অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য লাগছে। কেন 'আমি রাজাকার' শব্দটা আপত্তিকর, কেন সব মানলেও অনেকেই এইটা মানতে পারছে না, কেন? সমস্যা কই? ওরা বললেই তো আর রাজাকার হয়ে গেল না! ওরা তো রাগ ক্ষোভ থেকেই বলছে! এগুলা খুব যৌক্তিক কথা। মুশকিল হচ্ছে এইটা এমন এক জায়গা যেটা যুক্তির না, একশ ভাগ আবেগের জায়গা। প্রায় এক যুগ আছে যে জায়গার স্লোগান ছিল ক'তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার সেখানেই, সেই অদ্ভুত জাদুকরী জায়গায়ই কালকে স্লোগান দেওয়া হয়েছে আমি রাজাকার আমি রাজাকার! কষ্টটা কোন জায়গায় এইটা সবাই বুঝবে কীভাবে? যারা এই বিস্ফোরণ সময়ের ভাগীদার ছিল না সে কতখানি বুঝবে?
ধরুন শাহবাগ আন্দোলন হয়নি, গণজাগরণ মঞ্চ বলে কিছু এই দেশে হয়নি। সাকা, মুজাহিদ, নিজামি, কামরুজ্জামান সবাই এখনও এই ভূখণ্ডেই বাস করছে। জামাত আগের মতোই একটা ধরার মতো শক্তি। এমন একটা পরিস্থিতিতে কালকের ঘটনা ঘটল! অট্টহাসি চিনেন? আহ্লাদে আটখানা কাকে বলে জানেন? সব দেখতে পারতেন! পাকিস্তানের আগেরদিন নাই, থাকলে গতকাল যা হয়েছে পাকিস্তানের রাস্তায় মিষ্টি বিলানো হত। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিত যে আমাদের কোন ভাইকে যেন অন্যায় ভাবে অত্যাচার করা না হয়! তারা আমাদের ভাই, তারা আমাদের বোন! এগুলা এক সময় নিয়ম করে দেখছি আমরা। খান...র পুলায় নায়েবে আমির মনের ভিতরের সুখানুভূতি চাপা দিয়ে গম্ভীর স্বরে টিভি ক্যামেরার সামনে বলত, খুব অন্যায় হচ্ছে! বৈষম্য দূর করে সঠিক ইশতেহার দেওয়া হোক!
আমাদের কপাল ভালো যে সেই দিন দেখতে হচ্ছে না। এখন একবার চিন্তা করেন যারা রাজাকারদের ফাঁসির দাবীতে আন্দোলন করল, এই দেশে রাজাকারদের শাস্তি নিশ্চিত করল তাদের কাছেই এই স্লোগান বুলেটের মতো বিঁধছে। আর যারা সংগ্রাম করছে, যারা রাজাকাদের অত্যাচারে স্বজন হারিয়েছে, সরাসরি অত্যাচারের শিকার হয়েছে, তাদের কাছে কেমন লাগতে পারে এই স্লোগান?
এখন সব দোষ প্রধানমন্ত্রীর! তিনি কেন অমন কথা বলল! প্রধানমন্ত্রী যা বলেছে তার অর্থ এই না যে সবাই রাজাকার। কিন্তু আমি যদি ধরেই নেই প্রধানমন্ত্রী বলছে যারা আন্দোলন করছে তারা সবাই রাজাকার! এর জবাবেও আপনি আমি রাজাকার বলতে পারেন না! আপনি কোন অবস্থাতেই আমি রাজাকার বলতে পারেন না, এইটাই ফাইনাল। প্রধানমন্ত্রী কী বলছেন? তিনি বলেছেন কোটা মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতিরা পাবে না, তো রাজাকারদের নাতিপুতিরা পাবে? আচ্ছা, কথাটা একটু অন্য ভাবে বলে দেখি, যদি বেহুশ কারও মগজে ঢুকে। কথাটা যদি এমন হয় - দেশে মানুষ চাকরি পাবে, কোটা পাবে, কোন শূয়রের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা কোটা পাবে না। এতে যারা সাধারণ মানুষ তারা কিছুই বলবে না। কিন্তু কোটা আন্দোলনকারীরা মিছিল বের করবে, তুমি কে আমি কে, শূয়রের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা! কেন কথার এই প্যাচ বুঝতে পারবে না? প্রধানমন্ত্রী যদি আন্দোলনকারীদের উত্তেজিত করার জন্য, ভিন্ন দিকে দৃষ্টি নেওয়ার জন্য এমন একটা কথার ফাঁদ পাতেন তাহলে সবাই মিলে সেই ফাঁদেই পড়বে? এর জবাব তো দেওয়াই যেত যে না, দেশে শুধু মাত্র মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারই নাই, সাধারণ মানুষও আছে। চাকরির ক্ষেত্রে ন্যায্য হিস্যা পাওয়া সবার নাগরিক অধিকার। কিন্তু যে উত্তর দেওয়া হল তার কোন যুক্তি নেই।
এই আন্দোলন শুরু হল কেন, কেনই ধরে ধরে মার খাচ্ছে এইটার কিছুই আমার বুঝে ধরে না। ২০১৮ সালে রাষ্ট্র সমস্ত কোটা বাতিল করেছে। এখন এসে আদালত বলছে সেইটা ভুল, কোটা থাকবে। আদালতে রাষ্ট্র কোটা বাতিলের জন্য আইনই লড়াই করছে না টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে? এখন যে আপিল করেছে, এতে রাষ্ট্র কোটা বহালের পক্ষে লড়ছে না বিপক্ষে লড়ছে? যদি রাষ্ট্র কোটা বাতিলের জন্যই লড়ে থাকে তাহলে কেন কোন যুক্তিতে আন্দোলন চলছে? রাষ্ট্র যদি বহালের বিরুদ্ধে আবেদন না করত, আইনই লড়াই না চালাত তাহলে বুঝতাম আন্দোলনের কারণ। এখন বলছে সংস্কার করতে হবে। হ্যাঁ, এইটা সবাই চায় যে সংস্কার হোক। কিন্তু এ জন্য তো আদালত থেকে রায় আসতে হবে!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আন্দোলন তো হচ্ছে। সবাই পাগল? সম্ভবত না। কিন্তু এইটা সম্ভবত সত্য যে এরা জানেই না আসলে কার ইশারায় কিসের আন্দোলন করছে। জ্বালাও পোড়াও না করে আমি বুদ্ধি দিতাম সরকারের উপরে ভরসা না করে আইনই লড়াই লড়ার জন্য নিজেরা প্রস্তুত হওয়ার। সরকার খামখেয়ালি করবে, তার যেন সুযোগ না থাকে। প্রয়োজনে নিজেরা আলাদা রিট কর। আদালত থেকে সমস্যাটা যখন সরকারের কাছে আসবে তখন আন্দোলন করে ফল পাওয়া যেতে পারে। এখন সম্ভবত সরকারের কাছেও উপায় নাই।
এবং আজকের অ্যাকশন! ছাত্রদের উপরে এমন করে ঝাঁপিয়ে পরে কী প্রমাণ হল আমি জানি না। এর সমাধান অবশ্যই অন্য ভাবে করা উচিত ছিল। ছাত্রদের উপরে অত্যাচার কোনদিনই ভালো কিছু বয়ে আনে নাই। তুই রাজাকার তুই রাজাকার থেকে আমি রাজাকার আমি রাজাকারের যে পথটা এইটার দায় তো বর্তমান সরকারেরই! এর মাঝেই তো এই প্রজন্ম বড় হচ্ছে। কেন এরা এমন চিন্তা নিয়ে বড় হচ্ছে? কেন, কোন শিক্ষায় এরা এমন শিক্ষিত হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিবে কে? এমন করে মারা হল ছাত্রদের। কোন ধারণা আছে এই আন্দোলনের মধ্যে একটা লাশ পড়লে কী হবে? কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়াবে? ফাঁসানোর জন্যও তো কেউ লাশ ফেলে দিতে পারে, এইটা না বুঝার কী আছে? তখন সামাল দিতে পারবেন সব? কে নেয় এমন সিদ্ধান্ত! এইটা লেখার সময় কয়েকজন ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানালো যে রাতেও চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা! যদিও এই মুহূর্তে সত্য মিথ্যা নির্ণয় করা মুশকিল। কারণ এই সব পরিস্থিতিতে গুজব খুব জোরেশোরে চলে। সত্য তিন হাত যেতে যেতে গুজব দুনিয়া ঘুরে চলে আসে। তাই এই মুহূর্তের খবরের সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু সত্য হলেও অবাক হব না। কেন জানি ধ্বংসের পথ, হিংসার পথেই সহজে যেতে চায় মানুষ।
সরকার যতটা আন্তরিক কোটার ব্যাপারে ততটা আন্তরিক মুক্তিযোদ্ধাদের বাকি সব দাবী দাওয়ার ক্ষেত্রে হলে কোটা নিয়ে এতো হাঙ্গামা হতই নাই। কেন চাকরিই করতে হবে? মুক্তিযোদ্ধাদের সবার জন্য আরও অনেক কিছুই করা যায়। সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা যায়। স্বাবলম্বী হতে যা লাগে সেই পথে সাহায্য করা যায়। সরকার তো কম করে নাই, আরও করুক। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, তাঁদের সন্তানদের জন্য করতে তো সরকারের ইচ্ছা আছেই। তো দিক এগুলা সুবিধা। মুশকিল হচ্ছে এই ক্ষেত্রে কবি নিরব। কারণ এখন পর্যন্ত সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও বানাইতে পারি নাই আমরা। এখনও ৫০ বছর বয়সই লোক পাওয়া যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিয়ে ঘুরছে! এতদিন ধরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়, আজ পর্যন্ত জামাতকে নিষিদ্ধ করতে পারল না না কি করল না? কেন? মুক্তিযুদ্ধে জামাতের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ আছে? সপক্ষের দল বলে আর কিছু লাগে না, যা করবে সব জায়েজ।
যাই হোক, এই আন্দোলন কেন হচ্ছে কারা এইটা ঠাণ্ডা মাথায় না ভাবলে মুশকিল। ভাবতে হবে, বুঝতে হবে দিন দুনিয়ার প্যাচগুজ। সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।