সিওওওওওওওওওর শট। আভিজিৎ-মৌসুমীর তিন বছরের জমাট প্রেম ভাঙ্গতে সে সময় নিয়েছিল সাড়ে তিন মিনিট, মাত্র একটি চুম্বন। হায় তখন আমাদের জমাটি প্রেম নাই, ভাঙাভাঙিও নাই, শুধু হতাশা। ইংলিশ অনার্সে পড়ত রানু। রানু চক্রবর্তী। বিটিপিএস থেকে আসত। বন্ধু প্রতনুর তখন প্লে টাইম। আরেক সহপাঠী মিত্রার সঙ্গে লুকিয়ে চুটিয়ে প্রেম করায় রানুর কাছে আমি গেছি মাঝে মাঝে প্রক্সি দিতে, ডিস্ট্যান্ট প্রক্সিমিটি। ইংলিশ অনার্স পড়া রানু আমার সেকেন্ড পেপারের রিয়েল আনালিসিসের ক্লাস নোট সুন্দর করে ফেয়ার করে দিত, পাছে আমার একটু লেখাপড়ায় মন বসে। হা হতোস্মি, কাকস্যপরিবেদনা। না আমার কিস্যু পরিবর্তন হয়নি তাতে, বোঝে না সে বোঝে না। পরে, বছর ৫/৬ পরে শুনেছিলাম রানু বাড়ি থেকে পালিয়েছে শীতে কাশ্মীর থেকে আসা এক শাল-ওয়ালার সঙ্গে। কাজেই অকরিতকর্মা হিসাবে যেমন পেকে ঝানু হচ্ছিলাম দিনকেদিন, তেমনই পালাচ্ছিলাম সেই ছেঁড়া গার্ডারের মত নদীটির পাশে পড়ে থাকা চেনা মফস্বল ছেড়ে, কোন উপসিদ্ধান্তে আসাটা জরুরি নয় জেনেও। জানালার বাইরে তখন প্রবল ঝড়। মন অশান্ত। ঝান্ডা, মায়া, ভাষা সব সুনির্দিষ্ট অলৌকিকতার বশবর্তী ছিল না। অতঃপর আখ্যান আরম্ভ।
(১)
সকালে মেয়েরা আসে দুপুরে ছেলেরা করে ক্লাস,
একটাই স্কুলবাড়ি এক উঠোন একই চাঁপাগাছ
সীমাহীন ফাঁকা মাঠে, গরু চরে, আমগাছে আম
গ্রীষ্মের ঝাঁ-ঝাঁ রোদ, বহুদূরে বসে থাকে গ্রাম।
নদীর ওপারে বন, নীলিমায় ভেসে যায় পাখি
একই ঘন্টা বাজে একই টেবিলে বই রাখি।
জেগে ওঠা দুটি ঢেউ, নদীবড় স্থির মনোরম
ওই যে পালিয়ে যাওয়া অচেনা খেয়ালে ছমছম-
লাজুক পথের ধুলো সেজে ওঠা রঙিন আকাশ
সকালে মেঘেরা আসে, দুপুরে হাওয়ারা করে ক্লাস!
ক্রমশ আকাশ জুড়ে বেড়ে ওঠে লঘু চোরাটান
সিলেবাসে নেই তবু লিখে ফেলি কবিতা ও গান।
(স্কুল/ পার্থপ্রতিম আচার্য/ একটু যদি সময় পেতাম/ আনন্দ)
একে মফস্বল তার উপর বাংলা বয়েজ ইস্কুল ফলে বান্ধবীকে আমার সঙ্গে পেতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। প্রাইভেট টিউটররা সে আমলে একমাত্র ভরসা হলেও তারা মানসিকতার দিক থেকে ছিলেন আরো গোড়া, মফস্বলী সিদ্ধান্তে। কাজেই নানান ছুতোর জন্ম হয় ও বিস্তার লাভ করে। এক দুই করে শুরু হয় সংখ্যায় তারা যেমন বাড়ে ছুতোরা আরো গাঢ় হয়ে বাড়ে। খাতা বদল ও বাড়ি যাওয়াটা ছিল চ্যালেঞ্জের কিয়দংশ। ছিপ যদি ফেলতে হয় পুকুরে মাছ আছে কি না জেনে ফেলাই ভাল। বান্ধবীদের সংখ্যা তখনই চক্রবৃদ্ধিতে বাড়বে যে বান্ধবীর আবার অনেক বান্ধবী। যাক এই লেখা যে বান্ধবীদের নিয়ে না হলেও তাদের একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না বেশ বুঝতে পারছি। দীর্ঘশ্বাসের গল্প থাক আপাতত। আর নিদাঘ দগ্ধ এই লেখাতে বসন্তের বাতাস পাওয়া দুষ্কর। ফলত যারা বুদ্ধদেব মার্কা যৌবন যাপনের গল্পের নির্যাসটুকু নিতে এই লেখা এতক্ষণ পড়ছিলেন তারা এইবার এইখানে দাঁড়ি টানুন। এই একটা ব্যাপারে আমাকে ভরসা করুন, আমারও সময়ের দাম অনেক, অনর্থক না হেজিয়ে আমিও এবার সোজা রাস্তায় উঠিয়া পড়িব। সঙ্গত কারণেই আমি হয়ত তাদের নাম উল্লেখ করছি না তবে আভাস দিচ্ছি বুঝে নেওয়ার, নামের অদ্য অক্ষর দিয়ে লিখছি আপাতত বাট পাব্লিকের আপত্তিতে নট ইন দ্য সেম অর্ডার, আমার এ ধৃষ্টতা মাফ করবেন প্রিয় পাঠিকা। না এর সঙ্গে আমার কবে কোথায় পেত্থম দেখা মনে নেই, কীভাবে তাও না। ইস্কুল যে আলাদা তা আর নিশ্চয় বলতে হবে না, কলেজ আলাদা, বিষয় আলাদা। ইউনিভার্সিটি এক হলেও ক্যাম্পাস আলাদা, কী করে যে আমারা এত বন্ধু হয়েছিলাম কে জানে, মানে আদৌ তো কথা ছিল না। সলিড বলতে যা বোঝেন তাই। ইঁটভাটার রামধনু সন্ধেবেলার ক্লাসে সে গঙ্গার বাতাস হয়েই আসত। আমাদের বন্ধুত্বে অনেকটাই ছিল শ্রদ্ধা। নিষ্কাম। এত সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল লিখতে লিখতে কী-বোর্ডে আঙুল কী ফুরফুরে চলছে! সেই আমার জীবনে প্রথম অনাত্মীয়া যার সঙ্গে প্রথম সিনেমায় গেছি সেই সবেতেই চোঁয়া ঢেকুর তোলা মফস্বল শহরে, সিনেমার নাম বলে এস্থলে আর প্যাক খেতে চাই না। (ভাইকিং এর দিদি প্ল্যাটিনামের সঙ্গে যদিও আগে গেছি কিন্তু সেখানে ভাইকিংও ছিল)। তাদের বিশাল বাড়ি তখন শরিকি ভাগ হতে হতে মাত্র দুটি ঘরে এসে ঠেকেছিল। না –এর ছোট্ট বোনটা ছিল আমারও বোন, আর প্রচন্ড আদরের। দিদির সময় হত না তাই আমিই ছিলাম বিকালে ধান্যক্ষেত্র দেখতে যাওয়ার সঙ্গী আবার অঙ্কের কড়া মাষ্টার, এক কথায় ছায়াসঙ্গী বা ন্যাওটা। না এর কলেজ জীবনে টুইশানি আর পরবর্তী জীবনে চাকরি