সবার আগে বলি কথামৃত রামকৃষ্ণের জীবনের শেষ সাড়ে চার বছরের মধ্যে মাত্র ১৮৬ দিনের কথা। মিশনের চতুর প্রচারের সহায়তায় তাই এখন রামকৃষ্ণের সর্বাধিক প্রামাণ্য জীবনী হিসেবে প্রচলিত। এবং গোটা বইটাই অসংখ্য গুলতাপ্পিতে ভরপুর।
গোপালচন্দ্র রায় এ বিষয়ে যা যা লিখেছেন তা এইরকম ---
১. রামচন্দ্র দত্ত, স্বামী সারদানন্দ, অক্ষয়কুমার সেন ও শ্রীম ( মহেন্দ্র গুপ্ত ) রামকৃষ্ণের এই চারজন পার্ষদভক্তই এঁদের রামকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় নিজ নিজ গ্রন্থে লিখেছেন— কলকাতার বেনেটোলা-নিবাসী ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট অধরলাল সেনের বাড়িতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের দেখা হয়েছিল। রাম দত্তই সর্বপ্রথম তাঁর বইয়ে মাত্র দুটি ছোট্ট বাক্যে ঐ সাক্ষাতের কথাটি লিখেছিলেন। সারদানন্দ রাম দত্তের ঐ লেখাটি নিয়ে তাতে নিজের একটু মন্তব্য জুড়ে সেটিকে বাড়ান। কিন্তু 'মনে ময়লা’ধারী, ‘বিদ্যাবুদ্ধিহীন' অক্ষয় সেনই প্রথম রাম দত্ত বর্ণিত রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্রের ঐ সাক্ষাতের কথার উপর নিজের কল্পনা জুড়ে ব্যাপারটাকে নোংরা করে তোলেন । শেষে শ্রীম এঁদের সকলেরই লেখা নিয়ে তাতে নিজের অবাধ কল্পনা মিশিয়ে ঐ সাক্ষাৎকারের কথাটিকে সেই নোংরা তো বটেই, তাছাড়া আরও জটিল করে তাঁর বইয়ে ২৬ পাতা ধরে লিখেছেন।
২. শ্রীম তাঁর বইয়ের পৃষ্ঠা বাড়াবার জন্য রাম দত্ত এবং সারদানন্দের বই থেকেও রামকৃষ্ণ-বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গের কথাগুলি নিয়েছেন এবং নিজের দেওয়া অনেক কাহিনী রচনা করেছেন।
৩. শ্রীম নিজেই বলেছেন- রামকৃষ্ণের কাছে বসে যে সব শুনেছেন, পরে সে সব লিখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে কাছে বসে লেখেন নি। শ্রীমর বইয়ে ৩০।৪০ পৃষ্ঠা করে লেখা। রামকৃষ্ণের এক এক সময়ের দীর্ঘ আলোচনা বা কথাবার্তা সঙ্গে সঙ্গে না লিখে পরে লিখলে, তাতে যে শ্রীমর নিজের অনেক কথাই ঢুকবে, তা বলাই বাহুল্য। কেন না শ্রীম এমন শ্রুতিধর ছিলেন না যে, পরে ঐ অত কথা লিখবার সময় তিনি স্মৃতি থেকে হুবহু সেই কথাগুলোই লিখেছিলেন।
দ্বিতীয়তঃ—‘লিপিবদ্ধ থাকাতে যে ভুলের সম্ভাবনা' এই কথা বলে শ্রীম নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর ডায়রির লেখাতেও ভুল ছিল।
৪. শ্রীম শুধু যে একই দিনের এক এক সময়ের ঘটনা এক এক গ্রন্থে দিয়েছেন, তা নয়, তিনি একই দিনের একই সময়ের ঘটনার কিছুটা এক ভাগে, আবার কিছুটা অন্যভাগে, এমনও করেছেন। যেমন—১৯-১২-৮৩ তারিখে বেলা ১টার সময়ের রামকৃষ্ণের কথা (কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ ও সমাধি সম্বন্ধে) শ্রীম তাঁর বইয়ের চতুর্থ ভাগে (৭ম খণ্ড, ৫ম পরিচ্ছেদ) লিখেছেন, আবার ঐদিন ঐ বেলা ৯টার সময়েরই ঐ একই ব্যক্তির সহিত কথা (জ্ঞান ও ভক্তি সম্বন্ধে) শ্রীম বহু বৎসর পরে প্রকাশিত তাঁর পঞ্চম ভাগে লিখেছেন (১২শ খণ্ড, ৩য় পরিচ্ছেদ)।
শ্রীমর এইরূপ লিখন পদ্ধতি দেখে এইটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি তাঁর বইয়ের বিক্রি দেখে বইয়ের [পৃষ্ঠা] সংখ্যা বাড়াবার জন্যই পরে পরে এক এক দিনের বা এক এক সময়ের ঘটনা ঐ ভাবে চিন্তা করে করে লিখেছেন। এরূপ লেখা যে খুব কষ্টকর তা মোটেই নয়। কেননা, রামকৃষ্ণের কথা বা উপদেশাবলীর সঙ্গে যিনি কিছুটা পরিচিত তাঁর পক্ষে রামকৃষ্ণের কথা নিয়ে এই ভাবে
ফেনিয়ে লেখা খুব কষ্টসাধ্য নয়। এরূপ ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণের কথা বা উপদেশাবলীর পুনরাবৃত্তি হওয়া স্বাভাবিক। শ্রীমর কথামৃতে তাই-ই হয়েছে। সম্বন্ধে শ্রীমর পক্ষ থেকে হয়ত যুক্তি হবে যে, রামকৃষ্ণ একই কথা বা উপদেশ পুনরাবৃত্তি করতেন বলে, তাঁর বইয়েও তাই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু, শ্রীম একই দিনের ঘটনার কিছুটা একভাগে, আবার কিছুটা বহু বৎসর পরে প্রকাশিত অপরভাগে লিখলেন কেন? এতেই তো মনে হতে পারে, পরে তিনি তাঁর গ্রন্থের এই অপর ভাগটি রচনা করবার জন্যই আগের দিনের লেখার জের টেনে বাড়িয়ে এই ভাগ রচনা করেছেন। এবং এরূপ সন্দেহ বা অনুমান করা খুবই স্বাভাবিক।