করে অবসর বলতে বেঁচে ছিল সামান্যই। বাবার ফ্যাক্টরি লক আউট আর দীর্ঘ রোগ-ভোগে ক্লান্ত। কাকিমার বাতে পা টেনে টেনে চলতেন। দুই বোনের পড়াশোনা ও সংসার খরচ। না আমাদের কাছে ছিল মেঘে ঢাকা তারার জীবন্ত এক দলিল। তবু দাঁতে দাঁত চিপে সে নিজে পড়াশোনা করত আর বোনকে পড়াত। তাদের কাকা জ্যাঠাদের মধ্যে সবারই ছিল মেয়ে, একটি ছেলে ছিল বলে মনে পড়ছে, তবে সে পড়াশোনার চাইতে ক্রিকেট খেলেই বেশির ভাগ সময়টা কাটাত এবং ধীরে ধীরে বনেদী বাড়ির কায়দাটা রপ্ত করে ফেলে, হর্ষ ভোগলে না হয়ে মহাহর্ষে ভোগে গেল। না অবশ্য অবসরে তেল রঙে নিজের ছবি আঁকত, তখন তাকে গিরীশ দয়ালের মত লাগত, সর্বত্র ফুটে উওঠছে তার মুখ। আর যখন সে খুব কষ্টে থাকত ভারী সুন্দর রবি ঠাকুরের গান শোনাত, বিনা অনুরোধেই বেশিরভাগ সময় হয় লোডশেডিং নয় বিখ্যাত লেবুতলা প্রান্তর- আমি ছাড়া কেউ শোনারই নাই, ফলত অন্ধকারে রইল পড়ে আঁধার-মানিক। কষ্টটা দীর্ঘ সময় ধরেই তার জীবনে স্থায়ী হতে যাচ্ছিল। এই সময় চাকুরিগত সমস্যার কারণে তার প্রেমটা ভেঙে যায়, যদিও আমার দৃঢ় ধারণা তার কারণটা ছিল অন্য।
বছর খানেক পরে সে তখন সেন্ট্রাল গভর্ণমেন্টের জনকল্যাণ অফিসার। এক বান্ধবীর সঙ্গে বাঘাযতীনে একটা বাসা ভাড়া করে থাকে। বাড়িওয়ালার ফরমানে ‘পুরুষ নিষেধে’র সে বাসায় আমিও একবার গেছি। যাই হোক কিছুদিন পর তার স্তনে একটা লাম্প ধরা পড়ল, বড়সড়। অপারেশনের পরদিন দেখতে গেলাম চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে। তোমরা কথা বল, বলে কাকু চলে গেলেন বাইরে। না জিজ্ঞাসা করল, ক্যামন দেখতে লাগছে রে আমায়? এর তো ভাল বা খারাপ কোন উত্তর হয় না, আমি না-এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি, ইহাকে যদি স্পর্শ করা বলে আট অল ধর্মাবতার, তবে একবারই স্পর্শই করি আমি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি যদিও সান্ত্বনা বলে কিছুর কথা মাথায় ছিল না আজও নেই, না এর সঙ্গে শব্দটি বড়ই বেমানান। বাঘাযতীনের বাড়ি ছেড়ে আবার চন্দননগর। আবার ডেলি প্যাসেঞ্জারি। জোয়াল টানা আর রবি টাকুরের গান। প্রয়োজন না থকলেও ফিল্ড অভিসারদের সঙ্গে ঘুরে সার্ভে করত, বেছে বেছে অন-উন্নত এলাকেতেই, ওই যারে কয় বস্তি। ক্ষ্যাপা যে ভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়, আমাদের মফস্বলের ইঁটভাটার স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও, অন্য গোলার্ধ আলোকিত হওয়ার মত, অন্যত্র অনেকগুলি স্কুল খুলেছে নিশ্চিত। তার আগে নিজের চরকায় তেল দিতেও সে ভোলেনি, তার সর্ব মোট ৮ জন বোনকে উৎসাহ প্রদান, কিছুতেই পড়া বন্ধ করা যাবে না। আবার সেই ছিল আমার প্রথম দিকের সমস্ত গল্পের উৎসাহী পাঠিকা, তার মত মানুষের ভেতর ঢুকে যেতে আজও পারিনি। তার দুটি প্রিয় গল্প ছিল পরীক্ষিতের উপপাদ্য ও মিউজিক ভিডিও। শেষেরটি তার অধিক পছন্দ। একটি গানের শুটিং এর জন্য প্রচুর ধান নষ্ট করা হচ্ছিল দেখে গ্রামবাসী ডাকাত সেজে সেই ধান লুঠ করে, এর বেশি দুটি গল্পের কোন অস্তিত্বই আমার কাছে নেই, যেমন না এর সঙ্গে নুন্যতম যোগাযোগটুকুও নেই আমার দীর্ঘদিন। ২০০৩-০৪ তার বিয়ের পরে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে। কিন্তু আমি জানি, না-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলে দুটো গল্পই সে হু-বহু বলে দিতে পারবে, এক নিশ্বাসে, ড্যাস সেমিকোলন সমেত। আমাদের একটা গল্প পাঠের জায়গা ছিল সুজয় মুদির পুকুর পাড়ে সার সার লেবুগাছের বেড়ার পাশে। সুজয় মুদির টেলরিং-এর হতশ্রী দোকান ছিল তালডাঙ্গার মোড়ে, চলতও না ভাল, ফলে বেদম সংসার। তবু সে ছিল তামাম সংস্কৃতির উজ্জ্বল পৃষ্ঠপোষক সেই বিশাল চুঁচুড়া-চন্দননগরে। চাহিদা ক্বচিৎ দুই পাত্তর রাম পান বা এক-দুইটা সিগারেট। তাদের ছিল বিবিধ মানবসমাজের কাজ। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি করা। লিটিল ম্যাগাজিন বার করার ফান্ডের আয়োজন সবই ছিল যেন তার পূর্বজন্মের কৃতকর্মের শাস্তিসরূপ। রবীন্দ্রজয়ন্তী থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি তখনও মফস্বলে ঘন ঘন হত। তার রিহার্সাল চলত তার বাড়িতে সূর্য ঢোবার পরপর। ঘেঁটু ঝোঁপের নাছন থেকে ফিসফিস প্রেমালাপও কানে আসত ফিরতি পথে, হায় সন্ধ্যার মেঘমালা। সে যুগ নিতান্তই মোবাইলহীন। সেটটপ বক্সের গরিমাহীন। হাওয়ার রঙ ছিল আসমানি। গন্ধের নাম ছিল হাস্নুহানা। লেবুফুলের গন্ধে বিষাদ ঢেলে না গাইত, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি। সেই নিকষ কালো আঁধারে দুয়ার দেখতে পাওয়া আমার সাধ্যি ছিল না, ভাঙাভাঙি অনেক দূরবর্তী সংকল্প। পুকুরের ওইপারে ঘন হয়ে থাকা ঝোপে হয়ত প্রথম নারীবাদী তরঙ্গে লুকিয়ে ছিল বিষাদ তবুও ( ১৯শতক-২০শতকের গোড়ার দিক, mainly concerned with suffrage, working conditions and educational rights for woman and girls)। ক্লারা জেটকিন মনে করতেন, কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজেই নারীমুক্তি সম্ভব। নারী আন্দোলন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনেরই একটি অংশ। এবং তা অবশ্যই বুর্জোয়া নারী আন্দোলনের থেকে বিচ্ছিন্ন। হ্যাঁ প্রিয় পাঠিকা আপনার বুর্জোয়া সত্ত্বা যখন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি সত্তা হওয়ার জন্য নারীবাদের বুলি ঝাড়ে তখন না-এর মত আমাদের বান্ধবীরা নিতান্তই চিত্তপ্রসাদ খচিত সর্বহারা নারী হয়ে থাকে না পরিবারের জন্য লড়ে রুটি রুজি জোগাড় করে। কখনো সে টিউশানি করে, কখনও কারখানার শ্রমিক, কখনও সেলাই দিদিমণি। সেদিনগুলিতে সবাই লাল টুকটুক। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ অদূরদর্শী ক্লারা যখন বিশ্ব-শ্রমজীবী নারী দিবস পালনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন- হায়, দেখিতে পান নাই একভাগ স্থলের সঙ্গে তিনভাগ জল, নারীরা আহ্লাদিত হয়ে আজ যদি তাকে স্মরণ করে নেহাত ‘শ্রমজীবি’দের হাটিয়ে, তাতে তো আমার আপনার সবারই মঙ্গল। ঘামের গন্ধময় সন্ধ্যার গল্প-পাঠের আসর, কাঠফাটা রোদে পোড়া ঘুঁটে ময় দেওয়াল, ফিচকে বর্ষায় কাদা প্যাচপ্যাচে মাছের বাজার, এবার শীতে কার কার বিয়ে এই নিয়ে ডেলি প্যাসেঞ্জারি রসিকতা, বসন্ত বাতাসে সই হাতকাটা ব্লাউজে চৈত্র সেলে দরাদরি, পুজোর ছুটিতে ইঁটভাটায় সান্ধ্যস্কুল, আমার এই একরত্তি মফস্বল মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সুবাতাস বহিছে পবনে। মলয় মল ময়। রুটে ফিরতে হবে, বস্তি-> উচ্ছেদ-> ফ্ল্যাট। ডানা ঝাপটায় শান্তির প্রতীক পায়রা। আমার বান্ধবীরা এখন কল্লোলিনী তিলোত্তমা (সানন্দা)।
(২)
বৃষ্টির পর চাঁদ, রাতের গানে ওঠেছে জেগে,
ভেলা পাতাগুলি তার আলোয় ঝিকিমিকি নদী;
স্থিরতা কন্ঠস্বর, মৃত্যু পাগল, পুরাতন আর পরিবর্তন
আবহাওয়ায় ভেসে চলেছে
উজ্জ্বল রাত, আকাশে উড়ন্ত মেঘ, স্থিরচিত্র বধিরের
আরো আলোকিত জোছনায়, প্রান্তরের হাওয়া
এই মধ্যরাতে বলছে, আজ সে অনেক দূরে;
তার অবয়ব মেঘেরা কসরত করে আর ব্যর্থতায় কেঁদে কেঁদে ওঠে
গাছগুলি দেখছে এখন, মেঘেরা জাগছে এখন, তার ভালবাসা নিশ্চুপ স্বপ্নের ভিতর।
(চিরনাপাসিত জগতের বাসনা/ ইমরুল হাসান/ কালিকাপ্রাসাদে গেলে আমি যা যা দেখতে পাবো/ জনান্তিক)
২০০৮ সালে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশে থাকার সুযোগ এল। আমি যেখানে পড়াতাম সেই পাঠশালার সংলগ্ন এক চিলতে ঘরে সান্ধ্যবাসরে নিয়মিত-বা অনিয়মিত অনেকেই এসেছে। পান ও ভোজনের বাইরে এইঘর হয়ত ছিল এক অদ্ভূত ব্যতিক্রম, মুক্তচিন্তার স্থানের অভাব বাংলাদেশে মারাত্মক। ফলে সংক্রামকের মত ঘরখানা অনেককেই উঠিয়ে এনেছিল, কেবল এর সুবাদেই অনেকের সঙ্গে পরিচিতি। নামের লিস্টি বানানোর চাইতে চেস্টা করি আমার নিজের পরিবর্তনটা বোঝার। সবাই যে বাংলাদেশি মুসলিম তা নয়, নেপালি দুই সুন্দরী আসত হানি ও শর্মিলা- শেষের জন এখন আমার এক বন্ধুর স্ত্রী, চাইনিজ দুই সুন্দরী আসত যাদের মধ্যে বাই চি’র সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক, সে এলে আমি তাকে নিয়ে বাজারে ঘুরতাম, আমার এটা একটা পুরানো নেশা, বাই চি’ও আনন্দ পেত তাতে মারাত্মক, বাই চি’ও অবশ্য থেকে গেছে বাংলাদেশে, নেহাতই কিঞ্চিতকর এক ফটোগ্রাফারের প্রেমে পড়ে। ইউরোপের লেনা আসত নানা উদ্ভট মেমোরি গেমের আইডিয়া নিয়া। জাপানি মাকি আসত তবে তার মূল কাজ ছিল আমগাছ তলায় বসে সাগরের সঙ্গে চন্দ্র অবলোকন করা, আকাশে চাঁদ থাক বা না থাক। শর্মি বা তামান্না এলে পরিবেশনটা তারা নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে করত, দুনিয়া দাপিয়ে বেড়ানো শিল্পী লিপি বা আইনের প্রথম বর্ষের ছাত্রী বর্ষা এসে বসত বাসন মাজতে- কেননা প্রয়োজনীয় বাসন মজুত থাকলেও অতিথি সংখ্যা মাঝেমাঝেই দুই ফিগারে গিয়া পড়িত। অনেকেই হাতে হাতে কাজ করত এসে ইস্তক, কাঁকন বা লিপি অনেকদিনই (হিসাবটা দিনে নয়, মাসে) রান্নাঘরে ঢুকে রান্না-বান্না করেছে, যেমনটা আমাদের ঘরের মা, কাকিমাদের ছোটবেলা থেকে দেখে ধারনার মধ্যে সামিয়ানা টানিয়ে নিয়েছি, আর দেশটা যেহেতু বাংলাদেশ তাই দৃশ্যত সবই ছিল স্বাভাবিক। সবাই কিছু না কিছু হাতে হাতে করত। বন্ধু পপির সঙ্গে তার দিদি এলে দেখেছি সেও বসে গেছে মাছ কাটতে এ ঘটনা কেবলমাত্র একবার বা দুইবার ঘটেনি, হ্যাঁ ঋতু’কেই একমাত্র কুটোটি নাড়াতে দেখিনি আমি আমার সেই অস্থায়ী দশ ফুট বাই দশ ফুটে। শুধু তাই নয় সেসবের বিন্দুমাত্র পরোয়া সে তো করতই না, মাড়াতও না সামান্য ছায়াও। প্রথমদিনের কথা বলি। সে আসে মধ্যরাত্রে। আমাদের বোতলে হুইস্কি তখন বিপদসীমার অনেক নীচে। মাকি কুরিস্মাকি ও মোল্লা সাগর ব্যস্ত কোন একটা দেশ উদ্ধারের কাজে বিধেয় চন্দ্র, কাঁকন হয়ত দুলে দুলে গান গাইছে। সাগরের সঙ্গে দেখা করতে এসে ঋতু ঘরে ঢুকেই সবাইকে জানায় সে মেলা টায়ার্ড, আমরা ফালতু সব প্রশ্ন করে তাকে অযথা না ডিসটার্ব করি। সকালবেলা কোন এক বাস্টার্ড শুটিংএ ডাকিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে বসিয়ে রাখে তো বসিয়েই রাখে, বসে থেকে থেকে তার জীন্দেগি হারাম করে ছেড়ে দিসে। আবার নাকি কাল যেতে হবে! বলে সে শাড়িটা খুলে খাটের একপাশে ফেলে দের আর, আমার খাটের একপাশে গিয়ে শোয় এবং তক্ষনাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। তখনও তার নাম জেনে থাকলেও আলাপ হয়নি আমার তার সঙ্গে। পরদিন সকালে খাওয়ার টেবিলে আলাপ হওয়ার পর সে আমায় ধমকায়, ইস এত সব খাওয়ার তুমি আমায় ডেকে খাওয়াইলা না! আগের রাতের ময়ুরকন্ঠী শাড়িটা পরেই সে পরদিন কাজে বেরিয়ে যায় হয়ত বা সেই না হওয়া শুটিং এ, যেটা সম্ভবত কাঁকন পাট করে রেখেছিল আমার চেতনা লুপ্তির প্রথম প্রহরে, তাই হবে এখনও সে সব মনে আছে কিন্তু বড় আবছা। রাত থেকেই যে অস্বস্তি হচ্ছিল মাথার মধ্যে অস্বীকার করি কেন, অথচ বারবার মনে হয়েছিল খুবই পরিচিত সে। ১৯৯০ সালে দেশ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক বের হত- বিনিসুতোয়, আমার পাঠিকাদের মনে আছে কী না জানি না, আমার মনে আছে স্পষ্ট। মনোজের সঙ্গে একটা সিঙ্গলস বারে সমরেশের আলাপ হয় ফরিদার সঙ্গে। দুইবার বিয়ে করেছেন, একবার বোধহয় ডিউকের সঙ্গে। পোষায় নি। একা ফ্ল্যাটে অনেক বইপত্র নিয়ে থাকেন। আঙ্গুলে সিগারেট, হাতে হুইস্কির গ্লাস, ঠোঁটে চারটে ভাষার সেরা কবিতা মজুত, যেমনটা লিখেছেন, সমরেশ। মনোজের বাড়িতে একদা পার্টিতে এসে তিনি রাত্রে থেকে যান, অন্য অতিথিরা তাকে লিফট দিতে না রাজী হওয়ায়। আমি জানি সে রাত্রে ফরিদাও আমাদের এনের মতই শাড়িটা খুলে রেখে তাদের সঙ্গে বাক-বিতন্ডায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, সে রাত্রে রাত কতটা বাকী ছিল তা জানি না তাই কতক্ষণ চলেছিল জানি না। তবে যে অস্বস্তির কথা লিখেছেন সমরেশ তা দীর্ঘ ও অবলুশ, যা অবশ্য এখন বিনিসুতোয় তাক থেকে নামিয়েও আমি খুঁজে পেলাম না আজ, সম্ভবত অন্যত্র লিখেছিলেন, নবকল্লোলে একদা ধারাবাহিক লিখতেন, মেয়েরা যেমন হয়, সম্ভবত।
ঋতু-র ক্ষেত্রে সত্যি নামটা হয়ত লেখাই যায়, তাও লিখছি না কারণ অলরেডি সবাই তাকে চিনতে পারছেন, তাকে চেনে না এমন মানুষ বাংলাদেশে খুবই কম, সাইবার জগতে আরো দুর্লভ। গান্ডু (নামটা ভুল হতে পারে) বলে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, ছবির হাটের টানানো পর্দায়। গান্ডু ছাড়া আর কোন ফিল্মে কাজ করিসো বললে সে বলে তুমি আমাগো ফুলবাড়ি নিয়ে সিনেমাটা দেখসো? কানসাট? নাহ, আমার আজও দেখা হয়নি। ফলে আবার ধমক। মজা করেই সে বলে, তুমি আমার সনে ফারবা না, একে মহিলা তয় নোয়াখাইল্যা! একদা, পরদিন ভোরে নোয়াখালি হয়ে নিঝুম দ্বীপ যাব। ফোন করলাম, ঘোড়ার মুখের কথা শোনা যাবে। নাহ তুমি ফারতা না বলে সে ফোনটা কেটে দেয়। তারপর সে হাজির আধঘন্টার মধ্যে। নোয়াখালি বাসস্ট্যান্ডের কোন হোটেলের কাবাব খাবা, এইখানকার ফরোটা অবশ্যই খাবা, অঈ দোকানের মিস্টি খাবা আর আমার জন্য বেঁধে নিয়ে আসবা, মেয়েদের দিকে তাকাবা না, সব দুই-তিন লেয়ারের বুরকা, কুন লাভ নাই। এমন একটা লিস্টি বানিয়ে সে উধাও হয়ে যায় মধ্যরাত্রে, তবে সে রাত্রে কৌশিক তার সঙ্গে ছিল সেটাই ভরসার। (ঘটনাটা বানানো, অন্য কিছু হয়েছিল)। অল্প বয়সে বিয়ে করেছিল সে দুরন্ত প্রেমের পরে। তার সন্তান থাকে তার মায়ের কাছে, খুব স্বাভাবিক সে নয় বলেই জানি। তারপর ছাড়াছাড়ি। একাকী। কৌশিক আর আশিক দুইজনেই ছিল আর প্রাণের বন্ধু। গতবছর বছর খবর এল কৌশিক স্নান করতে গিয়ে ডুবে মারা গিয়েছে, বিবিসিতে কাজ করা দুরন্ত কেতা-দুরস্ত কোঁকড়া চুলের কৌশিক, ওহ কত স্মৃতি, বাংলাদেশময়। কৌশিকের সঙ্গে এক সময় সে(ঋতু) লিভ ইন করত- সে বাসায় আমিও গেছি মধ্যরাতে। রান্নাবান্নার পাট নেই, আছে বাহারি সব গ্লাস, বিভিন্ন দামী মদের বোতল ঘরের বিভিন্ন স্থানে রাখা মায় কেতাদুরস্ত গড়গড়াটিও সাজিয়ে রাখা মহার্ঘ চরস সেবনের জন্য। এই ছিল ঋতুর সংসার- সুবিশাল এক ফ্ল্যাট বিভিন্ন রঙের পর্দায় মোড়া, ঢাকা শহরের এক অভিজাত এলাকায়। পোশাকের দিক থেকে সে ছিল খুবই ইউনিক কোথাও কোথাও বিবি রাসেলের আলট্রা-মড ভার্সন। বেলফুল বা বকুল ফুলের মালা দিয়ে মাথায় সে ট্যাঁয়রা বা সীতাপাটি বানিয়ে ঘুরে বেড়াত ঢাকা শহরে যত্র-তত্র। যেদিন ঢাকা শহরে প্রথম আগ্নেয়াস্ত্রের স্পর্শে আমার দেহ শীতল হয়ে গিয়েছিল, ঠিক আমার অস্থায়ী বাসার সামনে, তার ঠিকঠিক ২ মিনিট আগেও ঋতু ছিল আমার সঙ্গে, সেই আমায় ছেড়ে দিয়ে যায় নয়নের স্পোর্টস কারে, মধ্যরাতে কুমিল্লার ময়নামতি বিহার থেকে প্রভূত নেশা করে ফিরেছিলাম আমরা।
অথচ সে কখনই কুয়াশা ছিল না আমাদের কাছে, যে কথাটা এইবার স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে। সে ছিল ভনিতাহীন, দিবালোকের অধিক প্রজ্জ্বল। তার সঙ্গে কথা বলা বা আলোচনা করার সময়ে আমিও হয়ে পড়তাম আড়ালবিহীন, সেই মাঝে চিমটি কেটে বলে দিত, হেইডা আমারে বললা ঠিক আসে, বাইরে কইয়ো না। সে সবের কিছুটা আল্লা সম্পর্কিত কিছুটা নারীঘটিত সামাজিক পালা, হয়ত সবই ছিল আমাদের অনাচার। যেমন, বুঝলা ও একটা ফিল্ম বানাইসে। তুমি দেইখো। কই পাই? কই দেখি? ঋতু বলে, তুমি কি উরে চিনো? সে কি, ওমি বানাইসে। ও তো ম্যালা পুরানা দোস্ত, আমায় তো কিসু কয় নাই। অরে কী আমি অর বৌরেও ইস্লাইট চিনি (একদা একত্রে মদ্যপান করিয়াছিলাম কলিকাতার অলিপাবে বন্ধু ওমি ওবিশ্যি কোল্ড-ড্রিংক্সেই সঙ্গত দিয়েছিল)। স্লাইট শুইন্যা সে মজা পায়। সত্যি গভীর কোন আলাপ নাই। আমাকে সতর্ক করে অর্থাৎ ধমকায়। একবার পদ্মার চরে গেছি ঘুড়ি উৎসবে। অন্ধকারে ফানুস ছাড়া হবে। তপুভাই-এর আপিসের কলিগদের ( নদীর কাদায় কেতা দুরস্ত স্যুট পরা বড় সাহেব সব) সঙ্গে গলদঘর্ম দুপুরে আপ্রাণ কেরু(দেশী মদ) পান করে আমি বেশ টাল্লি। ঋতু শেষবেলায় প্রচুর চেঁচামেচি করে একা পিছনের ক্ষেত থেকে আলু টেনে এনে সে নিজেই পুড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল। সে প্রায় একবস্তা আলু। খাওয়ার লোক কম ছিল না সেইদিন। জাহাঙ্গীর নগরে এক সন্ধ্যায় গেছিলাম তার সঙ্গে। সে তখন সদ্য বেরিয়েছে সেখান থেকে, জনপ্রিয়তা তার এমন ছিল আরেকটু হলে সে আমাদের নিয়ে কোন একটা মেয়েদের হোস্টেলেই ঢুকে যাচ্ছিল। শেষে সহস্রাধিক প্রেমের সমাধিস্থল শুকনা সুইমিং পুলে বসে আমরা শুনি তার পরিকল্পনা, এই তো এখন স্টিং অপারেশন নিয়ে ভাবছে, এবং অচিরেই মেয়েদের শ্লীলতাহানি নিয়ে একটা ফিল্ম বানাতে চায়। পুরো শুটিংটাই হবে গোপনে। আর লোকেশন নাকি এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রচুর গাঁজা-টাজা খেয়ে ভুলে মেরে দেওয়ার পাত্রী সে নয়, আমি জানি একদিন সে সত্যি বানাবে এমন একটা কিছু, বা ততধিক গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত তার তাই মনে হয়। সময়টা আর আমাদের কাছে এক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ নয়, হওয়াটা অধিক প্রয়োজন। এই যে দ্বিতীয় নারীবাদী তরঙ্গ (১৯৬০-১৯৮০) এসে আমাদের পদলেহন করছে ২০০৯ সালে, তাও শুকনো খটখটে এক সুইমিং পুলে (Inequality of laws as well as cultural inequalities and the role of women in the society)। তারপর তার বিদেশ যাত্রা।নেদারল্যান্ডের একটি বিশ্ব-বিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি করছে বটে কিন্তু টের পাই সে ঢাকায় বসে। কী ব্যাপার? আপাতত কনফ্লিক্ট রিসলিউশনের কারনে। তার ফিল্ড ওয়ার্ক চলছে চট্টগ্রামে। রোহিঙ্গা্য এতশত ঘটে গেল সে দূরে থাকবে কী করে।তারপর শাহবাগ। ফেসবুকে ছবি দেখি, বিভিন্ন স্থানে পারফর্মেন্স করছে সে। ফেসবুকেই জিজ্ঞাসা করি? কী ব্যপার নতুন কিছু খুঁজতেস নাকি জীবনে, আনন্দ পাচ্ছ? সে উত্তরে বলে পুলাপান সব উত্তেজিত, পুড়াইতে ভালবাসে কিন্তু পারে না কিছুই তাই আমি যাই আর আগুন জ্বালাইয়া দিয়া আসি। পুড়ুক সব। পুড়ুক।
(৩)
উঠোনে বসেছে হাঁড়ি, তলে নাচে ধোঁয়ার কুয়াশা
ফাঁপা পেটে নোনাজল ছলছল সমুদ্রের ভাষা
একআকাশ শঙ্খচিল একমাঠ জীবনানন্দ দাশ
একপাশে হেলে পরা একচিলতে চালাঘরে বাস
তলেতলে ভরা নদী, থেকে থেকে বিদ্যুৎ লহমা
ন্যাড়া অঙ্গে মৃগনাভী, চন্দন-ঘৃত-দাঁড়ি-কমা।
যখন তখন ঘরে ঢুকে পড়ে সুজন বেহুঁশ
এক অঙ্গে এত রূপ! কেন তুই খিল দিয়ে শুস!
আমরা সব মুখেমুখে মেঘ হই, মুখে মুখে ঝড়
পালে পালে ছাড়া গরু সারা মাঠ খুঁটে খাই খড়
এ দেহ আসলে মাটি, মাটি তোর সমস্ত শরীর
জানিসনা রাত্রিকালে আমরা সব বাউল ফকির।
সমস্ত প্রবাহতলে একটাই অনিবার্য তুমি
ঘেঁটে যাচ্ছে ইতিহাস কোন পথে আলো- জন্মভূমি
এক পা বেঘোর ফ্রিজ, অন্য পায়ে নিঃশব্দ মিছিল
না দিন, না রাত্রিকাল- শুধুশুধু ডেকে যায় চিল।
(বনসাই/ সুভাষ বিশ্বাস/ জঙ্গল ও অমৃতের উপপাদ্য/ এই সহস্রধারা প্রকাশনা)
মহিলারা লক্ষ্য করেছি মহিলাদের নির্মেদ দেখতেই পছন্দ করেন, অধুনা কতিপয় মহিলা চিত্রকর যে সেলফ পোট্রেটে নিজেদের স্থূল চেহারাটা আঁকছেন বা ভাস্কর্য নির্মাণ করছেন তা যে মোমবাতি পোড়ানোর মতই কিচ (kitsch) প্রতিবাদ সরূপ তা আমার পাঠিকা মাত্রেই জানেন। আর এই যে বোরখা-টোরখা পরিয়ে এই ভ্যানতারা লিখছি, তার সপক্ষে যাই যুক্তি থাক, অস্বস্তি আমারই ঢের হচ্ছে। এই পর্যায়ে এমন কতগুলি ঘটনা এসে হাজির ঘোমটা এমনিই খুলে পড়তে বাধ্য। এই পর্যায়ে আমি যে বন্ধুটিকে নিয়ে পড়েছি তার নাম আর, আমরা তার অন্য নামটাও পর্যায়ক্রমে জেনে যাব, গোপন কথাটি রবে না গোপনে কেননা নারীবাদী আন্দোলনের তৃতীয় প্রবাহ, আশিতে শুরু হয়ে থাকলেও আমি যখন নখ কাটছি তখন আবার বছর কুড়ি পরে, মানে সিম্পলি বিশ শাল নাছাইয়া। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ আমার শরীরে ততদিনে ঝুপ করে নেমে এসেছেন এক উজ্জ্বল নারী। আনন্দমেলার জ্যকেটে রক্ষিত দেবনায়ারে ছাপা কতিপয় স্থিরচিত্র আমাকে বধিরতা দান করছে পুনঃপুনঃ। এম টিভি তখনও সাহস পায়নি শরীরের উপর আদেখলের মত ঝুঁকে অস্থিরতাকে তুরঙ্গমে পরিনত করতে। সেই এম টিভিতে ১৯৯০ সালে ব্যান করে দেওয়া হল জাস্টিফাই মাই লাভ বলে এক ঘুম জাগানিয়া মিউজিক ভিডিও। যাকে এলিস স্ট্রস বলেছিলেন, দ্বিতীয় নারীবাদী তরঙ্গের তুঙ্গ অবস্থান, কাকা কথা হবে না। তবে তার ধারণা ছিল দ্বিমাত্রিক ও রৈখিক। এমনটাই হতে হবে মাথার দিব্যি যেন- বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিনোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে-(1) all about celebration of self (2)being the protagonist in her own story হায়! কাংড়া অববাহিকার চিত্রমালার রচয়িতারা জানতেন না, সৃষ্ট নারী চরিত্রের দীর্ঘশ্বাসই তাদের নগ্ন করে তুলেছিল ছবির পর ছবিতে। কেহ না বুঝে নারীর বেদন! হয়ত লালনগীতিও এত সুলভ হয়ে পড়েনি সেই সময়। অন্য গোলার্ধে ১৯৮০ থেকে স্ট্রস বেড়ে উঠছিলেন ম্যাডোনার সঙ্গেই, কাজেই তরঙ্গের তৃতীয় মাত্রায় পৌঁছাতে আরো কয়েক বছর জলাঞ্জলি। জল সর্বাধিক ঘোলা দেখাল- Sex/Book প্রকাশিত হওয়া মাত্র, ২১ অক্টোবর, ১৯৯২। হ্যাঁ বইএর নামটা ছিল এমনই। ম্যাডোনা প্রকাশ করলেন পঞ্চম স্টুডিও আলবাম ইরোটিকার সঙ্গে উপরি হিসাবে, সেটি বেরোনোর ঠিক এক দিন বাদে। গোদের উপর বিষফোঁড়া থেকে না সর্বত্র, আমার ধারনার পানাপুকুরে ছোঁড়া ঢিল তৃতীয় তরঙ্গ তুলে আমার হেমেন মুজুমদারী ধ্যানে মাখিয়ে দিয়ে যায় নিখাদ আলকাতরা, যেমত আমাদের চন্দননগরের জোনাকী সিনেমা হলের পোস্টারে, লিথোর পাথুরে মহিলাদের মত আলকাতরার জামা পরা, সুতরাং পাঠিকা জ্ঞাত হউন, আমার নারীবাদ-পাঠ এক্ষণে হয়ে উঠছে আরো রহস্যময়ী।
পি এর সঙ্গে আমার পরিচয় দার্জিলিং-এ। সালটা মনে পড়ছে, ২০০০ -২০০২ এর মধ্যে যে কোন সময়। বিস্কফার্ম বলে যে বিস্কুটের কোম্পানী সেই বছরই আত্মপ্রকাশ করে। তারই বিজ্ঞাপন শুট করতে আমরা দার্জিলিং। কলকাতা ছাড়ার আগে নায়কের সঙ্গে আলাপ হলেও নায়িকা কে? মেওয়া সবুরেই ফলবে। এই বিজ্ঞাপনের প্রডিউসার ছিল মুকুদিরা (খেয়ালী দস্তিদার)। এজেন্সি বেটস। ক্ল্যারিয়ন টাটকা টাটকা বেটস হয়েছে। ক্রিয়েটিভের সৌভিক গীটার বাজিয়ে সারাদিন গান গায় হোটেলের লবিতে বসে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লবি ফাঁকা হয়ে আসে ভর্তি হয় গাঁজার ধোঁয়ায়। একটা ছোট্ট-খাট্ট মেয়ে সৌভিকের পিঠের ওপর পিঠ দিয়ে শুয়ে গান শোনে আর গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে। আমাদের ক্যামেরাম্যান মধু শী আমাকে সেখান থেকে ডেকে নিয়ে যায়, আমরা ঘরে বসে দুপুর থেকে মাল চাপাই আর... দরজা ভেদ করে গান না ঢুকলেও ধোঁয়ার জামা পরা একটা মেয়ে আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে যায়, আয় আমাদের লবিতে আয় (রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুসৃত)। তিনদিন সারা ইউনিট বসে বৃষ্টির জন্য। প্রোডাকশন ম্যানেজার বাবলু হালদার একদিন জোর করে আমাদের পাঠিয়ে দিলেন পশুপতি মার্কেটে, হোটেলে থাকলে আরো টেনশন হবে। শুধু সৌভিক আর সেই মেয়েটি গেল না। হোটেলের ঘরে রয়ে গেল আমাদের কল্পনাকে উসকে দিতে। শেষ পর্যন্ত ফেরার দিন শুটিং হয়েছিল ঝলমলে রোদ্দুরেই। আর সেইদিনই আমার পেত্থম আলাপ হল ছোট্টখাট্ট কিন্তু টরটরে পিয়ালীর সঙ্গে। নায়ক টয়ট্রেনে শহরে যাচ্ছে নায়িকা দৌড়ে তাকে বিস্কুট দিয়ে যাবে। আমি আর পিয়া বাতাসিয়া লুপের নীচে দাঁড়িয়ে, দূরে অন্য পাথরের উপর হাই তুলছে সহকারী মেক-আপ ম্যান। ট্রেনের আসার আওয়াজ শুনলে ক্যামেরা চলবে। আকশন শুনলে বিস্কিট প্যাকেট হাতে পিয়ালী দৌড়বে। সব কিছুই ঝুলছে অনেক যদির উপর, যেমন সভ্যতা নির্ভর করে নদীকে। একটা পাথরের উপর সে বসল এক্কেবারে আমার পূর্ব বর্ণিত পোজে। খালি এবারের নাঠটা আমার, তার কাছে অবশ্য আরাম কেদারা বলেই মনে হয়ে থাকবে। ফস করে গাঁজা ধরিয়ে দিব্যি সে নাঠে দোল খেতে লাগল। আমায় জিজ্ঞাসা করলে অসঙ্গত কারণে না বলি, আসলে সেটাই তখন একমাত্র বেরোয় শুকিয়ে আসা গলা দিয়ে। সে অস্ফুটে একটা ছোট্ট খিস্তি দিয়ে বলে তোদের ড্যাসের ট্রেন আর আসবে না। আমি ঘুমোলাম বেশি বাওয়াল দিস না কিন্তু!
২০০৫-০৬ সালে দ্বিতীয়বার হট্টমেলা হল। আয়োজক ই-টিভি বাংলা। সেইটাই শেষবারের মত। শহর থেকে শহরে ঘুরছি। মেলায় যখন স্টলেরা দেউটি নেভাত তখন আমার কাজ ছিল মূল মঞ্চে, সারাদিন ফিরি থাকতাম নেশার ফিকিরে। একদিন হট্টজলসা, অন্যদিন হট্টচলচ্চিত্র। আমি আর পিয়া বেশিরভাগ সময় একই গাড়িতে ট্রাভেল করতাম। আজ বহরমপুর তো কাল রায়গঞ্জ, আমাদের অভিযানগুলিতে গাঁজা ও মদের এতটাই ভূমিকা থাকত যে অন্য সঙ্গীরা (স্বদেশদা, রাজীব, ড্রেসার স্বদেশ) সদা সন্ত্রস্ত। সামলাতে বেশ হিমসিম খেত, খিস্তি খেউড়ও উড়ত কুরুক্ষেত্রের মত বিস্তর। ততদিনে যেমন পিয়ালী থেকে সে পিয়া (আমরা বলতাম ছোট পিয়া), পোশাকেও সে বাহুল্যবর্জিত। ফলে খাওয়ার যায়গা বা থাকার হোটেলে বা পেট্রোলপাম্পে কতগুলো ছানাবড়া চোখ পিয়ার মতই আমারও গা সওয়া হয়ে এসেছিল। বুঝতে পারছি সে বিদ্রোহ (ইগনোর) করছে, বিরোধিতা করছে, কিন্তু আলকাতরাও মাখানো আছে নিয়ম-মাফিক, ফলত ঢংটা কেমন যেন দাঁতক্যালানে। সেই দিনগুলোতে পিয়া আমার কাছে নেশা করার বন্ধু ভিন্ন নারীবাদের অন্য কোনও অবয়ব ছিল না। তখনও দেখা পাইনি Elana Stozkman-এর। এর কাছাকাছি সময়ে বসেই তিনি লিখছেন, দ্বিতীয় নারীবাদী তরঙ্গে ম্যাডোনা ছিলেন পুরোপুরি বে-নিশানা। Guilty trading on her sexuality and has resisted what is known as “aging gracefully” at all costs. সেই টানা দেখা, এর আমার টেলিভিশন থেকে দূরে সরে আসা আর নয়ন-এর শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরে ওভারডোজ জয়েন্টে ঝাঁনায়ে পড়া, যাই হোক খুব বেশিবার দেখা হয় নি। ২০০৩ তেপান্তরের মাঠ করলেও আমি দেখিনি। সিনেমাটা দেখলাম একদা নীতেশ শর্মার অফিসে বসে। আমার কিন্তু তেমন কিছু ভাল লাগেনি যে আবার দেখব। তবু লাল আলোর মধ্যে পিয়া যখন বলছে, আমি মেয়ে, আমি মেয়ে, আমি সব পারি এবং স্ল্যাং-এর পঞ্চব্যঞ্জন সহ, টের পাই অর্বাচীন পৃথিবীতে লেখা হচ্ছে, Le Lièvre de la Cite de’s Dane(The book of the city of Ladies) পিয়া এক ঝটকায় যেমন পি হয়েছে তেমনই আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে। ফ্রান্সে বসে লিখছেন Christine de Pizan আর পি এই গাঙ্গেয় অববাহিকায় ঘুরিয়ে দিচ্ছে সুরধুনীর গতিপথ। পেনড্রাইভে করে লখীন্দরের বাসরঘরে ঢুকে পড়ল ইতিহাস কন্যা, ফলত পি এইবার সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ইতিহাস কন্যার স্বপ্নদৃশ্যে হিরো ছত্রাক খ্যাত অনুব্রত। নয়নের বাইরে আমিতাভ চক্রবর্তীর কসমিক সেক্স। ২০১২ সালের ১৭ নভেম্বর মেট্রো সিনেমায় দেখা গেল অবশেষে। জাস্ট উড়ে গেলাম। বুঝলাম পি এখন সাধন-সঙ্গিনী। কত কী যে দেখতে পেলাম। সিদ্ধেশ্বরীর পর ফিল্ম ধারণের সময়কে বিষয় করে তোলার জাদু ফিরে দেখলাম। বিপ্লব। সাধনা মা’ও বিদ্রোহিনী, এক্ষণে যারা অন্তত কিছু বর্ণনা বা দৃশ্য শোনার জন্য ছটফট করছেন, তাদের জন্য কিঞ্চিত নিকোটিন সাপ্লিমেন্ট। মুনি-ঋষি উবাচ, পি’কে নির্বাচন করে যে খুব খুশি ছিলেন পরিচালক, এমনটা নয়। প্লাস পয়েন্ট ছিল সে ন্যুডিটিতে অভিজ্ঞ, যেমন সে বলে আমি কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস ভূগোল স্ট্যাটিস্টিক্স কিস্যু পড়িনি, নিজের শরীরটাকে পড়েছি ওটা নিয়েই পড়ে আছি। সিউড়ির আউটডোর বা গ্রে-স্ট্রিটের বাড়িতে যেখানে নগ্ন দৃশ্যগুলি তোলা হত অবশ্য অসাধারন সতর্কতায়। ক্যামেরাম্যান ও পরিচালক ছাড়া কারো প্রবেশের ক্ষমতা ছিল না সেখানে। পাছে ছত্রাকের মত ক্লিপিং ছড়িয়ে পড়ে! সাউন্ড রেকর্ডিস্ট পর্যন্ত সব সেট করে বেরিতে যেতেন। চারপাশ ঘেরা থাকত দু-তিন ফোল্ড কালো কাপড়ে, সলিড ব্যবস্থা। ক্যামেরার ফিল্ম শেষ হলে নতুন ফিল্ম লাগাতে প্রথাগত ৫ মিনিটের যায়গায় আধ ঘন্টা সময় ব্যয় হত সতর্কতার কারণে। রাতের সব তারা অন্ধকারে ডুবে গেলে, জেগে থাকে উশখুশ, পরিচালকের এ হেন ব্যববস্থায়ও সে ছিল উদ্ধত। সিউড়ি গিয়ে জ্বর হয় এবং বেঁকে বসে শুটিং করতে। শেষে নয়ন সিউড়ি গিয়ে তাকে রাজি করায়, দুইদিন ইউনিট বসে থাকার পর চালু হয় শুট, পি হয়ত ভাবছিল, তার যে কোন বিকল্প নেই আমাদের হাতে, আর এটা কেন সবাই স্বীকার করবে না? অথবা সিউড়িতে নদীর ধারে আসতে তার গো, যাবে না। গাড়ির থেকে নেমে নদীতে আসতে হাঁটতে হত কিলোমিটার খানেক, সেখানেই তৈরি হয়েছিল ছোট্ট সেট। পি অস্বীকার করে সেই পর্যন্ত হেঁটে আসতে। তার জন্য তৈরি হয় পালকির মত এক মাচা। পি তাতে উঠে বসলে মানুষ কাঁধে করে নিয়ে আসবে তাকে, জিও তিন নম্বরি। পরে অবশ্য সে হেঁটেই আসতে রাজি হয় পড়ে যাওয়ার ভয়ে, সম্ভবত। বা শুটিংএর আগে পরিচালক চেয়েছিলেন একটু রোগা হোক সে, তাতে রেয়াত করেনি সে। সে কেবল নিষিদ্ধ হয়েই থাকতে চায় যেমত Nietzschean Creative woman.
ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফেরে, আমাদের চেনা চৌহদ্দির গল্প কথা চেনা চৌহদ্দিতেই আটকা পড়ে। এ যাত্রায় আপাতত আমরা শেষের দিকে, ১৯০০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক কাঠখড় পুড়েছে। তেলা মাথায় কে না তেল দিতে চায়! আমিও কিঞ্চিত শব্দ যোজনা করে গেলাম, আমাকে খুঁজিয়া লইয়ো উহাদেরই ভিড়ে, একদিন জানি তারা শত সহস্র নখরা-অভিমান-বিলাস নিয়েও ঠিক আগুন খুঁজে নেবে, ছাই হবে নচিকেতার গানের মত অহেতুক প্রশ্রয়। আমি আমার বন্ধুদের মধ্যেও খুঁজেছিলাম বিবিধ আগুণ, চেতনা হইতে ভাষা বিবিধ সম্ভারে। নারীবাদ নিজের মত বুঝে নেওয়ার প্রকান্ড যেন এক দায় ছিল আমার, যখন কেবল নিরন্তর সময়কে খুঁজে চলেছি আমার চারপাশেই, সামান্য এই লেখালিখি, কিঞ্চিতকর ভাষা- If we take feminism to be that cast of mind that insists that the difference and in equalities between the sexes are the result of historical process and are not blindly ‘natural’ we can understand why feminist history has always had a dual mission- on the one hand to recover the lives, experiences and mentalities of women from the condescension and obscurity in which they have been so un-naturally placed and on the other to reexamine and rewrite the entire historical narrative to revel the construction and working of Gender (Susan Pederson/ The future of feminist History). আমি কান পেতে রই। তিন ছাড়িয়ে একদিন হয়ত শুনব, হুড়মুড়িয়ে সব চতুর্থ নারীবাদী তরঙ্গের কথা আউড়াচ্ছেন আমার পরিচিতা সব নারীবাদের জ্যাঁদরেল অধ্যাপিকারা, এই লেখায় অবশ্য তাদের প্রবেশ নিষেধ, সোনালী চুলের কয়েকটি নাম ভাবনার শিশুটিকে ঘিরে থাকা পরীদের মত চলে এসেছে অন্দরে (The Three Graces Holding Cupid in the Clouds), তারা হয়ে থাক ধোঁয়া আঁকা আলপনার মত, কোন এক বৃহত্তর সমাজব্যবস্থার মঙ্গল কামনায়, স্রেফ। কন্ডাক্টেড ট্যুর আমার কোনোদিনই পছন্দ নয়, এক্ষণে তাই নিজের মতই ঘুরি, নিজের কথাই আউড়ে গেলাম কয় চিলতে। জানালার ধারে সিট পেলে, কি ভাগগি, আর তো কথাই নেই, না হয় ডাকঘরে টিঁকে গেল অমল। এক ছুটন্ত জানালা দিয়েই দেখব, দেখা যায় তোমাদের বাড়ি। আর যেমন মাঝে মাঝে হই দেশান্তরী, ফলত বন্ধু বিচ্ছেদ, মোবাইল হারালে যেমন বিস্বাদ লাগে সব কিছু। সব হারাইয়া কান্দি গো, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে মেমরি। আবার একদিন বেরিয়ে পড়ব পথে, কী বলেন, প্রিয় পাঠিকা? আমাদের তো টিকিট কাটাই রইল, লঙ্ঘিতে হবে গিরি দুস্তর পারাবার। মাঝেমাঝে PNR এর স্ট্যাটাসটা চেক করে নিতে হবে, সিস্টেম। অগত্যা।
(পুঃ - লেখাটা পাঠানোর পর সম্পাদকেরা উনু-ঝুনু নামগুলি নিয়ে কিঞ্চিত সমস্যায় পড়ে ছিলেন। ক্যালাইডোস্কোপ ঝাঁকিয়ে এযাত্রা তাদের চুপসানো বুকে বল ভরে দেওয়া হল, সব দায় শালা স্কচশ্রী David Brewster এর -
লেখক)